এক ফোঁটা মধু
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
অনেক দিন আগের কথা। এক ধূর্ত শিয়াল কোন এক জঙ্গলে বসবাস করত। তার শিকার করার মত শক্তি ছিল না। সে কারণে শিয়াল ছোট পশু-পাখিদের বিভিন্ন প্রতারণামূলক কথায় ভুলিয়ে তাদের কাছাকাছি যেত এবং সুযোগ বুঝে তাদেরকে শিকার করত।
একদিন শিয়াল ক্ষুধার্ত অবস্থায় বনের মধ্যে হাঁটছিল। তাই মনোযোগ দিয়ে চারপাশে দেখছিল আর ভাবছিল, যদি কোন খরগোশ, তিতির পাখি অথবা মোরগ-মুরগি পাই তাহ’লে এমন কাজ করতে হবে যেন তারা আমাকে দেখে না পালায়। হঠাৎ সে এক আজব জিনিস দেখল। রাস্তার মাঝখানে এক মুঠো ঘাস ছড়ানো আছে, তার চারপাশে কয়েকটি কাঠের টুকরা এবং সুতা টানানো আছে। সেগুলোর মাঝখানে একটি তরতাজা মাছ। শিয়াল চিন্তা করলো ক্ষুধার জ্বালায় সে হয়তো ভুল দেখছে। কিন্তু কাছে যেতেই ভালভাবে তাকিয়ে দেখল সত্যিই একটি মাছ। সে মাছের তাজা গন্ধ তার নাকে এসে পৌঁছাল। শিয়াল যদিও ক্ষুধার্ত ছিল তবুও মাছটি না খেয়ে ভাবতে থাকল এটি কোথায় থেকে আসল? সে ভাবল, এটা তো নদীর কিনারা নয় যে বলব মাছ পানি থেকে লাফ দিয়ে এখানে এসে পড়েছে। এখানে কোন মাছের দোকান নেই আবার কোন রান্না ঘরও নেই। মাছ তো কোন বনের পশুও নয় যে পায়ে হেঁটে এখানে চলে আসবে। তাহ’লে এই মাছের উপস্থিতির দুইটা কারণ হ’তে পারে। প্রথমত : এটা শিকারীর পাতা ফাঁদ একারণে শিকারী মাছটাকে এখানে রেখেছে। এবং সে পাশে কোথাও লুকিয়ে আছে যেন কোন পশুকে ফাঁদে আটকিয়ে ধরতে পারে। দ্বিতীয়ত : কোন জেলে নদীর অনেক মাছ ধরে এ রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তার ঝুড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে কিন্তু সে বুঝতে পারেনি। তবে কারণ যেটাই হোক না কেন বিপদের সম্ভবনা রয়েছে। সেজন্য এই মাছ খাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না। শিয়াল কিছুদিন আগে দেখেছিল কিভাবে একটা শিকারী হঠাৎ জঙ্গল থেকে বের হয়ে তার এক বন্ধুকে ফাঁদে ফেলেছিল। এ কারণে সে শপথ করেছিল প্রকৃত অবস্থা না বুঝে কখনো কোন কিছু ধরবে না এবং খাবে না।
তাই সে পরীক্ষা করার জন্য মাছটাকে সেখানে রেখে দিল। অন্য খাবারের খোঁজে সে রাস্তা দিয়ে সামনে যেতে থাকল। কিন্তু অনেকক্ষণ হাঁটার পরেও কোন খাবার পেল না। দূরে একটি বানরকে সে রাস্তা দিয়ে যেতে দেখল। শিয়াল জানত বানর খাওয়া যায় না কিন্তু নরম কথায় কিভাবে সবাইকে ঠকানো যায় সেটা তার জানা ছিল। বানরকে দেখে তার মাথায় একটা বুদ্ধি আসে। সে ভাবল, বানরকে যেভাবেই হোক ফাঁকাবুলি দিয়ে ফুলিয়ে সেই ফাঁদের কাছে নিয়ে গিয়ে তার রহস্য উদঘাটন করতে হবে। সে দ্রুত বানরের কাছাকাছি গেল। পেছন থেকে তাকে ডাক দিল জনাব বানর নাকি? কিছু কথা আছে, দয়া করে দাঁড়ান। বানর মাথা ঘুরিয়ে শিয়ালকে দেখে আবার হাঁটা শুরু করল। অতঃপর একটি গাছের কাছে গিয়ে গাছের উপরে উঠে বসল। শিয়াল সে গাছের কাছে গিয়ে বানরের সামনে বসে কথা বলা শুরু করল। শিয়াল বলল, জানি না কিভাবে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। অবশেষে এখানে এসে আপনাকে দেখতে পেলাম। আমি অনেক ভাগ্যবান। কারণ আজকে আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছি এবং আপনার খেদমত করার সুযোগ পেয়েছি। আপনি বিশ্বাস করুন আজকে সমস্ত জঙ্গল আপনাকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। এখন অনুরোধ করছি দ্রুত নিচে আসুন। বানর এই কথাগুলো শুনে আশ্চর্য হয়ে উত্তর দিল, বুঝতে পারছি না আপনি কি বলছেন? আপনার এই কথাগুলোর উদ্দেশ্য কি?
