কোন কোন ব্যক্তি আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়তর (পূর্বে প্রকাশিতের পর)
মিনারুল ইসলাম
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম 722 বার পঠিত
পর্ব ১ ।
৫. আল্লাহর প্রতি সুধারণা পোষণ করা : আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা, ক্ষমাকারী ইত্যাদি। তার প্রতি সুধারণা পোষণ করা যে, তিনি অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং সৎ আমলের পুরস্কার দিবেন। যেমন হাদীছে এসেছে,عَنْ جَابِرٍ، قَالَ: سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَبْلَ وَفَاتِهِ بِثَلَاثٍ، يَقُولُ: لَا يَمُوتَنَّ أَحَدُكُمْ إِلَّا وَهُوَ يُحْسِنُ بِاللهِ الظَّنَّ- জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি নবী করীম (ছাঃ)-এর ইন্তেকালের তিনদিন পূর্বে তাঁকে বলতে শুনেছেন, ‘আল্লাহর প্রতি সুধারণা না রেখে তোমাদের কেউ যেন অবশ্যই মৃত্যুবরণ না করে’।[1]
অপর হাদীছে এসেছে, عَنْ أَنَسٍ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ دَخَلَ عَلَى شَابٍّ وَهُوَ فِي الْمَوْتِ فَقَالَ : كَيْفَ تَجِدُكَ ؟ قَالَ : وَاللهِ يَا رَسُولَ اللهِ إِنِّي أَرْجُو اللهَ وَإِنِّي أَخَافُ ذُنُوبِي فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ يَجْتَمِعَانِ فِي قَلْبِ عَبْدٍ فِي مِثْلِ هَذَا الْمَوْطِنِ إِلاَّ أَعْطَاهُ اللهُ مَا يَرْجُو وَآمَنَهُ مِمَّا يَخَافُ- আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা নবী করীম (ছাঃ) একজন মরণাপন্ন যুবকের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে বললেন, কেমন লাগছে তোমাকে? যুবকটি বলল, আল্লাহর কসম; হে আল্লাহর রাসূল! আমি আল্লাহর (রহমতের) আশাধারী। তবে কৃত পাপের ব্যাপারে ভয় হচ্ছে। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বললেন, এহেন অবস্থায় যে বান্দারই হৃদয়ে আল্লাহর রহমতের আশা ও আযাবের ভয় পাশাপাশি থাকে, সে বান্দাকেই আল্লাহ তার আকাঙ্খিত বস্ত্ত প্রদান করে থাকেন। আর যা সে ভয় করে তা হ’তে তাকে নিরাপত্তা দান করেন’।[2] অন্য হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আমি সেইরূপ, যেরূপ বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি তার সাথে থাকি, যখন যে আমাকে স্মরণ করে। আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবায় তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী খুশী হন, যে তার মরুভূমিতে হারিয়ে যাওয়া বাহন ফিরে পায়। আর যে ব্যক্তি আমার দিকে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। যে আমার দিকে এক হাত পরিমাণ অগ্রসর হয়, আমি তার দিকে দুই হাত পরিমাণ অগ্রসর হই। আর সে যখন আমার দিকে হেঁটে অগ্রসর হয়, আমি তখন তার দিকে দৌড়ে অগ্রসর হই’।[3]
অন্য হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: قَالَ يَقُولُ اللهُ تَعَالَى: أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِيْ بِيْ وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلأٍ ذَكَرتُهُ فِي مَلأٍ خَيْرٍ مِنْهُمْ- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আমি আমার বান্দার ধারণার পাশে থাকি। আর আমি তার সাথে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে। সুতরাং সে যদি তার মনে আমাকে স্মরণ করে, তাহ’লে আমি তাকে আমার মনে স্মরণ করি, সে যদি কোন সভায় আমাকে স্মরণ করে, তাহ’লে আমি তাকে তাদের চেয়ে উত্তম ব্যক্তিদের (ফেরেশতাদের) সভায় স্মরণ করি’।[4]
