আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 295 বার পঠিত
[মাওলানা বেলাল হোসাইন (৬৬) আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য ও পাবনা যেলা ‘যুবসংঘ’, ‘আন্দোলন’-এর সাবেক সভাপতি ও বর্তমানে প্রধান উপদেষ্টা। তিনি পাবনা খয়েরসূতি দারুলহাদীছ রহমানিয়া মাদ্রাসার প্রবীণ শিক্ষক ও দক্ষ মুনাযের। তিনি ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর শুরুকাল থেকে অদ্যাবধি এই আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন এবং দাওয়াতী ময়দানে জিহাদী ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন তাওহীদের ডাক’-এর নির্বাহী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিব।]
১. তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও বংশ পরিচয় সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা বেলাল হোসাইন: আমার জন্ম ১৯৫৭ সালে। আমার পিতার নাম মাওলানা আব্দুল হক হক্কানী। যিনি এক সময় বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক ছিলেন। আমার পিতা মূলত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর স্টেশনের পাশে সোলেডাঙ্গা গ্রামের বাসিন্দা। দেশ ভাগের পূর্বে তিনি করাচী থেকে লেখাপড়া শেষ করেন এবং দেশ ভাগের পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। অতঃপর পাবনার খয়েরসূতিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। মুর্শিদাবাদে আমার পিতার ১ম পক্ষের ৪ পুত্র ও ৩ কন্যা এবং ২য় পক্ষের আমরা ৫ ভাই ৩ বোন। দুই পক্ষের ৯ ভাই ৬ বোন। আলহামদুলিল্লাহ উভয় পক্ষের ভাই-বোনদের মধ্যে এখনও যাতায়াত আছে। আমার ১ ছেলে ৩ মেয়ে। বড় ছেলে দাখিল পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়েছে। এরপর পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে বি.এ পাস করে একটি ঔষধ কোম্পানীতে চাকুরীরত। আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই বিবাহিত।
২. তাওহীদের ডাক :আপনার শিক্ষাজীবন সম্পর্কে কিছু বলুন।
মাওলানা বেলাল হোসাইন: ঢাকার ৮৬, কাযী আলাউদ্দীন রোড সংলগ্ন বাংলা দুয়ার স্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তির মাধ্যমে আমার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। অতঃপর তৃতীয় শ্রেণীতে নিজ গ্রাম খয়েরসূতি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই এবং সেখানেই খয়েরসূতি হাইস্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। এরপর আমার বোনের বাড়ি থেকে নাটোরের খোলাবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৭ম ও ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ি। অতঃপর ঢাকার নাযিরাবাজারের মাদ্রাসাতুল হাদীছের কিতাব বিভাগে ভর্তি হই। সেখানে মীযান, নাহুমীর, হেদায়াতুন্নাহু ইত্যাদি পড়ি। তখন সেখানে মীযান-মুনশায়েব ও নাহুমীরসহ অনেক বই ফার্সী ভাষায় ছিল। স্কুল থেকে আসার কারণে ফার্সী ভাষা আমার জন্য খুবই কঠিন ছিল। ১৯৭৫ সালে মাদ্রাসাটি যাত্রাবাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়। ফলে আমার পিতা আমাকে নারায়ণগঞ্জের পাঁচরুখীতে মাওলানা আলীমুদ্দীন নদীয়াভী ছাহেবের মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন। সেখানকার পরিবেশ আমার অনুকুলে না হওয়ায় ৭৮ উত্তর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ায় ভর্তি হই। এখানে আমার পড়াশোনা ভালই চলছিল। কিন্তু ১৯৭৯ সালে মাদ্রাসা কমিটি হঠাৎ মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করলে শিক্ষকরা চলে যেতে থাকেন। তখন আমি দাওরায়ে হাদীছ শেষ না করেই চলে আসি। অতঃপর রাজবাড়ী যেলার পাংশা ছিদ্দীকিয়া ফাযিল মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং নাটোর যেলার নলডাঙ্গার শাখারীপাড়া মাদ্রাসায় আলিমে ভর্তি হয়েও দুর্ভাগ্যবশত ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। এভাবেই আমার শিক্ষাজীবন শেষ হয়।
