মাওলানা মুহাম্মাদ ছফিউল্লাহ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 374 বার পঠিত
তাওহীদের ডাক : বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ‘যুবসংঘ’-এর সাথে যুক্ত থাকাটা আপনার জন্য কতটুকু প্রতিকূল ছিল?
শামসুল আলম : বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘যুবসংঘ’-এর কাজ করাটা আমার জন্য বেশ প্রতিকূল ছিল। আমাকে যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি করা হ’ল তখন জবাবদিহিতা, আমানতদারিতা ও দায়িত্ববোধ স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে গেল। দাওয়াতী কাজের অংশ হিসাবে রাবি ‘যুবসংঘ’-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন দাওয়াতপত্র বা বিজ্ঞপ্তি বিভাগসমূহ, মসজিদ, হলের গেট, লাইব্রেরী চত্বরসহ প্রভৃতি স্থানে লাগিয়ে দেওয়া হ’ত। এতে করে আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আমার মাদার বখশ হল, জোহা হল, হবিবুর রহমান হল, কেন্দ্রীয় মসজিদ এবং ইসলামী দলের নেতৃবৃন্দসহ সর্বত্র আমাদের নাম ও সংগঠনের পরিচিতি হ’তে থাকল। ফলে কাজের মাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিরোধিতা ও শত্রুতাও বহুগুণ বেড়ে গেল। যেমন-
(১) ১৯৯৩ সালের একটি ঘটনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষকগণের সাথে আমার পরিচয় ও ভাল সম্পর্ক ছিল। হঠাৎ একদিন আরবী বিভাগের শিক্ষক সম্ভবত প্রয়াত প্রফেসর আব্দুল হক্ব স্যার আমাকে ডেকে বললেন, তোমার নাম তো শামসুল আলম তাই না? তোমাকে নিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্টে আলোচনা হয়। এর কিছুদিন পর আমি ড. গালিব স্যার কর্তৃক রচিত ডক্টরেট থিসিস ও মাওলানা ছফীউর রহমান মুবারকপুরী রচিত আর-রাহীকুল মাখতূম বই দু’টি নিয়ে আরবী বিভাগে প্রবেশ করি। তখন বিভাগীয় চেয়ারম্যান ছিলেন প্রফেসর এ কে এম শামসুল আলম স্যার। তখন ড. গালিব স্যার ডিপার্টমেন্টে ছিলেন না। আমি সালাম ও অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করি। আমাকে বসতে বলা হ’লে বসলাম।
কুশলাদি বিনিময়ের পর শামসুল আলম স্যারকে উক্ত বই দু’টি আরবী বিভাগের লাইব্রেরীতে রাখতে অনুরোধ করলাম। তখন তিনি মাথা উঁচু করে এবং চোখ দু’টি বড় বড় করে ধমকের সাথে প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে বললেন, তোমার এত বড় সাহস! তাঁর থিসিস আমাদের বিভাগে দিতে এসেছ? তোমাকে এই ডিপার্টমেন্টে কে পাঠিয়েছে আমরা বুঝিনা? আমার নাম ভাঙ্গিয়ে তোমার নাম ব্যবহার করা হচ্ছে! উনি অনেক অস্বাভাবিক কথা বললেন। সেখানে অনেক শিক্ষক উপস্থিত ছিল। প্রায় সকলেই আমার পরিচিত। কিন্তু তাঁরা কেউ কিছু বলছেন না। অবশেষে আমি বললাম, স্যার! আপনার ধারণা ঠিক না। একই নাম কি আর কোন মানুষের হ’তে পারে না? আপনি বই নিবেন না সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এরকম অযৌক্তিক ও অবাস্তব কথা অন্তত আপনাদের মত শিক্ষকের কাছ থেকে আমরা আশা করি না। তাঁর বিদ্বেষী আচরণে সেদিন আমি খুবই কষ্ট পেলাম এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে সেখান থেকে সকলকে সালাম দিয়ে ফিরে আসলাম।
(২) আমি যখন ‘যুবসংঘ’-এর রাবি শাখার সভাপতি তখন জমঈয়তে শুববানের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন সাতক্ষীরার রবীউল ইসলাম। অতঃপর ড. ইফতিখারুল আলম মাসঊদ, যিনি বর্তমানে আরবী বিভাগের প্রফেসর। তাদের সাথে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে তেমন কোন সমস্যা হয় নি। বরং সহযোগিতা নিয়েই পাশাপাশি কাজ করেছি। মাসঊদ ভাই আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন এবং মাঝে মধ্যে বলতেন, ‘মুরুববীরা কোনদিন এক হবে না। যদি কখনো তা পারে যুবকরাই পারবে’। যাইহোক হলগুলোতে শিবির ও অন্যান্য ইসলামী দলগুলো আমাদের সাংগঠনিক কাজে নানান প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করত। মাদার বখশ হল ছাড়া অন্যান্য হল গেটে আমাদের দাওয়াতপত্র, পোস্টার শিবিরের ছেলেরা ছিঁড়ে ফেলত। নানাবিধ বাধা-বিপত্তির থাকা সত্ত্বেও মাঝে মধ্যে শিমুলের তত্ত্বাবধানে যোহা হলে এবং আমার তত্ত্বাবধানে ও ইমাম যয়নুল আবেদীনের সহযোগিতায় মাদার বক্স হলে ৩০-৪০ জন ছাত্রের উপস্থিতিতে প্রোগ্রাম করতাম। এছাড়াও আমাদের বেশীরভাগ প্রোগ্রাম কেন্দ্রীয় মসজিদে হ’ত। শেষের দিকে কাজলা হাদীছ ফাউন্ডেশন ভবনে হ’ত।
১৯৯৩ সালে আমি যখন মাদার বখশ হলের ৩৪০ নং কক্ষে অবস্থান করতাম, তখন ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াতী কাজ খুব যোরদার গতিতে এগিয়ে চলেছে। ছাত্রদের ঘরে ঘরে, প্রত্যেক মসজিদে, হলের গেটে বিভিন্ন প্রচার পত্র, ক্যালেন্ডার, বই-পুস্তক বিতরণসহ নানামুখী কার্যক্রম চলতে থাকে। সেসময় মাদার বখশ হলটি ছিল মূলত ছাত্রদলের নিয়ন্ত্রণে। ফলে প্রায় শিবিরমুক্ত। এ সময়ে আমাদের অগ্রযাত্রা ছাত্রদলের কিছু নেতাদের চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল। একদিন সন্ধ্যার পর আমি রুমে আসতেই রুমমেট কাওছার (চুয়াডাঙ্গা) ভাই আমাকে বললেন, আলম তুমি এখনই হলের বাইরে চলে যাও! নতুবা ওরা তোমাকে আজই মেরে ফেলবে। ওরা (ছাত্রদল) আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে যে, সে যেন আজ রাতের মধেই হল ছেড়ে চলে যায়। তা না হ’লে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার লাশ পড়ে যাবে। আমি শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হয়েছে কাউছার ভাই? তিনি বললেন, তোমার সংগঠন ‘যুবসংঘ’ নাকি একটি ইসলামী রাজনৈতিক সংগঠনের আন্ডারগ্রাউন্ড পার্টি হয়ে কাজ করছে? হলের মসজিদে অথবা কেন্দ্রীয় মসজিদে তোমাদের প্রোগ্রামে এত ছেলেদের উপস্থিতি ওদের দৃষ্টি কেড়েছে। তুমি ভাই এখুনি চলে যাও, ভয়ে আমার শরীর কাঁপছে।
আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আল্লাহর উপর ভরসা করে বললাম, কাওছার ভাই! ভয় পাবেন না। আমি কী করি, আমাদের কাজ কী তা তো আপনি ভাল করেই জানেন। তিনি বললেন, তোমাদের সংগঠন তাদের সমর্থন করে না তা আমি জানি (কারণ সে নিজেও ছাত্রদলের সমর্থক), তবে তুমি কি করবে দ্রুত সিদ্ধান্ত নাও অথবা কারও রুমে গিয়ে আজকের মত রাতটা পার কর। আমি পাশের কক্ষের আইনের ছাত্র যিয়া (বরিশাল) ভাইকে বিষয়টি বললাম। এরপর ঐ রাতেই হলে তাদের কয়েকজন বড় লিডারের সাথে দেখা করলাম এবং ঘটনাটি যারা ঘটিয়েছে তাদের নামও বললাম। ওরা সকলেই আমাকে ভাল করে চেনে। আমি সাংবাদিকতা করি এবং ‘যুবসংঘ’-এর সাথে জড়িত তারা জানে। তারা বলল, ঠিক আছে আপনি হলেই থাকেন, আমরা দেখছি। তাদের মধ্যে যশোরের কবীর ভাই (ছাত্রদলের বড় নেতা) ছিলেন। যাই হোক আল্লাহর রহমতে আমাকে আর হলের বাইরে যেতে হয়নি। আমার সে রুমেই ছাত্রজীবন শেষ করি।
(৩) ১৯৯৪ সালের ঘটনা। ভাবলাম আমীরে জামা‘আতের থিসিস ও আর-রাহীকুল মাখতূম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে, মসজিদে, হলগুলোতে দেয়া হ’ল, অথচ আমার নিজ হলে থাকবে না এটা কেমন কথা! এজন্য মেহেরপুরের আব্দুর রব ও কলারোয়া, সাতক্ষীরার শিমুলসহ আমরা প্রভোস্ট স্যারের বাসায় যাই। ইমাম যায়নুল আবেদীন ছাহেবও এ বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন। স্যারের সাথে এ বিষয়ে কথা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তিনি ‘না’ করে দিলেন। স্যারের সাথে দু’একটা কথা কাটাকাটিও হয়ে গেল। মনের দুঃখে ফিরে আসি। পরবর্তীতে আমার সার্টিফিকেট ওঠানোর জন্য প্রভোস্টের স্বাক্ষর প্রয়োজন হয়। অফিস সহকারী খাদেমুল ভাই বললেন, প্রভোস্ট তোমার সার্টিফিকেট দিতে নিষেধ করেছেন। তোমার সাথে স্যারের কিছু হয়েছে না কি? তিনিও জানতেন না কেন আমাকে সার্টিফিকেট দিবে না। তখন আমি সেদিনের কথা কাটাকাটির বিষয়টি খুলে বললাম। আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তিনি বললেন, এজন্য কি একটি ছেলের সার্টিফিকেট আটকিয়ে দিতে হবে? তিনি বললেন, ২/৩ দিন পর আস। কয়েকদিন পর গেলাম। হাসতে হাসতে খাদেমুল ইসলাম ভাই বললেন, এই নাও তোমার সার্টিফিকেট। তিনি অন্য এক হাউজ টিউটরকে দিয়ে ক্লিয়ারেন্স স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন। তখন হলের একাউন্টস অফিসার ছিলেন আব্দুস সালাম (কাটাখালী)। পরে উনি ডেপুটি রেজিস্টার হয়েছিলেন। তিনি আহলেহাদীছ ছিলেন। তিনি আমার সার্টিফিকেট পেতে সহযোগিতা করেছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংগঠনিক জীবনে এমন নানা প্রতিকূলতা নেমে এসেছিল।
তাওহীদের ডাক : ক্যাম্পাস জীবনের দুর্বিসহ কিছু ঘটনা যদি বলতেন।
শামসুল আলম : ক্যাম্পাস জীবনের একটি দুর্বিষহ ঘটনা আমি কখনো ভুলব না। সেটা হ’ল- মাদার বখশ হলের ৩৪০ নং কক্ষে (২ সীট বিশিষ্ট) আমার সীট পুনঃবরাদ্দ হয়। ঐ রুমে তখন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বড় ভাই ফারুক (যিনি বর্তমানে পাবনা জেলখানার জেল সুপার) এবং কাওছার ভাই থাকতেন। আমি ফারুক ভাইয়ের সাথে কিছুদিন সীট ডাব্লিং করি। কারণ উনি চলে গেলে আমি একাই থাকব। রান্নার স্মৃতির কথা বলতে গেলে বিশেষ করে ফারুক ভাইয়ের কাছ থেকেই সবজি খিচুড়ি রান্না শিখি। যা আজও আমার প্রিয় খাবার।
এসময় বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস চরম উত্তপ্ত। আমি সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ত থাকায় মারামারির সংবাদ একটু আঁচ করতে পারতাম। এজন্য কিছু হলেই আমার পার্শ্বস্থ রুমের আইন বিভাগের ছোট ভাই যিয়াসহ কয়েকজন আমার রুমে চলে এসে বলত, আলম ভাই বলেন কাল বা পরশু ক্যাম্পাসে কিংবা হলে কি ঘটতে যাচ্ছে? তখন হেসে বলি আমি কি করে বলব? ওরা বলে, ভাই আপনার প্রতি আমাদের আন্তরিক ভালবাসা ও বিশ^াস রয়েছে, ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনার অনুমান প্রায়ই ঘটে যায়। ওদেরকে বললাম যে, খুব শীঘ্রই ছাত্রদলের সেরা ঘাঁটি মাদার বখশ হলে আক্রমণ হ’তে পারে। ঠিক কয়েকদিন পর ক্যাম্পাসে ছাত্রদল কর্মী দ্বারা ২ জন শিবির কর্মী নিহত হ’ল। ফলে পরদিন সকালে শিবির কর্মীরা মাদার বখশ হলে সশস্ত্র আক্রমণ করল। প্রধান ফটকে তালা থাকায় বোমা মেরে ভেঙ্গে দিল। বোমা আর গুলি করতে করতে ওরা হলে প্রবেশ করল। এর মধ্যে ছাত্রদল, ছাত্রমৈত্রী, ছাত্রলীগসহ সকল সাধারণ ছাত্ররা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে জানালা ভেঙ্গে, ডাইনিং-এর পিছনের রুম দিয়ে, কেউবা দো-তিন তলা থেকে লাফ দিয়ে আর্তচিৎকার দিতে দিতে পালিয়ে গেল। কিন্তু আমি আর গেলাম না। আল্লাহর উপর ভরসা করে নিজের ঘর ও বই-পুস্তক রক্ষা করতে এবং অনেকটা প্রত্যক্ষ সবকিছু দেখার জন্য থেকে গেলাম। তাই সকলে গেলেও আমি গেলাম না। আমার এই হলের নিরীহ বন্ধু কিরণ, গ্রামের ছোট ভাই টিপু, কোট চাঁদপুরের ছোট ভাই ছাদেকুলসহ পার্শস্থ রুমের মোট ১০/১২ জন ছাত্র আমার রুমে ওদের বই-পুস্তক, কাপড়-চোপড়সহ আশ্রয় নিল। মনে হ’ল এ যেন সেই ৭১-এর যুদ্ধের শরণার্থীদের আশ্রয় নেওয়ার দৃশ্য।
