বাংলাদেশে ইসলাম : প্রাচীন ও মধ্যযুগ
আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
শাহীন রেযা 328 বার পঠিত
ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসের দাপ্তরিক নাম ‘দ্য রিপাবলিক অব মরিশাস’, যা আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে এবং মাদাগাস্কারের পূর্ব দিকে অবস্থিত। মরিশাসের আয়তন দুই হাযার ৪০ বর্গকিলোমিটার এবং জলসীমার আয়তন এক হাযার ১০০ নটিক্যাল মাইল। ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশটির মোট জনসংখ্যা ১২ লাখ ৭১ হাযার ৭৬৮ জন। এর মধ্যে ১৭.৩০ শতাংশ মুসলিম এবং তারা উর্দূ ভাষায় কথা বলে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ হিন্দু সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী এবং মরিশাসের ৮৬.৫ শতাংশ মানুষ মরিশিয়ান ভাষায় কথা বলে। ১২ মার্চ ১৯৬৮ সালে দেশটি যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। নিম্নে মরিশাসে মুসলমানদের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা করা হ’ল।
মরিশাস মুসলমানদের আবিষ্কার : মুসলিম ব্যবসায়ীরাই সর্বপ্রথম মরিশাস আবিষ্কার করেন। আনুমানিক ৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তারা মরিশাসের মাটিতে পা রাখেন। তবে তারা সেখানে উপনিবেশ গড়ে তোলেননি। আরব বণিক ও পর্যটকরা মরিশাসকে ‘দিনা আরবী’ নামে চিহ্নিত করেছেন। পরে পর্তুগিজ বণিকরা মরিশাসের সন্ধান পান এবং ১৫০৭ সালে সেখানে তাদের যাতায়াত শুরু হয়। ইতিহাস গবেষক ব্রিজান বরুণ বলেন, ‘আরবরা যে মরিশাস আবিষ্কার করেছেন তার প্রমাণ হিসাবে আল-ইদ্রিসির (মৃত. ১১৬৫ খ্রি.) মানচিত্রই যথেষ্ট। যিনি মরিশাসের তিনটি দ্বীপ : মরিশাস, রিইউনিয়ন ও রড্রিগেস নির্ভুলভাবে চিহ্নিত করেছেন যথাক্রমে দিনা আরবি, দিনা মাগরিবিন ও দিনা নোরাজি নামে। যদিও তারা এসব দ্বীপে বসতি গড়ে তোলার চেষ্টা করেননি।’
মুসলিম বসতি স্থাপন : ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে মরিশাসে ফরাসি উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই সেখানে মুসলমানের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সে সময়ের মুসলমানদের ফার্সীতে ‘লস্কর’ (ভারতবর্ষীয় নাবিক/নৌ খালাসী) বলা হ’ত। তৎকালীন ফরাসি সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন চুক্তির অধীনে তারা মরিশাসে আগমন করেছিল। বন্দর নগরী পোর্ট লুইসে (বর্তমান রাজধানী) তারা কাঠমিস্ত্রি, কামার, রাজমিস্ত্রি, দর্জি ও নাবিক হিসাবে কাজ করত। ১৭৩২, ১৭৪০ এবং ১৭৪৩ সালে পরিচালিত তিনটি নোটারি দলীলে মুসলমানদের যথাক্রমে এগারো, দশ এবং সাতটি নাম রেকর্ড করা হয়েছিল। এতদভিন্ন তৎকালীন মুসলমানদের সংখ্যা সম্পর্কে আর কোন পরিসংখ্যান জানা যায় না। পরবর্তীতে মাহে দে লেবারডোনাইস (১৭৩৫-১৭৪৬) গভর্নর থাকাকালীন আরও মুসলিম ব্যবসায়ীকে মরিশাসে আনা হয়েছিল। তারা বেশীরভাগ পন্ডিচেরি[1] এবং বাংলা অঞ্চল থেকে এসেছিল। এভাবেই পর্যায়ক্রমে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বিধায় ১৭৬৫ সালে মুসলমানদের জন্য ১০ই মুহাররামকে সরকারী ছুটিতে পরিণত করা হয়েছিল। সে সময়ের মুসলমানদের মধ্য থেকে কয়েকজনের নাম জানা যায়। তারা হ’লেন, ড্যানোলজি, রোমিয়ানি বেঙ্গলি, তাজে বেঙ্গলি এবং মোবোল। তারা অত্যন্ত ধার্মিক মানুষ ছিলেন। ক্যাম্প দেস লাস্কার্স (আধুনিক প্লেইন ভার্তে) নামে পোর্ট লুইসের পূর্ব অংশে তারা বসতি স্থাপন করেছিল। ফরাসিরা তাদেরকে ‘মোহামেটান’ (যার অর্থ মুসলিম) বলে ডাকত। মরিশাসের সর্বপ্রাচীন মুসলিম পরিবার ‘গ্যাসি সবেদার’ (সম্ভবত গিয়াস সরদার উদ্দেশ্য)। ১৭৯১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই দ্বীপরাষ্ট্রে সবেদার পরিবারের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।
