মুসলিম সমাজে প্রচলিত হিন্দুয়ানী প্রবাদ-প্রবচন (শেষ কিস্তি)

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 833 বার পঠিত

(৮৫) চ্যালা-চামুন্ডা : ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ কোন প্রবাদ কিংবা প্রবচন নয় বরং বাংলায় বহুল ব্যবহৃত একটি শব্দ। চ্যালা হিন্দি শব্দ আর চামুন্ডা সংস্কৃত ভাষার ধর্ম সম্পর্কিত শব্দ। উভয় শব্দের অর্থ নেতার সহচর, অনুগামী, সহযোগী ইত্যাদি। আমরা নেতার সহযোগীকে এক প্রকার ব্যাঙ্গার্থে ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ বলে থাকি। চ্যালা শব্দের সাথে আপত্তিকর কোন বিষয় না থাকলেও চামুন্ডা শব্দের সাথে পৌরাণিক ঘটনা সংযুক্ত রয়েছে। ‘রক্তবীজের ঝাড়’ প্রবাদে আলোচনা করা হয়েছে যে, একবার শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামক অসুর স্বর্গ দখল করে নেয়। তাদের সাথে দেবতাদের ভীষণ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে দেবতাদের পক্ষে দেবী দুর্গা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শুম্ভ ও নিশুম্ভের সেনাপতি দৈত্য চন্ড ও মুন্ডকে হত্যা করার জন্য দুর্গার কপাল থেকে এক দেবীর জন্ম হয়। সে দৈত্য চন্ড ও মুন্ডকে হত্যা করে তাদের মস্তক দুর্গার কাছে অর্পণ করে। সেই থেকে এই দেবীর নাম হয় চামুন্ডা।[1]

যেহেতু এই দেবী দুর্গার সহযোগী হিসাবে কাজ করে সেকারণে সহচর বোঝানোর জন্য হিন্দু সমাজে ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ শব্দ ব্যবহৃত হয়। সেখান থেকে মুসলিম সমাজেও ‘চ্যালা-চামুন্ডা’ শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। এই শব্দ ব্যবহার করার অর্থ দাঁড়ায় দুর্গার সহযোগীর ন্যায় অনুচর। যা মুসলমানদের আক্বীদা পরিপন্থী ঘোর আপত্তিকর বিষয়। সুতরাং এ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

(৮৬) মন্বন্তর : বাংলার ইতিহাসে ১১৭৬ বঙ্গাব্দের (ইংরেজি ১৭৭০ সাল) সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সাথে ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ শব্দটি জড়িত।[2] ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস এবং এর নামকরণ সম্পর্কে তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায় না। বাংলা অভিধান অনুযায়ী মন্বন্তর অর্থ আকাল, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি।[3] অপরদিকে মন্বন্তর শব্দের সন্ধি বিচ্ছেদ হয় মনু + অন্তর। এখানে অন্তর অর্থ ব্যবধান। কিন্তু মনু অর্থ ব্রহ্মার মানসপুত্র, যা হিন্দু পুরাণের সাথে সম্পৃক্ত। হিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী পৃথিবীর স্রষ্টা ব্রহ্মার মন থেকে জন্ম নেওয়া সন্তানদের মানসপুত্র বলা হয়। ব্রহ্মার ১৪জন মনু তথা মানসপুত্র রয়েছে।[4]

এই সমস্ত মানসপুত্রগণ পৃথিবী শাসন করেন। এক এক জনের রাজত্বকালকে এক মন্বন্তর বলা হয়। যা ত্রিশ কোটি সাতষট্টি লক্ষ বিশ হাজার (৩০,৬৭,২০,০০০) বছরের সমান। এই ১৪জন মনুর রাজত্বকালকে এক কল্প বলা হয়। ব্রহ্মার কাছে এক কল্প মাত্র এক দিন। এই এক দিনে ১৪জন মনুর রাজত্বকাল পালাক্রমে আবর্তিত হয়। এক মনুর রাজত্বকাল শেষ হ’লে অন্য মনু রাজ্যভার গ্রহণ করে। এক এক মনুর রাজত্বকালকে মন্বন্তর বলা হয়।[5]

সুতরাং মন্বন্তর বলতে দেবতা ব্রহ্মার সন্তানদের রাজত্বকালের ব্যবধান বোঝানো হয়। যেহেতু এক মনুকাল অতিক্রান্ত হ’লে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং পরবর্তী মনু আবার নতুনভাবে সবকিছু শুরু করেন। সেহেতু ধারণা করা যায় যে, ১৭৭০ সালের বিধ্বংসী দুর্ভিক্ষে ক্ষয়ক্ষতির পরে পুনরায় সবকিছু নতুনভাবে গড়ে উঠে বিধায় একে মন্বন্তরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আবার মন্বন্তরের রাজত্বকাল দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় এবং ৩ বছরের দুর্ভিক্ষের চিহ্ন প্রায় ২৫ বছর যাবৎ পরিব্যাপ্ত ছিল; সে কারণে হ’তে পারে সময়ের সাথে তুলনা করার জন্য মন্বন্তরের উদাহরণ দেয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের আক্বীদা বিরোধী শব্দ। অথচ আমরা না জেনেই হরহামেশা ব্যবহার করে যাচ্ছি।

