ব্রেলভী সম্প্রদায় : ভারতীয় উপমহাদেশের এক ভ্রান্ত ফেরকা
মুখতারুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 770 বার পঠিত
ভূমিকা : ইসলাম প্রতিটি মানুষের জন্য এক শাশ্বত জীবনবিধান। মানব জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগে করণীয় কার্যাবলীর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ ইসলামে রয়েছে। এমনকি কোন কাজটি মানুষের জন্য উপকারী এবং কোনটি ক্ষতিকর তাও ইসলাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভুলবশত কিংবা অজ্ঞতাবশে এমনও কিছু কাজ করে থাকি যেগুলো কুরআন-হাদীছে নিষিদ্ধ বলে ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু সেগুলোকে সরাসরি হারাম বা কবীরা গুনাহের কাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়নি। সেকারণে আলেমগণ সেসমস্ত কাজকে ক্ষেত্রবিশেষে জায়েয অথবা অপসন্দনীয় কাজ হিসাবে বিধান সাব্যস্ত করেছেন। একজন মুমিনের কর্তব্য যেমন আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর পসন্দনীয় কাজ আঞ্জাম দেয়া, তদ্রূপ বাধ্যগত অবস্থা ছাড়া অপসন্দনীয় কাজ পরিহার করে চলা। কেননা কোন ব্যক্তি অপসন্দনীয় কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, ধীরে ধীরে হারাম কাজের দিকেও প্রলুদ্ধ হ’তে পারে। তাই অপসন্দনীয় কাজ থেকে বেঁচে থাকার মধ্যেই মুমিনের জন্য কল্যাণ নিহিত রয়েছে। আলোচ্য প্রবন্ধে ইসলামে অপছন্দনীয় এমন কিছু কাজ বর্ণনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
১. দাঁড়িয়ে পানি পান করা : পানি ছাড়া মানব জীবনের অস্তিত্য অকল্পনীয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীছের অসংখ্য স্থানে পানির আলোচনা এসেছে। রাসূল (ছাঃ) পানি পান করার আদব বর্ণনা করেছেন। বসে পানি পান করা ইসলামী আদবের অন্তর্ভুক্ত। দাঁড়িয়ে পানি পান করতে হাদীছে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন- আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, ‘রাসূল (ছাঃ) জনৈক লোককে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে নিষেধ করলেন। ক্বাতাদাহ (রাঃ) বলেন, তা’হলে দাঁড়িয়ে খানা খাওয়া কেমন? তিনি বললেন, তা হচ্ছে আরও নিকৃষ্ট এবং নোংরা কাজ’।[1] অন্য বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لاَ يَشْرَبَنَّ أَحَدٌ مِنْكُمْ قَائِمًا فَمَنْ نَسِىَ فَلْيَسْتَقِئْ ‘তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই দাঁড়িয়ে পান না করে। আর যদি ভুলে যায় (ভুলবশতঃ পান করে ফেলে), তাহ’লে সে যেন বমি করে দেয়’।[2] অন্য হাদীছে এসেছে,
عَن أَبِيْ هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، أَنَّهُ رَأَى رَجُلاً يَشْرَبُ قَائِمًا، فَقَالَ لَهُ: قِهْ، قَالَ: لِمَهْ؟ قَالَ: أَيَسُرُّكَ أَنْ يَشْرَبَ مَعَكَ الَهِرُّ ؟ قَالَ: لاَ، قَالَ: فَإِنَّهُ قَدْ شَرِبَ مَعَكَ مَنْ هُوَ شَرٌّ مِنْهُ الشَّيْطَانُ-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) একদা জনৈক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পান করতে দেখে বললেন, ‘তুমি বমি করে ফেলে দাও। সে বলল, কেন? তিনি বললেন, তুমি কি চাও তোমার সাথে কোন বিড়াল পানি পান করুক? সে বলল, না। তখন তিনি বললেন, তোমার সাথে বিড়াল থেকেও এক নিকৃষ্ট প্রাণী পান করেছে। আর সে হচ্ছে শয়তান’।[3] এ সমস্ত ছহীহ হাদীছ থেকে বোঝা যায় যে, দাঁড়িয়ে পানি পান করা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। তবে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পানি করাও জায়েয।[4]