৬. সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করা : ফরয ইবাদতগুলো সম্পাদন করার পাশাপাশি নফল ইবাদতগুলো পালনের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা করা। আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ- ‘আর প্রত্যেকের জন্য রয়েছে একটি দিক, যেদিকে সে মুখ করে। কাজেই তোমরা সৎকর্ম সমূহের দিকে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাও’ (বাক্বারাহ ২/১৪৮)। তিনি আরো বলেন,وَسَارِعُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ- ‘আর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও। যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য’ (আলে ইমরান ৩/১৩৩)।
অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,سَابِقُوا إِلَى مَغْفِرَةٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَرُسُلِهِ ذَلِكَ فَضْلُ اللهِ يُؤْتِيهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ- ‘তোমরা প্রতিযোগিতা কর তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে। যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার ন্যায়। যা প্রস্ত্তত করা হয়েছে ঐসব লোকের জন্য, যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে আল্লাহ ও তার রাসূলগণের উপর। যেটা আল্লাহর অনুগ্রহ। তিনি এটা দান করেন, যাকে তিনি চান’ (হাদীদ ৫৭/২১)।
আল্লাহ তা‘আলা সৎকর্মে প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি বলেন,وَفِي ذَلِكَ فَلْيَتَنَافَسِ الْمُتَنَافِسُونَ ‘আর এরূপ বিষয়েই প্রতিযোগীদের প্রতিযোগিতা করা উচিত (মুত্বাফফেফীন ৮৩/২৬)। ছাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফগণ কল্যাণের কাজে প্রতিযোগিতা করতেন।
হাদীছে এসেছে, উমর বিন খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, ‘একদা আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে দান করতে আদেশ দিলেন। সে সময় আমার কাছে বেশ কিছু মাল ছিল। আমি মনে মনে বললাম, যদি কোনদিন আবু বকরকে হারাতে পারি, তাহ’লে আজ আমি প্রতিযোগিতায় তাঁকে হারিয়ে ফেলব। সুতরাং আমি আমার অর্ধেক মাল নিয়ে এসে রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে হাযির হলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, (এত মাল!) তুমি তোমার ঘরে পরিজনের জন্য কী রেখে এলে? উত্তরে আমি বললাম, অনুরূপ অর্ধেক রেখে এসেছি। আর এদিকে আবু বকর তাঁর বাড়ির সমস্ত মাল নিয়ে হাযির হলেন। তাকে আল্লাহর নবী জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি তোমার পরিজনের জন্য ঘরে কী রেখে এলে? উত্তরে তিনি বললেন, আমি ঘরে তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি! তখনই মনে মনে বললাম যে, আবু বকরের কাছে কোন প্রতিযোগিতাতেই আমি জিততে পারব না’।[5]
৭. জ্ঞান অর্জনকে পাথেয় হিসাবে গ্রহণ করা : আল্লাহ এবং তার রাসূলের পরিচয় জানা, তাদের আদেশ-নিষেধ জেনে সে অনুযায়ী আমল করার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান অর্জন করা। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ يُرِدِ اللهُ بِهِ خَيْرًا يُفَقِّهْهُ فِى الدِّينِ ‘আল্লাহ যার মঙ্গল চান, তাকেই দ্বীনী জ্ঞান দান করে’।[6] জ্ঞান অর্জন থেকে দূরে অবস্থানকারীদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ- يَعْلَمُونَ ظَاهِرًا مِنَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ عَنِ الْآخِرَةِ هُمْ غَافِلُونَ ‘কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। তারা তো পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিকের সামান্য কিছু বিষয় অবগত। কিন্তু পরকাল বিষয়ে তারা উদাসীন’ (রোম ৩০/৬-৭)। যারা দুনিয়াতে অজ্ঞ থাকবে তারা পরকালেও অজ্ঞ থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلًا ‘বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি ইহকালে অন্ধ, সে ব্যক্তি পরকালেও অন্ধ এবং অধিকতর পথভ্রষ্ট’ (ইসরা ১৭/৭২)।
