শিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষাক্রম মনিটরিং-এর গুরুত্ব
মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
মুখতারুল ইসলাম 2246 বার পঠিত
জ্ঞান
মানুষের অমূল্য সম্পদ। অতৃপ্ত হৃদয়ের তৃপ্তির রস। অজানাকে জানা, অচেনা
চেনা। নতুনের জগতে হারিয়ে যাওয়া। জ্ঞান আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় আমানত। এই
আমানতের মাধ্যমে অন্ধকার ও পথভ্রষ্টতা থেকে কত মানুষকে যে আল্লাহ সুন্দর ও
সত্যের পথে নিয়ে এসেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ‘আলাদীনের চেরাগ’-এর মতই
জ্ঞানভান্ডার যা মানুষকে দিয়েছে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’-এর অন্যন্য সম্মাননা।
আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞান দ্বারা তাঁর নবীকে সিক্ত করে মহান সম্মানে ভূষিত
করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ وَكَانَ فَضْلُ اللَّهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا-
‘এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। বস্ত্ততঃ তোমার উপর আল্লাহর অসীম করুণা রয়েছে’ (নিসা ৪/১১৩) । আল্লাহ তাঁর নবীকে অন্য কিছু অধিক চাওয়ার ব্যাপারে আদেশ করেননি কিন্তু জ্ঞান অর্জনের জন্য তাকিদ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَقُلْ رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا‘আর বল, হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৪)। আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানী সম্প্রদায়কে দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,
يَرْفَعِ اللَّهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ-
‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদেরকে মর্যাদায় সমুন্নত করবেন। আর তোমরা যা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (মুজাদালাহ ৫৮/১১)। জ্ঞানী বা আলেমরা আল্লাহকে অধিক ভয় করেন। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللَّهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কেবল জ্ঞানীরাই আল্লাহকে ভয় করে’ (ফাতির ৩৫/২৮)। আল্লাহ তা‘আলা জ্ঞানীদের জ্ঞানের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিয়ে বলেন, شَهِدَ اللَّهُ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ وَالْمَلَائِكَةُ وَأُولُو الْعِلْمِ قَائِمًا بِالْقِسْطِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। ফেরেশতামন্ডলী ও ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/১৮)।
সবচেয়ে বড় জিহাদ হলো দালীলিক জিহাদ (Documentary Evidence) ও কথার জিহাদ। আর সেটিই হলো নবীদের ওয়ারিছ আলেম-ওলামা, জ্ঞানীগুণীদের জিহাদ। মহান আল্লাহ বলেন, وَلَوْ شِئْنَا لَبَعَثْنَا فِي كُلِّ قَرْيَةٍ نَذِيرًا فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِينَ وَجَاهِدْهُمْ بِهِ جِهَادًا كَبِيرًا- ‘আমরা ইচ্ছা করলে প্রত্যেক জনপদে একজন করে সতর্ককারী (নবী) প্রেরণ করতাম। অতএব তুমি কাফেরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি তাদের বিরুদ্ধে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম কর’ (ফুরক্বান ২৫/৫১-৫২)।
ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রহঃ) বলেন, ‘কুরআন দ্বারা তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ। আর দু’টি বড় জিহাদের একটি হলো মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ। মুনাফিকরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জিহাদ করেন না ঠিকই কিন্তু প্রকাশ্যেভাবে থেকে ভিতরে ভিতরে শত্রুদের সাথে সঙ্গ দেয়। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম। আর ওটা হল নিকৃষ্ট ঠিকানা’ (তাওবা ৯/৭৩)।
