ঘুরে এলাম দার্জিলিং ও ভুটান
আব্দুর রশীদ
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 9520 বার পঠিত
আট্টাবাদ লেক :
১৮ই আগস্ট ২০১৬। চীনের বর্ডারের উদ্দেশ্যে গাড়ী এগিয়ে চলেছে। গিরিখাদে হুনজা নদী বহমান। অনেক উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে একটা ঝর্ণাধারা হুনজা নদীতে পতিত হচ্ছে। দৃশ্যটা অন্য রকম এক মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেল। প্রায় ঘন্টাখানেক পাহাড়-নদীর লুকোচুরির মধ্য দিয়ে একসময় গাড়ী এসে থামে এক পাহাড়ী টানেলের গেটে। পাক-চায়না ফ্রেন্ডশীপের আরও একটি নযীর এই টানেল। ২০১৬ সালে পাক-চায়না মেগা অর্থনৈতিক প্যাকেজ তথা ঐতিহাসিক ‘সীপেক’ (China–Pakistan Economic Corridor) চুক্তির পূর্ব থেকে প্রস্ত্ততিমূলকভাবে চীন সরকার নিজেদের অর্থায়নে এই রাস্তা ও টানেলগুলো তৈরী করে দিয়েছে পাকিস্তানকে। ২০১০ সালে এক বিরাট পাহাড়ধ্বসে হুনজা নদীর প্রবাহ অবরুদ্ধ হয়। বহু মানুষ নিহত এবং বাস্ত্তচ্যুত হয় এই ভয়াবহ ধ্বসে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। শুধু তাই নয় এতে অঞ্চলের ভূভাগেও আসে বড়সড় পরিবর্তন। হুনজার নদীর স্রোতধারা আটকে পড়ে রুপান্তরিত হয় ১৩ কি.মি. দৈর্ঘের এক বিশালাকার গভীর হৃদে। অবশেষে চীনের সহযোগিতায় ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরায় সচল করা হয় এবং লেকের পার্শ্ব দিয়ে ২৪ কি.মি. দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে পাহাড়ের নীচ দিয়ে নির্মিত হয়েছে ৫টি টানেল, যার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৭ কি.মি.।
টানেলের মুখে দাঁড়িয়ে আবার পুলিশী চেকিং। এই ফাঁকে ছাত্ররা ‘লং লিভ পাক-চায়না ফ্রেন্ডশীপ’ লেখা সাইনের নীচে দাঁড়িয়ে ফটো তোলে। চারিপার্শ্বে সুউচ্চ পাথুরে পাহাড় ঘিরে রেখেছে। রুক্ষ্ম, ধুসর লালচে বরণ। তার নীচ দিয়ে ইঁদূরের গর্তের মত ঢুকে গেছে টানেল। গঠনাকৃতিতে অত্যন্ত মজবুত মনে হয়। টানেলের ভেতর গাড়ি প্রবেশ করতেই নিকষ কালো রাত নেমে আসে। আলোর কোন ব্যবস্থা নেই। অর্থাৎ নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি তখনো। প্রথম...দ্বিতীয়... তৃতীয় টানেল একে একে সা সা করে অতিক্রম করল গাড়ি। তৃতীয় টানেলটা অন্ততঃ ৩ কি.মি. দীর্ঘ হবে। শেষ হতেই চায় না। একটুখানি আলোর মুখ দেখার জন্য যখন সবাই হাঁসফাঁস করছে, সবেমাত্র টানেলের অপর মুখ থেকে বের হয়ে আলোর স্পর্শ পেয়েছে গাড়ি, তখনই আচমকা ভোজবাজির মত উদয় ঘটল বিশাল এক নীল সাম্রাজ্যের। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই চতুর্থ টানেলে ঢুকে গেল গাড়ি। বের হওয়ার পর আবার একই দৃশ্য। এবার সবাই হইচই করে ওঠে। আট্টাবাদ লেকের সীমানায় পৌঁছে গেছি আমরা। গিরিখাদের মধ্যে এঁকে বেঁকে বয়ে চলা এত অদ্ভুত নীল পানির লেক! চোখ ধাঁধিয়ে যায়। শরীরের রোম যেন খাড়া হয়ে ওঠে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এটা কোন ক্যালেন্ডারের পাতা নয়।