শিয়াল বলল, এখন জঙ্গলের সমস্ত প্রাণী একটি মাঠে সমবেত হয়েছে। আপনার আদেশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বানর বলল, পশু-পাখি? আমার আদেশের অপেক্ষায়? কিন্তু কিসের জন্য? কি হয়েছে? কি এমন হ’ল! পশু-পাখির সাথে আমার কোন কাজ নেই।
শিয়াল বলল, হায়! মনে হচ্ছে গতকাল আপনি জঙ্গলে ছিলেন না। এ কারণে খবর পাননি। আজকে সকালে জঙ্গলে ক্বিয়ামত হয়েছিল। গতকাল সমস্ত হিংস্র পশু-পাখি একত্রিত হয়ে সিংহকে বনের রাজা করেছিল কিন্তু সে আজ পালিয়ে গেছে। সিংহ খারাপ হয়ে গেছে, সবার সাথে যুলুম করছে। নিরুপায় হয়ে সমস্ত প্রাণী একমত হয়েছে যে, তাকে আর বনের রাজা রাখা যাবে না। অতঃপর সমস্ত প্রাণী মত দিয়েছে আমাদের নেতা অবশ্যই বানরদের মধ্য থেকে হওয়া উচিত।
বানর বলল, এটা ঠিক নয়। বানর যতই শক্তিশালী ও চালাক হোক এবং তার রাজনৈতিক জ্ঞান থাকুক সে কখনো অন্য প্রাণীদে নেতৃত্ব দিতে পারে না। কারণ নেতৃত্বের বোঝা আমাদের জন্য অনেক ভারি। তাই আমি এই কাজ করতে সক্ষম নই। সুতারাং পশুদের রাজা এমন একজনকে হওয়া উচিত যার জ্ঞান ও বিবেক অন্য সমস্ত প্রাণী থেকে বেশী এবং সবার উপরে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে সক্ষম।
শিয়াল বলল, দয়া করে এমন অশোভনীয় কথা বলবেন না। যদি সমস্ত পশু-পাখি একমত হয় তাহ’লে কোন সমস্যা নেই। যখন সকলেই মতামত দিয়ে একজনকে পসন্দ করেছে তখন অবশ্যই তারা তাকে সমর্থন করবে। সম্ভবত সকলের চাইতে বানরদের যোগ্যতা বেশী। বানররা মানুষের ভাষা ভাল বুঝতে পারে। গাছের অনেক উচ্চতায় উঠতে পারে। তারা দক্ষ ও হুশিয়ার। তারা অন্যের উপর জোর করা এবং জোরপূর্বক দোষ চাপানো পসন্দ করে না। পশুদের এমন নেতৃত্ব প্রয়োজন যে ন্যায় বিচার করতে সক্ষম। আজ পর্যন্ত বানর জাতির মধ্যে কেউ খারাপ কিছু দেখেনি। বানর জাতি এক বাক্যে আপনাকে পসন্দ করেছে। এখন তারা জঙ্গলে সমবেত হয়েছে। আমার উপরে দায়িত্ব ছিল দ্রুত এই খবর আপনার কাছে পৌঁছানো যাতে আপনি সেখানে গিয়ে কাজগুলো যথাযথভাবে করতে পারেন। আপনার দায়িত্ব থেকে বিরত থাকা উচিত হবে না। অন্যের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা উচিত, খেদমত করা উচিত। সকলেই অপেক্ষা করছে, আসুন আমরা যাই। বানরের কাছে এ সমস্ত কথা কপটতা মনে হচ্ছিল কিন্তু নেতৃত্বের লোভ তার অন্তরে প্রকট হ’ল। সে নেতৃত্বের প্রস্তাবে খুশি হয়ে গাছ থেকে নেমে বানরের সাথে চলতে লাগল । কিন্তু বানরের মনে শিয়ালের প্রতি তখনও সন্দেহ ছিল। শিয়াল বানরকে চিন্তা করার কোন সুযোগ দিল না। পথ চলতে চলতে সে নেতৃত্বের বিষয়ে তার সাথে কথা বলছিল।
বানরকে উৎসাহিত করছিল যে, দায়িত্ব গ্রহণের পরে সর্বদা তাকে ন্যায়নীতি অবলম্বন করতে হবে। সিংহের অত্যাচারের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে যেন সমস্ত পশু-পাখি বানরের ন্যায়বিচারের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। তারা বানরের প্রশংসা করে এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারে। শিয়াল এভাবে কথা বলতে বলতে শিকারীর পাতা ফাঁদের কাছে পৌঁছায়। অতঃপর সে বানরকে লক্ষ্য করে বলে আমি ইস্তেখারা করতে অভ্যস্ত। আমি আমার বাবাকে বলতে শুনেছি ইস্তেখারার মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমার বাবা অনেক কিছু জানেন। তবে আমারও কিছু অভিজ্ঞতা আছে। অনেক সময় আমি অন্তর থেকে নিয়ত করে ইস্তেখারা করলে সে কাজের ভাল-খারাপ সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
