ইসলামের প্রথম সমাচার (২য় কিস্তি)
আসাদ বিন আব্দুল আযীয
আশরাফুল ইসলাম 472 বার পঠিত
উপস্থাপনা : জানাযার ছালাতে প্রথম তাকবীরের পর ছানা পড়ার বিশুদ্ধ কোন দলীল পাওয়া না গেলেও অনেক সমাজে তা পড়া হয়। আবার সূরা ফাতিহা পড়ার দলীল থাকা সত্ত্বেও তা পড়া হয় না। অথচ রাসূল (ছাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন বাণী রয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার ছালাত হ’ল না’।[1] প্রথম কথা হ’ল জানাযা হ’ল ছালাতের নাম যা মৃত ব্যক্তির জন্য অন্যরা আদায় করে। যা অন্য ছালাতের মত না, এই ছালাতে কোন আযান, ইক্বামত, রুকু বা সিজদাহ ও তাশাহুদ নেই। তবুও এর নাম ছালাত। যেমনটা ইমাম বুখারী (রহঃ) ‘জানাযার ছালাতের নিয়ম’ অনুচ্ছেদে বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,صَلُّوا عَلَى النَّجَاشِيِّ ‘তোমরা তোমাদের সঙ্গীর জন্য (জানাযার) ছালাত আদায় কর’। অতঃপর তিনি বলেন, سَمَّاهَا صَلاَةً لَيْسَ فِيهَا رُكُوعٌ وَلاَ سُجُودٌ وَلاَ يُتَكَلَّمُ فِيهَا وَفِيهَا تَكْبِيرٌ وَتَسْلِيمٌ ‘নবী করীম (ছাঃ) একে ছালাত বলেছেন, অথচ এর মধ্যে রুকূ ও সিজদাহ নেই এবং এতে কথা বলা যায় না, এতে রয়েছে তাকবীর ও তাসলীম’।[2] নিম্নে যারা জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়েন না তাদের দলীল ও তার জবাব দেওয়ার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
দলীল-১ :عَنْ نَافِعٍ أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ لَا يَقْرَأُ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجَنَازَة- নাফে‘ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) জানাযার ছালাতে কোন ক্বিরাআত পড়তেন না’।[3]
জবাব : প্রথমত এখানে ছানা পড়ার কোন দলীল নেই। তবে এই বর্ণনায় কয়েকটি উদ্দেশ্য হ’তে পারে। (১) তিনি জানাযার ছালাতে ‘পড়েন নি’ দ্বারা সূরা ফাতিহা, না কুরআনের অন্য কোন সূরা তা স্পষ্ট নয়। (২) এই হাদীছ দ্বারা রাসূল (ছাঃ) জানাযায় সূরা ফাতিহা পড়তেন না এমনটিও প্রমাণিত নয়। বরং এটি ইবনু ওমরের ব্যক্তিগত আমল। (৩) তিনি প্রত্যেক তাকবীরের পরে সূরা ফাতিহা পড়তেন না। এমনটিও হ’তে পারে। যেমনটা ইমাম মাকহুল প্রথম দুই তাকবীরের পরে সূরা ফাতিহা পড়তেন এবং ইমাম হাসান বছরী প্রত্যেক তাকবীরের পরে সূরা ফাতিহা পড়তেন’।[4]
উপরন্তু এটি না বোধক দলীল। আর উসূল হ’ল হ্যাঁ বোধক না বোধকের উপরে প্রধান্য পাবে’।[5] আরও উসূল হ’ল স্পষ্ট সুন্নাহর কাছে ছাহাবীর কথা, কাজের কোন মূল্য নেই’।[6]
দলীল-২:عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْمَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِيهِ أَنَّهُ سَأَلَ أَبَا هُرَيْرَةَ كَيْفَ تُصَلِّي عَلَى الْجَنَازَةِ؟ فَقَالَ أَبُو هُرَيْرَةَ: أَنَا، لَعَمْرُ اللَّهِ أُخْبِرُكَ. أَتَّبِعُهَا مِنْ أَهْلِهَا. فَإِذَا وُضِعَتْ كَبَّرْتُ، وَحَمِدْتُ اللَّهَ. وَصَلَّيْتُ عَلَى نَبِيِّهِ ثُمَّ أَقُولُ: اللَّهُمَّ إِنَّهُ عَبْدُكَ... আবু সাঈদ মাকবুরী (রহঃ) তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, তার পিতা জানাযার ছালাত কিভাবে পড়বেন তা আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আল্লাহর কসম, আমি তোমাকে (তার নিয়ম) জানাব। আমি মৃত ব্যক্তির পরিবার-পরিজন হ’তে জানাযার সাথে চলি। জানাযা যখন রাখা হয়, আমি তখন তাকবীর বলি এবং আল্লাহর হামদ ও তার নবীর উপর দরূদ পাঠ করি। তারপর বলি, আল্লাহুম্মা ইন্নাহু আব্দুকা...।[7]