ওদিকে শিবিরের ধ্বংসাত্মক কান্ড স্বচক্ষে দেখতে লাগলাম। হল প্রভোস্টের অফিসসহ সকল অফিসে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে। তালিকাভুক্ত রুমগুলো তো আগুনে জ্বলছে। চারিদিকে ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। আমার রুমের ভেতর ওদেরকে রেখে দরজা হালকা খোলা রেখে আমি তিনতলায় ৩০৪ নং কক্ষের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখছিলাম। ইতোমধ্যে দক্ষিণ দিকের দু’সারি বিল্ডিংয়ের অপারেশন শেষে আমার ৩য় ব্লকে আসবে ওরা। হঠাৎ কিরণ রুমের ভেতর থেকে একটু বেরিয়ে চাপা এবং ভীত কণ্ঠে বলল, বন্ধু আলম আমার রুমে সম্ভবত আগুন জ্বলছে মনে হয় ওদের আগুনে সব শেষ হয়ে গেল। দেখ না নিচে গিয়ে আগুনটা নিভাতে পারিস কিনা। বললাম, ঐ অগ্নিগর্ভের চারিদিকে সশস্ত্র ক্ষিপ্ত কর্মীদের অস্ত্রের সামনে আমি কিভাবে যাব? ওরা যদি আমাকে গুলি করে অথবা আঘাত করে তাহ’লে তো অন্ধকারাচ্ছন্ন ঐ জ্বলন্ত আগুনের ঢেউয়ে আমাকে বাঁচানোর কেউ নেই। বারবার ওর আর্তনাদে আমি আল্লাহর ওপর ভরসা করে মধ্য ব্লকের নিচ তলার মাঝামাঝিতে এগিয়ে যেতে থাকি। ইতোপূর্বে আমি কখনো এমন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে পড়িনি। আমার সাথে অন্য কেউ নেই! ভয়ও লাগছে।
হঠাৎ সশস্ত্র কর্মীদের একজন বলে উঠল, আরে ভাই! আপনার নিজের জীবন বাঁচান, নিজের রুম সামলান, ওদিকে যাবেন না বিপদ হ’তে পারে। বললাম, ভাইয়েরা, আমার বন্ধু একজন নিরীহ ছাত্র। ও কোন দল করেনা। ওর রুমে আগুন জ্বলছে। অন্তত আগুনটা নিভিয়ে আসি। ওরা জবাব না দিয়ে ওদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি রণক্ষেত্রের এই পরিবেশে দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বন্ধু কিরণসহ কয়েকটা রুমে ট্যাপের পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে দ্রুত আমার রুমে চলে আসি। কারণ আমার রুমের জিনিসের চেয়ে ১০/১২ জন নিরীহ ছাত্রদেরকে যেভাবেই হোক বাঁচাতে হবে। কারণ ওরা ভাল করেই জানে এই হলে শিবিরের কেউ নেই, ওদেরকে থাকতে দেয়নি। সে হিসেবে যারা আছে সবাই তাদের শত্রু দলের কর্মী অথবা তাদের সমর্থক।
ওরা আমার ফ্লোরে উঠে গেছে! তখন আমি বারান্দায় স্বাভাবিকভাবে সশস্ত্র কর্মীদের সম্মুখে দাঁড়িয়ে! একটার পর একটা রুমে আগুন জ্বালিয়ে আসছে। আমার রুমের সারিতেই বেশ কয়েকজন ছাত্রদল ক্যাডারদের রুম ছিল। যারা আমাকে ইতোপূর্বে ‘যুবসংঘ’ করার কারণে হুমকি দিয়েছিল। ট্রাজেডির কথা হ’ল ওরা ঐদিন পালানোর সময় আমার রুমে ওদের বই-পুস্তক রেখে নিরাপদে পাড়ি দেয়। যাওয়ার সময় তারা আমার কাছে ক্ষমাও চেয়েছিল। যে শাকিল গং একসময় আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল, তারাই আজ আমার সাহায্য পেল। রুমের ভিতর থেকে চাপা কান্না ভেসে আসছে। বারান্দা থেকেই আমি তাদেরকে বললাম, তোমরা সাহস হারিও না, দো‘আ-দরূদ পড়।
এরই মধ্যে শিবির কর্মীরা আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। একজন বলছে যে, ঐ এই ঘরের ঢুক, এখানে শত্রু পক্ষ রয়েছে। আমি বললাম, দেখেন ভাই ওখানে সবাই নিরীহ ছাত্র এবং আমার পরিচিত ছোট ভাই, বন্ধু। ওরা কোন অপরাধী নয়। ওরা জোর করেই প্রবেশ করতে চায়। হঠাৎ আল্লাহর কি রহমত! উচ্চ কণ্ঠে একপ্রান্ত থেকে ভেসে আসল আরে আলম ভাই না? আপনি এখানে? আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই আমার রুম এটা। ছেলেটা সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্র নাম ছিল মুরাদ; আমার পরিচিত। অন্য কর্মীরা বলে, এই রুমে ঢুকতে হবে ভাই। মুরাদ বলল, চল এগিয়ে চল, এখানে কেউ থাকার দরকার নাই। ধমক দিয়ে ওদেরকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল। যাওয়ার সময় এক শিবির কর্মী রড দিয়ে জানালার গ্লাসে আঘাত করল। মুহূর্ত গ্লাসটি ঝরে পড়ল। ততক্ষণে আমার পাশের রুমগুলো পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিল। ছোট্ট ভাই যিয়ার ঘরেও আগুন জ্বলছে। ভ্যাগিস ওরা আমার রুমে সব রেখে গিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ আমার এবং আমার ঘরে আশ্রিত বন্ধু ও ছোট ভাইদেরকে আল্লাহ রক্ষা করলেন।
আমি ঘরে প্রবেশ করতেই ওরা সমস্বরে বলে উঠল আলম ভাই, আজ যদি আপনি না থাকতেন তাহ’লে নির্ঘাত আমাদের মৃত্যু হ’ত। বললাম, আমি নই আল্লাহ্ই এই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছেন। আর তোমরা জেনে রাখ, আমি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ করি। এই ‘যুবসংঘ’ই আমাদের সত্য, সরল ও মুক্তির পথ দেখাতে পারে। তোমাদের জন্য এই পথে আসার আহবান রইল। এভাবে মাদার বখশ হলের ৩৪০ নং কক্ষটিতে ছাত্রজীবনে ‘যুবসংঘ’ করার কারণে অনেক মর্মস্পর্শী বেদনা-বিধুর স্মৃতি যে অমলান হয়ে লুকিয়ে রয়েছে, কে তার হিসাব রাখে!
তাওহীদের ডাক : আপনার শ্বশুর হাজী আব্দুর রহমানের পরিবারে আপনার বিবাহ কীভাবে হয়েছিল?