(৮৭) সংজ্ঞা হারানো/সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া : সংজ্ঞা সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ চেতনা, বুদ্ধি, জ্ঞান এবং সূর্য দেবতার স্ত্রী ইত্যাদি। ‘সংজ্ঞা হারানো’ কিংবা ‘সংজ্ঞা ফিরে পাওয়া’ শব্দ দ্বারা আমরা চেতনাহারা ও জ্ঞানে ফিরে আসা বুঝে থাকি। কিন্তু এই বাক্যদ্বয়ের সাথে চটকদার একটি পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। সেটি হ’ল, দেবতাদের শিল্পী বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞাকে বিবাহ করেছিরেন সূর্য দেব। তাদের বৈবস্বত মনু, যম (মৃত্যুর দেবতা) ও যমুনা (যমুনা নদী) নামে তিন সন্তান জন্মলাভ করে। কিন্তু সংজ্ঞা কিছুতেই সূর্যের তেজ সহ্য করতে পারছিলেন না। সেকারণে সংজ্ঞা নিজের যমজরূপ ছায়া নামে এক নারীকে সৃষ্টি করে নিজের সন্তানদের দেখাশুনার জন্য সূর্যের ঘরে রেখে বাবার বাড়ীতে চলে যায়। সূর্য বুঝতেই পারে না যে, সে যার সাথে সংসার করছে সে রমণী তার স্ত্রী নয়। এ পক্ষে তাদের শনি (শনি গ্রহ) নামে এক পুত্র সন্তান জন্মলাভ করে। ছায়া নিজের সন্তানকে বেশী গুরুত্ব দিতেন এবং সতিনের সন্তানদের যত্ন নিতেন না। বিষয়টি সূর্যের কানে পৌঁছালে ছায়ার রহস্য ফাঁস হয়ে যায়। এতে সূর্য ক্ষেপে গিয়ে ছায়াকে অভিশাপ দিতে গেলে ছায়া সমস্ত কথা স্বীকার করে এবং সংজ্ঞার বাবার বাড়ীতে চলে যাওয়ার খবর প্রদান করে। সূর্য শ্বশুর বাড়ীতে গেলে জানতে পারে স্ত্রী তার তাপ সহ্য করতে না পেরে বাবার বাড়ীতে এসেছিল। কিন্তু বাবা বিশ্বকর্মা তাকে এ কাজের জন্য বকাবকি করেন এবং স্বামীগৃহে ফেরত যেতে বলেন। এদিকে সংজ্ঞা পিতার প্রতি অভিমানে স্বামীগৃহে না গিয়ে ঘোড়ার রূপ ধারণ করে ভ্রমণে চলে যায়। সূর্য তখন সমস্ত ঘটনা বুঝতে পেরে বিশ্বকর্মার কাছ থেকে নিজের তাপ কমিয়ে নিয়ে ঘোড়ারূপ ধরে সংজ্ঞার সাথে মিলিত হয়।[6]

এ ঘটনায় দেখা যায় যে, যিনি পৃথিবীকে আলো দেন তিনি নিজেই অন্ধকারে রইলেন। ছায়াকে সংজ্ঞা ভেবে সংসার করলেন অথচ জানতেই পারলেন না যে তিনি সংজ্ঞা হারিয়েছে (অর্থাৎ তার জ্ঞান লোপ পেয়েছে বিধায় স্ত্রীকে চিনতে অসমর্থ হয়েছেন)। পরবর্তীতে স্ত্রী চলে যাওয়ার কারণ বুঝতে পেরে সংজ্ঞাকে ফিরে পান (অর্থাৎ তার জ্ঞান ফিরে আসে)। ধারণা করা হয় সংজ্ঞাকে হারিয়ে পুনরায় ফিরে পাওয়ার ঘটনার আলোকেই জ্ঞান হারানো ও জ্ঞান ফিরে পাওয়ার অর্থ গ্রহণ করা হয়েছে।

(৮৮) ধ্রুব সত্য : ধ্রুব সংস্কৃত শব্দ। যার বাংলা অর্থ স্থির, নিশ্চল, দৃঢ়, বদ্ধমূল ইত্যাদি।[7] আকাশের উত্তর দিকে স্থির নক্ষত্র ধ্রুবতারা নামে পরিচিত। যা দেখে নাবিকরা দিক নির্ণয় করে থাকে। চরম সত্যের উদাহরণ বোঝাতে আমরা ‘ধ্রুব সত্য’ বাক্যটি ব্যবহার করে থাকি। ধ্রুব শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ স্থির বা দৃঢ় হওয়ার পেছনে একটি পৌরাণিক কাহিনী বিদ্যমান রয়েছে। পৌরাণিক রাজা উত্তানপাদের সুরুচি ও সুনীতি নামে দুই স্ত্রী ছিল। তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী সুরুচিকে প্রথম স্ত্রী সুনীতির চেয়ে বেশী ভালবাসতেন। রাজা সুরুচির প্ররোচনায় সুনীতিকে অন্যায়ভাবে বনবাস দেন। একদিন বনে শিকার করতে গিয়ে ঘটনাক্রমে রাজা সুনীতির কুটিরে উপস্থিত হয়ে পরস্পরে মিলিত হন। তাদের ধ্রুব নামে এক সন্তান জন্মগ্রহণ করে। একদিন শিশুপুত্র ধ্রুব সৎভাইদের সিংহাসনে বাবার কোলে বসে থাকতে দেখে সেও বাবার কোলে বসতে চাইল। কিন্তু সৎমায়ের দুর্ব্যবহারে অপমানিত হয়ে নিজ মায়ের কাছে ফিরে গিয়ে অভিযোগ দিল। মা তাকে বিষ্ণুর আরাধনা করতে বললেন। পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু বনে গিয়ে কঠোর তপস্যা শুরু করল। অন্যান্য দেবতারা কঠোর তপস্যায় ভীত হয়ে ধ্যান ভঙ্গের জোর চেষ্টা চালালো কিন্তু সে অবিচল থেকে ধ্যান অব্যাহত রাখল। পরিশেষে বিষ্ণু তাকে রাজ্য এবং সকল তারা ও গ্রহের উপর ধ্রুবতারা হিসাবে আশ্রয়দানের প্রতিশ্রুতি দিল।[8]

