কুরআনের আলোকে সুশোভিত জীবন (১ম কিস্তি)

আসাদুল্লাহ আল-গালিব 478 বার পঠিত

উপস্থাপনা : কুরআন এমন এক এলাহী গ্রন্থ যেখানে মানবজীবনে পথচলার সর্ববিষয় উল্লেখ রয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, مَا فَرَّطْنَا فِي الْكِتَابِ مِنْ شَيْءٍ، ‘এই কিতাবে কোন কিছুই আমরা বলতে ছাড়িনি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। নিজের ব্যক্তিজীবনকে পরিশুদ্ধ ও পরিপূর্ণ করতে চাইলে পবিত্র কুরআনে ও হাদীছে বর্ণিত দিক-নির্দেশনাগুলি গ্রহণ করা আবশ্যক। আলোচ্য প্রবন্ধে সেই বিষয়গুলিই আলোকপাত করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।

১. এলাহী বিধান অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা : জীবনকে সুশোভিত করতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত সর্বশেষ এলাহীগ্রন্থ আল-কুরআন এবং ছহীহ সুন্নাহকে ধারণ করতে হবে। নচেৎ পথভ্রষ্ট হয়ে যেতে হবে। আর পথভ্রষ্টরা কখনই হেদায়াতপ্রাপ্ত হয় না। আল্লাহ বলেন,فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيبُوا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُونَ أَهْوَاءَ هُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ- ‘অতঃপর যদি তারা তোমার ডাকে সাড়া না দেয় তবে জেনে রাখ যে, তারা কেবল তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর হেদায়াতকে অগ্রাহ্য করে নিজের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে, তার চাইতে বড় পথভ্রষ্ট আর কে আছে? নিশ্চয়ই আল্লাহ যালেম সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (ক্বছাছ ২৮/৫০)

কুরআনের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখনীঃসৃত হাদীছকেও গ্রহণ করতে হবে। কেননা হাদীছ এক প্রকার অহি যাকে ‘গায়রে মাতলু’ বলে। সেটাও আল্লাহর পক্ষ থেকেই নাযিলকৃত। মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى- إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى ‘তিনি নিজ খেয়াল-খুশীমত কোন কথা বলেন না’। ‘(যা বলেন) সেটি অহি ব্যতীত নয়, যা তার নিকট প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নজম ৫৩/৩-৪)

২. ভুল স্বীকার করে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা : জীবন পরিক্রমায় কখনও কোথাও ভুল হ’লে নিজের ভুল স্বীকার পূর্বক আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। যেমনটি আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর দো‘আ পবিত্র কুরআনে এসেছে,قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ- ‘(তখন) তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এক্ষণে যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহ’লে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (আ‘রাফ ৭/২৩)

আল্লাহ বলেন, قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُنْ مِنَ الْخَاسِرِينَ ‘সে বলল, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি এমন বিষয়ে আবেদন করা থেকে, যে বিষয়ে আমার কোন জ্ঞান নেই। এক্ষণে যদি তুমি আমাকে ক্ষমা না কর এবং আমার প্রতি দয়া না কর, তাহ’লে আমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব’ (হূদ ১১/৪৭)

আল্লাহ আরও বলেন, قَالَ رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي فَاغْفِرْ لِي فَغَفَرَ لَهُ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ ‘সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আমি আমার নিজের উপর যুলুম করেছি। অতএব তুমি আমাকে ক্ষমা কর! তখন আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি তো ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ক্বাছাছ ২৮/১৬)

তিনি আরও বলেন, وَآخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلًا صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ- ‘আরও কিছু লোক রয়েছে, যারা তাদের অপরাধসমূহ স্বীকার করেছে। তারা তাদের কর্মে ভাল ও মন্দ মিশ্রিত করেছে। অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ অতীব ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/১০২)

