যুবসংঘ : আমার চেতনা, আমার প্রেরণা
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 451 বার পঠিত
দিয়ে পাশেই বসা এক ভদ্র মহিলার সাথে কথা বলে সময় পার করছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বিয়ের কত বছর? বললেন, ২৫ বছর। একটিও সন্তান নেই? না। উত্তর শুনে কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ হয়েছিলাম। বললাম, আপনার স্বামী কোথায়? বলল, নীচে রিসিপশনে গিয়েছে। একটু পর একজন মধ্যবয়স্ক লোকের দিকে ইশারা করে বলল, উনিই আমার স্বামী। মুখ ভর্তি সাদা দাড়ি। আর চুলেও বার্ধক্যের ছাপ।
আমি তখন কিছু সময়ের জন্য আনমনা হয়ে গিয়েছিলাম। ২৫ বছর ধরে এই মানুষ দু’টি একটি সন্তানের আশায় প্রহর গুনছে। তারা কিভাবে দু’যুগেরও অধিক সময় পার করেছে ভেবেই যাচ্ছিলাম। কারণ আমরাও যে এক নিঃসন্তান দম্পতি। আমি তো ৫/৬ বছরে ধরে একটি সন্তানের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছি। কিভাবে সম্ভব এত বছর এভাবে পার করা। ভাবতে ভাবতেই আমার সিরিয়াল আসল। ডাক্তার ছাহেব সব রিপোর্ট দেখে বললেন, অনেক দিন ধরেই তো ট্রিটমেন্ট নিচ্ছেন। বরের রিপোর্ট তো ভাল আসছে না। এই রিপোর্টে বাবা হওয়া সম্ভব নয়। একটা কথা বলি, আপনারা একটা সন্তান দত্তক নেন। কথাটা শুনে আমার ভিতরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে কিছুই বুঝতে দিচ্ছিলাম না।
বাসায় আসলাম। দত্তক নেওয়ার বিষয়টি ভাবলাম। আমি পর্দা করি। ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী চলার চেষ্টা করি। আর ইসলামের নিয়ম অনুযায়ী পালক সন্তান ঔরসজাত সন্তানের মত নয়। প্রাপ্ত বয়স্ক হ’লে তার সাথে পর্দার বিধান প্রযোজ্য হবে। তাই এই চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিলাম।
আমার কোন বোন নেই। ছোট একটি ভাই আছে। একদিন মাকে কল করে কথায় কথায় ছোট ভাইয়ের কথা বললাম, মা ধর, আমার যদি বাচ্চা না-ই হয়, পালক পুত্রও তো আনতে পারব না। কারণ সে বড় হ’লে শারঈ পর্দার কারণে তাকে কাছে রাখতে পারব না। কিন্তু যদি ওর (ছোট ভাই) বিয়ের পর আল্লাহ সন্তান দিলে আমাকে যদি একটা ছেলে সন্তান দেয়, তাহ’লে তো আমি তো তার ফুফু হব। তার সাথে আমার দেখা করা জায়েয। এভাবে আমি ওকে নিজের সন্তানের মত লালন-পালন করে তুলব। কিন্তু ছোট ভাইয়ের মেয়ে হ’লে সে তো বড় হয়ে শারঈ পর্দার কারণে আমার বরের সাথে দেখা করতে পারবে না। আমার মা আমার বাচ্চাসূলভ অদূর ভবিষ্যতের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল, আল্লাহ তোমাকেও সন্তান দিবে মা। তুমি দো‘আ করতে থাক।