ধ্রুব যেহেতু লক্ষ্য অর্জনে ধ্যান অবস্থায় স্থির ও অবিচল ছিল সেহেতু ধ্রুব অর্থ সুদৃঢ়। তদ্রূপ ধ্রুবতারা উত্তর আকাশে চিরস্থায়ী অবিচল সত্যের প্রতীকরূপে বিদ্যমান থাকবে। তাই ‘ধ্রুব সত্য’ বাক্য দ্বারা ধ্রুবতারার ন্যায় চরম সত্য বোঝানো হয়। মূলত ধ্রুবতারা ও ধ্রুব সত্য নামকরণের মূল উৎস হিন্দু শাস্ত্রীয় বিষ্ণু পুরাণ। বাংলা সাহিত্যের প্রতি পরতে পরতে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির প্রভাব এতই প্রবল যে, এই সমস্ত শব্দ ও সাহিত্যের অনুসঙ্গগুলো বাদ দিলে হয়ত বাংলা শব্দসম্ভারই অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে। আর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অধিকাংশ অংশই তো পৌরাণিক কাহিনী নির্ভর। সেখানে ধ্রুবতারা একটি উদাহরণমাত্র!

(৮৯) আগুনে ঘি ঢালা : ‘আগুনে ঘি ঢালা’ বাক্যটি বাংলার মানুষের মুখে মুখে বহুল প্রচলিত একটি বাগধারা। যার ভাবার্থ হ’ল উত্তেজনা বৃদ্ধি করা। ঘি তৈলাক্ত পদার্থ হওয়ায় আগুনে ঘি ঢাললে আগুনের প্রজ্বলন বেড়ে যায়। অনুরূপভাবে কোন সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে ইন্ধন যুগিয়ে আগুনের ন্যায় উত্তেজনা সৃষ্টি করার প্রেক্ষাপটকে ‘আগুনে ঘি ঢালা’ উপমার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। আগুনে ঘি ঢালার সংস্কৃতি হিন্দু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান থেকে আগত যেটাকে আহুতি বলা হয়। অভীষ্ট ইচ্ছা পূরণের জন্য দেবতাদের সন্তুষ্ট করতে আগুন জ্বালিয়ে তাতে ঘি ঢালাকে আহুতি বলা হয়।[9] ধারণা করা যায়, এখান থেকেই কালক্রমে উক্ত বাগধারার জন্ম। যদিও এই বাগধারা ব্যবহারে ইসলামী আক্বীদা বিনষ্ট হয় না। তথাপি এ বাক্য ব্যবহার করা থেকে বিরত হওয়া উত্তম। কেননা এ বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা ভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির ধারক ও প্রচারক হয়ে যাচ্ছি।

(৯০) রাম ভজি কি রহিম ভজি : ধর্ম সম্বন্ধে সন্দিহান চেতনাকে উপলক্ষ্য করে এই প্রবাদ ব্যবহৃত হয়।[10] সংস্কৃত ভজন শব্দের অর্থ দেবদেবীর গুণগান সম্বন্ধীয় সংগীত। অর্থাৎ আরাধনা বা উপাসনা করা। এই প্রবাদ দ্বারা উভয় সংকট বা সন্দেহ বোঝানো হয়েছে। ধর্ম সংকটে পড়ে রামের উপাসনা করা হবে নাকি রহিম তথা আল্লাহর ইবাদত করা হবে সেটা বুঝতে না পারার পরিস্থিতিকে ‘রাম ভজি কি রহিম ভজি’ বাক্য দ্বারা ভাবপ্রকাশ করা হয়। এই বাক্য ব্যবহারের মাধ্যমে নাঊযুবিল্লাহ আল্লাহকে রামের সমকক্ষ করা হয়েছে। সুতরাং কোন মুসলিমের এই প্রবাদ মুখে উচ্চারণ করা উচিত নয়। বরং এর পরিবর্তে একই অর্থ বহনকারী বাক্য শাঁখের করাত, দুই নৌকায় পা, জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ ইত্যাদি বাগধারাগুলো ব্যবহার করা যেতে পারে।