পঞ্চম টানেল অতিক্রম করে আমরা নির্দিষ্ট স্পটে এসে দাঁড়াই। ভুমিধ্বসের পর এখনও পর্যটন স্পট সেভাবে গড়ে ওঠেনি। গাছপালা কিংবা সবুজের চিহ্ন প্রায় বিরল। আশেপাশে জনবসতিও শূন্যের কোঠায়। আমরা ভিন্ন কোন পর্যটকও দেখা গেল না। তা সত্ত্বেও লেকে ঘোরার জন্য বেশ কিছু সাম্পান প্রস্ত্তত। আমরা লেকের পাড়ে বসে সকালের নাশতা সারি। তারপর অন্যদের সাথে সাম্পানে চড়ে লেকের পানিতে ভ্রমণে বের হই। নীল আসমানের নীচে সুগভীর লেকের নীল পানি কেটে কেটে সাম্পান এগিয়ে চলে। সবাই ফটোসেশনে মশগুল। এদিকে আমি একবার কাঁচপনা লেকের গভীরতা মাপি, সসম্ভ্রমে তার মোহনীয় শীতল নীল স্পর্শ নেই; আরেকবার আকাশময় ঘিরে থাকা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা টানেলের কৃষ্ণ মুখগহবর দেখি। বিপুলা পৃথিবীর অপার ঐশ্বর্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দু’চোখ মুদে আসে। নিঃশ্বাস থেমে থেমে বের হয়। শরীরের প্রতিটি রেণু কোথাও ছুটে চলে যেতে চায়। কোন এক অজানা শক্তির দুর্নিবার আকর্ষণে অন্তরাত্মা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। ধরাছোঁয়ার বাইরে কোন এক পরাবাস্তব জগতের হাতছানি অনুদিত হয় ধরাপৃষ্ঠের প্রতিটি অনু-পরমাণুতে। কী এক প্রহেলিকায় ছেয়ে যায় প্রকৃতি! বৈরাগ্যের অনুভূতি কি এমনতরো কিছু! এমন কোন রহস্যময় জগতে মিশে যাওয়ার তাড়নাই কি বৈরাগী সাধকদের নৈঃশব্দ আর নির্জনতার সাধনায় বুদ করে রাখে! কে জানে! তবে তাদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে ভাবার নতুন এক আগ্রহ সত্যিই তৈরী হ’ল।
সাম্পানওয়ালা লেকের মাঝে অনেকটা ঘুরে পুনরায় কিনারায় ফিরে এসে নোঙর ফেলার কোশেশ করে। আমি চারিপাশের দৃশ্যাবলী ক্যামেরাবন্দী করায় মনোনিবেশ করি। জীবন চলার পথে অনেকবার জনহীন বিরাণ প্রান্তর মাড়িয়েছি, কতশতবার নৈঃশব্দের গহীনে কান পেতেছি; কিন্তু আট্টাবাদ লেকের এই নির্জনতা, এই নীল জলাধার, ধুসর পাহাড়ের কাঁধে এই সুনীল আকাশ যে গভীর আত্মবিহনে ডুবিয়ে দিল, স্রষ্টার প্রতি যে আত্মনিবেদনের সূর বেঁধে দিল, তার মত প্রশান্তিময় অনুভূতি আর কোথাও যেন পাইনি। এ ক্ষুদ্র সময়টুকু হৃদয়পটে পুলকিত ভাবের যোগান হয়ে থাকবে বহুদিন।
পাস্সু ভ্যালি :