ঘটনাটি ২০১৫ সালের। আজ ২০২৩ সালের জুন মাস। ১০ই জুন বিয়ের ১৪ বছর পূর্ণ হবে। বৈবাহিক জীবনের ১৩ টি বসন্ত পার করলাম। আজও আমরা ২ থেকে ৩ হ’তে পারিনি। প্রতিটি মাসেই আশায় থাকি। মাস শেষে সুসংবাদ পাব, কিন্তু না। আমার আশা অপূরণীয়ই থেকে যায়। মাস শেষে সুখবর না পেয়ে পাথর হয়ে যাই। এখন আর হাউমাউ করে কাঁদি না। চোখ দু’টি শুধু ঝাপসা হয়ে আসে। মুখ ফুঁটে কোন আওয়াজ বের হয় না। এই ১৪ বছরে কত ডাক্তার, কত ঔষধ, কত কি কি করেছি, কত টাকা খরচ করেছি তার কোন হিসাব নেই।
জীবনের এই সময় এসে আমার মনে পড়ে সেই মহিলার কথা যে বিয়ের ২৫ বছর পরেও মা হ’তে পারেনি। সেদিন কি আমি ভেবেছিলাম, আমিও ১৪ বছরে সন্তানের মুখ দেখব না। এই ১৪ সংখ্যাটি ভবিষ্যতে কত সংখ্যায় রূপ নেয় সেটাও জানিনা। এটাও জানিনা কতদিন বাঁচব? কিভাবে কাটবে আমার এই নিঃসন্তান জীবন? একাকীত্ব, বিষন্নতা আমাকে কুরে কুরে খায়।
স্বামীর প্রতি আমার বিন্দুমাত্র কোন অভিযোগ নেই। বড্ড ভালবাসি মানুষটাকে। একবার এক ডাক্তার আগেরজনের মতই রিপোর্ট দেখে বলল, নরমালি সম্ভব না। আইভিএফ করেন, হ’লে হ’তেও পারে। আরও কিছু হতাশজনক কথাবার্তা। সেদিন আমার স্বামী আমাকে বলেছিল, তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে? তোমাকে ছাড়া কিভাবে বাঁচব আমি? তবুও তোমার মা ডাক শোনার অধিকার আছে। যদি তুমি অন্যত্র কারও বাহুতলে আবদ্ধ হ’য়ে মা হ’তে চাইলে আমি তোমাকে আটকাবো না। কারণ আমি তোমাকে কখনই কষ্ট দিতে চাই না।
কথাগুলো উনার মুখ থেকে বের হয়ে আমার কলিজাটাকে যেন ছিদ্র করে ফেলল। চোখ দু’টি যেন ঝাপসা হয়ে এল। উনার মুখের দিকে তাকিয়ে উনার হাত দু’টিকে আমার হাতে মুষ্ঠিবদ্ধ করে বললাম, এই চিনলেন আমাকে? এক যুগেরও বেশী সময় পার করলাম একসাথে। এটা সত্য যে আমি সন্তানের মা হ’তে চাই। কিন্তু তার বাবা হবেন আপনি। আমি আপনারই সন্তান গর্ভে ধারণ করতে চাই। আপনাকে ছাড়া আমার পৃথিবীটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। আপনি আমার জন্য আল্লাহর দেয়া এক বিশেষ নে‘মত। সন্তানের জন্য এই নে‘মত আমি হারাতে চাই না।
আমার মা আর ছোট ভাই ছাড়া কোন আত্মীয়-স্বজন জানে না যে, ডাক্তারী হিসাবে আমার স্বামীরই সমস্যা। আর কাউকে জানাতেও চাই না। কিছু কথা গোপন থাক না। যেই মানুষটিকে উন্মাদের মত ভালবেসে হৃদয়ের মণি কোঠায় জায়গা দিয়েছি, তাকে অন্যের সামনে ছোট করতে চাই না। আসলেই মানুষটার প্রতি আমি মুগ্ধ। এই মুগ্ধতায় বিভোর থাকতে চাই আজীবন। এমন নয় যে, উনার সমস্যা বলে উনি আমার প্রতি অমায়িক। কেননা তার সমস্যা তো জানতে পেরেছি ৫/৬ বছর পর। কিন্তু এতগুলি বছর তো আমি মানুষটাকে দেখেছি, তিনি আমাকে কতটা ভালবাসেন।