(৯১)বলির পাঁঠা : হিন্দু ধর্মানুসারে দেবতাদের সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পশু যবেহ করাকে বলি বলা হয়। তাদের পশু বলির পদ্ধতিকে নির্মম পশু হত্যা বললেও অত্যুক্তি হবে না। দশ প্রকার পশু দিয়ে বলি দেয়া হয়।[11]

উপমহাদেশের পৌত্তলিক সমাজে সাধারণত কালি পূজায় পাঁঠা বলি দেয়া হয়। বলির পশু অন্যের পাপ মুক্তি কিংবা অভিষ্ট ইচ্ছা পূরণের জন্য যবেহ করা হয়। আমরা কখনো নিজের কৃত ভুলের কারণে কিংবা অন্যের কৃত দোষে এমন পরিস্থিতির স্বীকার হই যা আমাদেরকে বিপাকে ফেলে দেয়। এমন পরিস্থিতির সাথে তুলনা করার জন্য ‘বলির পাঁঠা’ বাগধারাটি ব্যবহার করা হয়। অর্থাৎ বলির পাঁঠার ন্যায় শোচনীয় অবস্থা বোঝানো হয়। আমরা সচরাচর আত্মোৎসর্গ বা সীমাহীন ত্যাগ বোঝাতে ‘বলিদান’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। যেহেতু বলি হিন্দু ধর্মীয় সংস্কৃতির অংশ সেহেতু বলিদানের পরিবর্তে আমাদের কুরবানী শব্দ ব্যবহার করা উচিত।

(৯২) দিগ্গজ : সংস্কৃত ‘দিগ্গজ’ শব্দের অর্থ আট দিক রক্ষাকারী হাতি। পৌত্তলিকদের বিশ্বাস অনুযায়ী পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, নৈর্ঋত, ঈশান, অগ্নি ও বায়ু এই আটদিকের আটকোণ রক্ষা করেন যথাক্রমে ঐরাবত, পুন্ডরীক, বামন, কুমুদ, অঞ্জন, পুষ্পাদন্ত, সার্বভৌম ও সুপ্রতীক নামক আটটি হাতি। এই আটদিকের যাবতীয় বিষয়ে তারা জ্ঞান রাখে এবং এসমস্ত এলাকার সকল সংবাদ দেবতাদের জানায়। সেজন্য তাদের মহাপন্ডিত বিবেচনা করা হয়। মূলত এখান থেকেই বাংলা ভাষায় ‘দিগ্গজ’ অর্থ বিশেষণে মস্ত বড়, প্রখ্যাত ব্যক্তি অর্থ করা হয়েছে।[12] তবে ড. মোহাম্মাদ আমীনের মতে, ‘দিগ্গজ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ (ব্যাঙ্গার্থে)-মহামূর্খ, হস্তিমূর্খ।[13] এখানে অর্থ যা-ই হোক না কেন উৎস যেহেতু পৌরাণিক ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে সেহেতু এই শব্দ পরিতাজ্য।

(৯৩) লোমহর্ষক/রোমহর্ষক : বাংলা অভিধান অনুযায়ী রোম বা লোম অর্থ শরীরের সূক্ষ্ম পশম। অপরদিকে হর্ষণ অর্থ হর্ষজনক, শিহরণ, আনন্দদায়ক কিংবা শিউরে বা খাড়া করে তোলে এমন। সেখান থেকে ‘লোমহর্ষক’ অর্থ শিহরিত করে এমন। ভারতীয় পুরাণ মতে, ‘রোমহর্ষণ’ বা ‘লোমহর্ষণ’ ঋষি বেদব্যাসের একজন প্রধান শিষ্য। ঋষি বেদব্যাস ধর্মগ্রন্থ বেদকে চারভাগ করে প্রথমত চারজন শিষ্যকে শিক্ষা দেন। রোমহর্ষণ সে চারজনের অন্তভুক্ত ছিল। রোমহর্ষণ স্বীয় গুরুর নিকট শিক্ষা গ্রহণের সময় উত্তেজনায় তার গায়ের পশম (রোম/লোম) হর্ষিত হচ্ছিল অর্থাৎ শিউরে উঠে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিল বলে তার নাম হয় ‘রোমহর্ষক’।[14] সেখান থেকেই কোন কারণে উত্তেজনায় গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ‘রোমহর্ষক/লোমহর্ষক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলায় সাধারণত ভয়ংকর কোন কিছু বোঝাতে যেমন ‘লোমহর্ষক কাহিনী’, ‘লোমহর্ষক ব্যাপার’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা হয়।