আট্টাবাদ লেক থেকে আমরা পরবর্তী গন্তব্যের পথে রওনা হই। আধাঘন্টা বাদে গুলমিট পৌঁছি। সেখান থেকে পাস্সু বা পাসু ভ্যালি। প্রায় জনবসতিহীন এই ভ্যালিতে বিশ্বের কয়েকটি বিশালকায় হিমবাহের অবস্থান। এর মধ্যে একটি হ’ল বাতুরা গ্লেসিয়ার। দৈর্ঘে ৫৬ কি.মি. এই গ্লেসিয়ার এ্যান্টার্কটিকার বাইরে পৃথিবীর সপ্তম দীর্ঘতম হিমবাহ। রাস্তা থেকে এর লেজের অংশটুকু নযরে আসে। তবে সবচেয়ে দর্শনীয় হ’ল হুনজা নদী অববাহিকায় খৃষ্টধর্মের উপাসনালয়ের উর্ধ্বাংশের মত দেখতে তীক্ষ্ম ফলা বিশিষ্ট খাঁজ কাটা পাহাড়ের দীর্ঘ সারি। এগুলোকে পাস্সু কোন্স বা পাস্সু ক্যাথেড্রাল বলা হয়। উচ্চতায় গড়পড়তা ৬০০০ মিটারের উর্ধ্বে। তাতে নানান রঙের যাদুকরী খেলা দৃষ্টিসুখকর সৌন্দর্য উৎপাদন করেছে। কারাকোরাম হাইওয়ের সুমসৃণ ঢালু রাস্তায় গাড়ি যখন তীরের মত ছুটে চলে এই পাহাড়গুলোর দিকে আর দু’পার্শ্বের পাহাড়গুলো চক্রাকারে ঘোরে, তখন বাস্তব জগতের বাইরে নিজেদেরকে বিলকুল কোন চলচ্চিত্রের অংশ মনে হয়। বাহনের সম্মুখ আসনে বসে এমন মনোহর দৃশ্য দেখা যে কারো জন্য আরাধ্য। চোখের কোণ দিয়ে আমি আমার প্রতি পেছনের অর্ধশত জোড়া নয়নের তৃষিত, ইর্ষান্বিত চাহনি বিলক্ষণ টের পাই।
সোস্ত বাযার :
খাড়া পর্বতশ্রেণীর রুক্ষ দেয়াল আর একদিকে খরস্রোতা হুনজা নদীর গর্জনকে সঙ্গী করে আরও প্রায় ৪০ কি. মি. যাওয়ার পর আমরা সোস্ত বা সুস্ত নামক এক বাযারে পৌঁছি। চায়না বর্ডারের পূর্বে এটাই সর্বশেষ শহর এবং স্থলবন্দর। এখানেই কাস্টমস এবং ইমিগ্রেশন অফিস অবস্থিত। চায়না পণ্যবাহী ট্রাক ড্রাইভাররা বা পর্যটকরা দীর্ঘ সফরের মধ্যবর্তী বিরতি গ্রহণ করে এই বাযারে। ফলে বেশ কিছু ভাল মানের আবাসিক হোটেল দেখা গেল। রাস্তার সাইনপোস্টগুলোতে ইংরেজী, উর্দূর সাথে চাইনিজ ভাষাতেও নির্দেশনা দেয়া রয়েছে।
খানজেরাব ন্যাশন্যাল পার্ক :
সঠিক উচ্চারণে ‘খুনজেরাব’। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ রক্তের ধারা কিংবা পানির ঝরণা। তবে সাধারণ্যে খানজেরাব হিসাবে বেশী প্রচলিত। সোস্ত থেকে আরও প্রায় ২৫ কি.মি. পর আর্মি চেক পোস্ট। সর্বশেষ এই চেক পোস্ট থেকে চায়না বর্ডার আরও ৪২ কি.মি.। মধ্যবর্তী কয়েক হাযার বর্গফুট এলাকাটি খানজেরাব ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৭৯ সালে সরকারীভাবে এটিকে ন্যাশনাল পার্ক হিসাবে ঘোষণা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর অর্ধেকটা অংশের গড়পড়তা উচ্চতা ৪০০০ মিটার। দীর্ঘ শিং বিশিষ্ট মার্কো পোলো ভেড়া, সাইবেরিয়ান আইবেক্স এবং স্নো লেপার্ড এই পার্কের বিশেষ প্রাণী। বছরের প্রায় ৭/৮ মাস বরফাবৃতই থাকে। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১৪ ডিগ্রি আর নিম্নে মাইনাস ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে সবুজের চিহ্ন প্রায় নেই। পার্কের প্রবেশমূল্য ৪০ রুপি প্রদান এবং পরিচয়পত্র চেকিং শেষ হওয়ার পর গাড়ি আবার যাত্রা শুরু করে। আমি আলহামদুলিল্লাহ আবারও সেফ জোনে। পরিচয়পত্রের ঝামেলা স্যাররাই মিটিয়ে এলেন।