৩. নিজেকে পাপ-পুণ্যের মানদন্ডে দাঁড় করানো : প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী ওয়াক্বিফহাল। ব্যক্তি তার আমলনামায় কতটুকু পাপ-পুণ্য পরকালের জন্য প্রেরণ করেছে তা সে জানে। তথাপি সে ক্বিয়ামতের দিন সে নানাবিধ অজুহাত পেশ করবে। কিন্তু তার কাজে আসবে না। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,بَلِ الْإِنْسَانُ عَلَى نَفْسِهِ بَصِيرَةٌ-وَلَوْ أَلْقَى مَعَاذِيرَهُ- ‘বরং প্রত্যেক মানুষ নিজের সম্পর্কে ভালো করেই জানে’। ‘যদিও সে (বাঁচার জন্য) নানা অজুহাত পেশ করে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৪-১৫)

পার্থিব জীবনে আমরা আমাদের পিছনের দিকে তাকালেও উপলদ্ধি করতে পারি আমরা কি পাপ-পুণ্য করেছি। সুতরাং মৃত্যুর পূর্বে আমাদের নফসকে পরিশুদ্ধ করতে পারলেই পরকালীন জীবনে সফলকাম হ’তে পারব। আল্লাহ বলেন, قَدْ أَفْلَحَ مَنْ زَكَّاهَا ‘সফল হয় সেই ব্যক্তি, যে তার নফসকে পরিশুদ্ধ করে’ (শামস ৯১/৯)

৪. কোন কিছুর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কল্যাণ ও অকল্যাণ মেনে নেওয়া : অনেক সময় আমরা এমন কিছু পাওয়ার আকাঙ্খা করি, যা না পেলে হতাশ হয়ে যাই। অথচ এই হতাশ হওয়াই তাক্বদীর পরিপন্থী। কেননা তাক্বদীরে যা আছে তা আসবেই। আর তাক্বদীরে না থাকলে সেটা পাওয়া কখনই সম্ভব নয়। সুতরাং কোন কিছুর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির জন্য অসন্তুষ্ট না হয়ে মেনে নিতে হবে। হয়ত আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা এর মধ্যে কল্যাণ রেখেছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ- ‘আর অবশ্যই তোমরা এমন বহু কিছু অপসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। আর অবশ্যই তোমরা এমন বহু কিছু পসন্দ কর, যা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)

বিচ্ছেদের ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ নারীদের প্রতি সহমর্মিতার পরশে তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কল্যাণের বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন,فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْرًا كَثِيرًا ‘যদি তোমরা তাদের অপসন্দ কর, (তবে হ’তে পারে) তোমরা এমন বস্ত্তকে অপসন্দ করছ, যার মধ্যে আল্লাহ প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন’ (নিসা ৪/১৯)

সুতরাং কোন কিছুর প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কল্যাণ ও অকল্যাণ আল্লাহর উপর সোপর্দ করতে হবে। কেননা তিনি বলেন,وَاللهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ ‘বস্ত্ততঃ আল্লাহ সবকিছু জানেন, কিন্তু তোমরা জানো না’ (বাক্বারাহ ২/২১৬)

আমাদের চর্মচক্ষুতে কোন কিছুর মধ্যে অকল্যাণ মনে হ’লেও হয়ত আল্লাহ তার মধ্যে কল্যাণ রেখেছেন। যেমন সূরা কাহফে হযরত মূসা ও খিযিরের ঘটনায় তাঁরা দু’জন যখন সাগরপাড়ে খেলায় রত একদল বালককে দেখলেন। খিযির তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ও বুদ্ধিমান ছেলেটিকে ধরে এনে নিজ হাতে তাকে হত্যা করলেন। এ দৃশ্য দেখে মূসা বললেন, আপনি একটা নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করলেন? এটা অন্যায়। অথচ আল্লাহ এর মধ্যেই প্রভূত কল্যাণ রেখেছিলেন। তিনি বলেন,وَأَمَّا الْغُلَامُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤْمِنَيْنِ فَخَشِينَا أَنْ يُرْهِقَهُمَا طُغْيَانًا وَكُفْرًا- فَأَرَدْنَا أَنْ يُبْدِلَهُمَا رَبُّهُمَا خَيْرًا مِنْهُ زَكَاةً وَأَقْرَبَ رُحْمًا- ‘আর বালকটির বিষয় এই যে, তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, (বড় হয়ে) সে অবাধ্যতা ও কুফরীর মাধ্যমে তাদের উপর যুলুম করবে’। ‘ফলে আমরা চাইলাম যে, তাদের প্রতিপালক তাদেরকে তার পরিবর্তে একটি সন্তান দান করবেন, যে হবে চারিত্রিক পবিত্রতায় উত্তম ও পিতা-মাতার প্রতি অনুগ্রহে ঘনিষ্ঠতর’ (কাহাফ ১৮/৮০-৮১)