(৯৪) চক্ষু চড়ক গাছ : বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনকে পৌত্তলিকগণ চৈত্র সংক্রান্তির দিন বলে থাকেন। এদিন শিবভক্ত সন্ন্যাসীরা ‘গাজন’ নামে এক প্রকার অনুষ্ঠান করে। ‘চড়ক’ গাজন উৎসবের পর্ববিশেষ। চড়ক উৎসবে গাজন সন্ন্যাসীদের ঘুরপাক খাওয়ার বাঁশের খুঁটিবিশেষ কে ‘চড়ক গাছ’ বলা হয়।[15] সংস্কৃত শব্দ ‘চক্র’ থেকে বিশেষণ হিসাবে ‘চড়ক’ শব্দের উৎপত্তি। গাজনের দিন একটি বাঁশের খুঁটিতে আড়া বেঁধে সন্ন্যাসীরা দঁড়ির এক প্রান্তে লোহার হুক এঁটে দিয়ে সেটা নিজেদের পিঠে ফুঁড়িয়ে নিয়ে বাঁশের সাথে চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে থাকেন। বিভিন্ন ধরণের দৈহিক যন্ত্রণা যেমন- পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহবায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ বা শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা গায়ে ফুঁড়ে দেয়ার মাধ্যমে কষ্ট ভোগ করায় নাকি ধর্মের অঙ্গ বিবেচিত হয়। ১৮৬৫ সালে ইংরেজ সরকার আইন করে এ নিয়ম বন্ধ করলেও এখনো তা প্রচলিত আছে।[16] যে কাজ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব এমন কাজ কাউকে করতে দেখলে যে কেউ বিস্ময়ে হতবাক হবে এটাই স্বাভাবিক। তেমনি চড়কপূজারীদের উপরোক্ত কর্মকান্ড দেখে মানুষ হতবাক হয়ে যায়। সেকারণে এই উৎসবকে উপজীব্য করে ‘চক্ষু চড়ক গাছ’ বলতে বিস্ময়ে হতবাক হওয়া বোঝায়।

(৯৫) রামপাঠ : ‘রামপাঠ’ মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত একটি প্রবচন। রাম অর্থ যেমন বড় বোঝায় তেমন অযোধ্যার রাজা দশরথ পুত্র বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামচন্দ্রকেও বোঝায়। রামচন্দ্রের জীবন ও কর্ম নিয়ে ৭ কান্ডে ২৪,০০০ শ্লোকের সমন্বয়ে ‘রামায়ণ’ গ্রন্থ রচনা করা হয়েছে। রামায়ণের সুবিশাল এ রাম কাহিনী পাঠ সময় সাপেক্ষ্য ও কষ্টসাধ্য বিষয়। ‘রামপাঠ’ প্রবচনটি আমরা কিঞ্চিৎ ব্যাঙ্গার্থে যা শেষই হয়না এমন বিরক্তিকর অর্থে প্রয়োগ করে থাকি। কোন বিষয় সংক্ষিপ্ত পরিসরে সমাপ্ত না করে বিস্তারিত পাঠ করতে গেলে সে অবস্থাকে ‘রামপাঠ’ প্রবচন দ্বারা ভাব প্রকাশ করা হয়। যেমন আমরা যদি বলি সে রামপাঠ শুরু করল। অর্থাৎ সে এমন একটা বিষয় শুরু করেছে যেটা বিস্তর ঘটনাপ্রবাহ সমৃদ্ধ এবং যা রামায়ণের রাম কাহিনীর ন্যায় সহজে শেষ হওয়ার নয়। রামায়ণ ও রাম উভয়েই পৌরাণিক চরিত্রের অংশ। সুতরাং এ শব্দ মুসলমানদের জন্য ব্যবহার উপযোগী নয়।

(৯৬) হরিলুট : বাংলা একাডেমী আধুনিক বাংলা অভিধান মতে, সংস্কৃত হরি ও বাংলা লুট শব্দের সমন্বয়ে গঠিত হরিলুট অর্থ- (বিশেষ্যে) হরি সংকীর্তনের পর ভক্তদের মাঝে হরির নামে বাতাসা প্রভৃতি ছড়িয়ে দেওয়ার সংস্কার।[17] সরল বাঙ্গালা অভিধান মতে, তুলসীতলায় নারায়ণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত মিষ্টান্নাদি সকলের মধ্যে বিতরণ।[18]

অর্থাৎ নারায়ণ তথা বিষ্ণুর পূজা পরবর্তী তাঁর নামের মিষ্টান্নবিশেষ তুলসী গাছের প্রাঙ্গণে উপাসকদের উদ্দেশ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ভক্তগণ কল্যাণের আশায় হুড়াহুড়ি করে সেগুলো লুট করতে থাকে। এই সংস্কৃতিকেই হরি নামের প্রসাদ গ্রহণ তথা ‘হরিলুট’ বলা হয়। বাংলা বাগধারায় ‘হরিলুট’ অর্থ অপচয় করা। তবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ‘হরিলুট’ দ্বারা হরির প্রসাদের ন্যায় মাগনা পাওয়া জিনিস গ্রহণ করা অর্থ প্রকাশ করে। যে অর্থই প্রকাশ করুক না কেন এর উৎসমূল হিন্দুয়ানী সংস্কৃতির নগ্ন আগ্রাসন জানান দেয়।