ন্যাশনাল পার্কের মধ্য দিয়ে গাড়ী চলতে থাকে গিরিপথে। যথারীতি জনমানবহীন পর্বতবেষ্টিত অঞ্চল। বরফঢাকা চওড়া পর্বতশিখর চতুর্দিকে। তার পাদদেশে নেমে এসেছে গ্লেসিয়ার তথা হিমবাহ। পাহাড়ের ঢালে মাঝে মাঝে লম্বা শিংওয়ালা ভেড়ার পাল দেখা যায়। আইবেক্স কিংবা পাকিস্তানের জাতীয় পশু মার্খর। এছাড়া মাইলের পর মাইল আর কোথাও প্রাণের চিহ্ন দেখা যায় না। কেবল বিপরীত দিক থেকে আসা চীনা পণ্যবাহী দু’চারটি দীর্ঘকায় ট্রাক হুস হুস শব্দ তুলে অতিক্রম করে যায়। একটা ক্ষীণ খরস্রোতা নদীও বয়ে যায় রাস্তার পাশ দিয়ে। নাম-পরিচয়হীন জহির রায়হানের বরফ গলা নদী। কারাকোরাম পর্বতশ্রেণীর এই অংশটি প্রলম্বিত হয়ে চীনের পামির পর্বতশ্রেণীর সাথে মিশেছে। ১৯৮২ সালে এই গিরিপথ দিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ে সম্প্রসারিত হয়ে চীনের সাথে প্রথম পাকিস্তানের স্থলবাণিজ্য যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ইতিপূর্বে উভয় দেশের মধ্যে যাতায়াতে স্থানীয়ভাবে ভিন্ন দু’টি স্থলপথ ব্যবহৃত হ’ত। তবে তা যানবাহন চলাচলের জন্য উপযুক্ত ছিল না। ফলে এই সড়কপথটি এখন বাণিজ্যিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুট। এটি বিশ্বের অন্যতম সুউচ্চ সড়কপথ হিসাবে পরিগণিত। আরও প্রায় ঘন্টাখানেক যাত্রার পর আমরা রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৮৬০ কি.মি. পাড়ি দিয়ে অবশেষে পাকিস্তানের সর্ব উত্তরের সীমান্তে এসে পৌঁছলাম।
খানজেরাব বর্ডার পাস :
এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ সীমান্ত পারাপার সড়ক। উচ্চতা ৪৬৯৩ মিটার বা ১৫৩৯৭ ফুট। অর্থাৎ নাঙ্গাপর্বতের বেসক্যাম্প-১ থেকেও কয়েক’শ মিটার উঁচু। ফলে তাপমাত্রা মাইনাসে। আপাদমস্তক শীতের পোষাক পরিহিত। তবুও বাস থেকে নামতেই সুঁচ ফুটানো ঠান্ডা বাতাসের আক্রমণে কাবু হয়ে গেলাম। পাহাড়গুলোতে গতরাতেও তুষারপাত হয়েছে দেখা যাচ্ছে। মিনিটে মিনিটে প্রকৃতি ঢেকে যায় মেঘের কুয়াশায় আবার পরক্ষণেই ছেড়ে যায়। আমরা প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে সীমান্তরেখায় নির্মিত বিশাল ফটকের কাছাকাছি এসে দাঁড়াই। ক্ষুদ্র চোখওয়ালা চীনা বর্ডারগার্ডরা এগিয়ে এসে নিষ্প্রাণ শুকনো সম্ভাষণ জানায়। সম্ভাষণ বললে অবশ্য ভুল হবে। কেউ যেন নির্ধারিত সীমানা অতিক্রম করে না ফেলে সেজন্য হুশিয়ার করতে আসে। তীক্ষ্ম হুইসেল বাজিয়ে দলছুট চিড়িয়া তাড়ানোর ভঙ্গিমা করে। তাদের হাবভাবে স্পষ্ট অভদ্রতার ছাপ। তবুও ছেলেরা নাখোশ হয় না। তাদের সাথে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে ছবি তোলে। অবশেষে গার্ডরা বাধ্য হয়ে চোখে গগলস লাগিয়ে ঠোটের কোণে এক চিলতে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে দেয়। আমি প্রকৃতির দিকে মনোযোগ দেই।