৩. তাওহীদের ডাক :আপনি কর্মজীবন কীভাবে শুরু করেছিলেন?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত খয়েরসূতি দারুলহাদীছ রহমানিয়া মাদ্রাসায় ১৯৮১ সালের জানুয়ারীতে যোগদানের মধ্য দিয়ে আমার কর্মজীবন শুরু হয়। আমার পিতাও এই মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। আলহামদুলিল্লাহ প্রায় ৪৩ বছর যাবৎ এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছি।
৪. তাওহীদের ডাক :মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ হয় কীভাবে?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : স্যার সম্পর্কে আমার পিতা ও অন্যান্য ব্যক্তিদের নিকট এমন প্রশংসা শুনতাম যে, তিনি খুবই বিপ্লবী চেতনাসম্পন্ন এবং আপোষহীন মানুষ। তাই কৌতুহলবশত ১৯৭৪ সালে মাদ্রাসাতুল হাদীছে পড়া অবস্থায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে প্রথম দূর থেকে দেখি। এরপর তিনি ১৯৭৭ সালের শেষ দিকে যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসায় তিনি মুহতামিম হিসাবে যোগদান করলে আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করি। এখানে আমি তাঁর কাছে আরবী সাহিত্য ও ফার্সী নাহুমীর পড়েছি।
৫. তাওহীদের ডাক :আপনি যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসার ছাত্র থাকা অবস্থায় ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠন প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : আমীরে জামা‘আত একদিন বললেন, ‘আহলেহাদীছ যুবকরা নিজেদের আত্মপরিচয় ভুলে অন্যের ঘরে বাতি জ্বালাচ্ছে। নামধারী কিছু ইসলামী সংগঠন আমাদের ছেলেদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। তাদের জিহাদী জাযবাকে কাজে লাগিয়ে নানাবিধ শিরক ও বিদ‘আতী কাজে যুক্ত হচ্ছে। এদেরকে ঘরে ফিরিয়ে আনা এবং ঘরের ছেলেদেরকে ঘরে রাখা প্রয়োজন’। এ বিষয়ে তিনি জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আহলেহাদীছ তরুণ ছাত্র ও যুবকদের জন্য একটি বিশুদ্ধ দ্বীনী প্লাটফর্ম গঠনের উদ্যোগ নিলেন। আগের দিন তিনি আমাদের বললেন, ‘আগামীকাল তোমরা সবাই ছিয়াম রাখবে। নফল ছিয়ামের মধ্য দিয়ে আমরা ‘যুবসংঘ’ গঠন করব ইনশাআল্লাহ’। ফলে আমরা মাদ্রাসার অধিকাংশ ছাত্র ছিয়াম রেখেছিলাম।
অতঃপর ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারী রবিবার ৭৮, উত্তর যাত্রাবাড়ী ‘মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া’র জামে মসজিদে বাদ যোহর ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠনের উদ্দেশ্যে স্যারের আহবানে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা হ’তে আগত আহলেহাদীছ যুবকদের একটি বড় ধরনের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সমাবেশে বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছের সেক্রেটারী আব্দুর রহমান বি.এ.বি.টি ও সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সামাদ (কুমিল্লা) সর্বসম্মতিক্রমে আমীরে জামা‘আতকে আহবায়ক ও মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়ার শিক্ষক দেওয়ান হাসান শহীদ (টাঙ্গাইল)-কে যুগ্ম-আহবায়ক করে ৩৩ সদস্যের একটি ‘প্রস্ত্ততি কমিটি’ গঠনের মধ্য দিয়ে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর পথচলা শুরু হয়। আমি ছিলাম সেদিনের চাক্ষুষ স্বাক্ষী। ফালিল্লাহিল হামদ!