২. দাঁড়িয়ে ফিতাযুক্ত জুতা পরা : বসে জুতা পরিধান করা সুন্নাত। রাসূল (ছাঃ) দাঁড়িয়ে জুতা পরতে নিষেধ করেছেন। হাদীছে এসেছে,عَنْ جَابِرٍ قَالَ نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ يَنْتَعِلَ الرَّجُلُ قَائِمًا- জাবির (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ) লোকদেরকে দাঁড়িয়ে জুতা পরতে নিষেধ করেছেন’।[5]
এ হাদীছের ব্যাখ্যায় ছাহেবে ‘আওন বলেন, এর কারণ এই যে, জুতা পরা ও ফিতা আটকানোর প্রয়োজনে মাথা নীচু করতে হয়। তাই উক্ত কষ্টের পরিবর্তে বসে পরার কথা বলা হয়েছে’।[6] এছাড়াও অনেক সময় দেখা যায়, জুতার ভিতরে বিষাক্ত পোকা-মাকড়, সাপ, বিচ্ছু ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকে। আমরা ব্যস্ততার তাড়নায় সেগুলো খেয়াল না করেই দাঁড়িয়ে জুতা পরা শুরু করি। ফলে দুর্ঘটনার শিকার হ’তে হয়। আবার দাঁড়িয়ে জুতা পরার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যাওয়ারও সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে যদি বসে জুতা পরা হয় তাহ’লে উক্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। সর্বপরি রাসূল (ছাঃ) দাঁড়িয়ে জুতা পরতে নিষেধ করেছেন অর্থাৎ সেখানে অবশ্যই কল্যাণ রয়েছে। সুতরাং খোলামেলা কিংবা ফিতা ছাড়া সাধারণ জুতাগুলো দাঁড়িয়ে পরলেও পারতপক্ষে ফিতাযুক্ত জুতা বসে পরা উচিত।
৩. ঘুমানোর পূর্বে আগুন জ্বালিয়ে রাখা : ঘুম আল্লাহর বড় নে‘মত। মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম অত্যন্ত যরূরী। ঘুমের মাধ্যমে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হয়, দেহ ও মন সতেজ হয় এবং মনোবল সুদৃঢ় হয়। কুরআনুল কারীমে এ নে‘মতের কথা তুলে ধরে আল্লাহ বলেন,وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا ‘এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী’(নাবা ৭৮/৯)। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব থেকে ফজরে ঘুম ছেড়ে উঠার মধ্যবর্তী সময়ের করণীয় হিসাবে হাদীছে একাধিক দিক-নির্দেশনামূলক নছীহত পেশ করা হয়েছে। আল্লাহর মুমিন বান্দাগণ যদি সেই নির্দেশনা মেনে শারঈ পদ্ধতিতে নিদ্রাযাপন করে, তবে সে ঘুমও ইবাদতে পরিণত হবে। ঘুমাতে যাওয়ার পূর্বে রাসূল (ছাঃ) প্রজ্জ্বলিত আগুন ও বাতি নিভিয়ে কিংবা লাইট অফ করে ঘুমাতে নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা আগুন মানুষের জন্য খুবই বিপজ্জনক। আমাদের সামান্য অবহেলা কিংবা অসাবধানতার কারণে ঘটে যেতে পারে হৃদয় বিদারক ঘটনা। রাতের জ্বালিয়ে রাখা আগুন একটি পরিবার, গ্রাম-মহল্লা, দোকানপাট অথবা সমগ্র বাজার পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে এরূপ বহু উদাহরণ বিদ্যমান। সেজন্য ঘুমানোর পূর্বে আগুন জ্বালিয়ে রাখা নিষিদ্ধ। সালেম (রহঃ) হ’তে তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেন,لاَ تَتْرُكُوا النَّارَ فِى بُيُوتِكُمْ حِينَ تَنَامُونَ- ‘তোমরা ঘুমানোর প্রাক্কালে তোমাদের ঘরসমূহে আগুন জ্বালিয়ে রেখ না’।[7] অপর হাদীছে এসেছে,احْتَرَقَ بَيْتٌ بِالْمَدِينَةِ عَلَى أَهْلِهِ مِنَ اللَّيْلِ، فَحُدِّثَ بِشَأْنِهِمُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ هَذِهِ النَّارَ إِنَّمَا هِىَ عَدُوٌّ لَكُمْ، فَإِذَا نِمْتُمْ فَأَطْفِئُوهَا عَنْكُمْ- ‘একবার রাত্রিকালে মদীনার এক ঘরে আগুন লেগে ঘরের লোকজনসহ পুড়ে গেল। এদের অবস্থা নবী (ছাঃ)-কে অবহিত করা হ’ল। তিনি বললেন, এ আগুন নিঃসন্দেহে তোমাদের চরম শত্রু। সুতরাং তোমরা যখন ঘুমাতে যাবে, তখন তা নিভিয়ে দিবে’।[8]
ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘একটি ইঁদুর এসে চেরাগের সলতে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। একটি বালিকা তার পিছু ধাওয়া করলে নবী করীম (ছাঃ) বলেন, একে ছেড়ে দাও। ইঁদুর সলতেটি টেনে নিয়ে এসে যে চাটাইয়ে নবী (ছাঃ) উপবিষ্ট ছিলেন তার উপর রেখে দিল। ফলে চাটাইয়ের এক দিরহাম পরিমাণ জায়গা পুড়ে গেল। তাই রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা ঘুমানোর পূর্বে তোমাদের বাতিগুলো নিভিয়ে দিও। কারণ শয়তান অনুরূপ অপকর্ম করবে এবং তোমাদের অগ্নিদগ্ধ করবে’।[9] সুতরাং রাসূল (ছাঃ)-এর এই সুন্নাটি আমাদের মেনে চলা উচিত। সেই সাথে বৈদ্যুতিক বাতি অপ্রয়োজনে জ্বালিয়ে অপচয় করা থেকেও বিরত হওয়া উচিত।
৪. মধ্যমা ও শাহাদাত আঙ্গুলে আংটি পরা : পুরুষের জন্য স্বর্ণের যেকোন অলংকার নিষিদ্ধ। তবে স্বর্ণ ছাড়া যেকোন ধাতব আংটি পরা বৈধ হ’লেও তা মধ্যমা ও শাহাদাত আঙ্গুলে পরা নিষিদ্ধ। যেমন হাদীছে এসেছে,عَنْ أَبِى بُرْدَةَ قَالَ قَالَ عَلِىٌّ نَهَانِى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَتَخَتَّمَ فِى إِصْبَعِى هَذِهِ أَوْ هَذِهِ. قَالَ فَأَوْمَأَ إِلَى الْوُسْطَى وَالَّتِى تَلِيهَا আবু বুরদাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) আমাকে এ আঙ্গুল অথবা এ আঙ্গুলে আংটি পরতে নিষেধ করেছেন। এ বলে তিনি তাঁর মধ্যমা ও শাহাদাত আঙ্গুলের দিকে ইশারা করলেন’।[10]
রাসূল (ছাঃ) ডান ও বাম উভয় হাতে আংটি পরিধান করতেন। তবে হাদীছে এসেছে, তিনি কনিষ্ট আঙ্গুলে আংটি পরতেন।[11] সুতরাং কেউ আংটি পরতে চাইলে উভয় হাতের শাহাদাত ও মধ্যমা আঙ্গুল ছাড়া কনিষ্ঠ আঙ্গুলে পরতে পারবে।
৫. ছালাতরত অবস্থায় এদিক-সেদিক তাকানো : ইসলামের পাঁচটি ভিত্তির মধ্যে ছালাত প্রধান ভিত্তি। যদি এই ভিত্তি দুর্বল হয়ে যায় তাহ’লে ইসলাম দুনিয়া থেকে বিদায় নিবে। সেজন্য ঈমানের দাবীদার প্রত্যেক মুসলমানকে ঈমান টিকিয়ে রাখার জন্য ছালাতকে মজবূতভাবে অাঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। পূর্ণ একাগ্রতার সাথে ছালাত আদায় করতে হবে। অলসতা, অমনোযোগিতা পরিহার করতে হবে। ছালাতে মনোযোগ ধরে রাখার গুরুত্ব বোঝানোর জন্য এমনও কিছু কাজ হাদীছে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে যেগুলো করলে একাগ্রতা নষ্ট হয়। তন্মধ্যে ছালারত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকানো, এদিক-সেদিক তাকানো অন্যতম।
হাদীছে এসেছে,عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ سَأَلْتُ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-عَنْ الاِلْتِفَاتِ فِى الصَّلاَةِ فَقَالَ، هُوَ اخْتِلاَسٌ يَخْتَلِسُهُ الشَّيْطَانُ مِنْ صَلاَةِ الْعَبْدِ- আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূল (ছাঃ)-কে ছালাতে এদিক-সেদিক তাকানো সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, এটা এক ধরণের ছিনতাই, যার মাধ্যমে শয়তান বান্দার ছালাত থেকে অংশ বিশেষ কেড়ে নেয়’।[12]
অপর এক হাদীছে ছালাতরত অবস্থায় আকাশের দিকে তাকানোকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَرْفَعُونَ أَبْصَارَهُمْ إِلَى السَّمَاءِ فِى صَلاَتِهِمْ. فَاشْتَدَّ قَوْلُهُ فِى ذَلِكَ حَتَّى قَالَ لَيَنْتَهُنَّ عَنْ ذَلِكَ أَوْ لَتُخْطَفَنَّ أَبْصَارُهُمْ- ‘লোকদের কী হ’ল যে, তারা ছালাতে আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়? এ ব্যাপারে তিনি কঠোর বক্তব্য রাখলেন; এমনকি তিনি বললেন, যেন তারা অবশ্যই এ হ’তে বিরত থাকে, অন্যথায় অবশ্যই তাদের দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নেয়া হবে’।[13]
পৃথিবীতে ছালাতই একমাত্র ইবাদত যার মাধ্যমে বান্দা প্রতিনিয়ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ পায়। তাই ছালাতে একাগ্রতা অত্যন্ত যরূরী। এছাড়াও ছালাতের একাগ্রতা ভঙ্গের কাজগুলো বর্জন করা অপরিহার্য।