রাস্তার উপরে সাইনপোস্ট। তাতে লেখা উরুমুচি ১৮৯০ কি.মি., কাশগড় ৪২০ কি.মি. এবং তাশকোরগান ১৩০ কি.মি.। সীমান্তের ওপারে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত সিংকিয়াং (চাইনিজ উচ্চারণ শিনঝাং, যার অর্থ নয়া সীমান্ত) প্রদেশ। সেদিকে তাকালে বিস্তীর্ণ পাহাড়ী অঞ্চলে বহু দূরে অল্প কিছু জনবসতি নযরে আসে। রাস্তায় অবশ্য কিছু বাস এবং প্রাইভেট গাড়ি অপেক্ষমান দেখা যায়। গিলগিত থেকে প্রতিদিন একটি যাত্রীবাহী গাড়ি কাশগড় পর্যন্ত যাতায়াত করে। ফলে যতটা জনশূন্য পরিবেশ মনে হচ্ছে, বাস্তবে ততটা হওয়ার কথা নয়। উরুমুচি, কাশগড় শব্দগুলোর সাথে পরিচয় সেই শৈশব থেকে। সাইমুম সিরিজের সুবাদে। ফলে নামসূত্রে এসব এলাকা সম্পর্কে জানাশোনা বহুদিনের। আমি তৃষ্ণার্ত দু’চোখ ভরে দেখতে থাকি সিংকিয়াং-এর যমীন। দেখতেই থাকি। নযর ফেরাতে পারি না।
হিজরী প্রথম শতকে যখন ইসলামের বিজয়ডঙ্কা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হয়েছিল, সেসময় অকুতোভয় মুসলিম সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিম (মৃ. ৯৬হিঃ) মধ্যএশিয়ার খাওয়ারযিম, বোখারা, সমরকন্দ ও বলখ প্রভৃতি শহর জয় করে এই কাশগড় পর্যন্ত এসে থেমেছিলেন। কোন কোন ইতিহাসে পাওয়া যায়, সেনাপতি কুতায়বা বিন মুসলিম তুরস্ক জয় করার পর একই সফরে চীনে অভিযানের প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। এসময় তাঁর জনৈক উযীর বলল, হে সেনাপতি! আপনি তুরস্ক জয় করেছেন ক’দিন পূর্বেই। মাল-সামান আমাদের হাতে যথেষ্ট নেই। প্রস্ত্ততির জন্য আমাদের কি আর সামনে অগ্রসর না হলেই ভাল হত না! তখন কুতায়বা বিন মুসলিম গর্জন করে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহর সাহায্যের প্রতি বিশ্বাস থাকার কারণেই আমরা তুরস্ক জয় করতে পেরেছি। নির্ধারিত সময় যখন পার হয়ে যায়, তখন কোন প্রস্ত্ততি কাজে আসে না’। তাঁর এই দৃঢ়চিত্ততা দেখে উযীর যখন দেখলেন কোনভাবেই তাঁকে ফেরানো যাবে না, তখন তিনি বললেন, ‘আপনি যেভাবে ইচ্ছা আপনার পথে অগ্রসর হৌন হে কুতায়বা! আপনার সংকল্প এমনই কঠিন যে কেবল আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ আপনাকে ফেরাতে পারবে না’। অতঃপর কাশগড় বিজয় শেষে খলীফা ওয়ালীদের মৃত্যু সংবাদে তাঁর বিজয়াভিযান থেমে যায়। নতুবা সমগ্র চীন হয়ত তাঁর পদানত হয়ে যেত।