৮. অছিয়ত করার ক্ষেত্রে অগ্রগামী হওয়া : মৃত্যুর উত্তম প্রস্ত্ততির জন্য অছিয়ত লিখে রাখা অন্যতম মাধ্যম। কারণ কার কখন মৃত্যু চলে আসে তা কেউ জানে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমাদের কারু যখন মৃত্যুকাল উপস্থিত হয়, তখন যদি সে কিছু ধন-সম্পদ ছেড়ে যায়, তবে তার জন্য অছিয়ত করা বিধিবদ্ধ করা হ’ল পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের জন্য ন্যায়ানুগভাবে। এটি আল্লাহভীরুদের জন্য আবশ্যিক বিষয়। অতঃপর যদি কেউ অছিয়ত শোনার পর তা পরিবর্তন করে, তাহ’লে তার গোনাহ তাদেরই হবে, যারা তা পরিবর্তন করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও জানেন (বাক্বারাহ ২/১৮০-৮১)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَا حَقُّ امْرِئٍ مُسْلِمٍ لَهُ شَىْءٌ يُوصِى فِيهِ يَبِيتُ لَيْلَتَيْنِ إِلاَّ وَوَصِيَّتُهُ مَكْتُوبَةٌ عِنْدَهُ- ‘যে মুসলিমের নিকট অছিয়ত করার মত কোন কিছু আছে, তার জন্য দু’রাত কাটানো জায়েয নয়; এমন অবস্থা ছাড়া যে, তার অছিয়ত-নামা তার নিকট লিখিত (প্রস্ত্তত) থাকা উচিত’।[7] মুসলিমের অন্য এক বর্ণনায় তিন রাত কাটানোর কথা রয়েছে। ইবনে উমর (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে যখন থেকে এ কথা বলতে শুনেছি, তখন থেকে আমার উপর এক রাতও পার হয়নি এমন অবস্থা ছাড়া যে আমার অছিয়তনামা আমার নিকট প্রস্ত্তত আছে’।[8]
রাসূল (ছাঃ) অন্যত্র বলেন,إِنَّ اللهَ تَصَدَّقَ عَلَيْكُمْ، عِنْدَ وَفَاتِكُمْ، بِثُلُثِ أَمْوَالِكُمْ، زِيَادَةً لَكُمْ فِي أَعْمَالِكُمْ- ‘তোমাদের মৃত্যুর সময়ও তোমাদের মাল থেকে আল্লাহ তা‘আলা এক-তৃতীয়াংশ অছিয়াত করার অধিকার প্রদান করে তোমাদের নেক আমলের পরিমাণ আরো বাড়ানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন’।[9]
তবে অছিয়ত যেমন ওয়ারিছদের জন্য করা যাবে না, তেমনি যুলুমও করা যাবে না। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ قَدْ أَعْطَى كُلَّ ذِي حَقٍّ حَقَّهُ فَلَا وَصِيَّةَ لِوَارِثٍ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক পাওনাদারকে তার পাওনা দিয়ে দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ারিছের জন্য আর কোন অছিয়ত চলবে না’।[10]
উপসংহার : মৃত্যু এক অনিবার্য সত্য। মৃত্যুক্ষণ যে কার কখন চলে আসে কেউ তা বলতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ- ‘কেউ জানে না কোন মাটিতে তার মৃত্যু হবে’ (লোক্বমান ৩১/৩৪)। এই মৃত্যু থেকে কেউ পালিয়ে বাঁচতেও পারবে না। সুতরাং উত্তম মৃত্যুর জন্য উত্তম প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সকলকে মৃত্যুর জন্য উত্তম প্রস্ত্ততি গ্রহণ করার তওফীক দান করুন।-আমীন!
আব্দুর রহীম
লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
১. মুসলিম হা/২৮৭৭; মিশকাত হা/১৬০৫।
২. তিরমিযী হা/৯৮৩; মিশকাত হা/১৬১২; ছহীহুত তারগীব হা/৩৩৮৩।
৩. মুসলিম হা/২৬৭৫; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৫২।
৪. বুখারী হা/৭৪০৫; মিশকাত হা/২২৬৪।
৫. আবুদাউদ হা/১৬৭৮; তিরমিযী হা/৩৬৭৫; মিশকাত হা/৬০২১।
৬. বুখারী হা/৭১; মুসলিম হা/১০৩৭।
৭. মুসলিম হা/১৬২৭; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪৮২।
৮. বুখারী হা/২৭৩৮; মিশকাত হা/৩০৭০।
৯. ইবনু মাজাহ হা/২৭০৯; ছহীহুল জামে‘ হা/১৭৩৩।
৯. আবুদাউদ হা/২৮৭০; মিশকাত হা/৩০৭৩, সনদ ছহীহ।