শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাক্রম মনিটরিং-এর গুরুত্ব
মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
মানব জীবন প্রবহমান নদীর ন্যায় এক চলমান যাত্রা। আল্লাহর নিকট থেকে মায়ের গর্ভে আগমনের মাধ্যমে যার সূচনা এবং চিরস্থায়ী জান্নাত কিংবা জাহান্নাম হ’ল শেষ ঠিকানা। মাঝখানে মানুষ ক্ষণকাল বিচরণ করে পৃথিবী নামক এই গ্রহে। সেখানে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মরীচিকার ন্যায় বিচিত্র স্বপ্নের পিছনে ছুটে চলে। জাগতিক সফলতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্খায় ভুলে যায় তার চূড়ান্ত গন্তব্য। যে গন্তব্যের দিকে অনবরত এগিয়ে চলছে মহাবিশ্বের সকল জীব ও জড়। ইচ্ছায় অনিচ্ছায় সকলেই ফিরে যাবে মহান স্রষ্টা আল্লাহর কাছে। তাই ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনই জীবনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কেননা আল্লাহ বলেন,وَمَا خَلَقْتُ ٱلجِنَّ وَٱلإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন এবং ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদতের উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেছি’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। আর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে শিক্ষা হবে সে লক্ষ্য পূরণের অন্যতম হাতিয়ার।
সঠিক লক্ষ্যে যাপিত জীবন নির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে চলা ট্রেনের মত। যার আরোহণকারী যাত্রী ততক্ষণ স্থায়ী হয়, যতক্ষণ সে ট্রেনের সাথে একই লক্ষ্যে চলতে পারে। লক্ষ্য ভিন্ন হ’লে তাকে খুঁজতে হয় অন্য পথ। কিন্তু ট্রেন তার অবিচল লক্ষ্যপাণে এগিয়ে চলে। এই পৃথিবীর প্রতিটি জীবই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে জীবন নির্বাহ করে। সেকারণে মানব জীবনেরও একটা স্থির লক্ষ্য থাকা জরূরী। যে লক্ষ্য তাকে ইহকালীন মুক্তি ও পরকালীন শান্তির পথে ধাবিত করবে। শিক্ষা সেই লক্ষ্য পূরণের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। লক্ষ্যহীন জীবনে শিক্ষার উদ্দেশ্য তালাশ করা সাগরে ভাসমান মাঝিহীন নৌকার যাত্রীর কাছে গন্তব্য জানতে চাওয়ার মতই বৃথা। যার জীবন অকুল সাগরে চরম হতাশা, ঝড়ের আশংকা আর টিকে থাকার চেষ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। মোটকথা জীবনের প্রকৃত লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারলে প্রতিটি পদক্ষেপই সফলতার দিকে এগিয়ে দেয়। আর লক্ষ্যচ্যুত জীবন সামান্য হোঁচট খেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়।
কথায় আছে, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত মানুষ শিক্ষা লাভ কর। হামাগুড়ি দিতে না পারা শিশুটি একদিন পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করতে শিখে। শুদ্ধ উচ্চারণে মা-বাবা ডাকতে না পারা নবজাতকও একদিন লাখো জনতার সামনে ভাষণ দিতে পারে। খেলার ছলে কলম ধরে হাতে মুখে কালি মাখা আর বড় ভাই-বোনের বই খাতা নষ্ট করা ছেলেটিও বই লিখে জাতির পথনির্দেশ করে। এসবই মানুষের নিরন্তর শিক্ষা অর্জনের ক্রমোন্নতির ফল।
শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য হ’ল নিজের অজ্ঞতা দূর করে সৃষ্টির সেবা ও স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা। নিজের ও সমাজের উপকার সাধনের মাধ্যমে ইহকাল ও পরকালে সফলতা লাভই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য। শিক্ষা অর্জন যে বিভাগেই হোক, এই লক্ষ্য সামনে থাকলে মানুষ মানবতার কল্যাণ সাধনে নিজেকে উৎসর্গ করার জন্য সদা প্রস্ত্তত থাকে। আল্লাহর নিকট প্রতিদানের আকাঙ্খা ও সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বানুভূতি তাদের প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। অপরদিকে ক্ষণস্থায়ী দুনিয়াবী উদ্দেশ্য মানুষকে স্বার্থপর করে তোলে। তাদের কাছে নশ^র পৃথিবীর ভোগ-বিলাসই মুখ্য বলে গণ্য হয়। মানবতার প্রতি কোন দায়িত্ববোধ তারা অনুভব করে না।