৬. তাওহীদের ডাক :আপনি কি তখনই সংগঠনে যুক্ত হয়েছিলেন?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : যখন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ‘যুবসংঘে’র দাওয়াত দিলেন এবং আহলেহাদীছ-এর মূল স্পিরিটটা বুঝালেন, তখন ভাবলাম, আল্লাহ হয়ত আমার ইচ্ছা পূরণ করবেন। অতঃপর শক্তভাবে এই সংগঠনে থাকার সিদ্ধান্ত করলাম। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে আমি সাংগঠনিক কোন দায়িত্বে ছিলাম না। সম্ভবত ১৯৮২ সালে পাবনা যেলা ‘যুবসংঘ’-এর প্রথম সভাপতি হিসাবে মনোনীত হই। ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘আন্দোলন’ প্রতিষ্ঠিত হলে আমীরে জামা‘আত পাবনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রথম সভাপতি হিসাবে আমার বড় ভাই খসরু পারভেযকে মনোনীত করেন। তিনি এখন গাযীপুর (উত্তর) যেলা আন্দোলনের উপদেষ্টা এবং তিনি সেখানেই বসবাস করেন।
অতঃপর ১৯৯৮ সালে পাবনা শহরের নূরপুর গ্রামের হাবীবুল্লাহ ভাই দায়িত্বে আসেন। তাঁর পরে ২০০০ সাল থেকে ২০২১ পর্যন্ত আমি টানা প্রায় ২২ বছর সভাপতি হিসাবে দায়িত্ব পালন করি। বর্তমানে আমি পাবনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রধান উপদেষ্টা। আল্লাহর নিকট কামনা করি তিনি যেন আমৃত্যু বাতিলের বিরুদ্ধে আপোষহীন এই আন্দোলনের সাথে টিকে থাকার তাওফীক দান করেন। আমীন!
৭. তাওহীদের ডাক :আপনার প্রায় পুরা পরিবারই সাংগঠনিকভাবে সচেতন। এটা কিভাবে সম্ভব হ’ল? বিস্তারিত বলবেন কি?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : কথা ঠিক। আমার আববা ছিলেন বাংলাদেশ জমঈয়তে আহলেহাদীছের কেন্দ্রীয় দফতর সম্পাদক। আমার বড় ভাই খসরু পারভেয ছিলেন পাবনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর পরপর দুই সেশনের সভাপতি। তাঁর ছেলে হাতেম বিন পারভেয ছিল গাযীপুর যেলা ‘যুবসংঘ’-এর সভাপতি। সে গত সেশনে ছিল যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাধারণ সম্পাদক। আমার বোন মাহমূদা ‘কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্যা’। ভগ্নিপতি আবুল কালাম আযাদ রাজবাড়ী যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১১ সালের ৩রা মার্চ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাজবাড়ী যেলা সভাপতি এবং ‘কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য’। আমীরে জামা‘আত নিজে গিয়ে তার জানাযা পড়ান। আমার মা ছিলেন আমাদের গ্রামে সার্বক্ষণিক দাওয়াতী কাজ করতেন। ফলে আমরা মূলত পিতা-মাতা সূত্রেই সাংগঠনিক পরিবার।
৮. তাওহীদের ডাক :‘যুবসংঘে’র সাথে জমঈয়তের সম্পর্কহীনতার বিষয়ে কোন ঘটনা যদি বলতেন?