মূল্যহীন দুনিয়ার প্রতি অনর্থক ভালোবাসা (৭ম কিস্তি)
আব্দুর রহীম
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর 791 বার পঠিত
(১১) রিসালাতের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাসী : মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলা যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে অসংখ্য নবী ও রাসূল পাঠিয়েছেন। এসব নবী ও রাসূলগণ মানুষের নিকটে আল্লাহর পরিচয় ও তাওহীদের বাণী প্রচার করেছেন এবং মানুষকে ভ্রান্ত পথ ছেড়ে সঠিক পথে ফিরে আসার দাওয়াত দিয়েছেন। এই দাওয়াতকেই রিসালাত বলা হয়। উত্তম ব্যক্তি তো তিনিই, যিনি রিসালাতের প্রতি পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাসী।
আবু মুহায়রীয (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদিন আমি আবু জুম‘আহ (রাঃ) নামক এক ছাহাবীকে বললাম, আমাকে এমন একটি হাদীছ বলুন, যা আপনি রাসূল (ছাঃ) হ’তে শুনেছেন। তিনি বললেন,نَعَمْ أُحَدِّثُكُمْ حَدِيثًا جَيِّدًا تَغَدَّيْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَمَعَنَا أَبُو عُبَيْدَةَ بْنُ الْجَرَّاحِ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللهِ. أَحَدٌ خَيْرٌ منَّا؟ أسلمْنا وَجَاهَدْنَا مَعَكَ. قَالَ: نَعَمْ قَوْمٌ يَكُونُونَ مِنْ بَعْدِكُمْ يُؤْمِنُونَ بِي وَلَمْ يَرَوْنِي- ‘হ্যাঁ, আমি তোমার নিকট খুবই চমৎকার একটি হাদীছ বর্ণনা করব। একদিন আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সকালের খাবার খাচ্ছিলাম। আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)ও আমাদের সাথে ছিলেন। তখন আবু ওবায়দাহ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চেয়েও কোন উত্তম লোক আছে কি? কেননা আমরা আপনার প্রতি ঈমান এনেছি এবং আপনার সাথে জিহাদ করেছি। উত্তরে তিনি বললেন, হ্যাঁ, তারা এমন এক জাতি, যারা তোমাদের পরে দুনিয়াতে আসবে এবং আমার ওপর ঈমান আনবে অথচ তারা আমাকে দেখেনি’।[1]
উপরোক্ত হাদীছ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, যারা রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে তাঁর রিসালাতের উপর ঈমান আনবে, তারাও শ্রেষ্ঠ মানুষ।
(১২) উত্তম প্রতিবেশী : সুখে-দুঃখে কিংবা বিপদে-আপদে একে অপরের সহযোগিতায় সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে প্রতিবেশী। এ কারণেই প্রতিবেশীর প্রতি সদাচরণ করার জন্য ইসলাম জোর তাকীদ দিয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَى وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنْبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَنْ كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا- ‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না। তোমরা সদ্ব্যবহার কর পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, পথচারী মুসাফির ও তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসী সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ দাম্ভিক ও আত্মম্ভরীকে ভালবাসেন না’ (নিসা ৪/৩৬)।
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,خَيْرُ الأَصْحَابِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِصَاحِبِهِ، وَخَيْرُ الجِيرَانِ عِنْدَ اللهِ خَيْرُهُمْ لِجَارِه- ‘আল্লাহ তা‘আলার নিকট সঙ্গীদের মাঝে উত্তম সঙ্গী হ’ল সে ব্যক্তি যে তার সঙ্গীর নিকট উত্তম। আল্লাহ তা‘আলার দৃষ্টিতে প্রতিবেশীদের মাঝে উত্তম হ’ল সে প্রতিবেশী যে তার প্রতিবেশীর নিকট উত্তম’।[2]