রাসূল (ছাঃ) শিক্ষার্জনের চমৎকার একটি দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। আবূ মূসা (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, নবী (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যে হিদায়াত ও ইলম দিয়ে পাঠিয়েছেন তার দৃষ্টান্ত হ’ল যমীনের উপর পতিত প্রবল বর্ষণের ন্যায়। কোন কোন ভূমি থাকে উর্বর, যা সে পানি শুষে নিয়ে প্রচুর পরিমাণে ঘাসপাতা এবং সবুজ তরুলতা উৎপাদন করে। আর কোন কোন ভূমি থাকে কঠিন, যা পানি আটকে রাখে। পরে আল্লাহ তা‘আলা তা দিয়ে মানুষের উপকার করেন। তারা নিজেরা পান করে ও (পশুপালকে) পান করায় এবং তা দ্বারা চাষাবাদ করে। আবার কোন কোন জমি রয়েছে যা একেবারে মসৃণ ও সমতল; তা না পানি আটকে রাখে, আর না কোন ঘাসপাতা উৎপাদন করে। এই হ’ল সে ব্যক্তির দৃষ্টান্ত যে দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করে এবং আল্লাহ তা‘আলা আমাকে যা দিয়ে প্রেরণ করেছেন তাতে সে উপকৃত হয়। ফলে সে নিজে শিক্ষা করে এবং অপরকে শিখায়। আর সে ব্যক্তিরও দৃষ্টান্ত যে সেদিকে মাথা তুলে দেখে না এবং আল্লাহর যে হিদায়াত নিয়ে আমি প্রেরিত হয়েছি, তা গ্রহণও করে না’ (বুখারী হা/৭৯)। হাদীছের ভাষ্যমতে, প্রকৃত শিক্ষিত তো সেই মানুষ যে, শিক্ষার্জন করে নিজে উপকৃত হয় এবং অন্যের উপকার সাধনে ব্রতী হয়। আর যে মানুষের শিক্ষা মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় না, তা ঐ ভূমির মত যা বর্ষার পানি আটকে রাখতে পারে না এবং শস্যও উৎপাদন করে না। অর্থাৎ যেখানে স্বার্থের চোরাবালি মরীচিকার ন্যায় জ্বলজ্বল করে, মানবতার সবুজ ডালপালা সেখানে শাখা মেলতে পারে না।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মহান লক্ষ্যেই যুগে যুগে ইমাম চতুষ্টয়, ইমাম বুখারী, আল-বিরূনী, আল-কিন্দী, আল-ফারাবী, আল-খাওয়ারেযমী, আল-হামদানী, ইবনে সীনা প্রমুখের মত ইতিহাস বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ, ভূগোলবিদ, চিকিৎসাবিদ ও সাহিত্যিকদের জ্ঞান সাধনা পূর্ণতা পেয়েছে। যারা নিজেদের সাধনালব্ধ শিক্ষা মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেও আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার ভয় করেন। তারা নিজেদের গর্ব-অহংকার চূর্ণ করে এক আল্লাহর সামনে আত্মসমর্পণ করেন।
অপরদিকে বস্ত্তবাদী লক্ষ্য চার্লস ডারউইন, আলফ্রেড নোবেল, জেসুয়া স্টিভেন্সদের মত বিজ্ঞানীর উদ্ভব ঘটিয়েছে। যারা মানুষের আত্মপরিচয় ভুলিয়ে দেয় ও মানবতা ধ্বংসের আয়োজন করে। তারা অনু-পরমাণু গবেষণার মাধ্যমে মানুষের প্রাণরক্ষার পরিবর্তে প্রাণনাশের অস্ত্র তৈরি করে। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী বিশে^র শতকরা ৭০ জন বিজ্ঞানী মরণাস্ত্র আবিষ্কারে লিপ্ত। তাদের শিক্ষা পৃথিবীতে ভয়, শঙ্কা, বিভেদ ছড়িয়ে জাতিকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও চলছে ঠিক একই পথে। যেখানে দুনিয়াবী ও ব্যক্তিগত স্বার্থই প্রাধান্য পায়। যেকোন উপায়ে ধন-সম্পদ ও মাল-মর্যাদা অর্জনই মূল লক্ষ্যে পরিণত হয়। ফলে অর্থনৈতিক সুবিধা, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও পদমর্যাদা লাভের আশায় দুর্নীতি ও চাটুকারিতার পথ বেছে নেয়। মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতা শুধু মুখের কথা আর বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে, বাস্তবে রূপ লাভ করে না। ফলে জীবনের মূল লক্ষ্যই লাইনচ্যুত হয়। জীবনের একটি বড় অংশ পার করে এসে বার্ধক্যের কোলে বসে তারা অনুভব করে তাদের সব অর্জনই তাদের ধোঁকা দিয়েছে। বস্ত্তত তারা নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জগতকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, ‘নিশ্চয়ই যারা অবিশ্বাস করেছে, তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি আল্লাহর নিকটে কোন কাজে আসবে না। আর তারাই হবে জাহান্নামের ইন্ধন’ (আলে ইমরান ৩/১০)।