উল্লেখ্য যে, মুনাফিকের বিরুদ্ধে কুরআনের দলিল ভিত্তিক জিহাদ। অর্থাৎ আল্লাহর পথে জিহাদ আর সেটি হলো জ্ঞানার্জন ও জাতিকে আল্লাহর পথে ডাকা’।[1] মানুষ মৃত্যুর পরেও জ্ঞান থেকে পুরো দস্ত্তর ফায়দা হাছিল করে। হাদীছে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষ যখন মারা যায় তখন তার আমলের সকল দরজা বন্ধ হয়ে যায় তিনটি ব্যতীত। ছাদক্বায়ে জারিয়া, উপকারী (ইলম) জ্ঞান এবং সৎ সন্তান যে তার জন্য দো‘আ করে’।[2]
সুতরাং তালেবে ইলমের জন্য সবচেয়ে গর্বের বিষয় হলো তারা নবীদের ওয়ারিছ। আর নবীরা কোন দিনার বা দিরহাম রেখে যাননি। বরং তারা উম্মতের জন্য জ্ঞান বা ইলম রেখে গেছেন। অতএব যে চায় সে যেন তার পূর্ণ অংশের ভাগীদার হয়। কেননা বিদ্যার্জন জান্নাতের পথ যা পাওয়ার প্রথম হকদার তালেবে ইলমরাই। হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللَّهُ لَهُ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ. আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘যে লোক জ্ঞানের খোঁজে কোন পথে চলবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতের পথ সহজ করে দিবেন’।[3]
জ্ঞানী সম্প্রদায়ের সবের্বাচ্চ মর্যাদার কথায় ধ্বনিত হয়েছে সমস্ত কুরআন-হাদীছের পরতে পরতে। জ্ঞান বা ইলম ছাড়া এমন ঈর্ষনীয় সম্মান বা মর্যাাদায় পোঁছা কারো সম্ভব নয়। বিশেষ করে দ্বীনী ইলম অর্জন করা সবার জন্য আবশ্যক । কেননা বর্তমান মতবাদ বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে দ্বীনী জ্ঞান শিক্ষার বিকল্প নেই। বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও তার বাস্তবতা অনেক কঠিন। শুধু দ্বীনী শিক্ষার অভাবে মুসলিম জাতির ঘাড়ে জাহেলিয়াতে প্রগাঢ় অমানিশা ভর করেছে। ফলে শতধা বিভক্ত মুসলিম জাতি এ থেকে বাঁচার জন্য নব্য জাহেলিয়াতের অন্ধকারের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে বারংবার। জাতীয় ও বিজাতীয় মতবাদ এখন মুসলমানের পুঁজির বা∙∙ পরিণত হয়েছে। দ্বীনী জ্ঞান জাতির এ দুর্দিনে অনুঘটকের ভূমিকা রাখতে পারে। শত্রুদের পাতানো ফাঁদ থেকে বাঁচতে, দ্বীনের হেফাযতে সময়ের বিবেচনায় ‘ইলমুশ শারঈ’ তথা দ্বীনী ইলম শিক্ষায় এখন তালেবে ইলমকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। আর দ্বীনী ইলম বলতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর জ্ঞানকে বুঝায়। যা ব্যক্তি পরিশুদ্ধি থেকে শুরু করে সমাজ, রাষ্ট্র মানব জীবনের প্রতিটি অঙ্গনকে নাড়া দেয়।
যখন কোন তালেবে ইলম দ্বীনী জ্ঞান অন্বেষণে নিজেকে মনোনিবেশ করে তখন তাঁর উচিৎ হবে জ্ঞানের প্রতিটি শাখায় পদচারণা। দ্বীনী জ্ঞানে উছূলী বিদ্যায় পারদর্শিতায় অর্জন করা। এর মানহাজ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সর্ম্পকে সম্যক ধারণা লাভ করা। তাহলে একজন তালেবে ইলম তার নিদিষ্ট লক্ষস্খলে পোঁছে সক্ষম। দ্বীনী জ্ঞান অর্জনে কিছু বিশেষ গুণ অর্জন করতে হয়। নচেৎ জ্ঞার্নাজনের মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। নিম্নে এমনই কিছু গুণাবলী তুলে ধরা হলো-
(১) একজন তালেবে ইলমকে অবশ্যই তার অন্তর জগৎকে যাবতীয় পাপাচার, ধোঁকাবাজি, হিংসা, অহংকার, অপরিচ্ছন্ন আক্বীদা ও কলূষিত চরিত্র বিশেষ করে রিয়া, আমিত্ববোধ, লৌকিকতা মুক্ত হতে হবে। পরিশুদ্ধ আত্মা নিয়ে এ ময়দায়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে তাহলে একজন তালেবে ইলম কাক্ষিত বিদ্যার্জন ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পোঁছতে তাকে বেগ পেতে হবে না।