জবাব : প্রথমত এখানেও সুবহানাকা আল্লাহুম্মা...ছানা পড়ার কোন স্পষ্ট দলীল নেই। এখানে হামদ বলতে আবু হুরায়রা (রাঃ) সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্য কিছুই বোঝাননি (মুসলিম হা/৩৯৫)। আর সূরা ফাতিহার চেয়ে বড় হামদ আর কিংবা হ’তে পারে? এই হাদীছে সূরা ফাতিহা না পড়ার বিষয়ও স্পষ্ট নয়, যেমনটি এই হাদীছে একটি তাকবীরের কথায় উল্লেখ আছে। বাকী তাকবীরগুলো কি তাহ’লে দেওয়া লাগবে না? আবার শেষে সালামের কথাও উক্ত হাদীছে নেই, তাহ’লে কি সালাম ছাড়াই জানাযা শেষ হবে? যেখানে অন্য ছাহাবীগণ স্পষ্ট প্রথম তাকবীরের পরে সূরা ফাতিহা পড়া ও অন্যান্য বিষয়গুলো বলেছেন।
দলীল-৩ :عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: لَمْ يُوَقَّتْ لَنَا فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْمَيِّتِ قِرَاءَةٌ وَلَا قَوْلٌ، ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (ছাঃ) আমাদের জন্য জানাযার ছালাতে কোন ক্বিরাআত ও দো‘আ নির্ধারণ করেননি’।[8]
জবাব : ইবনু মাসঊদ (রাঃ) নিজেই জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়তেন’।[9] তাহ’লে এটা স্পষ্ট যে, কোন ক্বিরাআত নির্দিষ্ট করেননি বলতে ফাতিহা ছাড়া অন্য কোন ক্বিরাআত নির্দিষ্ট করেননি। কেননা রাসূল (ছাঃ)-এর কথা ছাহাবীর থেকে ভাল কে বুঝবে?
ইমাম আবু মুহাম্মাদ ইবনু হাযম (রহঃ) বলেছেন,لَيْسَ عَنْ وَاحِدٍ مِنْ هَؤُلَاءِ أَنَّهُ قَالَ: لَا يَقْرَأُ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ- ‘কোন একজন ছাহাবী থেকে এটি স্পষ্ট প্রমান নেই যে, তিনি বলেন, জানাযাতে উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়েননি’।[10]
তিনি আরও বলেন,وَنَعَمْ، نَحْنُ نَقُولُ: لَا يُقْرَأُ فِيهَا بِشَيْءٍ مِنْ الْقُرْآنِ إلَّا بِأُمِّ الْقُرْآنِ- ‘আর হ্যাঁ আমরা এটা বলছি, জানাযাতে কুরআনের অন্য কোন সূরা পড়া হ’ত না, ফাতিহা ছাড়া’।[11] অর্থাৎ ছাহাবীদের বিষয়ে যে সকল আছার বর্ণিত হয়েছে যে, তাঁরা কেনা‘ ক্বিরাআত করতেন না, এখানে কোন ক্বিরাআত বলতে উদ্দেশ্য হ’ল সূরা ফাতিহা ছাড়া অন্যান্য ক্বিরাআত করতেন না।
দলীল-৪ :عن أبىِ هريرةَ، سمعتُ النبي صلَّى الله عليه وسلم يقول إذا صلَّيتُم على الميِّتِ فأخلِصُوا له الدعاء- আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘তোমরা জানাযার ছালাত আদায়ের সময় মৃত ব্যক্তির জন্য খালেছ অন্তরে দো‘আ করবে’।[12]
জবাব : এই হাদীছের ব্যাখ্যাতে হানাফী ইমাম মুফতি তাকী উছমানী লিখেছেন, حنفیہ کی دلیل میں عموماً ابو داود کی اک حدیث پیش کی جاتی ہے ، إذا صليت على الميت فأخلصوا له الدعا، لیکن اس سے استدلال درست نہیں کیو نکہ اس کا مطلب اخلاص کے ساتھ دعا کرنا ہے نہ کہ فاتحہ نہ پڑھی جائے۔ ‘হানাফীদের দলীল হিসেবে আবু দাউদের একটি হাদীছ পেশ করা হয়ে থাকে, আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, যখন তোমরা কোন মৃতের জানাযার ছালাত পড়, তখন তার জন্য ইখলাছের সাথে দো‘আ কর। কিন্তু এই বিষয়ে এই হাদীছের দলীল দেওয়া ঠিক না। কেননা এই হাদীছের উদ্দেশ্য হচ্ছে ইখলাছের সাথে দো‘আ করা, ফাতিহা না পড়া উদ্দেশ্য না’।[13]
