পাপ পুণ্য
মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ
অনেক দিন আগের কথা। এক শিকারীর একটি পোষা কুকুর ছিল। কুকুরটি চিকন ও লম্বা হওয়ায় অনেক দ্রুত দৌড়াতে পারত। শিকারীর নির্দেশে কুকুরটি কখনো খরগোশ ও হরিণের পিছু ধাওয়া করত। আবার কখনো তীরবিদ্ধ পাখিকে মারা যাওয়ার পূর্বেই মালিকের কাছে পৌঁছে দিত। একদিন শিকারী তার কুকুরকে সাথে নিয়ে শিকারে গেল। অতঃপর একটি হরিণের পিছু ধাওয়া করে একটি পাহাড়ের কাছে এসে পৌঁছাল। পাহাড়টি সবুজ গাছ, লতা-পাতা ও ফুল-ফলে ঘেরা ছিল। সেখানে সে একটি গুহা দেখতে পেল। সে গুহার চারপাশে মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছিল। আর এক পাথরের গা বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় মধু পড়ছিল। শিকারী বুঝতে পারল পাশেই হয়ত মৌমাছির বাসা রয়েছে। সেখানে দীর্ঘদিন কোন মানুষ যায় নি। ফলে অনেক মধু জমা হয়ে পাথরের গা বেয়ে চুইয়ে পড়ছে। এটা দেখে শিকারী অনেক খুশি হ’ল।
সে ভাবল, এই মধুর সন্ধান আর কেউ না পেলে অনেক দিন কষ্ট করে শিকার ধরার প্রয়োজন হবে না। প্রতিদিন এখানে এসে কিছু মধু শহরে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করব। এভাবে আমার অনেক দিন কেটে যাবে। এ মধু অনেক দিন শেষ হবে না। কারণ পাহাড়ের পাদদেশে অনেক ফুল রয়েছে। মৌমাছিরা সে ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে নতুন নতুন বাসা তৈরী করবে।
শিকারী নিজের মুখে একটা কাপড় বেঁধে মধু সংগ্রহে নেমে পড়ল। তার কাছে যে পানির পাত্র ছিল তাতে মধু ভর্তি করে শহরের এক বাজারে নিয়ে আসল। কুকুরটি তার সাথেই ছিল। এক মুদি দোকানীর কাছে গিয়ে বলল, আমার কাছে খাঁটি মধু আছে, আমি সেটা বিক্রি করতে চাচ্ছি। দোকানদার সে মধুর কিছুটা স্বাদ নিয়ে বলল, অনেক সুন্দর। আমার কাছে কয়েক রকমের মধু মওজুদ আছে। এক প্রকার মধু আমি গ্রাম থেকে নিয়ে এসে মোম আলাদা করে পরিশোধন করে খাঁটিটা বিক্রি করি। আর এক প্রকার মধু যা মৌয়ালদের কাছ থেকে কিনে মোমসহই বিক্রি করি। আর একটি মধু পরিশোধিত করে তারা নিয়ে আসে। আমি আলাদাভাবে সেটা কিনে বিক্রি করি। মাঝে মাঝে তাতে চিনি মিশানো থাকে। যারা মধু চিনতে পারে তারা সেটা পসন্দ করে না। প্রত্যেক প্রদেশের খাঁটি মধুর একটা বিশেষ স্বাদ রয়েছে। কিন্তু আপনার মধু অন্য সকল মধু থেকে আলাদা। তার গন্ধ এবং স্বাদ থেকে বুঝা যাচ্ছে এটি আসলেই খাঁটি। যে প্রদেশ থেকে এসেছে সেখানকার ফুল অবশ্যই সুগন্ধিময়। আমি ইনছাফ প্রিয় মানুষ, আপনার মধু চড়া মূল্যে কিনে নিব। কিন্তু আমায় কথা দিতে হবে এই মধু শুধু আমার জন্যই নিয়ে আসবেন। শিকারী আনন্দিত হয়ে বলল, কথা দিলাম। আমার কাছে অনেক মধু আছে। যদি দেখি আপনি ভাল মূল্য দিচ্ছেন এবং আমাকে প্রতারিত করছেন না তাহ’লে প্রতিদিন আমি এক মটকা মধু নিয়ে আসব। দোকানী খুশি হয়ে সেই মটকাটা দাঁড়িপাল্লায় ওযন করল। অতঃপর অন্য পাত্রে মধু ঢেলে খালি পাত্রটা ওযন করল যাতে মধুর সঠিক ওযন বুঝতে পারে।
ঐ দোকানী তার দোকানে ইঁদুর ধরার জন্য একটা বেজি পুষত। দোকানদার যখন মধু অন্য পাত্রে ঢালতে গেল ঠিক তখনই এক ফোঁটা মধু মাটিতে পড়ে গেল। বেজি দ্রুত সে মধু চেটে খাওয়ার জন্য দৌড় দিল। এ সময় শিকারীর পোষা কুকুর বেজিকে দেখতে পেয়ে হামলা করল। সে বেজির গলায় কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দিল। দোকানী তার বেজিকে খুব পসন্দ করত। কুকুরের এই কান্ড দেখে সে রেগে দাঁড়িপাল্লার হাতল দিয়ে কুকুরের মাথায় জোরে আঘাত করল। ফলে কুকুর বেহুশ হয়ে গেল। শিকারীও তার পোষা কুকুরকে অনেক পসন্দ করত, একারণে সেও রেগে গিয়ে মধুর পাত্রটা দিয়ে দোকানীর মাথায় আঘাত করে সেটা ভেঙ্গে ফেলল। দোকানী চিৎকার দিয়ে বেহুশ হয়ে গেল। দোকানীর প্রতিবেশীরা এই অবস্থা দেখে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের খবর দিল। তারা সেখানে একত্রিত হয়ে শিকারীকে কিল, ঘুষি দিতে থাকল। শিকারী নিজের কোমরে বেঁধে রাখা চাকু দিয়ে কয়েকজনকে যখম করে দিল।