জ্ঞান বা ইলমের উদাহরণে কেউ কেউ বলেন, এটি একটি গোপনীয় ছালাত, অন্তরের ইবাদত, আধ্যাত্মিকতার বাহন। যখন বির্দ্যাজনে আত্মা পবিত্র হয় তখন তা থেকে বরকত ঝরতে থাকে ঠিক যেভাবে ক্ষেতে সুশোভিত শস্য বাড়তে থাকে ও মালিক তা থেকে উপকার লাভ করে।
সাহল ইবনু আব্দুল্লাহ (রহঃ) বলেন, সেই অন্তরে (জ্ঞান) আল্লাহর নূর কক্ষনো প্রবেশ করতে পারে না যে অন্তরে আল্লাহর অপসন্দনীয় বিষয়াদি থাকে।
(২) তালেব ইলমের উদ্দেশ্যই হবে ইখলাছ লিল্লাহ তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, ইলম অনুযায়ী আমল, শরী‘আতের পুর্ণজাগরণ, অন্তরাত্মাকে আলোকিত করন, ক্বিয়ামতের কঠিন দিনে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন ও তালেবে ইলম বা জ্ঞানী সম্প্রদায়ের আল্লাহ ঘোষিত সম্মানে ভূষিত হওয়া।
সুফিয়ান ছাওরী (রহঃ) বলেন, ‘আমার অন্তর জগতের চিকিৎসার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। কেননা অন্তর সর্বদা পরিবর্তনশীল’। আবু হুরায়র (রাঃ) তিনজনের ব্যাপারে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তন্মধ্যে ঐ আলেমের ক্বিয়ামতের মাঠে প্রথম বিচারেরে সম্মুখীন করা হবে যে আলেম তার ইলম দিয়ে মানুষের প্রশংসা ও সম্মান কুড়ায়’।[4]
তালেবে ইলমের সবচেয়ে বড় বিপদ হলো অহংকার, তর্ক-বাহাছ, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান, দুনিয়া তালাশ ইত্যাদি। অথচ আল্লাহ যে বান্দার (তালেবে ইলম) কল্যাণ চায়, প্রথমেই তার অন্তর জগৎকে আল্লাহ ভীতি দিয়ে নরম করে দেন। ফলে তার প্রতিটি কাজে খুলূছিয়াত ফুটে উঠে। আর সে প্রতিটি আমলের ব্যাপারে অত্যন্ত গোপনীয়তা অবলম্বন করে।
কোন কোন সালাফে ছালেহীন বলতে চেয়েছেন, ‘আমার ইবাদত আল্লাহ ও আমার মাঝে মহববতের সেতুবন্ধন। তা অন্য কোন চক্ষু অবলোকন করতে পারে না’। হাদীছে এসেছে,
كَعْبِ بْنِ مَالِكٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ مَنْ طَلَبَ الْعِلْمَ لِيُجَارِىَ بِهِ الْعُلَمَاءَ أَوْ لِيُمَارِىَ بِهِ السُّفَهَاءَ أَوْ يَصْرِفَ بِهِ وُجُوهَ النَّاسِ إِلَيْهِ أَدْخَلَهُ اللَّهُ النَّارَ.
কা‘ব ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলতে আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে লোক আলেমদের সাথে তর্ক-বাহাছ করা অথবা জাহেল মূর্খদের সাথে বাক-বিতন্ডা করার জন্য এবং মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে ইলম অধ্যায়ন করেছে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’। [5] অন্যত্র এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ تَعَلَّمَ عِلْمًا مِمَّا يُبْتَغَى بِهِ وَجْهُ اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ لاَ يَتَعَلَّمُهُ إِلاَّ لِيُصِيبَ بِهِ عَرَضًا مِنَ الدُّنْيَا لَمْ يَجِدْ عَرْفَ الْجَنَّةِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ.
আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ইলমের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ করা যায়, কোন লোক যদি দুনিয়াবী স্বার্থ লাভের জন্য তা শিক্ষা করে, তবে সে ক্বিয়ামতের দিন জান্নাতের সুগন্ধি পাবে না’।[6] (ক্রমশ:)
[1]. মিফতাহু দারুস সা‘দাহ ১/৭০ পৃঃ।
[2]. মুসলিম হা/৪৩১০।
[3]. তিরমিযী হা/২৮৫৮।
[4]. মুসলিম হা/২/১৩১৫।
[5]. তিরমিযী হা/২৬৫৪।
[6]. আবুদাউদ হা/৩৬৬৬।