৫. নিজের পাপের বোঝা নিজেকেই বহন করতে হবে : মানুষের প্রবৃত্তি সর্বদা তাকে মন্দ কাজের দিকে প্ররোচিত করে থাকে। আল্লাহ বলেন, إِنَّ النَّفْسَ لَأَمَّارَةٌ بِالسُّوءِ ‘নিশ্চয়ই মানুষের প্রবৃত্তি মন্দের প্ররোচনা দেয়’ (ইউসুফ ১২/৫৩)। আর এই প্রবৃত্তির তাড়নায় সে মন্দ কাজ করে থাকে। কিন্তু সে চিন্তা করে না এর পরিণতি। অথচ তার পাপের জন্য তাকেই বোঝা বহন করতে হবে। আল্লাহ বলেন, وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى ‘আর (মনে রেখ) একজনের পাপের বোঝা অন্যজন বহন করবে না’ (যুমার ৩৯/৭)

তথাপি সে যদি চায় তাহ’লে অবশ্যই নিজেকে পাপ থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আল্লাহ বলেন, أَلَّا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى- وَأَنْ لَيْسَ لِلْإِنْسَانِ إِلَّا مَا سَعَى- وَأَنَّ سَعْيَهُ سَوْفَ يُرَى- ثُمَّ يُجْزَاهُ الْجَزَاءَ الْأَوْفَى- ‘আর একের বোঝা অন্যে বহন করবে না। আর মানুষ কিছুই পায় না তার চেষ্টা ব্যতীত। আর তার কর্ম অচিরেই দেখা হবে। অতঃপর তাকে পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে (নাজম ৫৩/৩৩-৪১)। সুতরাং যাদের জন্য পাপ করা হচ্ছে তারা কখনই ক্বিয়ামতের মাঠে পাপের বোঝা বহন করবে না। অতএব সাবধান!

৬. পিতা বা সন্তান পারস্পরিক উপকারী : পারিবারিক বলয়ে কখনও অসুস্থ সন্তান পিতা-মাতার দ্বারা উপকৃত হয়। কখনও অসুস্থ বা বৃদ্ধ পিতা-মাতা সন্তান দ্বারা উপকৃত হন। সুতরাং প্রয়োজনের তাগীদে একে অপরের দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকেন। কুলাঙ্গার সন্তান দ্বারা পিতা-মাতা কখনও নির্যাতনের স্বীকার হন। মহান আল্লাহ বলেন,وَأَمَّا الْغُلَامُ فَكَانَ أَبَوَاهُ مُؤْمِنَيْنِ فَخَشِينَا أَنْ يُرْهِقَهُمَا طُغْيَانًا وَكُفْرًا- ‘আর বালকটির বিষয় এই যে, তার পিতা-মাতা ছিল ঈমানদার। আমি আশংকা করলাম যে, (বড় হয়ে) সে অবাধ্যতা ও কুফরীর মাধ্যমে তাদের উপর যুলুম করবে’ (কাহফ ১৮/৮০)