ইমাম ইবনু হাযম (৩৮৪-৪৫৬ হি.) এই হাদীছের বিষয়ে বলেছেন,لَوْ صَحَّ لَمَا مَنَعَ مِنْ الْقِرَاءَةِ، لِأَنَّهُ لَيْسَ فِي إخْلَاصِ الدُّعَاءِ لِلْمَيِّتِ نَهْيٌ عَنْ الْقِرَاءَةِ، وَنَحْنُ نُخْلِصُ لَهُ الدُّعَاءَ وَنَقْرَأُ كَمَا أُمِرْنَا ‘যদি এই হাদীছ ছহীহও হয়, তবুও এই হাদীছ সূরা ফাতিহা পাঠ (ক্বিরাআত করতে) নিষেধ করে না। কেননা মৃতের ইখলাছের সাথে দো‘আ করা অর্থ ক্বিরাআত করা নিষেধ নয়। আমরা ইখলাছের সাথে দো‘আ করি আবার ক্বিরাআত পাঠ করি, ঠিক যেভাবে আমাদেরকে আদেশ করা হয়েছে’।[14]
দলীল-৫ : ইমাম ত্বাহাবী (রহঃ) লিখেছেন,من قرأها من الصحابة يحتمل أن يكون على وجه الدعاء لا التلاوة- ‘ছাহাবীদের যারা সূরা ফাতিহা পড়েছেন, সম্ভবত তারা দো‘আর নিয়তে পড়েছেন, তিলাওয়াতের নিয়তে না’।[15]
জবাব : এর জবাবে শুধুমাত্র দুইজন ইমামের কথা তুলে ধরা হ’ল, (১) ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেছেন, وفيه أن هذا ادعاء محض لا دليل عليه، واحتمال ناشيء من غير دليل، فلا يلتفت إليه- ‘এখানে এগুলো হ’ল বিশুদ্ধ দাবী মাত্র, যার কোন দলীল নেই, আর সম্ভাবনা তো হ’ল দলীল ছাড়াই উদ্ভাবন, এদিকে ভ্রক্ষেপ করার কোন দরকার নেই’।[16]
(২) ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ) বলেছেন,مَنْ قَالَ: لَعَلَّهُمْ قَرَءُوهَا عَلَى أَنَّهَا دُعَاءٌ كَذِبٌ بَحْت- ‘যে ব্যক্তি বলেছে, সম্ভবত তা দো‘আর নিয়তে পড়েছে, এটি মিথ্যা অপবাদ।’[17]
সূরা ফাতিহা না পড়ার বিষয়ে স্পষ্ট কোন দলীল নেই। আর ছানা পড়ার বিষয়ে কোন জাল হাদীছও নেই। ছানা পড়ার এই রীতি চলছে সম্পূর্ণ ক্বিয়াসের উপর নির্ভর করে। ছহীহ বুখারীর স্পষ্ট হাদীছ থাকার পরে এসব ক্বিয়াসের কিইবা মূল্য থাকতে পারে? যেমনটি উল্লেখ করেছেন, তুহফাতুল আহওয়াযী লেখক ইমাম আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ), আহকামুল জানায়েযের মধ্যে ইমাম আলবানী (রহঃ) প্রমুখগণ।
ইমাম বুখারী (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থে অনুচ্ছেদ রচনা ও হাদীছ চয়ন : হাদীছ শাস্ত্রের সম্রাট ইমামুল মুহাদ্দিছীন আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী ছহীহ বুখারীতে অধ্যায় রচনা করেছেন, بَاب قِرَاءَةِ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ عَلَى الْجَنَازَة ‘জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করা’।[18]
আর তিনি প্রথমে এনেছেন,عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَوْفٍ قَالَ صَلَّيْتُ خَلْفَ ابْنِ عَبَّاسٍ عَلَى جَنَازَةٍ فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ قَالَ لِيَعْلَمُوا أَنَّهَا سُنَّةٌ- তালহা ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি ইবনু আববাস (রাঃ)-এর পিছনে জানাযার ছালাত আদায় করলাম। তাতে তিনি সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন এবং (ছালাত শেষে) বললেন, (আমি সূরা ফাতিহা পাঠ করলাম) যাতে লোকেরা জানতে পারে যে, এটা সুন্নাত’।[19] আর ছাহাবী যখন কোন বিষয়কে সুন্নাহ বলেন, তা মূলত রাসূল (ছাঃ)-এরই সুন্নাহ উদ্দেশ্য হয়ে থাকে’।[20]