এই পরিস্থিতিতে চিৎকার-চেঁচামেচি বেশী হওয়ায় টহলদার পুলিশ এসে শিকারীসহ কয়েকজন ব্যবসায়ীকে দারোগার কাছে ধরে নিয়ে গেল। দারোগা এক এক করে বিষয়টি তদন্ত করে বললেন, যাও দেখে আস দোকানী জীবিত আছে নাকি মৃত। খবর আসল দোকানী জীবিত কিন্তু তার মাথা মারাত্মক যখম হয়েছে। দারোগা সকলকে বিচারকের কাছে পাঠালেন এবং বললেন, বিচারক যা রায় দিবেন তাই কার্যকর করা হবে। বিচারক দোকানী, শিকারী এবং যারা এই ঝগড়ায় অংশ নিয়েছিল তাদের সবাইকে এক এক করে জিজ্ঞাসা শেষে বললেন, বেজি একটা প্রাণী তাই সে এক ফোঁটা মধু খেতে চেয়েছিল। বেজিকে তো শাস্তি দেওয়া যায় না। কুকুরও তো একটা প্রাণী তাকেও তো শাস্তি দেওয়া যায় না। কিন্তু দোকানী ধৈর্য ধরতে পারত। তার কুকুরকে মারা ঠিক হয়নি। আবার শিকারীরও দোকানদারকে আঘাত করা উচিত হয়নি। এখানে ভুল তো শিকারীর। কেননা সে তার কুকুরকে বাঁধন ছাড়া বাজারে নিয়ে এসেছে। অন্যান্য লোকজন মুদি দোকানীর প্রতিবেশী হওয়ার কারণে দোকানীকে সমর্থন করে মারামারি করেছে। শিকারীও নিজের জীবনের ভয়ে ছুরি দিয়ে মানুষকে যখম করে প্রতিরোধ করেছে।
আমরা কাউকেই জরিমানা কিংবা শাস্তি দিতে পারি না। সকলের উচিত যুলুম দেখলে পুলিশ কিংবা বিচারকের কাছে যাওয়া। নিজেরা মতবিরোধ করে ছোট বিষয়কে বড় করা উচিত নয়। এখন কারও কি কোন অভিযোগ আছে? উপস্থিত কেউ কথা বলল না। বিচারক বললেন, তোমাদের অপরাধ হ’ল মূর্খতা। যখন মানুষ অশিক্ষিত হয় তখন প্রতিদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতে থাকে। যদি মানুষ শিক্ষিত ও দায়িত্ববান হ’ত তাহ’লে পোষা কুকুরকে এভাবে বাঁধন খুলে বাজারে আনত না, দোকানী বিড়ালের পরিবর্তে বেজি পুষত না, কুকুরকে আঘাত না করে পুলিশের কাছে বিচার দিত, ক্ষতিপূরণ দাবি করত আর ঝগড়া ওখানেই মিটে যেত। অতঃপর এক কুকুরকে যখন মারা হ’ল তখন মানুষ অপর মানুষকে মধুর পাত্র দিয়ে না মেরে বিচারকের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইত। যেখানে পুলিশ কর্মকর্তা ও বিচারক আছে সেখানে এমন ছোট খাট বিষয়গুলো সমাধান করা সম্ভব। পৃথিবীর সকল যুদ্ধ ও মারামারি প্রথমে ছোটই থাকে। অতঃপর মূর্খরা সেগুলোকে বড় বানায়। সামান্য এক ফোঁটা মধুর জন্য মানুষটি মারাত্মক আহত হ’ল। যাহোক এখানে যেহেতু কারও অভিযোগ নেই সুতরাং সবাইকে ক্ষমা করা হ’ল।
[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]
শিক্ষা : এই গল্পের শিক্ষণীয় দিকটি গল্পের মধ্যেই নিহিত রয়েছে। বাস্তবেই আমরা সামান্য বিষয়কে কেন্দ্র করে তুলকালাম কান্ড ঘটিয়ে ফেলি। ফলে নগণ্য বিষয় থেকে বড় ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যায়। এটি আমাদের অজ্ঞতা, মাত্রাতিরিক্ত রাগ ও হিতাহিতজ্ঞানশূন্যতার কারণে ঘটে থাকে। সেকারণে উদ্ভূত যেকোন অসন্তোষজনক পরিস্থিতিতে ঘটনা বিশ্লেষণপূর্বক সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। সেই সাথে রাগের বশবর্তী হয়ে সামাজিক বিশৃঙ্খলার অগ্নিতে উত্তাপ না বাড়িয়ে ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহ আমাদের ধৈর্যশীল হওয়ার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
[অনুবাদক : কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ।]