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : ‘যুবসংঘ’ প্রথম থেকেই সংস্কারবাদী মনোভাবটা প্রবলভাবে লালন করত। ফলে শিরক-বিদ‘আতের বিরুদ্ধে তারা সর্বদা সোচ্চার ছিল। কিন্তু এতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় রফাদানী আহলেহাদীছরা, যারা স্রেফ রফঊল ইয়াদাইন ছাড়া আহলেহাদীছের কোন চেতনাই ধারণ করত না। বরং তাদের মন ও মস্তিষ্ক তাক্বলীদী চিন্তাধারার মধ্যেই ডুবে ছিল। তৎকালীন জমঈয়তের নেতৃত্ব দিতেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। বিশেষ করে সেসময় জমঈয়তের যেসমস্ত নেতা জামায়াতে ইসলামীর সাথে সম্পৃক্ত ছিল, তারা কখনোই ‘যুবসংঘ’কে বরদাশত করতে পারত না। তাদেরকে জমঈয়তের অন্যান্য নেতাদেরকে কান ভারী করে ‘যুবসংঘে’র বিরুদ্ধে উস্কে দিতে দেখেছি। ‘যুবসংঘে’র অনুষ্ঠান নষ্ট করার জন্য বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র করতে দেখেছি। তবে সাধারণ মানুষ ‘যুবসংঘে’র দাওয়াতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করত এবং ভালবাসত।
এমন অনেক ঘটনাই স্মৃতিপটে রয়েছে। তন্মধ্যে অর্থনৈতিক বিষয়ের একটা ঘটনা স্মরণ করছি। কুয়েত থেকে আগত মেহমানরা ‘যুবসংঘ’-এর দাওয়াতী কাজ দেখে খুশী হয়ে তাদের অগ্রগতির জন্য কিছু অর্থ জমঈয়ত সভাপতি ড. আব্দুল বারী স্যারের কাছে দেন। কিন্তু এ ব্যাপারে ‘যুবসংঘ’-কে কিছু জানানো হয়নি। অনেক দিন পরে কুয়েতী মেহমানরা আবার দেশে আসলে তারা ড. আব্দুল বারী ছাহেব ও আব্দুল মতীন সালাফী ছাহেবের সাথে হোটেল সোনারগাঁওয়ে আলাপকালে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চান। তখন আব্দুল মতীন সালাফী ছাহেব বিষয়টি জানতে পারেন। সে টাকা কোন কাজে লাগানো হয়নি জেনে তখন মেহমানরা উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, কাজ না করলে টাকাগুলো ফেরৎ দেন অথবা কাজ করেন। মেহমানদের প্রশ্নের মুখে ড. আব্দুল বারী ছাহেব লজ্জা পেয়ে যান। তখন আব্দুল মতীন সালাফী ছাহেব ‘যুবসংঘে’র ছেলেদের বললেন, কুয়েতী মেহমানরা কিছু টাকা দিয়ে গেছেন যুবসংঘ-এর কাজ গতিশীল করার জন্য। ড. বারী ছাহেব তো খুব ব্যস্ত মানুষ, তোমরা গিয়ে সেই টাকা দিয়ে কাজ কর।
সেই কথামত ‘যুবসংঘে’র দায়িত্বশীলরা ড. আব্দুল বারী ছাহেবের কাছে গেলে তিনি বলেন, কুয়েতীরা এগুলো ‘শুববান’-এর জন্য দিয়েছে ‘যুবসংঘ’-এর জন্য নয়। ছেলেরা বলেছিল, কেন ‘যুবসংঘ’ই কি শুববান নয়? তিনি বললেন, যুবসংঘ একটা শিরকী নাম, এটি বৌদ্ধ-ভিক্ষুদের ভাষা। অতএব ‘শুববান’ গঠন কর, তাহ’লে এসব টাকা শুববানের কাজের জন্য পাবে।
কিছুদিন পর আমীরে জামা‘আতের অনুপস্থিতিতে জমঈয়তের এক মিটিংয়ে আকস্মিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ‘যুবসংঘে’র সাথে ‘জমঈয়তে’র ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করা হয়। ২৪শে জুলাই ১৯৮৯-এর সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ ৩০/৪৮ সংখ্যায় আমরা এই খবর দেখে হতবাক হয়ে গেলাম। দীর্ঘ প্রায় ১২ বছর ধরে ‘যুবসংঘ’ শিরকী নাম হ’ল না। আজ হঠাৎ করে শিরকী নাম হয়ে গেল! এটা নিয়ে সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে লাগল। সেদিন এই ঘটনায় কিছু মানুষ খুব খুশী হ’লেও যারা যুবসংঘ’-এর শুভাকাঙ্খী ছিলেন, তারা ভীষণ কষ্ট পেয়েছিলেন।