আমরা যদি শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা চিন্তা করি, সেটি বর্তমানে কেবল ডিগ্রী অর্জনের পদ্ধতিতে পরিণত হয়েছে। যেখানে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সবার লক্ষ্যই থাকে পরীক্ষায় পাশ ও পরবর্তী শ্রেণীতে উত্তরণ। সার্টিফিকেট অর্জন শেষে একটি চাকরির ব্যবস্থা হ’লেই যেন শিক্ষার্জনের সমাপ্তি ঘটে। শিক্ষা প্রদানকারী শিক্ষক থেকে অর্জনকারী শিক্ষার্থী সকলে যেন এই প্রক্রিয়ার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র। ফলে শিক্ষার স্থায়িত্ব হয় কেবল পরীক্ষার খাতা পর্যন্ত। জীবনে তার প্রভাব থাকে সামান্য। এ শিক্ষা স্রষ্টার পরিচয় সন্ধান ও সৃষ্টির কল্যাণ সাধনের পরিবর্তে মানুষকে কেবল ভোগবাদী ও স্বার্থবাদী প্রাণীতে পরিণত করে। উর্দূ কবি ইকবাল বলেছেন,
اللہ سے کرے دور، تو تعلیم بھی فتنہ
املاک بھی اولاد بھی جا گیر بھی فتنہ
ناحق کے لئے اٹھے تو شمشیر بھی فتنہ
شمشیر ہی کیا نعرہ تکبیر بھی فتنہ
‘আল্লাহর কাছ থেকে দূর করার শিক্ষা হ’ল ফেৎনা
সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, জমিজমাও ফেৎনা
অন্যায়ের পক্ষে উঠানো তলোয়ারও ফেৎনা
শুধু তলোয়ারই নয়, তাকবীর ধ্বনিও ফেৎনা’।
অর্থাৎ যে শিক্ষার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দারা তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যায় সেটা কোন শিক্ষা নয়। সন্তান-সন্ততি, সহায়- সম্পদ যা মানুষকে আল্লাহর ইবাদত থেকে আত্মভোলা করে রাখে তা কখনো উপকারী নয়। যে তলোয়ার অন্যায়ের পক্ষে উঠানো হয়, যে তাকবীর ধ্বনির মাধ্যমে অন্যায়ের পক্ষে সমর্থন যোগানো হয়, সে তাকবীর ধ্বনিও ফেৎনা। তাই দুনিয়াবী আমিত্ব প্রতিষ্ঠা নয় বরং আখেরাতে মুক্তির লক্ষ্যে শিক্ষার্জন করতে হবে। প্রকৃত আখেরাতমুখী শিক্ষা মানুষকে মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। চিকিৎসককে মানব সেবায় উদ্বুদ্ধ করে। দার্শনিককে প্রকৃত সত্যের সন্ধান দেয়। বৈজ্ঞানিককে মানবতার কল্যাণে নতুন আবিষ্কারে অনুপ্রেরণা যোগায়। শিক্ষককে আদর্শ ছাত্র গঠনে উদ্যোগী করে। সাহিত্যিককে সমাজে মূল্যবোধ তৈরিতে কলমী জিহাদে উৎসাহিত করে। রাজনৈতিককে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা ও আমানতদারিতায় উজ্জীবিত করে। সৈনিককে করে জাতির বিশ্বস্ত পাহারাদার। ইহকালীন স্বার্থকে তুচ্ছজ্ঞান করে পরকালীন পুরস্কার লাভের আশায় সকলে স্ব স্ব দায়িত্ব পালনে মনোযোগী হয়। ফলে জাতির সার্বিক উন্নতি ত্বরান্বিত হয়।
পরিশেষে বলা যায় যে, শিক্ষার লক্ষ্য নির্ধারণের পর তা বাস্তবায়ন ও জাতির সার্বিক উন্নতি ত্বরান্বিত করার একমাত্র পথ হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পথ। যা আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত অভ্রান্ত সত্যের পথ। যে পথ মানুষকে সৃষ্টিতত্ত্ব, সৃষ্টির উদ্দেশ্য, জীবন যাপন পদ্ধতি, স্রষ্টার পরিচয় ইত্যাদি অজানা বিষয়ের সন্ধান দেয়। সালাফে ছালেহীনের অনুসৃত সে পথেই কুরআন ও ছহীহ হাদীছের জ্ঞান অন্বেষণ ও তা সমাজে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিক্ষার মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে।
অতএব মানুষকে বস্ত্তবাদী ও ভোগবাদী নয়; বরং তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাতমুখী করাই হ’ল শিক্ষার মৌলিক লক্ষ্য। সে লক্ষ্যেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। তা’হলেই অহী ভিত্তিক আদর্শ সমাজব্যবস্থা আপনা থেকেই গঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের আদর্শ মানুষ এবং আদর্শ সমাজ গড়ার তাওফীক দিন- আমীন!
নাজমুন নাঈম
লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।