ব্রিটিশ আমলে মুসলমান : ২৮ নভেম্বর ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা ইলে ডি ফ্রান্স আক্রমণ করে মরিশাসে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করে। ফরাসিদের উপর ব্রিটিশ বাহিনীর বিজয় দ্বীপটির ফরাসি প্রশাসনের ৯০ বছরের অবসান ঘটায়। মরিশাসের প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর স্যার রবার্ট টাউনসেন্ড ফারকুহার (১৮১০-১৮২৩) শত শত ভারতীয় বন্দী সৈনিক ও রাজনীতিককে (স্বাধীনতা সংগ্রামী) মরিশাসের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য রাস্তার কাজে দ্বীপান্তরিত করেন। ১৮১৫ সালে প্রথম যাদেরকে দ্বীপান্তরিত করা হয় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ছিল। ক্লেয়ার অ্যান্ডারসনের মতে, সেখানে ৩১৬ জন মুসলিম ছিল এবং তাদেরকে ভারতের বোম্বে ও বাংলা থেকে আনা হয়েছিল। তারা মরিশাসের রাস্তা এবং বিভিন্ন ভবন ও দুর্গ নির্মাণ করেছিল।
শ্রমিক হিসাবে মুসলমান : ১৮১০ সালে ব্রিটিশ সরকার লন্ডন পার্লামেন্টে আইন পাশ করে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেন। ১৮৩৫ সালে মরিশাসের পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্ত হয়। মরিশাসের গভর্নর ব্রিটিশ সরকারের আর্থিক সহযোগিতা ছাড়াই দ্বীপটির প্রশাসনিক খরচ নির্বাহ করত। যে খরচের সিংহভাগ (১.৫ মিলিয়ন পাউন্ড) রাজস্ব আসত আখক্ষেত থেকে। ব্রিটিশরা মরিশাসকে চিনির উপর নির্ভরশীল করে তুলেছিল। তাই ব্রিটিশদের আখ শিল্পে সাহায্য করার জন্য ভারতের উপর নির্ভর করতে হয়েছিল। ১৮৩৩ সালে ভারতীয় শ্রমিকদের প্রথম দল মরিশাসে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসাবে উপস্থিত হয়েছিল। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলিম ছিল। তারা দিনমজুর হিসাবে কাজ করত। মজুরী হিসাবে নারী-পুরুষকে দৈনিক সামান্যই চাল, ডাল, লবণ ও তেল দেওয়া হ’ত। যতদূর জানা যায়, পরিধেয় পোষাক হিসাবে তাদেরকে বার্ষিক একটি ধুতি, একটি শার্ট, দুটি কম্বল, একটি জ্যাকেট এবং দুটি ক্যাপ দেওয়া হ’ত, যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে অপ্রতুল ছিল। ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের অভিবাসন ১৯২২ সাল পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত ব্যবধানের সাথে অব্যাহত ছিল। সে সময়ের মধ্যে ৪,৫০,০০০ শ্রমিককে আনা হয়েছিল। তাদের মধ্যে কেউ কেউ চুক্তির মেয়াদ শেষে ভারতে চলে আসেন আবার কেউ কেউ সেখানেই বসতি স্থাপন করেন। যারা থেকেছেন তারা হয় তাদের চুক্তি নবায়ন করে দিনমজুরী করেছেন অথবা ছোট-খাট ব্যবসায়ী হিসাবে কাজ করেছেন।
মুসলিম ব্যবসায়ী : ব্রিটিশ আমলে মরিশাসে কিছু মুসলিম ব্যবসায়ীর আগমন ঘটে। কুচ, কাথিয়াওয়ার, কোচিন, পাটনা, আহমেদাবাদ, বোম্বে এবং সুরাট থেকে ব্যবসায়ীরা মরিশাসে বাণিজ্য করতে যেত। মুসলিম ব্যবসায়ীরা খাদ্যসামগ্রী ও পোষাক শিল্পের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া তারা নিজস্ব আখক্ষেত ও কারখানা গড়ে তোলেন। জাহাজ ও পণ্য রপ্তানিতে বিনিয়োগ করেন। এক সময় আখ রপ্তানি, পাটের ব্যাগ ও পোষাক উৎপাদনে মুসলিমরা আধিপত্য বিস্তার করে। কোচির মুসলিম ব্যবসায়ীরা পোর্ট লুইস, রেমি ওলিয়ার স্টেট ও কুইন স্টেটে ব্যবসায়িক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেসব কেন্দ্র ‘মেইমেন বাজার’ (মুমিন বাজার) নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫১ সালের মেইমেন বাজারের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী হ’লেন- মুহাম্মাদ হাজী ইসমাঈল, হামির কাসিম, হাজী ইউসুফ, নূর মুহাম্মাদ, উসমান, হাজী আল্লাহরাখিয়া প্রমুখ। অন্যদিকে সুরাতের মুসলিম ব্যবসায়ীরা রয়েল স্টেট, বার্বন স্টেট, ফারকুহার স্টেট ও কোরডেরি স্টেটে বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপন করেন। তাদের স্থাপিত বাণিজ্য কেন্দ্রকে সুরাটি বাজার বলা হ’ত। সুরাটি বাজারের শীর্ষ ব্যবসায়ী ছিলেন মোল্লিদিনা আব্দুল্লাহ, হাসান আগা মুহাম্মাদ, ইলিয়াস হাজী হামিদ, মির্জা মাহমূদ, শেখ আব্দুর রায্যাক প্রমুখ।
মরিশাসের প্রথম মসজিদ : মরিশাসে মুসলিমরা নিজেদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করার পূর্ব পর্যন্ত গোপনে ইবাদত করত। ১৭৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মুসলিমরা প্রথম মসজিদ নির্মাণের জন্য ফরাসিদের কাছে আবেদন করে। ১৮০৫ সাল পর্যন্ত কয়েক বছর ধরে আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছিল। অবশেষে গভর্নর ডেকান মুসলমানদের আবেদন গ্রহণ করেন। গভর্নর স্বাক্ষরিত অনুমোদিত এই আবেদনটি ফরাসি শাসনামলে মরিশাসে ইসলাম ও মুসলমানদের উপস্থিতির অকাট্য প্রমাণ বহন করে। প্রায় ৫০০০ বর্গফুট জায়গায় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৮১৮ সালের একটি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে মসজিদটি ধসে পড়ে। এটি আবার পুনর্গঠিত হয়। মসজিদটির নামকরণ করা হয় ‘মসজিদুল আকসা’। যার প্রথম ইমাম ছিলেন ‘গ্যাসি সবেদার’।
মরিশাসের দ্বিতীয় মসজিদ : মেইমেন এবং সুরতি বাজারের গুজরাটি ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্থানের কাছাকাছি একটি মসজিদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৮৫২ সালের অক্টোবরে কিছু মেইমান বণিক শহরের মূলকেন্দ্রে একটি বাড়ি কিনেন এবং শীঘ্রই সেখানে ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা করেন। আল-আকসা মসজিদের ইমাম কিবলা চিহ্নিত করেন এবং ছালাতের ইমামতি করেন ইসমাঈল জিওয়া। ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত মসজিদ ঘরটি ‘মসজিদ ডেস আরব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। মসজিদের প্রথম মুতাওয়াল্লি ছিলেন হাজী জুনুস আল্লারাখিয়া, যিনি ১৮৫০ সালে মরিশাসে আসেন। ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য বাড়ি সংলগ্ন সাতটি সম্পত্তি কেনা হয়।
মসজিদ সম্প্রসারণের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন ছিল। বিধায় শস্য ব্যবসায়ীরা সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করা শস্যের প্রতিটি বস্তার উপর ২ শতাংশ হারে রুপি ধার্য করেন। বহু বছর ধরে শস্যের সমস্ত ডিলাররা মসজিদের জন্য বিনা দ্বিধায় উক্ত ২ শতাংশ অর্থ দান করেন। কিন্তু সরকার এবং বেশ কিছু আবাদকারীরা পরে তা দিতে অস্বীকার করেন। তখন শস্যের বাজার মূল্যের সাথে উক্ত ২ শতাংশ অর্থ যোগ করা হয়েছিল। ১৮৭৮ সাল থেকে দক্ষ ভারতীয় কারিগররা হাজী জাকারিয়া জান মামোদের তত্ত্বাবধানে মসজিদ ভবনে প্রতিদিন কাজ করতেন। ফলশ্রুতিতে ছোট্ট মসজিদ ‘ডেস আরব’ বর্তমানে জুম‘আ মসজিদে পরিণত হয়েছে।