শামসুল আলম : রাজপুর, কলারোয়া, সাতক্ষীরার হাজী আব্দুর রহমান সরদার (৮৫) আমার শশুর। উনার ৪র্থ মেয়ে খালেদা খাতুনের সাথে ১৯৯৭ সালের ২৩শে জুন আমার বিয়ে হয়। এই বিয়ের ঘটনাটি বেশ নাটকীয়। তার নাতি আল-মামূন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। সেই সুবাদে ১৯৯৫ সালে ২৩শে মে নওদাপাড়া মাদ্রাসায় উনার সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। তিনি সাংগঠনিক কাজে মারকাযে আসলে দেখা হ’ত। ১৯৯৭ সালে ১ সপ্তাহের জন্য মাদ্রাসা ছুটি হয়। তৎকালীন সহকারী শিক্ষক মাওলানা দুর্রুল হুদা (বর্তমানে মজলিসে আমেলা সদস্য এবং গোদাগাড়ী মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক) এবং বগুড়ার আব্দুর রঊফ (কাশিমপুর মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল) কে বললাম, দো‘আ করেন, যেন এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে করে মাদ্রাসায় আসতে পারি। বাড়িতে গেলাম। কোটচাঁদপুরে একটা মেয়ে দেখলাম। পসন্দ হ’ল, কিন্তু তারা মাযহাবী। সংগঠনের সূত্র ধরে সাতক্ষীরা যেলার দায়িত্বশীল মাওলানা আব্দুল মান্নান, মাওলানা ফযলুর রহমান ভাইকে মেয়ের সন্ধানের জন্য বলে রেখেছি। সাতক্ষীরায় গেলাম। বাঁকাল মাদ্রাসায় আমার জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হ’ল। সাতক্ষীরার ইটাগাছা শহরে একটা মেয়ে দেখার কথা। কিন্তু সেখানে সমস্যা থাকার কারণে যাওয়া হ’ল না। ফযলু ভাইয়ের গ্রামের দিকে একটা মেয়ে দেখা হ’ল। কিন্তু পছন্দ হ’ল না। ৩/৪ দিন থাকার পর এবার ফেরার পালা। তখন জনাব আব্দুর রহমান ছাহেব বাঁকালে থাকতেন। আমার খবর উনি মনে মনে রাখতেন, আমি তা জানতাম না।
ফেরার দিন আব্দুল মান্নান ভাই বললেন, চাচাজীর দু’টি মেয়ে আছে। চাইলে দেখতে পারেন। আমরা ৩ জনে রাজাপুর গেলাম। আমি মেয়ে দেখলাম। দ্বীনদার, সম্ভ্রান্ত বংশীয় এবং সাংগঠনিক পরিবার। সবমিলিয়ে তাদেরকে মেয়ে পসন্দের কথা জানালাম। উনারা আমাদের গ্রামে এলেন। তাদেরও পসন্দ শেষে এই বিয়েতে আমীরে জামা‘আতের অনুমতি চাইলেন। আমীর ছাহেব এক বাক্যে অনুমতি দিলেন। আলহামদুলিল্লাহ ২৩শে জুন বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সোনাবাড়ি থেকে ৪/৫ কিলোমিটার মারাত্মক কর্দমাক্ত রাস্তায় হেঁটে গিয়ে অত্যন্ত সাদাসিধা পরিবেশে বিয়ে হয়ে গেল।
তাওহীদের ডাক :আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী (বালিকা শাখা) প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আপনার ভূমিকা ছিল। এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
শামসুল আলম : হ্যাঁ, ছিল। আমার স্ত্রী বালিকা শাখা প্রতিষ্ঠাকালীন (২০০৪ সাল) প্রথম ৩ জনের ১ জন শিক্ষিকা ছিল। বর্তমানেও সে কর্মরত আছে। আমার একমাত্র বড় মেয়ে জারিন তাসনীম (২৩) অত্র মাদ্রাসার ১ম শ্রেণীর ১ম ছাত্রী, যাদেরকে কেন্দ্র করে আমাদের বালিকা শাখার স্বপ্ন বুনন শুরু হয়। একদিন আমীরে জামা‘আতকে অনুরোধ করে বললাম, স্যার আমার মেয়েকে সহশিক্ষার কোন প্রতিষ্ঠানে পড়াব না। স্যার আপনি শুধু একটি বালিকা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার অনুমতি দিন। ড. গালিব স্যার সেদিন খুশী মনে বালিকা শাখা করার অনুমতি দেন এবং সর্বপ্রথম ৫ হাযার টাকার অনুদান দেন। বর্তমানে দেশব্যাপী এই প্রতিষ্ঠানটি সুখ্যাতি লাভ করেছে। ফালিল্লাহিল হামদ!
তাওহীদের ডাক : আপনি হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ডের সচিব। ১৯৯৮ সালে আমীরে জামা‘আত যে লক্ষ্য নিয়ে এই বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে এবং বর্তমানে আপনাদের লক্ষ্যমাত্রা কী?
শামসুল আলম : ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর চার দফা কর্মসূচীর ৪র্থ দফা তাজদীদে মিল্লাত বা সমাজ সংস্কারের মূল যে তিনটি বিষয়কে উল্লেখ করা হয়েছে তন্মধ্যে শিক্ষা সংস্কার হ’ল অন্যতম। এ লক্ষ্যেই মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সর্বপ্রথম ১৯৯৮ সালে ‘আহলেহাদীছ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড’ গঠন করেন। মারকাযের তৎকালীন প্রিন্সিপ্যাল শায়খ আব্দুস সামাদ সালাফী ছিলেন সেই বোর্ডের আহবায়ক, মাওলানা সাঈদুর রহমান পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মোফাক্ষার হোসাইন সচিব। এছাড়াও উক্ত বোর্ডের সদস্য ছিলেন সাতক্ষীরার দারুল হাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল আহসান হাবীব, অধ্যাপক রেজাউল করীম (বগুড়া), আব্দুর রঊফ (বগুড়া), মাওলানা বদীউজ্জামান (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), মাওলানা আব্দুল্লাহ প্রমুখ। জোট সরকার কর্তৃক মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও কেন্দ্রীয় ৩ নেতাসহ অনেক কর্মী দায়িত্বশীল গ্রেফতার হ’লে সবকিছু ভন্ডুল হয়ে যায়। সাথে সাথে শিক্ষা বোর্ডের কাজও বন্ধ হয়ে যায়।
বর্তমানে দেশের বস্ত্তবাদী সমাজব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সংস্কৃতির আলোকে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যা ইসলামী আক্বীদা-আমলের সাথে সম্পূর্ণভাবে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে শিরক-বিদ‘আতে আচ্ছন্ন আলিয়া ও কওমী স্তরের যে শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে তা তাওহীদ ও সুন্নাহপন্থীদের জন্য মোটেও অনুকূল নয়। সেখানে ইসলামের মাযহাবী ব্যাখ্যা ও তাক্বলীদী অন্ধত্বকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের পরকালের মুক্তির জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। এহেন অবস্থায় শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে ১০ই জানুয়ারী ২০১৯ সালে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার মজলিসে আমেলায় আলোচনা করে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন শিক্ষা বোর্ড’ নামে নতুনভাবে আবার শিক্ষা বোর্ড গঠন করেন। এতে ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিবকে চেয়ারম্যান ও আমাকে সচিব হিসাবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। জানিনা আমি এ পদে কতটুকু উপযুক্ত। তবে মানুষের অভূতপূর্ব সাড়ায় মাত্র অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে আলহামদুলিল্লাহ আমাদের শিক্ষা বোর্ডের অধিভুক্ত প্রতিষ্ঠান শতাধিক অতিক্রম করে।
ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষা বোর্ডের পক্ষ থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ৫০-এর অধিক বই প্রকাশ করতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ। আপাতত ইবতেদায়ী পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সেট এবং ধীরে ধীরে দাখিল পর্যায়ের বই প্রকাশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। করোনা সংকটকাল বাদ দিয়ে আমরা নানামুখী কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছি। এ পর্যন্ত কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতি বছর পাঠ্যতালিকা, পাঠ পরিকল্পনা প্রকাশ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা বিধি এবং বার্ষিক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছি। এছাড়াও ২০২২ সালে দেশব্যাপী ১ম থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত অভিন্ন প্রশ্ন প্রণয়ন ও সরবরাহ করার মাধ্যমে বার্ষিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশকে ৮টি জোনে ভাগ করে আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ চলছে। ইতোমধ্যে খুলনা, সাতক্ষীরা, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর ও রাজশাহী জোনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করেছি। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষিকাগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও বরিশাল জোনের শিক্ষক প্রশিক্ষণ অচিরে শুরু হবে ইনশাআল্লাহ। এই প্রশিক্ষণ কোর্সকে সফল করার জন্য আঞ্চলিক পরিদর্শক নিয়োগ দিয়েছি। আগামীতে ১ম থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষার অভিন্ন প্রশ্ন প্রণয়ন ও সরবরাহ, ৪র্থ ও ৭ম শ্রেণীর সাধারণ বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা আপাতত দেশের মোট ৯টি জোনে ১৮ জনকে পরিদর্শক হিসাবে নিয়োগ দিয়েছি। এসব সংখ্যা প্রয়োজনে আরও বৃদ্ধি করা হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও লক্ষ্য হ’ল-
(১) প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সকল প্রতিষ্ঠান প্রধানকে দক্ষ এবং প্রত্যেক শিক্ষককে অভিজ্ঞ ভাল শিক্ষক হিসাবে তৈরি করা। (২) প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের সকল শিক্ষককে প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা। (৩) অচিরে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। (৪) বিশুদ্ধ কুরআন ও তাজবীদ শিক্ষার প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করা। (৫) দেশের প্রচলিত দ্বি-মুখী শিক্ষাকে একমুখী প্রবর্তনের লক্ষ্যে আরবী ও ইসলামী শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একই সিলেবাসে পাঠদান করা। অতঃপর মেধা ও আগ্রহের ভিত্তিতে মানবিক, বিজ্ঞান, কারিগরী প্রভৃতি শাখায় পৃথক পাঠ গ্রহণের ব্যবস্থা করা। (৬) শিক্ষক-ছাত্র কল্যাণ ফান্ড গঠন করা। (৭) পর্যায়ক্রমে আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেনদ্র তৈরি করা। (৮) বার্ষিক কিংবা দ্বি-বার্ষিক শিক্ষক ও ছাত্র সম্মেলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা। (৯) দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করা। (১০) শিক্ষা উপদেষ্টা মন্ডলীদের নিয়ে মাঝে মধ্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করা। (১১) কেন্দ্রীয় শিক্ষা সেমিনার পরিচালনা কমিটির সদস্যদের নিয়ে অভিভাবক সুধী সম্মেলনের ব্যবস্থা করা। (১২) দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল এমনকি গ্রাম পর্যায়ে অন্তত একটি করে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা চালু করা এবং মসজিদ ভিত্তিক মক্তব চালু করা। (১৩) শিক্ষা বোর্ডের সরকারী স্বীকৃতির জন্য জোর চেষ্টা চালানো। (১৪) কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে একদল যোগ্য আলেম ও দাঈ তৈরী করা। সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যমে জান্নাত লাভের উদ্দেশ্যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করাই আমাদের মৌলিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য।
তাওহীদের ডাক : ২০০৫ সালে আমীরে জামা‘আতকে গ্রেফতারের সময় এবং গ্রেফতার পরবর্তী দিনগুলো আপনার কিভাবে কেটেছিল? একজন আইনশাস্ত্রের মানুষ হিসাবে আপনার ভূমিকা তখন কী ছিল?