৭. উত্তম ভাষায় কথা বলা : মানুষের সাথে উত্তম ভাষায় কথা বলা উন্নত ব্যক্তিত্বের ভূষণ। এর মাধ্যমেই ব্যক্তির মাধুর্যতা ফুটে উঠে। ফলে একজন উত্তমভাষী ব্যক্তির সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ হ’লেও কর্কশভাষী ব্যক্তির সাথে তা সম্ভব হয় না। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ)-কে নির্দেশ দিয়ে বলেন, وَقُلْ لِعِبَادِي يَقُولُوا الَّتِي هِيَ أَحْسَنُ (হে নবী!) তুমি আমার বান্দাদের বল, ‘তারা যেন (পরস্পরে) উত্তম কথা বলে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৫৩)। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, وَقُولُوا لِلنَّاسِ حُسْنًا ‘মানুষের সাথে সুন্দর কথা বলবে’ (বাক্বারাহ ২/৮৩)। সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথেও উত্তম ভাষায় কথা বলেতে হবে। ব্যথাতুর হয়ে তাদের সাথে এমন নম্র আচরণ করতে হবে যাতে তারা উহ শব্দটিও না করবে। আল্লাহ বলেন,فَلَا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَّلَا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلًا كَرِيمًا ‘তাদেরকে ধমক দিয়ো না। আর তুমি তাদের সাথে নম্রভাবে কথা বল’ (বনু ইস্রাইল ১৭/২৩)। একইভাবে আল্লাহ পিতা-মাতার সাথে নম্রভাবে কথা বলার পাশাপাশি ফকীর, মিসকীনদের সাথে নম্রভাবে কথা বলতে বলেছেন, যাতে তারা কোন প্রকার কষ্ট না পায়। তিনি বলেন, وَأَمَّا السَّائِلَ فَلَا تَنْهَرْ

‘এবং সাহায্যপ্রার্থীকে ধমকাবে না’ (যোহা ৯৩/১০)

-আসাদুল্লাহ আল-গালিব

সুতরাং উত্তম ভাষায় কথা বলতে পারা একটি মহৎ গুণ। কেননা এই মহৎ গুণ অন্যের ভিতর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা নবী মূসা ও হারূন (আঃ)-কে ফিরআউনের নিকট যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন,فَقُولَا لَهُ قَوْلًا لَيِّنًا لَعَلَّهُ يَتَذَكَّرُ أَوْ يَخْشَى ‘অতঃপর তার সাথে নম্রভাবে কথা বল। হয়ত সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভয় করবে’ (ত্বোয়াহা ২০/৪৪)। সুতরাং নম্র ও উত্তম ভাষী হ’লে যেমন সাধারণ মানুষের মণিকোঠায় জায়গা হবে। তদ্রুপ পরকালীন জীবনে জান্নাতের পথও সুগম হবে।

৮. উত্তম পন্থায় বিতর্ক করা : কখনও যদি কারো সাথে বিতর্কের প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রেও উত্তম পন্থায় বিতর্ক করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَلاَ تُجَادِلُوا أَهْلَ الْكِتَابِ إِلاَّ بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ ‘আর কিতাবধারীদের সাথে তোমরা বিতর্ক করোনা উত্তম পন্থায় ব্যতীত। তবে তাদের মধ্যে যারা (তোমাদের উপর) যুলুম করে (তারা ব্যতীত) (আনকাবুত ২৯/৪৬)। তবে বির্তক এগিয়ে চলাই শ্রেয়। আল্লাহ বলেন, وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلَامًا ‘এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)

৯. পারস্পরিক সদাচরণ ভুলে না যাওয়া : ইসলাম এক ভ্রাতৃপ্রতীম ধর্ম। এতে পারস্পরিক সহমর্মিতা, সদাচরণ সর্বাবস্থায় বজায় রাখতে হবে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে যেন পারস্পরিক সদাচরণ যেন ভুলে না যাওয়া হয় সে বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَإِنْ طَلَّقْتُمُوهُنَّ مِنْ قَبْلِ أَنْ تَمَسُّوهُنَّ وَقَدْ فَرَضْتُمْ لَهُنَّ فَرِيضَةً فَنِصْفُ مَا فَرَضْتُمْ إِلَّا أَنْ يَعْفُونَ أَوْ يَعْفُوَ الَّذِي بِيَدِهِ عُقْدَةُ النِّكَاحِ وَأَنْ تَعْفُوا أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى وَلَا تَنْسَوُا الْفَضْلَ بَيْنَكُمْ إِنَّ اللهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘আর যদি তোমরা তাদেরকে স্পর্শ করার পূর্বেই তালাক দিয়ে থাক এবং তাদের জন্য মোহর নির্ধারণ করে থাক, তবে তাদেরকে নির্ধারিত মোহরের অর্ধেক প্রদান কর। অবশ্য যদি স্ত্রীরা মোহর মাফ করে দেয় অথবা যার হাতে বিবাহের বন্ধন সেই স্বামী যদি মার্জনা করে। তবে মার্জনা করাটাই তাক্বওয়ার অধিক নিকটবর্তী। তোমরা পরস্পরের প্রতি সদাচরণকে ভুলে যেয়োনা। নিশ্চয়ই তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/২৩৭)