৬. অন্যের ঘরে উঁকি দেয়া : অন্যের ঘরে উঁকি দেয়া কিংবা বিনা অনুমতিতে কারও ঘরে প্রবেশ করা ইসলামী শিষ্টাচার বহির্ভূত গর্হিত কাজ।আল্লাহ তা‘আলা বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَدْخُلُوا بُيُوتًا غَيْرَ بُيُوتِكُمْ حَتَّى تَسْتَأْنِسُوا وَتُسَلِّمُوا عَلَى أَهْلِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নিজেদের গৃহ ব্যতীত অন্যদের গৃহে প্রবেশ করো না। যতক্ষণ না তোমরা তাদের অনুমতি নাও এবং গৃহবাসীদের প্রতি সালাম কর। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম। সম্ভবতঃ তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে’ (নূর ২৪/২৭)। অন্যের ঘরে উঁকি দিলে ঘরের পর্দা বিঘ্নিত হয় এবং গৃহবাসী বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। সেজন্য কেউ যদি কারও ঘরের ছিদ্র দিয়ে অথবা দরজা, জানালা দিয়ে উঁকি দেয় তাহ’লে হাদীছে তার চোখ ফুঁড়ে দেয়াকে বৈধ বলা হয়েছে এবং ইসলামী দন্ডবিধি মোতাবেক তাকে কোন রক্ত মূল্য দিতে হবে না। যেমন হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَوِ اطَّلَعَ فِي بَيْتِكَ أَحَدٌ، وَلَمْ تَأْذَنْ لَهُ، خَذَفْتَهُ بِحَصَاةٍ، فَفَقَأْتَ عَيْنَهُ مَا كَانَ عَلَيْكَ مِنْ جُنَاحٍ ‘যদি কেউ তোমার ঘরে তোমার অনুমতি ব্যতীত উঁকি মারে আর তুমি পাথর মেরে তার চক্ষু ফুটা করে দাও, তাতে তোমার কোন গুনাহ হবে না’।[14]
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ أَنَّ رَجُلاً اطَّلَعَ مِنْ بَعْضِ حُجَرِ النَّبِىّ اللهُ صَلَّى عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَامَ إِلَيْهِ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِمِشْقَصٍ أَوْ بِمَشَاقِصَ فَكَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَيْهِ يَخْتِلُ الرَّجُلَ لِيَطْعُنَهُ-
আনাস ইবনে মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একবার জনৈক লোক নবী করীম (ছাঃ)-এর এক কক্ষে উঁকি দিল। তখন তিনি একটা তীর ফলক কিংবা তীর ফলকসমূহ নিয়ে তার দিকে দৌড়ালেন। আনাস (রাঃ) বলেন, তা যেন আমি এখনও দেখছি। তিনি ঐ লোকটির চোখ ফুঁড়ে দেয়ার জন্য তাকে খুঁজছিলেন’।[15]
৭. খারাপ স্বপ্ন বর্ণনা করা : খারাপ স্বপ্ন দেখলে সেটা মানুষের কাছে বর্ণনা করা নিষিদ্ধ। এক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে, বাম দিকে তিনবার থুক মারবে, পার্শ্ব পরিবর্তন করবে ও তিনবার ‘আউযুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাজীম’ পাঠ করবে।[16] অথবা অতিরিক্ত খারাপ কিছু দেখলে যখনই ঘুম ভাঙ্গবে সাথে সাথে দু’রাকা‘আত নফল ছালাত আদায় করবে এবং সেই স্বপ্নের খারাপী থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘মানুষের স্বপ্ন তিন ধরনের হয়ে থাকে (ক) ভাল স্বপ্ন, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সুসংবাদ বহন করে (খ) কষ্টদায়ক স্বপ্ন, যা শয়তানের পক্ষ থেকে হয় (গ) ঐ স্বপ্ন যা মানুষ অন্তরের চিন্তা-ভাবনার কারণে দেখে থাকে। আর তোমাদের কেউ যখন খারাপ স্বপ্ন দেখে, তখন তার উচিত উঠে ছালাত আদায় করা এবং সে স্বপ্ন কারও কাছে বর্ণনা না করা’।[17]
অপর হাদীছে রয়েছে, আবু সালামাহ (রহঃ) বলেন, ‘আমি এমন স্বপ্ন দেখতাম, যা আমাকে রোগাক্রান্ত করে ফেলত। তিনি বলেন, পরে আমি আবু কাতাদাহ (রাঃ)-এর সঙ্গে দেখা করলাম (এবং আমার সমস্যার ব্যাপারটি তাকে বললাম)। তখন তিনি বললেন, আমিও এমন স্বপ্ন দেখতাম, যা আমাকে অসুস্থ করে দিত। অবশেষে আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ভাল স্বপ্ন আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। তাই যখন কেউ পসন্দনীয় কোন স্বপ্ন দেখে তখন এমন লোকের কাছেই বলবে, যাকে সে পসন্দ করে। আর যখন অপসন্দনীয় কোন স্বপ্ন দেখে তখন যেন সে এর ক্ষতি ও শয়তানের ক্ষতি থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায় এবং তিনবার থুক ফেলে আর সে যেন তা কারও কাছে বর্ণনা না করে। তাহ’লে এ স্বপ্ন তার কোন ক্ষতি করবে না’।[18]