(৯৭) রামধনু/রংধনু : এক পশলা বৃষ্টির পর সূর্যের বিপরীত দিকে ধনুকের ন্যায় বৃত্তচাপযুক্ত সাত রঙের যে আলোক বিচ্ছুরণ দেখা যায় তাকেই ‘রংধনু’ বলা হয়। বাংলাদেশে রংধনুর ব্যবহার ব্যাপক হ’লেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রামধনু ও ইন্দ্রধনু বহুল প্রচলিত। সেকারণে বাংলা ভাষাতেও এর প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে। রামধনু ও ইন্দ্রধনু শব্দদ্বয় রংধনুর সমার্থক হিসাবে ব্যবহার করা হয়। পৌরাণিক বিশ্বাস মতে, রংধনু দেখতে রামের ধনুকের ন্যায় বাঁকা তাই সেটা রামধনু। আবার বৃষ্টির পর নাকি দেবতাদের রাজা ইন্দ্র তাঁর সাত রঙা ধনুক রোদে শুকাতে দেন। সেটাই ইন্দ্রধনু যা আমরা আকাশে রংধনু হিসাবে দেখতে পাই।[19] রাম বা ইন্দ্রের প্রতি হিন্দুদের ধর্মীয় আবেগ থাকায় বিজ্ঞানসম্মত রংধনু কাল্পনিক বিশ্বাসের মাধ্যমে পরিবর্তন হয়ে রামধনু ও ইন্দ্রধনুতে রূপান্তরিত হয়েছে। এই বিশ্বাস এতই সুদৃঢ় যে, ২০১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বই-পুস্তকে রামধনুর পরিবর্তে রংধনু লেখার কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। বলা হয়েছিল পাঠ্যপুস্তক থেকে রাম শব্দ সরিয়ে ইসলামীকরণ (?) করা হয়েছে।[20] যাহোক এ শব্দদ্বয়ের সাথে মুসলমানদের কোনই সম্পর্ক নেই। বরং আমাদের জন্য ‘রংধনু’ শব্দই শ্রেষ্ঠ।

(৯৮) দিব্য মহার্ঘ্য : ‘দিব্য’ ও ‘মহার্ঘ’ ভিন্ন দুটি শব্দ। কিন্তু অর্থের সাথে ব্রাহ্মণ রীতি বিদ্যমান। দিব্য শব্দের অর্থ স্বর্গীয়, আকাশোৎপন্ন, সুন্দর, মনোহর, উৎকৃষ্ট ইত্যাদি।[21]

এক কথায় দেবতা প্রদত্ত উৎকৃষ্ট বস্ত্ত। আমরা প্রায়শ দিব্যচক্ষু, দিব্যজ্ঞান, দিব্যদৃষ্টি, দিব্যদর্শী শব্দগুলো ব্যবহার করি। মোটামুটি সবগুলো শব্দের অর্থ দেবতা প্রদত্ত গায়েব দেখার বা গায়েব সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করার অলৌকিক ক্ষমতা। সুতরাং এখান থেকে বোঝা যায় যে, দিব্য শব্দটার সাথে ব্রাহ্মণ রীতি-রেওয়াজ প্রকটভাবে যুক্ত। অপরদিকে, ‘অর্ঘ’ ও ‘অর্ঘ্য’ শব্দ দুটির বানান ও অর্থে ভিন্নতা থাকলেও উচ্চারণ অভিন্ন। ‘অর্ঘ’ অর্থ মূল্য এবং ‘অর্ঘ্য’ অর্থ পূজার উপকরণ, মান্য অতিথিকে বরণের জন্য মালা, চন্দন প্রভৃতি উপচার।[22]

‘অর্ঘ্য’ শব্দটি কবি-সাহিত্যিকগণ স্বীয় সাহিত্যকর্মে ব্যবহার করেছেন। যেমন- কবি সুফিয়া কামাল ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় ‘অর্ঘ্য বিরচন’ শব্দ প্রয়োগ করে বসন্ত ঋতুকে ফুল, চন্দন দিয়ে বরণ করার কথা ব্যক্ত করেছেন।[23]

ব্রাহ্মণগণ দৈনন্দিন সকালে সূর্যকে ‘অর্ঘ্য’ প্রদানের মাধ্যমে বরণ করে থাকেন। এক্ষণে ‘অর্ঘ’ এবং ‘অর্ঘ্য’ উভয় শব্দের পূর্বে মহা উপসর্গ বসলে অর্থ হয় যথাক্রমে অত্যন্ত মূল্যবান এবং পূজার মহা উপকরণ। সে হিসাবে ‘দিব্য মহার্ঘ্য’ শব্দের ভাবার্থ হয় দেবতাদের যেমন প্রকৃষ্ট মানের পূজার উপকরণের মাধ্যমে বরণ করা হয়, তদ্রূপভাবে কোন ব্যক্তিকে যেন দেবতা প্রদত্ত অর্ঘ্যের মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন করা। সাধারণত ‘দিব্য’ ও ‘অর্ঘ্য’ শব্দদ্বয় পৃথকভাবে বিভিন্ন শব্দের সাথে ব্যবহৃত হয়ে উপরোক্ত অর্থ প্রদান করে। তবে শব্দগুলো যেখানেই বসুক না কেন তা কখনো ইসলামী সংস্কৃতির সাথেও সম্পর্ক রাখে না এবং পৌরাণিক কাহিনী মুক্ত স্বাভাবিক অর্থও প্রদান করে না। সেজন্য এ শব্দ থেকে দূরে থাকাই শ্রেয়।