১০. পারস্পরিক মীমাংসা করে নেওয়া : পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক সময় মতপার্থক্যের কারণে দূরত্ব তৈরী হয়। আর এই দূরত্ব যতদূর সম্ভব মীমাংসার মাধ্যমে মিটিয়ে নেওয়া উত্তম। নিম্নোক্ত আয়াতে মহান আল্লাহ স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করে নেওয়া সম্পর্কে বলেন,وَإِنِ امْرَأَةٌ خَافَتْ مِنْ بَعْلِهَا نُشُوزًا أَوْ إِعْرَاضًا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يُصْلِحَا بَيْنَهُمَا صُلْحًا وَالصُّلْحُ خَيْرٌ وَأُحْضِرَتِ الْأَنْفُسُ الشُّحَّ وَإِنْ تُحْسِنُوا وَتَتَّقُوا فَإِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرًا ‘যদি কোন স্ত্রী তার স্বামী থেকে দূরত্ব ও উপেক্ষার আশংকা করে, তাহ’লে তারা পরস্পরে কোন সমঝোতায় উপনীত হ’লে, তাতে কোন দোষ নেই। আর মীমাংসাই উত্তম। (যদিও) মানুষ স্বভাবতঃ কৃপণ। তবে যদি তোমরা সদাচরণ কর এবং সংযমী হও, তাহ’লে জেনে রেখ আল্লাহ তোমাদের সকল কৃতকর্ম বিষয়ে অবগত’ (নিসা ৪/১২৮)

আর এই ক্ষেত্রে (স্বামী-স্ত্রী) উভয় পক্ষ থেকে একজন করে মীমাংসার জন্য কাজ করবেন। আল্লাহ চাইলে উভয়ের মধ্যে মীমাংসা হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,وَإِنْ خِفْتُمْ شِقَاقَ بَيْنِهِمَا فَابْعَثُوا حَكَمًا مِنْ أَهْلِهِ وَحَكَمًا مِنْ أَهْلِهَا إِنْ يُرِيدَا إِصْلَاحًا يُوَفِّقِ اللهُ بَيْنَهُمَا إِنَّ اللهَ كَانَ عَلِيمًا خَبِيرًا ‘আর যদি তোমরা (স্বামী-স্ত্রী) উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশংকা কর, তাহ’লে স্বামীর পরিবার থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন শালিস নিযুক্ত কর। যদি তারা উভয়ে মীমাংসা চায়, তাহ’লে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে (সম্প্রীতির) তাওফীক দান করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও তোমাদের সকল বিষয়ে অবগত’ (নিসা ৪/৩৫)

সুতরাং একজন পূর্ণ মুমিনের জন্য পারস্পরিক কলহ মিটিয়ে নেওয়া অতীব যরূরী। আল্লাহ বলেন,فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ- ‘অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)

১১. মীমাংসা করে দেওয়া : মীমাংসা করে দেওয়া একটি মহৎগুণ। যারা ন্যায়সঙ্গতভাবে উভয়পক্ষের মাঝে মীমাংসা করে দিবেন তাদের জন্য রয়েছে মহান পুরস্কার। মহান আল্লাহ বলেন,لَا خَيْرَ فِي كَثِيرٍ مِنْ نَجْوَاهُمْ إِلَّا مَنْ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوْ مَعْرُوفٍ أَوْ إِصْلَاحٍ بَيْنَ النَّاسِ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ مَرْضَاتِ اللهِ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا ‘তাদের অধিকাংশ শলা-পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই। তবে যে পরামর্শে তারা মানুষকে ছাদাক্বা করার বা সৎকর্ম করার কিংবা লোকদের মধ্যে পরস্পরে সন্ধি করার উৎসাহ দেয় সেটা ব্যতীত। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে সেটা করে, নিশ্চয়ই আমরা তাকে মহা পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নিসা ৪/১১৪)

(ক্রমশঃ)


[কেন্দ্রীয় ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]



বিষয়সমূহ: কুরআন
আরও