৮. মুখমন্ডলে আঘাত করা : মানুষের গোড়াপত্তন ঘটেছে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলার মাধ্যমে। তিনি অন্যান্য সবকিছু ‘হও’ বলেছেন আর সৃষ্টি হয়ে গেছে। কিন্তু আদমকে তিনি নিজে তাঁর (আদমের) আকৃতিতে সৃষ্টি করেছেন। বিধায় মানুষের সম্মানার্থে মুখমন্ডলে আঘাত করা নিষিদ্ধ। নিজ স্ত্রীকেও যদি মারার প্রয়োজন পড়ে তাহ’লে তার মুখমন্ডলে আঘাত করতেও রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করেছেন।[19] এমনকি যুদ্ধের মাঠে শত্রুপক্ষের কারও মুখে আঘাত করাও নিষিদ্ধ। আমরা জেনে বুঝেই হোক কিংবা অজ্ঞতাবশেই হোক রাসূল (ছাঃ)-এর এই নিষেধ সহসাই উপেক্ষা করে যাচ্ছি। পিতা-মাতা ও শিক্ষকগণকে দেখা যায়, তাদের সন্তান ও শিক্ষার্থীদের শাসন করার সময় মুখমন্ডলে আঘাত করছেন। আমাদের এ জাতীয় অভ্যাস থেকে অবশ্যই বিরত হওয়া উচিত। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا قَاتَلَ أَحَدُكُمْ أَخَاهُ فَلْيَجْتَنِبِ الْوَجْه ‘তোমাদের মধ্যে কোন ভাই যদি তার অন্য ভাইকে আঘাত করে, সে যেন তার মুখমন্ডলে আঘাত করা হ’তে বিরত থাকে’।[20]
৯. স্বামীর কাছে অন্য মহিলার শারিরীক বর্ণনা দেয়া : বর্তমান সময়ে পরকীয়া এবং বিবাহ বিচ্ছেদ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাধি প্রসারিত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হ’ল পারিবারিক পর্দা এবং নারী-পুরুষের পারস্পরিক পর্দা লঙ্ঘন করা। একদিকে, পারিবারিক পর্দা না থাকায় নারী-পুরুষ অবাধে অন্যের ঘরে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। অপরদিকে, পারস্পরিক পর্দা না থাকায় নিজ ঘর থেকে বের হ’লেই নারী-পুরুষ পরস্পরের সংস্পর্শে আসছে। ফলশ্রুতিতে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্টের কারণে পরকীয়া প্রেম থেকে অবৈধ সম্পর্ক তৈরী হচ্ছে এবং এক পর্যায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটছে। একজন নারী যেমন নিজের পর্দা রক্ষা করে চলবে অনুরূপ অপর নারীর পর্দার দিকেও তাকে খেয়াল রাখতে হবে। সে কখনোই নিজের স্বামীর কাছে অন্য কোন নারীর শারিরীক বর্ণনা দেবে না, যাতে তার স্বামী সেই নারীকে কল্পনায় দেখতে পায় এবং তার দিকে আকৃষ্ট হয়। সমাজে বিবাহ বিচ্ছেদ বৃদ্ধি পাওয়ার এটাও একটি কারণ। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, لاَ تُبَاشِرِ الْمَرْأَةُ الْمَرْأَةَ فَتَنْعَتَهَا لِزَوْجِهَا، كَأَنَّهُ يَنْظُرُ إِلَيْهَا ‘কোন নারী যেন তার দেখা অন্য নারীর বর্ণনা নিজ স্বামীর নিকট এমনভাবে না দেয়, যেন সে তাকে (ঐ নারীকে) চাক্ষুস দেখতে পাচ্ছে’।[21]
১০. উপুড় হয়ে বুকের উপরে ভর দিয়ে শোয়া : আমরা অনেকেই উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা পসন্দ করি। এটা অনেকের জন্য আরামদায়কও বটে। তবে সাময়িক আরামদায়ক হ’লেও এভাবে শয়ন করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সর্বপরি ইসলামে উপুড় হয়ে শোয়া নিষিদ্ধ। যেমন হাদীছে বলা হয়েছে,
عن يَعيشَ بن طِخْفَةَ الغِفَارِيِّ رضي الله عنهما ، قَالَ : قَالَ أَبي : بَينَمَا أَنَا مُضْطَجِعٌ في الْمَسْجِدِ عَلَى بَطْنِي إِذَا رَجُلٌ يُحَرِّكُنِي برجلِهِ، فَقَالَ : إنَّ هذِهِ ضجْعَةٌ يُبْغِضُهَا اللهُ، قَالَ : فَنظَرْتُ، فَإذَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ-