রাজনীতিতে মরিশিয়ান মুসলমান : অর্থনৈতিকভাবে মুসলিমরা প্রভাবশালী হ’লেও তারা রাজনীতি থেকে বিমুখ ছিল। মহাত্মা গান্ধী এবং মগনলাল মণিলাল ডাক্তারের দ্বীপে আগমনের পরে তাদের ভেতর রাজনীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা তৈরি হয়। তারা স্থানীয় কাউন্সিল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৮৮৪ সালে স্যার জন পোপ-হেনেসি (১৮৮৩-১৮৮৯) মরিশাসের নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। তিনি সেখানে তিনজন বিশিষ্ট মুসলিম ভারতীয়ের নাম দিয়েছিলেন। তাঁরা হ’লেন গোলাম মুহাম্মাদ আঞ্জুম, আইয়ুব বকর তাহের এবং ড. হাসান শাকির। এটিই প্রথমবারের মত উপনিবেশের কোন ভারতীয় মুসলমান প্রতিনিধিদের সরকার কর্তৃক গঠিত একটি পরামর্শমূলক সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। তবে সে কমিশন ব্যর্থ হয়েছিল।
১৯০০ সালে মরিশাসের প্রথম মুসলিম কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ড. হাসান শাকির। পোর্ট লুইস থেকে প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন গোলাম মুহাম্মাদ দাউজি। তাঁর উদ্যোগেই প্রথম ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের সঙ্গে নির্বাচিত কাউন্সিলররা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হন। ১৯৪৭ সালে স্যার ম্যাকেঞ্জি-কেনেডির অধীনে একটি সংবিধান রচনা করা হয়েছিল যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রাচীনতম সংবিধান ছিল। নতুন সংবিধান কোনভাবেই মুসলমানদের উপকার করেনি। তারা বুঝতে পেরেছিল রাজনৈতিকভাবে তারা কতটা দুর্বল! ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্থান দেখা যায়। ১৯টি আসনের মধ্যে হিন্দুরা ১১টি, ক্রেওল ৭টি, শ্বেতাঙ্গরা ১টি এবং মুসলিমরা কোন আসনই পায়নি। মূলত সাতচল্লিশের দেশ ভাগের প্রভাব মরিশাসের মুসলমানদের উপর পড়েছিল।
আজুম দাহাল কিছু সহকর্মীকে সংবিধান এবং মুসলমানদের দুর্দশার কথা বলার জন্য এক বৈঠকে ডেকেছিলেন। বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা হ’লেন, আব্দুর রউফ জুমিয়ে, হুসাইন দাহাল, শেখ ইউসুফ রমযান, তৈয়ব তেগালি এবং মাহমূদ দিলজোর। বৈঠকের পর তারা ‘মুসলিম সংবিধান সংস্কার কমিটি (MCRC)’ নামে একটি সংস্থা গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সংস্থার লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের স্বতন্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দল গঠন, পৃথক ভোটার এবং মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত আসন আদায় করা। স্যার আব্দুর রায্যাক মুহাম্মাদ (মৃ. ১৯৭৮) মুসলিমদের ক্ষমতায়নে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। ফলস্বরূপ, ১৯৫৯ সালে মরিশাসের আইনসভায় ৪০টি নির্বাচিত আসন এবং ১২টি আসনে ভাল প্রতিদ্বন্দিতার মাধ্যমে হেরেছিল। MCRC শেষ পর্যন্ত ভেঙে দেওয়া হয় এবং ‘কমিট ডি অ্যাকশন মুসলিম (CAM)’ নামে দল গঠন করা হয়। দলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন শেখ ইউসুফ রমযান, হারূন আব্দুল, হাসাম বাহেমিয়া আব্দুল হামিদ জি এম ইসহাক, আব্দুল রঊফ বান্ধুন এবং আব্দুল হক্ব ওসমান। আব্দুর রায্যাক নেতা হিসাবে প্রশংসিত হন এবং আজুম দাহলকে সভাপতি এবং শেখ ইউসুফ রমযানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়।