(১৩) অন্যের কল্যাণকামী : বর্তমানে খুব কম সংখ্যক মানুষই আছে যাদের কাছ থেকে কল্যাণের আশা করা যায় এবং তার ক্ষতি হ’তে নিরাপদ থাকা যায়। আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব সকলের উপর থেকে মানুষের বিশ্বাস উঠে গেছে। কেউ কারও উপর সন্তুষ্ট নয় এবং পরস্পর পরস্পরের কাছে নিরাপদও নয়। অথচ হাদীছে সেই ব্যক্তিকে উত্তম বলা হয়েছে, যার কাছে অন্যরা নিরাপদ এবং যে অন্যের কল্যাণ কামনা করে। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَقَفَ عَلَى نَاسٍ جُلُوسٍ، فَقَالَ: أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخَيْرِكُمْ مِنْ شَرِّكُمْ؟ قَالَ: فَسَكَتُوا، فَقَالَ ذَلِكَ ثَلَاثَ مَرَّاتٍ، فَقَالَ رَجُلٌ: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، أَخْبِرْنَا بِخَيْرِنَا مِنْ شَرِّنَا، قَالَ: خَيْرُكُمْ مَنْ يُرْجَى خَيْرُهُ وَيُؤْمَنُ شَرُّهُ، وَشَرُّكُمْ مَنْ لَا يُرْجَى خَيْرُهُ وَلَا يُؤْمَنُ شَرُّهُ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, ‘কোন এক সময় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বসে থাকা কয়েকজন লোকের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মধ্যে সবচাইতে উত্তম কে এবং সবচাইতে নিকৃষ্ট কে তা কি আমি তোমাদেরকে জানিয়ে দিব না? বর্ণনাকারী বলেন, সকলেই চুপ করে রইল। তারপর তিনি ঐ কথা তিনবার জিজ্ঞেস করেন। তারপর এক ব্যক্তি বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদেরকে জানিয়ে দিন যে, কে আমাদের মধ্যে সর্বাধিক উত্তম এবং কে সর্বাধিক নিকৃষ্ট? তিনি বললেন, সেই লোক তোমাদের মধ্যে সবচাইতে উত্তম যার নিকট কল্যাণ কামনা করা যায় এবং যার ক্ষতি হ’তে মুক্ত থাকা যায়। আর সেই লোক তোমাদের মধ্যে সবচাইতে নিকৃষ্ট যার নিকট কল্যাণের আশা করা যায় না এবং যার ক্ষতি হ’তেও নিরাপদ থাকা যায় না’।[3]
(১৪) উত্তম চরিত্রের অধিকারী : চরিত্র মানুষের মূল্যবান সম্পদ। মানবিক গুণাবলী অর্জনের মাধ্যমে মানুষ উত্তম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হ’তে পারে। চরিত্রবান মানুষকে সবাই ভালবাসে, শ্রদ্ধা করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, خِيَارُكُمْ أَطْوَلُكُمْ أَعْمَاراً وَأَحْسَنُكُمْ أَخْلاَقاً- ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যার বয়স বেশী এবং চরিত্র ভাল’।[4] তিনি বলেন, أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا ‘ঐ মুমিন ঈমানে পরিপূর্ণ যার চরিত্র সর্বোৎকৃষ্ট’।[5] তিনি আরও বলেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَيُدْرِكُ بِحُسْنِ خُلُقِهِ دَرَجَةَ الصَّائِمِ الْقَائِم ‘নিশ্চয়ই মুমিন ব্যক্তি তার ভাল চরিত্রের মাধ্যমে (দিনে) ছিয়াম পালনকারী ও (রাতে) দাঁড়িয়ে ছালাত আদায়কারীর সমান মর্যাদা লাভ করতে পারে’।[6] এছাড়াও রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ شَيْءٍ أَثْقَلُ فِي الْمِيزَانِ مِنْ حُسْنِ الْخُلُقِ ‘মীযানের পাল্লায় সচ্চরিত্রের চেয়ে অধিক ভারী আর কিছুই নেই’।[7] উত্তম চরিত্রের গুণ ও দ্বীনের সঠিক জ্ঞান মুনাফিকরা অর্জন করতে পারে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, خَصْلَتَانِ لَا تَجْتَمِعَانِ فِي مُنَافِقٍ، حُسْنُ سَمْتٍ، وَلَا فِقْهٌ فِي الدِّينِ ‘এমন দু’টি স্বভাব আছে যা মুনাফিকের মধ্যে একত্রে সমাবেশ হ’তে পারে না, (১) উত্তম চরিত্র ও (২) দ্বীনের সুষ্ঠু জ্ঞান’।[8]
আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, لَمْ يَكُنِ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم فَاحِشًا وَلاَ مُتَفَحِّشًا ‘নবী করীম (ছাঃ) অশ্লীলভাষী ও অসদাচরণের অধিকারী ছিলেন না। তিনি বলতেন, إِنَّ مِنْ خِيَارِكُمْ أَحْسَنَكُمْ أَخْلاَقًا তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই সর্বোত্তম যার চরিত্র সর্বোত্তম’।[9]
(১৫) তওবাকারী ব্যক্তি : তওবা হ’ল ফিরে আসা বা প্রত্যাবর্তন করা। আল্লাহর নিষেধকৃত বিষয়সমূহ ত্যাগ করা ও তাঁর আদেশকৃত বিষয়সমূহের দিকে ফিরে আসাই তওবা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,وَتُوبُوا إِلَى اللهِ جَمِيعًا أَيُّهَ الْمُؤْمِنُونَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর কাছে তওবা (প্রত্যাবর্তন) কর, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পার’ (নূর ২৪/৩১)। মহান আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللهِ تَوْبَةً نَصُوحًا ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর নিকট তওবা কর বিশুদ্ধ তওবা’ (তাহরীম ৬৬/৮)।
আবু মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يَبْسُطُ يَدَهُ بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَهُ بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيْلِ، حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাত রাতে প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবা করে এবং দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবা করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে’।[10]
আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,كُلُّ بَنِي آدَمَ خَطَّاءٌ، وَخَيْرُ الْخَطَّائِينَ التَّوَّابُونَ- ‘মানুষ মাত্রই গুনাহগার। আর গুনাহগারদের মধ্যে উত্তম লোক তারাই যারা অধিক তওবা করে’।[11]
(১৬) অন্যের ক্ষতি করা থেকে বিরত ব্যক্তি : একজন মুসলিম ব্যক্তি কোনভাবেই তার অপর মুসলিম ভাইকে শারীরিক কিংবা মানসিকভাবে কষ্ট দিতে পারে না। সে তার জিহবা দ্বারা নিন্দা করা, গালমন্দ করা, দোষ বর্ণনা করা, অপবাদ দেয়া কিংবা উপহাস করার মাধ্যমে কষ্ট দিবে না। অনুরূপভাবে নিজের হাত দ্বারা আঘাত করা, হত্যা করা এমনকি হাতের ইশারার মাধ্যমে কষ্টদায়ক অঙ্গভঙ্গিও করতে পারবে না। একজন মুসলিম ব্যক্তির হাত ও জবানের অনিষ্ট থেকে অন্য মুসলিমের নিরাপদ থাকাটা তার অধিকারের মধ্যে গণ্য। যে ব্যক্তি বান্দার এই হক আদায় করতে পারবে ইসলামে সে-ই উত্তম ব্যক্তি। জনৈক ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-কে প্রশণ করেছিল যে, মুসলিমদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি কে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ ‘যার জিহবা ও হাত (এর অনিষ্ট) হ’তে অন্য মুসলিমগণ নিরাপদে থাকে’।[12]
(১৭) যাকাত প্রদানকারী ব্যক্তি : যাকাত ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। সম্পদশালী ব্যক্তিগণের উপরই কেবল যাকাত ফরয। যারা নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদের মালিক হবেন তারা বছরান্তে নির্দিষ্ট অংশ শরী‘আত নির্ধারিত খাতসমূহে বণ্টন করবেন। কেননা যাকাত প্রদান করা উত্তম ব্যক্তির কাজ। হাদীছে এসেছে,عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِخَيْرِ النَّاسِ؟ رَجُلٌ مُمْسِكٌ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللهِ. أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِالَّذِي يَتْلُوهُ؟ رَجُلٌ مُعْتَزِلٌ فِي غُنَيْمَةٍ لَهُ يُؤَدِّي حَقَّ اللهِ فِيهَا... ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘কে উত্তম মানুষ, আমি কি তোমাদের তা জানিয়ে দিব না? আল্লাহ তা‘আলার রাস্তায় যে নিজের ঘোড়ার লাগাম ধরে প্রস্ত্তত থাকে। আমি কি তোমাদের বলে দেব না তারপর কোন মানুষ উত্তম? যে নিজের মেষপাল নিয়ে মানুষদের কাছ হ’তে দূরে অবস্থান করে থাকে এবং তাতে আল্লাহ তা‘আলার যে হক (যাকাত) রয়েছে তা দিয়ে দেয়’...।[13]
(১৮) উত্তম আমলকারী ব্যক্তি : আমলে ছালেহ বা উত্তম আমল যেকোন ব্যক্তিকে বাস্তবিক ও কল্যাণকর জীবন যাপনে উৎসাহিত করে। উত্তম আমলের মাধ্যমে ব্যক্তি কেবল আল্লাহর নিকট প্রিয় বান্দা হিসেবে পরিগণিত হয় না বরং সমাজে ভাল মানুষ হিসাবেও বিবেচিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَتَعَاوَنُوا عَلَى الْبِرِّ وَالتَّقْوَى‘তোমরা সৎকর্ম ও আল্লাহভীতির কাজে পরস্পরকে সহযোগিতা কর’ (মায়েদাহ ৫/২)। পবিত্র কুরআনে উত্তম আমলকারীদের জন্য সুসংবাদ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,يَاعِبَادِ لَا خَوْفٌ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ وَلَا أَنْتُمْ تَحْزَنُونَ- ‘হে আমার (ইবাদতকারী) বান্দাগণ! আজ তোমাদের কোন ভয় নেই এবং তোমরা চিন্তিতও হবে না’ (যুখরুফ ৪৩/৬৮)। যার আমল যত সুন্দর সে তত উত্তম এবং পুলছিরাত অতিক্রম তার জন্য ততটাই সহজ হবে। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَرِدُ النَّاسُ النَّارَ ثُمَّ يَصْدُرُونَ مِنْهَا بِأَعْمَالِهِمْ، فَأَوَّلُهُمْ كَلَمْحِ البَرْقِ، ثُمَّ كَالرِّيحِ، ثُمَّ كَحُضْرِ الفَرَسِ، ثُمَّ كَالرَّاكِبِ فِي رَحْلِهِ، ثُمَّ كَشَدِّ الرَّجُلِ، ثُمَّ كَمَشْيِهِ- ‘সকল মানুষ জাহান্নামের নিকট উপস্থিত হবে এবং আমলের অনুপাতে মুক্তি পাবে। তাদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম লোক সকলের আগে বিদ্যুতের গতিতে, কেউ দ্রুতগামী ঘোড়ার গতিতে, কেউ উটের গতিতে, কেউ মানুষের দৌড়ের গতিতে, অতঃপর পায়ে হাঁটার গতিতে প্রস্থান করবে’।[14]
(১৯) স্ত্রীর উপর নির্যাতন থেকে বিরত ব্যক্তি : ইয়াস ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু যুবাব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা আল্লাহর দাসীদের প্রহার করো না। অতঃপর ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে বলেন, নারীরা তো তাদের স্বামীদের অবাধ্যতা করছে। অতঃপর তিনি তাদেরকে প্রহারের অনুমতি দিলেন। ফলে তারা প্রহৃতা হ’লে অনেক নারী তাদের নিজ নিজ স্বামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাড়িতে আসা-যাওয়া করল। তখন (সকাল বেলায়) নবী করীম (ছাঃ) বললেন,لَقَدْ طَافَ بِآلِ مُحَمَّدٍ نِسَاءٌ كَثِيرٌ يَشْكُونَ أَزْوَاجَهُنَّ لَيْسَ أُولَئِكَ بِخِيَارِكُمْ ‘আজ রাতে মুহাম্মাদের পরিবারে অনেক মহিলা এসে তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। (স্ত্রীকে প্রহারকারী) এ সকল স্বামী তোমাদের মধ্যে উত্তম নয়’।[15] অতএব যেসকল স্বামী স্ত্রীকে নির্যাতন থেকে মুক্ত থাকে তারা উত্তম ব্যক্তি।