উনি মসজিদের ইমাম। মসজিদ কমিটির ব্যবস্থাপনায় প্রতিদিন বিভিন্ন বাড়ী থেকে তার খাবার আসত। আর আমি মাদ্রাসায় চাকুরী করতাম। বোর্ডিংয়ের খাবার খাওয়া আমার জন্য কষ্টকর হবে ভেবে নিজের খাবার থেকে বাঁচিয়ে আমার জন্য নিয়ে আসতেন। নিষেধ করলে বলতেন, খাওয়ার সময় তোমার কথা মনে হয়। কি আর করব বল? একদিন এক ছোট্ট ছেলেকে দিয়ে টিফিন পাঠিয়ে দিয়ে কল করে বলছেন, টিফিন খুলে দেখলে বুঝতে পারবা তোমাকে রেখে খাওয়ার সময় আমার কেমন লাগে? আমি টিফিন খুলে দেখলাম কই মাছ ভাজা, আর কি যেন তরকারি তা মনে নেই। কথার মর্ম তেমন কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু যখন মাছ প্লেটে নেওয়ার জন্য হাত দিলাম তখন বুঝলাম। কারণ মাছের এক পিঠ খাওয়া ছিল। আরেক পিঠ তিনি আমার জন্য রেখে দিয়েছেন। অনেক সময় তরকারি, ভাজির মধ্যে ভাত লাগানো দেখতে পেতাম। মানে খাওয়ার জন্য প্লেটে নিয়েও আমার জন্য উঠিয়ে রেখে দিতেন। অনেকের কাছে এই বিষয়গুলো খুব তুচ্ছ। কিন্তু আমি সেই ভাজা মাছেও আমার স্বামীর ভালবাসা খুঁজে পেয়েছি।
এই ১৪টি বছরে আজও কোন কারণে তিনি আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেননি। কখনো গায়ে হাত তুলেন নি। কোন বিষয় নিয়ে আমার রাগ থাকলে, আমি কিছু বললেও তিনি চুপ থেকে আমাকে বুঝান। নিজেকে তিনি দুর্বল ভেবে এমনটি করেন, বিষয়টা এমন নয়। তিনি মানুষটাই এমন। সবাই বলে অনেক ভাগ্য করে নাকি এমন স্বামী পেয়েছি। এই মানুষটার সাথেই বাকী জীবন কাটাতে চাই। তাকে নিয়েই নাতী-নাতনীদের সাথে খেলা করতে চাই। আদৌ আসবে কি সেই দিন? হ’তে পারবো তো এক রত্নগর্ভা জননী?
নির্ঘুম রাত। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে নিঃশব্দে কান্না করার দিন কি কখনও শেষ হবে? একজন নিঃসন্তান নারীর মনের ভিতরে বয়ে যাওয়া যন্ত্রণা বুঝার ক্ষমতা কারও নেই। আমি কল্পনায় আমার সন্তান, আমার মাতৃত্বকে ভেবে যাই প্রতিনিয়ত। কিন্তু বাস্তবতায় যখন ফিরে আসি, তখন তার কোন অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাই না। আমার চারপাশটা ভীষণ রকম একা। বিছানায় নিজের পাশে হাত বুলিয়ে ছোট এক অবুঝ শিশুর হাত-পা নাড়িয়ে খেলা করার দৃশ্য আমি দেখতে পাই। কিন্তু সেটা কল্পনা মাত্র। আমার মাতৃত্ব কল্পনাতেই সুন্দর।
হে কা‘বার মালিক! তুমি চাইলে এই কল্পনা একদিন বাস্তবে রূপ নিতে পারে। এই আশা বুকে নিয়েই দিনগুলো পার করছি। আমি আশাবাদী। আমার প্রভুর আমাকে নিরাশ করবেন না। তিনি তো ঐ প্রভু, যিনি কুমারী মারিয়ামকে পিতা ছাড়া পুত্রের জননী করেছিলেন। নবী ইব্রাহীম ও যাকারিয়া (আঃ)-কে বৃদ্ধ বয়সে সন্তান দিয়েছেন। তুমি তো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। হে দয়াময় প্রভু! তুমি আমাকেও সন্তান দিতে সক্ষম। আমাকে এমন ভাগ্য দান কর, যেন আমার মৃত্যুর পর আমার সন্তান আমার জন্য তোমার দরবারে মাগফেরাতের দো‘আ করতে পারে। আমার জন্য ছাদাকায়ে যারিয়া হ’তে পারে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। সেই দো‘আটির জন্য হ’লেও আমি মা হ’তে চাই।
[সূত্র : ইন্টারনেট]