শামসুল আলম : সে স্মৃতি আসলে কখনো ভোলার নয়। ২৩শে ফেব্রুয়ারী’০৫ ভোর রাত। হঠাৎ দরজার বাইরে থেকে চাপা কণ্ঠ ভেসে এলো, আলম ভাই! আলম ভাই! উঠেন, তাড়াতাড়ি ওঠেন! ধড়ফড় করে ওঠে ভীত পদে অগ্রসর হয়ে দরজা খুলে দেখি ড. কাবীরুল ইসলাম ভাই। দেখলাম তার চোখে-মুখে ভীষণ উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার ছাপ। কি হয়েছে? বললেন, আমীরে জামা‘আতকে পুলিশ থানায় নিয়ে গেছে! শুধু তাই না, সালাফী ছাহেব, নূরুল ইসলাম ছাহেব এবং আযীযুল্লাহ ভাইকেও নিয়ে গেছে। শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাত আদায় করে বাসা থেকে বিদায় নিলাম। পার্শ্ববর্তী মসজিদে গেলাম। সেখানে ছিলেন মাসিক আত-তাহরীক সম্পাদক ড. সাখাওয়াত হোসাইন ও ‘যুবসংঘ’ দায়িত্বশীল ড. মুযাফফর বিন মুহসিন প্রমুখ।
আমরা ফজরের ছালাত শেষ করে নওদাপাড়া বাজার মসজিদে গেলাম। সেখানে উপস্থিত হ’লেন ‘আন্দোলন’-এর তৎকালীন কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ এস.এম আব্দুল লতীফ ভাই। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, আমাদেরকে থানায় যেতে হবে। আমি বললাম, থানার পরপরই কোর্টে যেতে হবে। ফাইলপত্র সাথে নিতে হবে। কারণ এরপরে ওরা নেতৃবৃন্দকে কোর্টে চালান দিবে। এখন প্রশ্ন হ’ল- মাদ্রাসায় কে যাবে? সেখানেই তো স্যারের বাসা ও পরিবার। সকলে আমরা একে অপরের দিকে তাকাতে লাগলাম। কারণ মাদ্রাসায় এ মুহূর্তে যে যাবে, সে নিশ্চিত গ্রেফতার হবে। শত শত পুলিশ-র্যাব, ডিবি, বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) মাদ্রাসা ঘিরে রেখেছে। বললাম, আমি যাব, ভাগ্যে আল্লাহ যা লিখে রেখেছেন তাই-ই হবে।
আমি রিক্সা নিয়ে চললাম মাদ্রাসার দিকে। দেখি নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, শত শত পুলিশ-র্যাব সদস্য রাস্তার দু’ধারে ও মাদ্রাসার চারিদিক বেষ্টন করে রেখেছে। ওদেরকে ডিঙ্গিয়ে রিক্সা নিয়ে সোজা মাদ্রাসার ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলাম। জিজ্ঞাসা করল, আপনি কে, কোথায় যাবেন? বললাম, আমি মাদ্রাসার শিক্ষক, কাজ আছে তাই যেতে হবে। ওরা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আচ্ছা যান। মাদ্রাসার ভিতরে প্রবেশ করলাম। চারিদিকে আতঙ্কের ছাপ! আমাকে দেখে ছাত্ররা দৌড়ে এসে বলল, স্যার আমীরে জামা‘আতকে নিয়ে গেছে, এখন আমাদের কি হবে? সহকর্মী শিক্ষক হাফেয লুৎফর রহমান, মাওলানা ফযলুল করীম ও কর্মচারীরা এলেন। সবার মধ্যে চরম ভীতি আর আতঙ্ক কাজ করছে। প্রথমে আত-তাহরীক অফিস খুললাম। সকলকে সান্ত্বনা দিয়ে, ধৈর্য ধরতে এবং স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যাবার পরামর্শ দিলাম। বললাম, তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিবে। এতে তারা অনেকটা সাহস পেল। ‘আন্দোলন’ অফিসে গেলাম। কিন্তু কেউ নেই। আনোয়ার ভাইকে বাসা থেকে ডেকে আনা হ’ল। আমীরে জামা‘আতের বাসার খোঁজ-খবর নেওয়া হ’ল। আনোয়ার ভাইয়ের নিকট থেকে কাগজপত্র, ফাইল নিয়ে চললাম থানায়। অতঃপর কোর্টে। শুরু হ’ল আদালত অঙ্গনে যাত্রা। জানি না এ যাত্রা কখন, কবে শেষ হবে? ভাবতে ভাবতে চললাম, আর আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানালাম, ‘হে আল্লাহ! আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতৃবৃন্দকে হেফাযত কর এবং অনতিবিলম্বে তাঁদেরকে মুক্ত করে দাও’।
রাজশাহী কোর্টে গেলাম। এ্যাডভোকেট শাহনেওয়ায, জার্জিস আহমাদ, মু’তাছিম বিল্লাহ প্রমুখ যামিনের মুক্তির আবেদন করলেন। কিন্তু নামঞ্জুর করা হ’ল। প্রথমে রাজশাহী শাহ মখদূম থানার ৫৪ ধারায় (সন্দেহমূলক) মামলাতে নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে এমন মামলা ব্যাপকভাবে দেখা গেলেও তখন আমাদের কাছে নতুন ছিল।
রাজশাহীতে বৃথা চেষ্টায় সপ্তাহ খানেক কেটে গেল। আমরা বুঝলাম, বিষয়টি খুব সহজ নয়। কথিত ইসলামী মূল্যবোধের সরকারের শুধু আমাদের তাবলীগী ইজতেমা ভন্ডুল করাই উদ্দেশ্য নয়, বরং এদের পরিকল্পনা ও নীলনকশা বহু দূর বিস্তৃত। অতএব ড. কাবীরুল ইসলাম, ড. মুযাফফর বিন মুহসিন, মুফাক্ষার হোসাইনসহ কয়েকজন আমরা আত-তাহরীক সম্পাদক ড. সাখাওয়াত হোসাইনের বাসায় একদিন সকালে যরূরী বৈঠকে বসলাম। বললাম, এখানে থেকে আর লাভ নেই। আমাদেরকে ঢাকা যেতে হবে। ঢাকাতে বিভিন্ন স্থানে যোগাযোগ ও হাইকোর্টে আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে কিছু করা যায় কি-না দেখা উচিত। অতঃপর সম্পাদক ছাহেব ও আমি ২৭শে ফেব্রুয়ারী ঢাকায় গেলাম। ২৮শে ফেব্রুয়ারী ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলাম কি করা যায়? আমরা প্রথমে সেন্ট্রাল শরীআহ বোর্ডের তৎকালীন সেক্রেটারী জনাব মোখলেছুর রহমান এবং মাসিক মদীনা সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দীন খান ছাহেবের সাথে দেখা করলাম। তারা অনেক ভাল পরামর্শ ও সান্ত্বনা দিলেন এবং বললেন, আল্লাহ ড. গালিব ছাহেবকে জেলে রেখে ভাল করেছেন। এ মুহূর্তে বাইরে থাকলে হয়ত এর চেয়ে অনেক বেশী ক্ষতি হ’তে পারত। একথা অবশ্য তিনি ছাড়াও অনেক রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন। সকলেরই বক্তব্য, একটু ধৈর্য ধরুন। এ জঘন্য কাজ কারা করেছে, তা আমরা বুঝতে পেরেছি। তাঁরা সেদিন ক্ষমতাসীন বৃহৎ ইসলামী দলটির দিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
পরদিন গেলাম হাইকোর্টে। সেখানে মাওলানা হাফীযুর রহমান ভাইয়ের নেতৃত্বে সকলের আগাম যামিন নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছিল। ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইদের সাথে দেখা ও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হ’ল। ঐদিন সম্পাদক ছাহেব এবং আমি মুছলেহুদ্দীন ভাইকে বললাম, ভাই এখানে দেখছি সকল দায়িত্বশীল অগ্রীম যামিন নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু আমীরে জামা‘আতের জন্য কি করা হচ্ছে? এতে যেন কেউ কেউ নাখোশ হ’লেন। ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইকে পরামর্শ দেওয়া হ’ল এ মুহূর্তে আপনি একটি যরূরী ‘আমেলা’ বৈঠক ডাকুন এবং পরবর্তী কর্মসূচী নির্ধারণ করুন। ‘যুবসংঘ’ ও ‘আন্দোলনে’র কর্মীগণ এখন দিশাহীন এবং অভিভাবকহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। আন্দোলনকে চালিয়ে নিতে হ’লে এভাবে পালিয়ে থাকলে চলবে না। পরিকল্পিতভাবে একটা কিছু করা এ মুহূর্তে অতীব যরূরী। তিনি তাই-ই করলেন। আমরা দু’জনে সেদিন মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের মুহাম্মাদপুরের বাসায় অনুষ্ঠিত সেই যরূরী বৈঠকে উপস্থিত ছিলাম।
ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইয়ের সভাপতিত্বে উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, জনাব গোলাম মুক্তাদির, মাওলানা হাফীযুর রহমান, এস.এম. আব্দুল লতীফ, জনাব বাহারুল ইসলাম, গোলাম আযম প্রমুখ। এখানে বেশ কিছু ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নেয়া হ’ল। পরদিন আবার হাইকোর্টে গেলাম। সেখানকার পরিবেশ ছিল গোয়েন্দাদের কঠোর নযরদারীতে। তবুও আমরা ভয় না করে আমাদের বন্ধু-বান্ধব ছোট-বড় ১৫/২০ জন উকিলের পরামর্শ গ্রহণ করলাম। কিন্তু দুর্ভাগ্য, বড় মাপের কোন এ্যাডভোকেট এ মামলা নিতে চাচ্ছেন না। তারা বলছেন, এখন না, পরে। কেউবা স্যারের নাম শুনেই আঁৎকে উঠছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছোট ভাই এ্যাডভোকেট লিটনকে (কুমিল্লা) নিয়ে রাতে প্রথমে ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল-মামূনের কাছে গেলাম। তিনি বললেন, এখন না। কয়েক মাস পরে আসেন। অবশ্য শেষে যামিনের ব্যবস্থা তাঁর মাধ্যমেই হয়েছিল। এভাবে স্যারের গ্রেফতারকালীন সময়ে আমাদেরকে এমন এক কঠিন পরিস্থিতির মুকাবিলা করতে হয়েছে, যার কোন পূর্বধারণা বা প্রস্ত্ততি আমাদের ছিল না। তবে আইনশাস্ত্রের ছাত্র হিসাবে আমি আমার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সাধ্যমত কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম।
প্রশ্ন : সাংগঠনিক কাজে অনেক সময় আপনাকে প্রশাসনিক লোকদের সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে। স্যার সম্পর্কে তাদের ধারণা কেমন?
শামসুল আলম : স্যারের ব্যাপারে পুলিশ, ডিসি কিংবা আরও উপর মহলের সব সময় সুধারনা ছিল এবং এখনও আছে। যার প্রমাণ আমরা বিভিন্ন সময় পেয়েছি। যেমন-
(১) ১৯৯৭ সালে বিমানবন্দর রোড সংলগ্ন অত্যন্ত মূল্যবান ৭ শতক জমি ইঞ্জিনিয়ার নযরুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ‘যুবসংঘ’কে দান করেন। সে জমি খারিজ হচ্ছিল না। আমি এডিএম আব্দুছ ছবুর ছাহেবকে বললাম, উনি সঙ্গে সঙ্গে এসিল্যান্ড হুমায়ুন কবীরকে ফোনে এভাবে বললেন, দেখ হুমায়ুন, আমি আহলেহাদীছ। আমাদের এ জায়গাটা খারিজ করার ব্যবস্থা কর। পরে আমাকে তার কাছে পাঠালেন। একদিন রাতে কাগজপত্র নিয়ে উনার বাসায় যাই। ‘যুবসংঘে’র তৎকালীন সভাপতি ড. কাবীরুল ইসলাম আমার সাথে ছিলেন। কিছুদিন পর একটি জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। আলহামদুলিল্লাহ!