৯. তাওহীদের ডাক : কক্সবাজারে যুবসংঘ-এর উদ্যোগে ত্রাণবিতরণকালে আপনার পিতার মৃত্যু হয়। সেসময় কী ঘটেছিল?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : ১৯৭৮ সালে আমার পিতার মৃত্যুর দিনটি আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা। সেসময় আমরা ‘যুবসংঘ’-এর উদ্যোগে আমীরে জামাআ‘ত স্যারের সাথে ১৯৭৮ সালের ১২ই মে থেকে ২৪শে মে পর্যন্ত ১২ দিন ব্যাপী বার্মা থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে টেকনাফ, নাইক্ষংছড়ি, কুতুপালং প্রভৃতি ক্যাম্পে প্রচুর বৃষ্টি-বাদলের মধ্যে ত্রাণ সাহায্য দিতে গিয়েছিলাম। একদিন বিকালে হঠাৎ আমীরে জামা‘আত আমাকে বললেন, বেলাল কেমন আছ? তাতে আমার সন্দেহ হ’লেও আমীরে জামা‘আত আমার পিতার মৃত্যুর খবর বেমালুম চেপে গেলেন এবং আমাদেরকে ক্যাম্প থেকে নিয়ে আসলেন।
এসময় এক ঘটনা ঘটে। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে ভেসে আসা একটা রূপচাঁদা মাছ আমার লুঙ্গীতে ধরা পড়ে। স্যার বললেন, ওটা তুমি রান্নার তরকারীতে দিয়ে দাও। সেদিন বিকাল ৪টার পর থেকে সমস্ত গাড়ী বন্ধ ছিল। দীর্ঘ অপেক্ষার পর সন্ধ্যার দিকে পুলিশের একটি গাড়ী কক্সবাজারের দিকে যেতে দেখে আমীরে জামা‘আত গাড়ীর সামনে দাঁড়ালেন। কিন্তু গাড়ীতে আমাদেরকে নিতে না চাইলে তিনি জোর করে বললেন, আমাদেরকে নিতেই হবে, সামনে গাড়ী দাঁড় করান। সেদিন স্যারের সাহস দেখে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর গাড়ীতে উঠলাম। কিন্তু গাড়ীর ছাদে ছিদ্র থাকায় বৃষ্টিতে আমরা প্রায় ভিজে গেলাম। অতঃপর কক্সবাজার হোটেল থেকে আমীরে জামা‘আত আমাদেরকে ঢাকায় নিয়ে আসলেন। সাপ্তাহিক ‘আরাফাত’ অফিসে গেলে জমঈয়ত সেক্রেটারী আব্দুর রহমান বি.এ.বি.টি ছাহেব আমাকে ‘আরাফাতে’র একটি সংখ্যা দিলেন। যেখানে আমার পিতার মৃত্যু সংবাদ পেলাম। কিন্তু তাঁর মরা মুখটাও আর দেখার সুযোগ হ’ল না। উনি মৃত্যুর মাসখানেক আগে অসুস্থতার কারণে বাড়ীতে এসেছিলেন। ফলে মৃত্যুর পর তাঁকে নিজ গ্রাম খয়েরসূতি গোরস্থানেই দাফন করা হয়।
১০. তাওহীদের ডাক : আপনি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মধ্যে কী বৈশিষ্ট্য পেয়েছিলেন যে এ সংগঠনকেই আপনার জীবনের অংশ করে নিলেন?
মাওলানা বেলাল হোসাইন : ‘যুবসংঘ’ গঠনের আগের রাতে আমি একটা স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নটাই আমাকে এই সংগঠনের সাথে দৃঢ়ভাবে থাকার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এছাড়াও ‘জমঈয়তে আহলেহাদীসে’র মধ্যে আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি যে, সেখানে বিভিন্ন জাহেলী রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালী ধনী ব্যক্তিদের সমাবেশ। ফলে তাদেরকে একটা আপোষমুখী নীতি নিয়ে চলতে হয়। বলা যায় এটি একটি রফাদানী সমিতিতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একমাত্র আদর্শ ও মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করেছে। যা বাতিলের সাথে কখনই আপোষ করে না। আর এজন্য আমি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’কেই আমার জীবনের অংশ বেছে নিয়েছি।
[আগামী সংখ্যায় সমাপ্য]