(২০) বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি : উত্তম মানুষ হওয়ার জন্য বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী ও সত্যভাষী ব্যক্তি হ’তে হবে। কেননা হাদীছে এসেছে,عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، قَالَ: قِيلَ لِرَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: أَيُّ النَّاسِ أَفْضَلُ؟ قَالَ: كُلُّ مَخْمُومِ الْقَلْبِ، صَدُوقِ اللِّسَانِ قَالُوا: صَدُوقُ اللِّسَانِ، نَعْرِفُهُ، فَمَا مَخْمُومُ الْقَلْبِ؟ قَالَ: هُوَ التَّقِيُّ النَّقِيُّ، لَا إِثْمَ فِيهِ، وَلَا بَغْيَ، وَلَا غِلَّ، وَلَا حَسَدَ- আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলা হ’ল, কোন ব্যক্তি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, প্রত্যেক বিশুদ্ধ অন্তরের অধিকারী সত্যভাষী ব্যক্তি। তারা বলেন, সত্যভাষীকে তো আমরা চিনি, কিন্তু বিশুদ্ধ অন্তরের ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, সে হ’ল পূত-পবিত্র নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষ যার কোন গুনাহ নেই, নে কোন দুশমনি, হিংসা-বিদ্বেষ, আত্মঅহমিকা ও কপটতা’।[16]
(২১) অন্যকে খাদ্য খাওয়ানো এবং সালামের উত্তর দেওয়া : অন্যকে খাওয়ানো যেমন উত্তম ব্যক্তির কাজ, অনুরূপভাবে কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দেওয়াও উত্তম কাজ। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,خِيَارُكُمْ مَنْ أَطْعَمَ الطَّعَامَ وَرَدَّ السَّلاَمَ ‘তোমাদের মাঝে উত্তম ব্যক্তি সেই, যে অন্যদের খাদ্য দান করে এবং যে সালামের জবাব দেয়’।[17] অপর হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,اعْبُدُوا الرَّحْمَنَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَأَفْشُوا السَّلَامَ، تَدْخُلُوا الجَنَّةَ بِسَلَامٍ- ‘তোমরা দয়াময় রাহমানের ইবাদাত কর, (মানুষকে) খাদ্য খাওয়াও এবং সালামের অধিক প্রচলন ঘটাও, তবেই নিরাপদে জান্নাতে যেতে পারবে’।[18]
উপসংহার : পরিশেষে বলতে চাই, মানুষ যেমন ‘আশরাফুল মাখকুলাত’ তথা সৃষ্টির সেরা জীব, সেজন্য তার প্রতিটি কাজ-কর্মও সেরা হওয়া উচিত। আর প্রত্যেক কাজ সেরা করতে চাইলে তাকে অবশ্যই উপরোক্ত গুণগুলো অর্জন করতে হবে। তবেই সে স্বয়ং আপন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দৃষ্টিতে সেরা মানুষ বলে বিবেচিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে উত্তম মানুষ হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
মুহাম্মাদ আব্দুন নূর
[লেখক : কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক,
বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. আহমাদ হা/১৭০১৮; মিশকাত হা/৬২৮২।
[2]. তিরমিযী হা/১৯৪৪; দারেমী হা/২৪৮১।
[3]. তিরমিযী হা/২২৬৩; ইবনু হিববান হা/৫২৭; মিশকাত হা/৪৯৯৩।
[4]. আহমাদ হা/৯২২৪; মিশকাত হা/৫১০০।
[5]. আবুদাউদ হা/৪৬৮২; দারেমী হা/২৮৩৪; মিশকাত হা/৫১০১।
[6]. আবুদাউদ হা/৪৭৯৮; ইবনু হিববান হা/৪৮০; আহমাদ হা/২৫৫৭৮।
[7]. আবুদাউদ হা/৪৭৯৯; তিরমিযী হা/২০০৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৭২১।
[8]. তিরমিযী হা/২৬৮৪; সিলসিলা ছহীহাহ হা/২৭৮।
[9]. বুখারী হা/৩৫৫৯; মুসলিম হা/২৩২১; মিশকাত হা/৫০৭৫।
[10]. মুসলিম হা/২৭৫৯; মিশকাত হা/২৩২৯।
[11]. মিশকাত হা/২৩৪১; দারেমী হা/২৭৬৯; ইবনে মাজাহ হা/৪২৫১।
[12]. মুসলিম হা/৪২; তিরমিযী হা/২৫০৪; আহমাদ হা/৬৭৯২।
[13]. তিরমিযী হা/১৬৫২; মিশকাত হা/১৯৪১।
[14]. তিরমিযী হা/৩১৫৯; মিশকাত হা/৫৬০৬।
[15]. দারেমী হা/২২৬৫; মিশকাত হা/৩২৬১।
[16]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; ছহীহুত তারগীব হা/২৮৮৯।
[17]. হাকেম হা/৭৭৩৯; আহমাদ হা/২৩৯৭১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩১৮।
[18]. তিরমিযী হা/১৮৫৫; মিশকাত হা/১৯০৮; ছহীহাহ হা/৫৭১।