ইয়া‘ঈশ ইবনে ত্বিখফাহ গিফারী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমার পিতা বলেন, ‘একদা আমি মসজিদে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম, এমতাবস্থায় একটি লোক আমাকে পা দিয়ে নাড়িয়ে বলল, এ ধরণের শোয়াকে আল্লাহ অপসন্দ করেন। তিনি বলেন, আমি তাকিয়ে দেখলাম তিনি রাসূল (ছাঃ)’।[22]
১১. কারও উপস্থিতিতে তার প্রশংসা করা : নিজের প্রশংসা বাক্য শুনতে সবাই পসন্দ করে। কিন্তু ব্যক্তির উপস্থিতিতে অতিরিক্ত প্রশংসার ভাল ও খারাপ উভয় দিক বিদ্যমান। প্রশংসা কারও মনোবল বৃদ্ধি করে, কাজের স্পৃহা জাগ্রত করে। আবার কাউকে আত্ম অহংকারী করে, ধোঁকায় ফেলে অথবা চাটুকারপ্রেমী করে তোলে। যারা বেশী প্রশংসা শুনতে পসন্দ করে তাদেরকে চাটুকাররা কপট প্রশংসার বাক্য বাণে ঘায়েল করে কার্যসিদ্ধি করে নেয়। সেকারণে হাদীছে কারও উপস্থিতিতে তার প্রশংসা করতে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন মু‘আবিয়া (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, إِيَّاكُمْ وَالتَّمَادُحَ فَإِنَّهُ الذَّبْحُ ‘তোমরা একে অপরের প্রশংসা করা থেকে দূরে থাক। কারণ সম্মুখ প্রশংসা কাউকে যবেহ করার সমতুল্য’।[23]
আবু মূসা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, নবী করীম (ছাঃ) এক ব্যক্তিকে অপর এক ব্যক্তির প্রশংসা করতে শুনে বললেন, أَهْلَكْتُمْ، أَوْ قَطَعْتُمْ، ظَهْرَ الرَّجُلِ ‘তোমরা তাকে ধ্বংস করে দিলে কিংবা (রাবীর সন্দেহ) বলেছেন, তোমরা লোকটির মেরুদন্ড ভেঙ্গে ফেললে’।[24]
অন্য হাদীছে এসেছে, হাম্মাম ইবনে হারেস হ’তে বর্ণিত, ‘এক ব্যক্তি ওছমান (রাঃ)-এর সামনেই তাঁর প্রশংসা শুরু করলে মিক্বদাদ (রাঃ) হাঁটুর উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে তার মুখে কাঁকর ছিটাতে শুরু করলেন। তখন ওছমান তাঁকে বললেন, কি ব্যাপার তোমার? তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা (মুখোমুখি) প্রশংসাকারীদের দেখলে তাদের মুখে ধুলো ছিটিয়ে দিও’।[25]
তবে কেউ কারও প্রশংসা করতে চাইলে হাদীছে নির্দেশিত পন্থায় করতে পারবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যদি তার ভাইয়ের প্রশংসা করতেই চায় তাহ’লে তার বলা উচিত, অমুককে আমি এরূপ মনে করি, তবে আল্লাহই তার সম্পর্কে অধিক জানেন। আর আল্লাহর প্রতি সোপর্দ না করে আমি কারও সাফাই পেশ করি না। তার সম্পর্কে ভাল কিছু জানা থাকলে বলবে, আমি তাকে এরূপ এরূপ মনে করি’।[26]
১২. কুরআন হাদীছের চেয়ে কবিতাকে প্রাধান্য দেয়া : ইসলামে কবিতা চর্চার বিধান বহুল আলোচিত একটি বিষয়। কবিতার মধ্যে ভাল খারাপ উভয়ই বিদ্যমান। যেহেতু রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবীদের জীবনীতে কবিতা চর্চার নযীর পাওয়া যায়, সেহেতু কবিতা চর্চা জায়েয-নাজায়েয বিষয়ে আলেমগণ দু’ধরণের মত প্রকাশ করেছেন। প্রথমত, যেসমস্ত কবিতা ন্যায় ও সত্যকে ধারণ করে, বাতিলকে প্রতিহত করে এবং ইসলামী শরী‘আতের প্রতিনিধিত্ব করে সেসমস্ত কবিতা চর্চা জায়েয। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,الشِّعْرُ بِمَنْزِلَةِ الْكَلَامِ، حَسَنُهُ كَحَسَنِ الْكَلَامِ، وَقَبِيحُهُ كَقَبِيحِ الْكَلَامِ ‘কবিতা হ’ল, কথার মত। ভাল কবিতা ভাল কথার মত আর খারাপ কবিতা খারাপ কথার মত’। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই কোন কোন কবিতার মধ্যে জ্ঞানের কথাও আছে’।[27] এমনকি জাহেলী যুগের কবিতার মাধ্যমে কুরআনের দুর্বোধ্য শব্দের ব্যাখ্যা গ্রহণ করাও জায়েয। সেজন্য ওমর (রাঃ) বলতেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ، عَلَيْكُمْ بِدِيوَانِكُمْ شِعْرِ الْجَاهِلِيَّةِ فَإِنَّ فِيهِ تَفْسِيرَ كِتَابِكُمْ وَمَعَانِيَ كَلَامِكُمْ ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা তোমাদের দিওয়ান তথা জাহেলী যুগের কবিতা সংরক্ষণ করে রাখ। কারণ তাতে তোমাদের কিতাব তথা কুরআনের ব্যাখ্যা এবং তোমাদের ব্যবহৃত বাক্যসমূহের অর্থ নিহিত রয়েছে’।[28] এছাড়াও রাসূল (ছাঃ) হাস্সান ইবনে সাবিত (রাঃ)-কে মুশরিকদের বিরুদ্ধে কবিতা আবৃত্তির অনুমতি দিয়েছিলেন।
হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,عَنْ هِشَامِ بْنِ عُرْوَةَ عَنْ أَبِيهِ قَالَ ذَهَبْتُ أَسُبُّ حَسَّانَ عِنْدَ عَائِشَةَ فَقَالَتْ لَا تَسُبُّهُ فَإِنَّهُ كَانَ يُنَافِحُ عَنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - হিশাম বিন ঊরওয়াহ তাঁর পিতার সূত্রে বর্ণনা করেন, একদিন আমি আয়েশা (রাঃ)-এর কাছে হাস্সান-কে গালি দিতে লাগলাম, তখন তিনি বললেন, ‘তুমি তাঁকে গালি দিওনা। কারণ, তিনি নবী (ছাঃ)-এর পক্ষ হ’তে মুশরিকদের (কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে) প্রতিরোধ করতেন’।[29]
এ সমস্ত হাদীছ প্রমাণ করে যে, ইসলামের স্বার্থে যেকোন ধরনের কবিতা আবৃত্তি বৈধ। দ্বিতীয়ত, যে সমস্ত কবিতা শুধু কল্পনার জগতে বিচরণ করে, অন্যায়ের দিকে আহবান করে, মিথ্যাচার, পাপাচার, যৌনাচার, বিশৃঙ্খলা ও ইসলাম বিদ্বেষ ছড়ায় সে কবিতা নিষিদ্ধ তথা হারাম। এ ধরণের কবিদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَالشُّعَرَاءُ يَتَّبِعُهُمُ الْغَاوُونَ- أَلَمْ تَرَ أَنَّهُمْ فِي كُلِّ وَادٍ يَهِيمُونَ ‘আর কবিগণ, যাদের অনুসরণ করে বিভ্রান্ত ব্যক্তিগণ। তুমি কি দেখনা, তারা প্রত্যেক উপত্যকায় উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়? (শো‘আরা ২৬/২২৪-২৫) ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, ‘(তারা প্রত্যেক উপত্যকায় উদভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়?) এর অর্থ হ’ল তারা প্রত্যেক নিরর্থক কথায় ডুবে থাকে’।[30]
বর্তমান আধুনিক মিডিয়ার যুগে এরকম বহু কবি ও ইসলামী সঙ্গিত শিল্পীকে দেখা যায়, তারা ইসলামী কবিতা কিংবা সঙ্গিত চর্চার আড়ালে বাংলা ও হিন্দি গানের সুর লয় নকল করে দেদারসে গান গায়ছে। অথচ সেসমস্ত সঙ্গীত ইসলামী ভাবাবেগ তো সৃষ্টি করেই না বরং ঢোল তবলাওয়ালা গানের অনুভূতি প্রদান করে। তাদের কাছে কুরআন হাদীছের চেয়ে তথাকথিত ইসলামী কবিতা ও সঙ্গীতের প্রাধান্য বেশী। কুরআন হাদীছ চর্চার পরিবর্তে তারা ইসলামের নামে গান, কবিতা নিয়েই বেশী ব্যস্ত। সেকারণে রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে সাবধান করে বলছেন,لأَنْ يَمْتَلِئَ جَوْفُ رَجُلٍ قَيْحًا يَرِيهِ خَيْرٌ مِنْ أَنْ يَمْتَلِئَ شِعْرًا অর্থাৎ ‘কোন ব্যক্তির পেট কবিতা দিয়ে ভরার চেয়ে এমন পুঁজে ভরা উত্তম, যা তোমাদের পেটকে ধ্বংস করে ফেলে’।[31] সুতরাং এ সমস্ত হাদীছ থেকে বোঝা যায় যে, ইসলামে কবিতা চর্চা অবশ্যই জায়েয কিন্তু কোনক্রমেই সেটা কুরআন ও হাদীছের উপরে প্রাধান্য দেওয়া যাবে না।
১৩. নিজেদের সন্তানাদি ও ধন-সম্পদকে বদ দো‘আ করা : নেক সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ আল্লাহর দেয়া নে‘মত। এই নে‘মতের মাধ্যমে একজন ব্যক্তি পরকালীন কামিয়াবী হাছিল করতে পারে। কেননা হাদীছে এসেছে, মানুষ মারা গেলে তার আমলের দরজা বন্ধ হয় কিন্তু তিনটি আমলের ছওয়াব জারি থাকে। তন্মধ্যে স্বীয় সম্পদের ছাদাক্বায়ে জারিয়ার ছওয়াব আমলনামায় যুক্ত হয় এবং নেক সন্তানের দো‘আর মাধ্যমে পিতা-মাতা ক্ষমা পেতে পারে।[32] কিন্তু সন্তানাদি ও ধন-সম্পদ আবার মানুষের জন্য বিপজ্জনক। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,إِنَّمَا أَمْوَالُكُمْ وَأَوْلَادُكُمْ فِتْنَةٌ ‘তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তোমাদের জন্য পরীক্ষা মাত্র’ (তাগাবুন ৬৪/১৫)। কাউকে আল্লাহ সন্তান ও সম্পদ না দিয়ে পরীক্ষা করবেন আবার কাউকে সেটা দিয়ে পরীক্ষা করবেন। মাল ও সন্তান-সন্ততির মোহে যদি মানুষ আল্লাহর আনুগত্যের পরিবর্তে অবাধ্যতা করে তাহ’লে সে মাল ও সন্তান তার জান্নাত প্রাপ্তির অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। সন্তানকে আদর্শ ও নেককার করে গড়ে তোলার দায়িত্ব পিতা-মাতার। সেটা করতে গিয়ে অনেক সময় ধৈর্য হারিয়ে পিতা-মাতা তার দুষ্টু, দুরন্ত সন্তানের মৃত্যু কামনা করে বলে ফেলেন, ‘তুই মরিস না; মরলে দশটা ফকিরকে খাওয়াতাম। আল্লাহ, আমি আর পারিনা, এর জ্বালা থেকে আমাকে নিস্তার দাও’। আবার সরাসরি অভিশাপ দিয়ে বলে, ‘আল্লাহ তোকে ধ্বংস করুক, তোর কোনদিন ভাল হবে না, তুই কোনদিন শান্তি পাবি না, তুই সুখ পাবি না’ ইত্যাদি। সন্তান যতই খারাপ হোক তাকে বদ দো‘আ করা ইসলামে নিষিদ্ধ। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَوْلاَدِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ لاَ تُوَافِقُوا مِنَ اللهِ سَاعَةً يُسْأَلُ فِيهَا عَطَاءٌ فَيَسْتَجِيبُ لَكُم- অর্থাৎ ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের উপর এবং নিজের ধন-সম্পদের উপরও বদ দো‘আ করো না। এমন যেন না হয় যে, তোমরা এমন মুহূর্তে বদ দো‘আ করবে যখন আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া হয় এবং তা কবুল হয়’।[33]
সুতরাং কেউ জানে না তার দো‘আ কখন কবুল হবে। দেখা যাচ্ছে রাগের বশে এমন একটা সময় বদ দো‘আ করে ফেলেছে সেসময় দো‘আ কবুল হয়ে গেছে। সেজন্য যেকোন পরিস্থিতিই হোক না কেন নিজের সন্তান ও ধন-সম্পদের অকল্যাণ কামনা করা হ’তে পিতা-মাতার বিরত থাকা উচিত।
(ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ |
[লেখক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ
এবং এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]
[1]. মুসলিম হা/২০২৪; মিশকাত হা/৪২৬৬।
[2]. মুসলিম হা/২০২৬।
[3]. আহমাদ হা/৭৯৯০; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৭৫।
[4]. বুখারী হা/৫৬১৫; ইবনু মাজাহ হা/৩৩০১; মিশকাত হা/৪২৭৫।
[5]. আবুদাঊদ হা/৪১৩৭; মিশকাত হা/৪৪১৪।
[6]. আওনুল মা‘বূদ হা/৪১৩৫-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ ৭/২৩৫ পৃঃ।
[7]. বুখারী হা/৬২৯৩; মুসলিম হা/২০১৫।
[8]. বুখারী হা/৬২৯৪; মুসলিম হা/২০১৬।
[9]. আবুদাঊদ হা/৫২৪৭; আল-আদাবুল মুফরাদ হা/১২২২; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৪২৬।
[10]. মুসলিম হা/২০৯৫; মিশকাত হা/৪৩০।
[11]. বুখারী হা/৫৮৭৪; আবুদাঊদ হা/ ৪২২৮।
[12]. বুখারী হা/৭৫১; আবুদাঊদ হা/ ৯১০।
[13]. বুখারী হা/৭৫০; নাসাঈ হা/১১৯৩।
[14]. বুখারী হা/৬৮৮৮; মিশকাত হা/৩৫১৪।
[15]. বুখারী হা/৬২৪২; আহমাদ হা/১৩৫৪৩।
[16]. বুখারী হা/৭০৪৪; ইবনু মাজাহ হা/৪০৪১; তিরমিযী হা/৩৭৮৭।
[17]. বুখারী হা/৭০১৭; আবুদাঊদ হা/৫০২১; তিরমিযী হা/২৪৩৯।
[18]. বুখারী হা/৩২৯২; মুসলিম হা/২২৬১।
[19]. আবুদাঊদ হা/২১৪২; ইবনু মাজাহ হা/১৮৫০।
[20]. বুখারী হা/২৫৫৯; মুসলিম/২৬১২; আহমাদ হা/৮৫৬১।
[21]. বুখারী হা/৫২৪০; মিশকাত, তাহক্বীক্ব আলবানী হা/৩০৯৯।
[22]. আবুদাঊদ হা/৫০৪০; আহমাদ হা/১৫৫৮২।
[23]. ইবনু মাজাহ হা/৩৭৪৩; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৬২৬১।
[24]. বুখারী হা/২৬৬৩।
[25]. মুসলিম হা/৩০০২।
[26]. মুসলিম হা/৩০০০।
[27]. বুখারী হা/৬১৪৫; ছহীহাহ হা/৪৪৭; সুনান দারাকুৎণী হা/ ৪৩০৮।
[28]. তাফসীরে কুরতুবী সূরা নাহলের ৪৮ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[29]. বুখারী হা/৬১৫০; হাকেম হা/৬০৬৩।
[30]. বুখারী হা/৬১৪৫; মিশকাত হা/৪৭৪৮।
[31]. বুখারী হা/৬১৫৫; মুসলিম হা/২২৫৭; মিশকাত হা/৪৭৯৪।
[32]. মুসলিম হা/১৬৩১; মিশকাত হা/২০৩।
[33]. মুসলিম হা/৩০০৯; মিশকাত হা/২২২৯।