এ কথা বলে শিয়াল আকাশের দিকে হাত তুলে বলে, আল্লাহ! হে আল্লাহ! আপনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব কিছু জানেন। আমরা আমাদের সমস্ত ভাল কাজের অসীলায় আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, যদি বানরের নেতৃত্ব তার জন্য এবং সমস্ত পশু-পাখির জন্য কল্যাণকর হয় তা’হল আপনার পক্ষ থেকে একটা ভাল ইঙ্গিত আমাদের সামনে প্রকাশ করুন। আর যদি অকল্যাণকর হয় তাহ’লে একটা খারাপ ইঙ্গিত প্রকাশ করুন। হে আল্লাহ! আপনিই ভাল-মন্দ সব কিছু সম্পর্কে সম্যক অবগত।
দো‘আ শেষ করতে না করতেই শিয়াল আনন্দের সাথে চিৎকার দিয়ে বলল, আল্লাহু আকবার! আমাদের দো‘আ কবুল হয়েছে! অতঃপর সেই ফাঁদে আটকানো মাছ দেখিয়ে বলে, এই শুষ্ক জঙ্গলে তরতাজা মাছটিই হচ্ছে তার নিদর্শন। হ’তে পারে এটি আসমান থেকে আসা বেহেশতের মাছ। যা আল্লাহ নিদর্শন স্বরূপ পাঠিয়েছেন। যেন জনাব বানর মাছটি খেয়ে মিষ্টিমুখ করে আনন্দের সাথে বনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।
বানর শিয়ালের এমন আনন্দ দেখে আশ্চর্য হয়ে বলে, সত্যি বলছেন! তাহ’লে আপনি আগে খান।
শিয়াল উত্তর দিল, এটা অসম্ভব। এ রকম বেয়াদবি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই বেহেশতী খাবার আল্লাহ আপনার জন্য আসমান থেকে পাঠিয়েছেন। এটা আপনার হক্ব। আল্লাহ আমার দো‘আ কবুল করেছেন এতেই আমি খুশি। আপনি দ্রুত এটা খেয়ে চলুন, সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
বানর যখনই মাছটি খেতে গেল তখনই সে ফাঁদে আটকা পড়ল। শিয়াল আর কোনই কথা বলল না। ফাঁদ তার কাজ সহজ করে দিল। শিকারী আসার আগেই সে সুযোগ পেয়ে মাছটি ফাঁদ থেকে বের করে খাওয়া শুরু করল।
বানর তখনো শিয়ালের এই সমস্ত কথা ধোঁকাবাজি বুঝতে পারেনি। সে শিয়ালকে বলল, এমন কেন হ’ল? আমি ফাঁদে পড়লাম আর আপনি মাছ খাচ্ছেন?
শিয়াল বলল, সবাই নিজের চিন্তা করে। নেতৃত্বে যেতে হ’লে মাঝে মাঝে জেল খাটতে হয়। তুমি ঘুঘু দেখেছ কিন্তু ফাঁদ দেখনি সেজন্য আটকা পড়েছ।
[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]
শিক্ষা : গল্পের বিষয়বস্ত্ত ঈষৎ রসাত্মক হ’লেও অন্তর্নিহিত নিগূঢ় অর্থ সকলের জন্য শিক্ষনীয়। এই গল্পের প্রথম শিক্ষা হ’ল, নেতৃত্বের সুপ্ত বাসনা যখন অযোগ্য ব্যক্তিকে লোভাতুর করে তখন তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। মেকি ভক্তিতে এতই আত্মবিশ্বাস হৃদয়ে সঞ্চার হয় যে, নিজের যোগ্যতা কতটুকু সেটাও ভুলে যায়। দ্বিতীয় শিক্ষা হ’ল, আমাদের সমাজে ‘শিয়াল’ শ্রেণীর কিছু ধূর্ত মানুষ স্বার্থসিদ্ধির জন্য যেকোন সীমা অতিক্রম করে। তারা অযোগ্য ব্যক্তিকে নেতৃত্ব্যের লোভ দেখিয়ে মসনদে তুলে দেয় কিন্তু কার্যকরী ক্ষমতা নিজেদের হাতে রেখে দেয়। যতক্ষণ স্বার্থ থাকে ততক্ষণ কপট ভক্তি দেখায়। স্বার্থ শেষ হয়ে গেলে বিপদসংকুল অবস্থায় ফেলে রেখে নিরাপদ দূরত্বে কেটে পড়ে। গল্পটি বর্তমান সমাজের চাটুকারিতা ও স্বার্থসিদ্ধির রাজনীতির প্রতিচ্ছবি ‘শিয়াল’ চরিত্রটাকেই স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তুলেছে। সুতরাং আমাদের নেতৃত্বের লোভ বর্জন করা উচিত এবং চাটুকারদের সংস্রবমুক্ত এমন নেতৃত্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত যারা দেশ ও দশের কল্যাণে কাজ করবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।