যাহোক, ১৯৬৭ সালের ৭ই আগস্টের নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে স্যার সিউসাগর রামগুলামের নেতৃত্বে মরিশাস লেবার পার্টি (এমএলপি), স্যার আব্দুর রায্যাক মুহাম্মাদের নেতৃত্বে কমিট ডি অ্যাকশন মুসলমান (সিএএম) এবং স্যার সুকদেও বিসুন্দয়ালের নেতৃত্বে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফরোয়ার্ড ব্লক (আইএফবি) এর একটি মহাজোট গঠন করা হয়েছিল যাকে ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্টি বলা হয়। ১৯৬৭ সালের ১২ই আগস্ট স্যার সিউওসাগর রামগুলাম ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হন যে, মরিশাসের জনগণ ‘কমনওয়েলথ অফ নেশনস’-এ যোগদান করতে ইচ্ছুক। ফলস্বরূপ, ১৯৬৮ সালের ১২ই মার্চ মরিশাস ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। তারা লাল, নীল, হলুদ এবং সবুজ রঙের যে স্বতন্ত্র পতাকা লাভ করে সেটাও স্যার আব্দুর রায্যাক মুহাম্মাদ প্রস্তাবিত ছিল।
মরিশাসে মুসলমানদের ধর্মীয় বৈচিত্র : মরিশাসে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষ হিন্দু ধর্মের অনুসারী। ইসলাম মরিশাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্ম। মুসলিমরা সুন্নি, বেরেলভী, তাবলীগ জামা‘আত, সালাফী, শিয়া, কাদিয়ানী, বাহাই এবং সূফীবাদে বিশ্বাসী। মরিশাসে বেরেলভী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের মেরুতের মাওলানা আব্দুল আলিম ছিদ্দিকী (মৃ. ১৯৫৪)। বলা হয় তিনি আহমাদ রেযা খান বেরেলভী (মৃ. ১৯২১)-এর ছাত্র ছিলেন। বেরেলভীরা সেখানে সংখ্যাগরিষ্ট এবং তাদের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাবলীগ জামা‘আতও পিছিয়ে নেই। তারা ১৯৭২ সালে Society Islamique De Maurice (SIM) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। মরিশাসে ১৮৭০ সালে শিয়ারা আগমন করে। তবে তারা এখনো সংখ্যালঘু। ২০০০ সালে মরিশাসের রোজ হিলে সংখ্যালঘু কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। মিস ওটিলি রাইন (১৯০৩-৭৯) ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি মরিশাসে বাহাই মতবাদ নিয়ে আসেন। তিনি ১৯৫৩ সালে মরিশাসে এসেছিলেন। রেইনের আগমনের তিন বছর পর সেখানে ১০০ জনেরও বেশী বাহাই সদস্য ছিল এবং তারা ১৯৫৬ সালের মধ্যে তিনটি স্থানীয় সমাবেশ করেছিল। আরেক মরিশিয়ান বাহাই ছিলেন রডি লুচমায়া (১৯৩২-১৯৯৯)। মরিশাসে সূফীবাদেরও ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
বিশ্বাস করা হয় যে, মরিশাসে সূফীবাদের প্রবর্তন হয়েছিল মুসলিম বণিক মেইমানদের দ্বারা। আজমিরের খাজা মঈনুদ্দীন হাসানের অধীনে মেইমানরা হিন্দু থেকে মুসলমান হয়েছিল। সেই থেকে তারা সর্বদা পীর বা সূফীদের শ্রদ্ধা করত। যখন মেইমানরা মরিশাসে আসে, তখন তারা তাদের পীরদেরকে তাদের সাথে বসতি স্থাপনের জন্য ডেকেছিল যাতে তারা তাদের সঠিক পথ দেখায়। এই কারণে ১৮৪৮ সালে পীর জামাল শাহ ভারতের কচ্ছ থেকে মরিশাস আসেন। তিনি পোর্ট লুইসের জুম‘আ মসজিদের ইমাম ও পীর ছিলেন। তিনি ১৮৫৮ সালে মারা যান এবং মসজিদের আঙ্গিনায় তাকে সমাহিত করা হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন পীর জাহাঙ্গীর শাহ (মৃ. ১৮৯০), যিনি তাঁর ভাতিজা ও ছাত্র ছিলেন। এই দুই পীর ছাড়াও পীর জহুর শাহ (মৃ. ১৯৩৮) এবং পীর আবু বকর শাহ একজন আরেকজনের উত্তরসূরি ছিলেন।
মরিশাসে বিভিন্ন তরিকা পাওয়া যায় যেমন- কাদরী, চিশতী, নকশাবন্দী ইত্যাদি। এগুলো ছাড়াও সালাফী আহলেহাদীছদেরও সরব উপস্থিতি মরিশাসে বিদ্যমান। ১৯৯৯ সালে ‘আল-হূদা ওয়ান নূর’ নামক একটি আহলেহাদীছ সংগঠন কার্যক্রম শুরু করে এবং বিশেষতঃ মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায়নকারী ছাত্রদের দ্বারা এটি পরিচালিত হয়।
[মরিশাসে ইসলাম প্রবন্ধ থেকে অনূদিত।]
শাহীন রেযা
অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।
[1]. পন্ডিচেরি বর্তমান ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের একটি শহর। পূর্বে এটি ফরাসি উপনিবেশের অধীনে ছিল।