একইভাবে তৎকালীন রাজশাহী যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি আবুল কালাম চাচার নিজ এলাকা সপুরায় ঈদগাহ মাঠ নিয়ে ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষের সাথে তার দারুন বিবাদ চলছিল। পরবর্তীতে ক্যান্টনমেন্ট কর্তৃপক্ষ ঈদগাহ মাঠ দখলে নিলে আব্দুছ ছবুর ছাহেবকে এ বিষয়টি বললাম। তিনি ইদগাহ মাঠেরও স্থায়ী বন্দোবস্ত করার ব্যবস্থা করলেন।
আব্দুছ ছবুর ছাহেব সচিব হয়ে অবসর গ্রহণের পর তার বাসায় গেলে তিনি ড. গালিব স্যার সম্পর্কে বলেন, গালিব ছাহেবের লেখা এতই সুন্দর, উচ্চ ভাষাশৈলীসম্পন্ন ও সহজ- সরল প্রাণবন্ত, যা অন্য কোন লেখকের বইয়ের মধ্যে পাই না। মনে হয় শুধু বাংলাদেশ না, দক্ষিণ এশিয়ায় তার মত সমাজ সচেতন ইসলামী লেখক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
(২) এডিসি হাবীবুর রহমান আমাদের মাদ্রাসার পার্শ্ববর্তী দীর্ঘ দিনের দখলকৃত অবৈধ বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ ও পুনর্বাসন বিষয়ে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি প্রত্যেক পরিবারকে গুচ্ছ গ্রামে একটি করে সরকারী বাড়ি বরাদ্দের ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে স্থানীয় এক প্রতিনিধির খপ্পরে পড়ে তারা সে সময়ে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেনি। আমিও মাদ্রাসায় যোগদানের পর মাদ্রাসার সুন্দর পরিবেশ রক্ষার কাজে তৎপরতা শুরু করি। বস্তিসহ আশেপাশের যত অবৈধ স্থাপনা ছিল তা উচ্ছেদের জন্য সড়ক ও জনপদ, পুলিশ, ডিসি, স্থানীয় কাউন্সিল প্রমুখের সাথে প্রচুর যোগাযোগ রাখি। শেষমেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীনের আমলে সওজ প্রশাসন এই বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করলে আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হয়। এ বিষয়ে সহকর্মী দুর্রুল হুদা, মুফাক্ষার হোসাইন প্রমুখকে সাথে নিয়ে ড. গালিব স্যারের পরামর্শমত কাজ করি এবং সব জায়গায় প্রশাসনের ইতিবাচক সাড়া পাই। সর্বোপরি ভেতরে-বাহিরে এত অপপ্রচার সত্ত্বেও বিভিন্ন অফিস-আদালতে গেলে প্রশাসনের এমন বহু কর্মকর্তা আমরা পাই, যারা ড. গালিব স্যার সম্পর্কে উচ্চ সুধারনা রাখেন। ফালিল্লাহিল হামদ।
তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতির কথা যদি বলতেন।
শামসুল আলম : (১) ১৯৯০-৯১ সালের কথা। আমীরে জামা‘আতের হড়গ্রামের ভাড়া বাসায় আমি ও মেহেরপুরের আব্দুর রব (বর্তমান ঝিনাইদহ পল্লী বিদুৎ-এর ডিজিএম) যেতাম। প্রথম দিন যখন যাই, তিনি মেহমান খানায় সবুজ কার্পেটের উপর একটি কাঠের ডেস্ক নিয়ে ফ্লোরে বসে লেখাপড়ায় মগ্ন ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হয়েও তার অনাড়ম্বর সাদাসিধে জীবন দেখে সেদিন আমরা বিমোহিত হয়েছিলাম।
(২) আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তখনও ‘যুবসংঘে’ যোগদান করিনি। শুনলাম আমীরে জামা‘আত পাকিস্তান সফর থেকে ফেরার পরপরই (৭ই অক্টোবর ১৯৯২) মটরসাইকেল দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন। আমি ও শিমুলসহ কয়েকজন রাজশাহী সদর হাসপাতালে যাই এবং স্যারের সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর জন্য দো‘আ করি। তিনিও আমাদের জন্য দো‘আ করলেন। পরে স্যার সুস্থ হয়ে উঠলে আমাকে ও আমার সাথীদের নামে একটা কৃতজ্ঞতা পত্র প্রেরণ করেন। পত্রের ভাষাশৈলী আমার মনে দারুন রেখাপাত করে। এতে ‘যুবসংঘ’-এর প্রতি আমার আস্থা ও ভালবাসা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। মনে পড়ে স্যার তখনও আমাদের সাথে আপনি বলে সম্বোধন করতেন, যদিও আমরা ছাত্র। এতে উনার উদারতা যে কত বড়, তা সহজেই অনুমেয়।
৩. ১৯৯০-৯১ সালে যোহা হলের ২১৬ নং কক্ষে ‘যুবসংঘ’-এর একটি প্রোগ্রামের নিউজ যশোর থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক স্ফুলিঙ্গ’ পত্রিকায় প্রকাশ পায়। সেদিনের বৈঠকে শেখ রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা), অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম (যশোর), শেখ শফীকুল ইসলাম (খুলনা), রফীকুল ইসলাম (সাতক্ষীরা), মঞ্জুরুল ইসলাম (যশোর), গোলাম মোস্তফা (মেহেরপুর), শফীকুল ইসলাম (কুমিল্লা), আব্দুর রব (মেহেরপুর) প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সেদিন সকলের সামনে আমি বলেছিলাম, আহলেহাদীছদের একটি ভাল পত্রিকা থাকা দরকার।
১৯৯৫ সালে আমি এলএলএম (মাস্টার্স) পরীক্ষা শেষে নওদাপাড়া মাদ্রাসায় স্যারের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে মাদ্রাসায় শিক্ষকতার প্রস্তাব দেন। পরীক্ষা শেষে যেহেতু অবসর, সে হিসাবে ২৩শে মে ১৯৯৫ সালে মারকাযের শিক্ষক হিসাবে যোগদান করি। এরপর একদিন সংগঠন থেকে একটি পত্রিকা বের করার ব্যাপারে স্যারের সাথে আলোচনা করি। কিন্তু এই চিন্তা আমার আগে থেকেই স্যারের মাথায় ছিল তা আমার জানা ছিল না। স্যার বললেন, এ দায়িত্বটা তোমাকে নিতে হবে। পত্রিকা রেজিষ্ট্রেশনের দায়িত্ব আমার উপর পড়ল। কয়েক মাস ডিসি, পুলিশ কমিশনার, ডিএসপি, রাজশাহী-ঢাকা প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন কাগজ-পত্র জমা দেওয়া-নেওয়ায় কাটল। প্রথমে ‘তাওহীদের ডাক’ নামে আবেদন করি। জানা গেল এ নামে পত্রিকার নিবন্ধন আছে। পরে মাসিক ‘আত-তাহরীক’ নামের জন্য আবেদন করি।
বহু ছুটাছুটি-দৌড়াদৌড়ি করে অবশেষে ১৯৯৭ সালে মাসিক আত-তাহরীক পত্রিকা ছাড়পত্র ও রেজিষ্ট্রেশন পাওয়া যায়। আলহামদুলিল্লাহ! প্রধান সম্পাদক হ’লেন ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার। বিনা ঘুষে এই পত্রিকার রেজিষ্ট্রেশন পাওয়া ঢের কষ্টকর ছিল। স্যার আমার জন্য অনেক দো‘আ করলেন এবং ধন্যবাদ জানালেন। স্যার আমাকে পত্রিকার সার্কুলেশন ম্যানেজারের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর প্রথম সংখ্যা ২ হাযার কপি ছাপানো হ’ল। অতঃপর পত্রিকার চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পেল। আমিও পত্রিকার প্রচারের জন্য শিক্ষকতার পাশাপাশি দিন-রাত পরিশ্রম করতে থাকি। ২০১২ সাল পর্যন্ত হিসাব রক্ষক ও বিজ্ঞাপন বিভাগের দায়িত্ব পালন করি। স্যারের ক্ষুরধার লেখনী ও দুরদর্শিতায় আত-তাহরীক এখন বাংলাদেশের একটি শীর্ষস্থানীয় ইসলামী মাসিক পত্রিকা। এটা আমার জীবনের একটা বড় স্মৃতিময় ঘটনা।
তাওহীদের ডাক : ব্যক্তি জীবনে আপনার এমন কোন অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিচারণ আছে কি যা আমাদের অনুপ্রাণিত করবে?