(৯৯) তান্ডবলীলা : তান্ডবলীলা অর্থ উদ্ধত বা উদ্দাম নৃত্য, শিবের নৃত্য। বাংলায় যার ভাবার্থ হয় প্রলয়ংকর বা ভয়ংকর ব্যাপার। শিবের অপর নাম নটরাজ তথা নৃত্যের রাজা। শিব গজাসুর ও কালাসুর নিধন করে তান্ডব নৃত্য করেছিলেন। অন্য মতে, উত্তেজক দ্রব্য পান করার পর তিনি স্ত্রীর সঙ্গে তান্ডবনৃত্যে রত হন।[24] এছাড়াও শিবের স্ত্রী দক্ষপুত্রী সীতা আগুনে ঝাপ দিয়ে আত্মহত্যা করলে তিনি স্ত্রী বিয়োগে সীতার মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডবনৃত্য করেন।[25] পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বে শিব স্বীয় জটার বাঁধন খুলে রুদ্ররূপ ধরে যে নৃত্য করবেন সেটাই তান্ডব। তাঁর তান্ডবেই নাকি পৃথিবী ধ্বংস হবে।[26] আমরা ভয়ংকর অর্থে বিভিন্ন শব্দের পূর্বে তান্ডব শব্দ ব্যবহার করি। যেমন-আগুনের তান্ডব, ঝড়ের তান্ডব, জলোচ্ছাসের তান্ডব, মহামারীর তান্ডব ইত্যাদি। এই সমস্ত তান্ডবের অর্থ শিবের ভয়ংকররূপে নৃত্য করার পৌরাণিক কাহিনী থেকে গৃহীত।

(১০০) ষন্ডামার্কা : ষন্ড ও অমর্ক শব্দ যোগে ‘ষন্ডামার্কা’ শব্দ গঠিত হয়েছে। বায়ু ও মৎস পুরাণ মতে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্যের ষন্ড ও অমর্ক নামে দুই পুত্র ছিল। তারা দৈত্য রাজা হিরণ্যকশিপুর পুত্র প্রহ্লাদের শিক্ষক নিযুক্ত হয়েছিলেন। দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধে এই দুইভাই অসুরপক্ষের সেনাপতির দায়িত্বপালন করত। এক যুদ্ধে দেবতারা অসুরদের কাছে হেরে যায়। ফলে তাঁরা চালাকি করে একটি যজ্ঞ অনুষ্ঠানে ষন্ড ও অমর্ককে দাওয়াত দেয় এবং তাদেরকে অমৃত পান করায়। অতঃপর পরবর্তী যুদ্ধে অসুরদের পক্ষত্যাগ করার অনুরোধ জানায়। অমৃত পানে মত্ত এই দুই সেনাপতি তখন অসুরদের পক্ষত্যাগ করে। ফলে পরবর্তী যুদ্ধে দেবতারা অসুরদের পরাজিত করেন।[27] বাংলা অভিধান অনুযায়ী ‘ষন্ডামার্কা’ অর্থ বলিষ্ঠ ও ষাঁড়ের মত একগুঁয়ে (ষন্ড শব্দের অর্থ ষাঁড়), গুন্ডা প্রকৃতির, দুর্বৃত্ত, দুর্জন ইত্যাদি। উপরোক্ত পৌরাণিক ঘটনার আলোকে ‘ষন্ডামার্কা’ যেহেতু অসুরদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেহেতু প্রবাদ বাক্যে ‘ষন্ডামার্কা লোক’ বলতে দুর্জন প্রকৃতির লোক বোঝানো হয়।

উপসংহার : ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক উপাদান হ’ল মানুষের দৈনন্দিন জীবনদর্শন। ধর্ম ও সমাজ, সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি উপাদান নিয়েই জীবনদর্শন গঠিত হয়। এ সমস্ত উপাদানকে কেন্দ্র করেই মানুষ দোয়াত-কালির আঁচড়ে মনের অলিন্দ থেকে সাহিত্যের ভাবাবেগ প্রকাশ করে থাকে। অনেকেই মনে করেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ধর্মের কোন স্থান নেই। অথচ মানুষের জীবনের সাথে ধর্ম যেমন অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কযুক্ত। তদ্রূপ বিশ্বের সকল ভাষা ও সাহিত্যে ধর্মীয় চেতনা গভীরভাবে প্রোথিত। ভাষা ও সাহিত্য থেকে কখনো ধর্মকে পৃথক করা সম্ভব নয়। তাইতো উপমহাদেশে দীর্ঘ সময় ধরে হিন্দু-মুসলিম সহাবস্থানে থাকার ফলে বাংলার মানুষের জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ্যবাদী দর্শনের প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বটে কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের হিন্দুয়ানী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে মুক্ত হ’তে পারেনি। এই আগ্রাসনকে বেগবান রাখতে মুসলিম নামধারী সুশীল সমাজ হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বাঙ্গালী সংস্কৃতি বলে চালিয়ে দিতে চায় এবং তা পালন করার জন্য জোর তাকীদ দেয়। হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের মানুষের মাঝে এমন কিছু ধর্মীয় বিশ্বাস আছে যা পরস্পরের জন্য পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। ইসলামে যা নিষিদ্ধ, নিন্দনীয় কিংবা অশ্লীল তা হ’তে পারে হিন্দুদের কাছে বৈধ, প্রশংসনীয়, পরম আরাধ্য কিংবা সুশীল। সেজন্য একজন মুসলমানের পক্ষে যেমন হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও জীবনাচার গ্রহণ করা অসম্ভব। ঠিক তেমনি একজন হিন্দুর পক্ষেও ইসলামী জীবনাচার ও সংস্কৃতি গ্রহণ করা অসম্ভব।

