জ্ঞানার্জন বনাম জ্ঞানের প্রয়োগ
রেহনুমা বিনতে আনীস
ডা. আব্দুর নূর তুষার, ঢাকা। 368 বার পঠিত
ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আমার মা আমাকে সপ্তাহে ১০০ টাকা দিতেন যাতায়াত ভাড়া আর ৫০০ টাকা দিতেন মাসের অন্যান্য খরচের জন্য। সব মিলিয়ে ৯০০ টাকা। আমার সারা মাসে যাতায়াতে লাগত ৩০০ টাকা।
সরাসরি মিনিবাসে চানখারপুল বা বখশিবাজার যেতে আসতে মিরপুর থেকে দিনে ১০ টাকা। মুড়ির টিন (বড় বাস)-এ চড়লে ৬ টাকা, ছাত্র আইডি কার্ড দেখালে হাফ ভাড়া ৩ টাকা। তাই প্রতিবার মাসের শেষ সপ্তাহের শুরুতে ১০০ টাকা পেলেই আমি চলে যেতাম নিউমার্কেটে। হেঁটে যেতাম যাতে পয়সা বাঁচে, আর জমানো পুরো টাকা দিয়ে বই কিনতাম।
একবার সেরকম বই কিনে পকেটে আছে ১২ টাকা। রিকশা দিয়ে বাড়ী ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন ২য় বর্ষে পড়ি। রিকশাওয়ালা অতিরিক্ত ভাড়া চাইতে থাকায় আমি হেঁটে কলাবাগান চলে আসলাম। কলাবাগান থেকে আমার বাসার রিকশা ভাড়া ছিল আট টাকা। কেন যেন কোন রিকশা সেদিন আর যেতে রাযী হয় না।
আমি রাগ করে হেঁটে চলে এলাম আসাদগেট। এবার একজন রাযী হল যেতে। কিন্তু ভাড়া তখনো বেশী। পকেটের ১২ টাকাই সে চায়, আমি সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই বাড়ী ফিরবো।
ঠিক কলেজ গেট আর শ্যামলীর সংযোগস্থলে আসতেই দেখি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দিনমজুর কাঁদছেন আর বলছেন, ‘আল্লাহ তোমার দুনিয়ায় কি কেউ নেই, যে আমায় একবেলা ভাত খাওয়াতে পারে!’
তার সাথে কথা বলে মনে হ’ল তিনি সত্যি কথা বলছেন। সকালে এসেছিলেন তুরাগ নদীর ওপার থেকে বছিলা হয়ে। দেরী হয়ে যাওয়ায় কাজ পাননি। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘আজকে না খেলে তো কালকেও কাজ করতে পারবো না’।
খাওয়ানোর জন্য উল্টোদিকের হোটেলে তাকে নিয়ে যেতেই বললেন, কই মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। হোটেলওয়ালা বলল, ভাত আর কই মাছ ১২ টাকা দাম। পকেটের সব টাকা দিয়ে তাকে ভাত আর কই মাছ খাওয়ালাম। তিনি হাত তুলে আমার জন্য যে দো‘আ করলেন, তা আমার স্পষ্ট মনে আছে।
‘আল্লাহ, আমার ভাইটার জীবনে যেন কোনদিন ভাতের অভাব না হয়’।
আমি বাকি রাস্তা হেঁটে মিরপুরে আমার বাড়ীতে ফিরলাম।
আমার পকেটে বহুদিন টাকা ফুরিয়ে গেছে। (যখন এভাবে বই বা খেলনা কিনেছি) এমনকি বিদেশেও একবার এমন হয়েছিল। পকেটে টাকা নেই। থাকতে হবে আরো দু’দিন। খিদে লাগার সাথে সাথে কেউ না কেউ, আমাকে খাবার সেধেছে। আমার জীবনে এখনো ভাতের অভাব হয়নি।
সেদিন কেন এতটা পথ হেঁটেছিলাম?
এখন বুঝি , আমি স্বেচ্ছায় হাঁটিনি। সেই দিনমজুরের দো‘আ কবুল হয়েছিল। আমি হেঁটেছিলাম, কারণ আল্লাহ সেদিন আমার মাধ্যমে তাকে ভাত পাঠিয়েছিলেন।
তাকে আরেকবার খুঁজে পেলে আমার জন্য দো‘আ করতে বলতাম।
বলতাম, আল্লাহকে বলেন ভাই! ‘আমার ভাইটা যেন প্রিয় মানুষের ভালবাসার মধ্যে মরতে পারে’।
ডা. আব্দুর নূর তুষার, ঢাকা।