শামসুল আলম : প্রত্যেক মানুষের জীবন আনন্দময় কিংবা দুঃখজনক ঘটনার সমন্বয়ে অতিবাহিত হয়। আমার জীবনও ব্যতিক্রম কিছু নয়। সেরকম কয়েকটি ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতিচারণ করছি-
(১) বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবন : আমি ১০ই আগস্ট ১৯৮৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন (সম্মান) প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। আমার সিট মাদার বখশ হ’লে বরাদ্দ ছিল। বড় ভাইদের কাছে শুনেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকাটা ক্যাম্পাসের অর্ধেক জ্ঞানার্জনের সমান। কারণ হলে আবাসিক থাকায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা অর্জনের মোক্ষম সুযোগ মেলে। সেদিন থেকে হলে ওঠার অধিক আগ্রহ সৃষ্টি হ’ল। তাছাড়া হ’লে থাকলে খরচও কম হয়। আমার হাইস্কুলের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক জাফর স্যারের সন্তান এ এস এম কবীর আহমাদ ভাই মাদার বখশ হলের ৩০৭ নং কক্ষে থাকতেন। সে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সমর্থক ছিল (বর্তমানে তিনি খুলনা এরিয়া উপ তথ্য অফিসার)। আমি কিছুদিন তার সাথে সেই কক্ষে ডাব্লিং করেছিলাম। কবীর ভাই বলেছিলেন, দেখ আলম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছ ভাল কথা। তবে কয়েকটি কথা মনে রাখবে। ১. কোন রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত হয়ো না। ২. বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ো না। ৩. তোমার যদি ইচ্ছা থাকে তাহ’লে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সাংবাদিকতার সুযোগ রয়েছে, তুমি প্রেসক্লাবের মেম্বার হ’তে পার। ৪. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পাঠক ফোরামের সাথে যুক্ত হ’তে পার। ৫. পড়ালেখার প্রতি যত্নশীল হবে এবং বেশী বেশী লাইব্রেরী ওয়ার্ক করবে, আর নিয়মিত মসজিদে যাবে ইত্যাদি। এই উপদেশগুলো আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি। উপদেশগুলো সত্যিই আমার জীবনে দারুণ উপকারে লাগে।
(২)শিক্ষকতা ও পারিবারিক জীবন : শিক্ষকতাকে পূর্ণ পেশা হিসাবে গ্রহণ করব, সেটা আমার ভাল লাগত না। তাই মারকাযে শিক্ষকতার পাশাপাশি আমি সাংগঠনিক দাওয়াতী কাজও করতাম। সহকর্মী মুজাম্মেল হক মাদানী, আখতারুল আমান মাদানী, আব্দুর রঊফ, আব্দুর রাযযাক (ভারত) প্রমুখের সাথে আশেপাশের গ্রামগুলোতে দাওয়াতী কাজে অংশগ্রহণ করতাম। কখনও আমীরে জামা‘আতের সাথে দূরবর্তী কোন প্রোগ্রামে সফরসঙ্গী হতাম। পুরাতন কর্মী-দায়িত্বশীলদের পদচারণা ও কাজকর্ম বেশ ভাল লাগত।
দ্বীনী পরিবেশে এভাবে দু’টি বছর পেরিয়ে যায়। বন্ধু-বান্ধব থেকে বিয়ের চাপ। তবে পরিবার থেকে বলতো মাত্র ৪০০ টাকা বেতনে মাদ্রাসায় চাকুরী করে কে তোমাকে ভাল মেয়ে দিবে। কেউ বলল, মুখে দাড়ি রাখলে তো ভাল মেয়ে বিয়ে করতে চাইবে না। বাস্তবেও কিন্তু এ রকম পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। এমন কি কিছু দায়িত্বশীলদের আত্মীয়দেরও পিছুটান দিতে দেখেছি। তবে আমার আস্থা ও ভরসা সর্বদা আল্লাহর উপর ছিল। বলতাম, আমীরে জামা‘আতকে ‘যুবসংঘ’-এর বিভিন্ন প্রোগ্রামে বলতে শুনেছি রিযিক আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। সুতরাং আমার আর চিন্তা কি! দেখা গেল ভাল পরিবেশে বিয়ে হ’ল। সন্তানাদি হ’ল। ভাল বাড়ি হ’ল। আল্লাহ সবমিলিয়ে খুব ভালই রেখেছেন আলহামদুলিল্লাহ। তবে প্রথম দিকের কষ্টের সেই বছরগুলোর কথা আজও স্মরণ হয়।
তাওহীদের ডাক : যুবসমাজের জন্য যদি কিছু নছীহত করতেন?
শামসুল আলম : আমি মনে করি ১৯৭৮ সাল থেকে ‘যুবসংঘ’ এ দেশে যুবকদের আদর্শ জীবন গঠনের লক্ষ্যে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। একজন তরুণ যুবক যদি এই প্লাটফর্মে এসে দাওয়াতী কার্যক্রমে শরীক হয়, তবে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির পাথেয় সঞ্চয়ের জন্য তা যথেষ্ট হবে। একজন যুবককে অবশ্যই সময়ের মূল্য দিতে হবে। যুবসমাজের জন্য আমার নছীহত হ’ল- অবসর সময়কে কাজে লাগাতে হবে। প্রচলিত দিকভ্রান্ত রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হওয়া যাবে না। অহী ভিত্তিক দ্বীনী সংগঠন সম্পর্কে জেনে বুঝে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে চেষ্টা করতে হবে। মনে রাখবে, কঠিন পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারার মধ্যে আলাদা একটা অভিজ্ঞতা, সাহস ও তৃপ্তি পাওয়া যায়। শিক্ষাঙ্গনের নোংরা সংস্কৃতি থেকে সর্বদা নিজেকে দূরে রাখতে হবে। মোবাইল নয়; বরং বইকে সঙ্গী করতে হবে। মাসিক আত-তাহরীক, তাওহীদের ডাক, ছাহাবীদের জীবনী, সালাফদের জীবনীসহ ভাল বই পড়তে হবে। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক-গুরুজনদের সাথে সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে কথা বলতে হবে। সর্বোপরি নফল ছালাত ও ছিয়াম আদায় এবং হালাল রূযীর মাধ্যমে জীবন ধারণ করতে হবে। দাওয়াতী কাজের মাধ্যমে আললাহর বিধানকে বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সমাজকে সংস্কার করতে হবে। বিনিময়ে স্রেফ জান্নাত লাভের আশা করতে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন।- আমীন!
তাওহীদের ডাক : তাওহীদের ডাক পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু বলতেন?
শামসুল আলম : পাঠকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার পূর্বে আমার নিজের কথাই বলতে হয়, ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকাটি দিব-মাসিক হ’লেও একটি ব্যতিক্রমী পত্রিকা। কারণ এর ভিতরে অনেক নতুন বিষয় রয়েছে, যা পাঠকদের চিত্তকে আনন্দিত করতে পারে। আমার ছেলে-মেয়েরা ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকা পড়তে অত্যন্ত ভালবাসে। তাওহীদের ডাকের সম্পাদকদের প্রতি কয়েকটি পরামর্শ থাকবে। সেটা হ’ল- ১. পর্যায়ক্রমে ছাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈ, মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদদের জীবনী প্রকাশ করা। ২. কিছু প্রশ্নোত্তর চালু করা। ৩. সাময়িক প্রসঙ্গটি নিয়মিত ও মানসম্পন্ন করা। ৪. নারী ও যুব বিষয়ক কলাম চালু করা। আর পাশপাশি সরকারী রেজিস্ট্রেশনের চেষ্টা করতে হবে। সর্বোপরি পত্রিকা পাঠকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য প্রচারণা বৃদ্ধি করতে হবে। পাঠকদের বলব, পত্রিকাটি পড়ুন। বাসায় পরিবারের সদস্যদের জন্য ও ছেলে-মেয়েদের জীবন গঠনের জন্য হ’লেও একটি কপি কাছে রাখুন। পত্রিকাটিকে সার্বিক সহযোগিতা ও সমৃদ্ধশালী করার জন্য পরামর্শ দিন। আল্লাহ সকলকে তাওফীক দিন।- আমীন!
তাওহীদের ডাক : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। জাযাকাল্লাহ খাইরান
শামসুল আলম : তোমাদেরকেও ধন্যবাদ। বারাকাল্লাহ ফীকুম।