যাইহোক কাশগড় বিজয়ের পর থেকে এই সিংকিয়াং-এর মাটিতে মুসলমানদের আনাগোনা শুরু হয়। খৃষ্টীয় দশম শতাব্দীতে কাশগড়ের তুর্কী বংশোদ্ভূত উইঘুর রাজার পুত্র সাতুক বোখারার জনৈক ফকীহের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন মাত্র ১২ বছর বয়সে। তবে পিতার ভয়ে তা গোপন রেখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি সালতানাতে অধিষ্টিত হয়ে নিজেকে মুসলিম হিসাবে প্রকাশ করেন এবং সুলতান বুগরা খান গাযী নামে পরিচিত হন। তাঁর মাধ্যমেই প্রথম তুর্কী বংশোদ্ভূত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী উইঘুরদের মাঝে ইসলামের বার্তা ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে সিংকিয়াং-এর অর্ধেকের বেশী জনগোষ্ঠী উইঘুর মুসলিম, যাদের বসবাস তিয়েনশান পাহাড়ের দক্ষিণভাগে কাশগড় শহরকে কেন্দ্র করে। অপরদিকে বৌদ্ধ হানরা বসবাস করে সিংকিয়াং-এর রাজধানী উরুমুচিকেন্দ্রিক।
ভুখন্ডের দিক থেকে সিংকিয়াং ১৬ লক্ষ বর্গকিমি তথা সমগ্র পাকিস্তানের দ্বিগুণ এবং চীনের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। বহু বছর ধরে এ ভুখন্ডের মুসলমানরা কম্যুনিস্ট সরকারের অত্যাচারে নিষ্পিষ্ট। পত্রিকায় প্রায়ই খবর আসে বোরকা, দাড়ি, মসজিদ এবং ছালাত, ছিয়াম পালনেও তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের খবর। এই অঞ্চলটি খনিজ সম্পদে পরিপূর্ণ এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের দাবীদার বলে চীন সরকার যে কোন মূল্যে একে ধরে রাখতে চায়। অপরদিকে উইঘুররা চায় স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র। এজন্য চীনা সরকার উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে এবং তাদেরকে মানসিকভাবে কোনঠাসা করে রাখে। ফলে এক প্রকার ঠান্ডা যুদ্ধ সেখানে সর্বদা বিরাজমান। চাইনিজ গোষ্ঠী হানদের সাথে উইঘুরদের প্রায়ই জাতিগত সংঘর্ষ লেগে থাকে। এতে উইঘুরদের স্বাধীনতার চেতনা আরও গভীরতর হয়েছে। তারা পারতপক্ষে চাইনিজ ভাষা (মান্দারিন) পর্যন্ত শেখে না। সবকিছুতেই নিজেদের আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে চায়। ইউনিভার্সিটিতে আমার এক উইঘুর বন্ধু ছিল। তুরসুং। সে তার মাতৃভাষা উইঘুরসহ কাজাখ, তুর্কী, উর্দূ, পশতু ইত্যাদি প্রায় সাতটি ভাষায় কথা বলতে পারত। অথচ চাইনিজ জানত না। অন্যান্য প্রদেশের চাইনিজদের সাথে তাকে আরবীতেই কথা বলতে দেখতাম। আবার অন্যান্য চাইনিজদেরকে দেখতাম উইঘুরদের প্রতি বেশ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে। যদিও তারা সবাই মুসলিম। তাদের মতে, উইঘুরদের বিদ্রোহী মনোভাবের কারণে চীনের অন্য প্রদেশের মুসলমানদেরকেও ভুগতে হচ্ছে এবং বৈষম্যের স্বীকার হতে হচ্ছে। আল্লাহ অধিক অবগত। (ক্রমশঃ)