এই বিশ্বাস ও জীবন দর্শনের পার্থক্য থাকার পরেও ইসলাম তাদের বিশ্বাসের বিপক্ষে অবস্থান নেয় না। বরং ইসলামে বিশ্বাসী মানুষদের তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখার তাকীদ দেয়। ভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাস লালন করে কুফরী করা থেকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়। সেদিক বিবেচনা করেই আলোচ্য প্রবন্ধে হিন্দুয়ানী ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে যে সমস্ত প্রবাদ-প্রবচন ও শব্দের উৎপত্তি ঘটেছে, সেগুলো পাঠকমহলের সচেতনতার জন্য পৃথক করার চেষ্টা করেছি। আল্লাহ আমাদেরকে এসমস্ত বিভ্রান্তিকর বিশ্বাস থেকে দূরে রাখুন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে হেফাযত করুন-আমীন!

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ

লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ ও
এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।


[1]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, প্রকাশক : শমিত সরকার (এম.সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, ষষ্ঠ সংস্করণ : মাঘ ১৩৯৬), পৃ. ১৬৭

[2]. ১৭৬৫ সালে ইংরেজরা দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে। বাংলার নবাবের হাতে থাকে নামে মাত্র প্রশাসনিক ক্ষমতা। রাজস্ব আদায় ও আয়-ব্যয়ের হিসাব থাকে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির কাছে। ক্ষমতাহীন নবাবের শাসনে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি খাজনা আদায়ের নামে সীমাহীন শোষণ আর লুণ্ঠন শুরু করে। পাশাপাশি সেই সময় (১৭৬৮-১৭৬৯) অনাবৃষ্টির কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। যা তিন বছর স্থায়ী হয়। জানা যায় এই দুর্ভিক্ষে তৎকালীন সমগ্র বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় এক কোটি মানুষ খাবারের অভাবে মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তরনামে পরিচিত। কালের কণ্ঠ, ২৫শে জানুয়ারী ২০২২, পৃ.

[3]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ : এপ্রিল ২০১৬, পৃ. ১০৮১

[4]. তারা হলেন স্বায়ম্ভূব, স্বারোচিষ, উত্তম, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ, বৈবস্বত, সাবর্ণি, দক্ষসাবর্ণি, ধর্মসাবর্ণি, ব্রহ্মসাবর্ণি, রুদ্রসাবর্ণি, দেবসাবর্ণি এবং ইন্দ্রসাবর্ণি।সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ১০৫৭

[5]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, প্রকাশক : শমিত সরকার (এম.সি সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, ষষ্ঠ সংস্করণ : মাঘ ১৩৯৬), পৃ. ৪১১

[6]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ৫২৩

[7]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৭০৬

[8]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ২৫৯-৬০

[9]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ২৪০

[10]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ১৬০৯

[11]. সেগুলো হ-হরিণ, ছাগ বা পাঁঠা, ভেঁড়া, মহিষ, শূকর, শজারু, খরগোশ, গুইসাপ, কুমির, গন্ডার। সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ৯১৯

[12]. সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ৬৮২

[13]. . মোহাম্মাদ আমীন, পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, পাঞ্জেরী পাবিলকেশন্স লি., প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারী ২০২২, পৃ. ২৬৫

[14]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪২৬

[15]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৪৪১

[16]. মুহাম্মাদ হাবিবুর রহমান, যার যা ধর্ম : বাংলা ভাষায় প্রথম ধর্ম অভিধান, পৃ. ১৪৬

[17]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ১৩৮৪

[18]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ১৩৪৭

[19]. . মোহাম্মাদ আমীন, পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, পৃ. ৪২১-২২

[20].https://www.bbc.com/bengali/news-38638569.

[21]. সুবল চন্দ্র মিত্র, সরল বাঙ্গলা অভিধান, পৃ. ৬৮৪

[22]. আধুনিক বাংলা অভিধান, বাংলা একাডেমি, পৃ. ৯৫

[23].‘‘বৃথা কেন? ফাগুন বেলায়

ফুল কি ফোটে নি শাখে? পুষ্পারতি লভে নি কি ঋতুর রাজন?

মাধবী কুঁড়ির বুকে গন্ধ নাহি? করে নি সে অর্ঘ্য বিরচন?’’

[24]. . মোহাম্মাদ আমীন, পৌরাণিক শব্দের উৎস ও ক্রমবিবর্তন, পৃ. ২৮০

[25]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ৫২৯

[26]. ফরহাদ খান, বাংলা শব্দের উৎস-অভিধান, প্রতীক প্রকাশনা সংস্থা, পরিবর্ধিত ২য় সংস্করণ : জানুয়ারী ২০১২, পৃ.৭৭

[27]. সুধীরচন্দ্র সরকার, পৌরাণিক অভিধান, পৃ. ৫২২



বিষয়সমূহ: শিরক বিদআত
আরও