এই হাদীছের ব্যাখ্যায় হানাফী মাযহাবের অনুসারী তাকী ওসমানী বলেছেন, اور صحابی جب کسی عمل کو سنت کہے تو وہ حدیث مرفوع ہوتی ہے اور اس لئے اس کی جو تاویلات کی گئی ہیں وہ سب کمزور ہیں اور یہ حدیث بہت سی احادیث مرفوعہ سے مؤید ہے۔ ‘আর ছাহাবী যখন কোন আমলকে সুন্নাত বলে, তখন সেই হাদীছ মারফূ হয়ে যায়, আর এজন্য এই হাদীছের বিপক্ষে যত ব্যাখ্যা করা হয়েছে সব দুর্বল। আর এই হাদীছটি আরও অনেক মারফূ হাদীছ দ্বারা শক্তিশালী’।[21]
এই হাদীছ উল্লেখ করার পরে ইমাম ছান‘আনী (মৃত ১১৮২ হি.) লিখেছেন,والحديثُ دليلٌ على وجوب قراءةِ الفاتحةِ في صلاةِ الجنازةِ ‘এই হাদীছ জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ ওয়াজিব হওয়ার দলীল’।[22]
ইমাম তিরমিযী (রহঃ) স্বীয় গ্রন্থে অনুচ্ছেদ রচনা : ইমাম বুখারী (রহঃ)-এর ন্যায় সুনানুল আরবা‘আর অন্যতম লেখক আবু ঈসা মুহাম্মদ ঈসা ইবনু তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হি./৮২৪-৮৯২খৃ.) তিনি স্বীয় গ্রন্থে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, باب مَا جَاءَ فِي الْقِرَاءَةِ عَلَى الْجَنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়ার বিষয়ে যা বর্ণনা’। আর তিনি প্রথম হাদীছ এনেছেন,عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَرَأَ عَلَى الجَنَازَةِ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ- ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, জানাযার ছালাতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা ফাতিহা পাঠ করেছেন’।[23]
অতঃপর তিনি ২য় হাদীছ এনেছেন,عَنْ طَلْحَةَ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَوْفٍ، أَنَّ ابْنَ عَبَّاسٍ، صَلَّى عَلَى جَنَازَةٍ، فَقَرَأَ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ، فَقُلْتُ لَهُ، فَقَالَ: إِنَّهُ مِنَ السُّنَّةِ، أَوْ مِنْ تَمَامِ السُّنَّةِ- তালহা ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু আওফ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে, ইবনু আববাস (রাঃ) এক মৃত ব্যক্তির জানাযা আদায় করলেন এবং তাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করলেন। তাকে এ প্রসঙ্গে আমি প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, এটা সুন্নাত অথবা সুন্নাতের পূর্ণতা দানকারী’।
অত্র হাদীছ উল্লেখ করার পর ইমাম তিরমিযী বলেন, هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ، وَالعَمَلُ عَلَى هَذَا عِنْدَ بَعْضِ أَهْلِ العِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَغَيْرِهِمْ: يَخْتَارُونَ أَنْ يُقْرَأَ: بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ بَعْدَ التَّكْبِيرَةِ الأُولَى، وَهُوَ قَوْلُ الشَّافِعِيِّ، وَأَحْمَدَ، وَإِسْحَاقَ ‘এই হাদীছটি হাসান ছহীহ। এই হাদীছ অনুযায়ী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একদল বিশেষজ্ঞ ছাহাবী ও অপরাপর আলিমগণ আমল করেছেন। জানাযার ছালাতে প্রথম তাকবীর পাঠ করার পর সূরা ফাতিহা পাঠকে তারা পছন্দ করেছেন। এই মত ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাকেরও।[24]
অন্যত্র এসেছে,عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، أَنَّهُ قَالَ السُّنَّةُ فِي الصَّلاَةِ عَلَى الْجَنَازَةِ أَنْ يَقْرَأَ فِي التَّكْبِيرَةِ الأُولَى بِأُمِّ الْقُرْآنِ مُخَافَتَةً ثُمَّ يُكَبِّرَ ثَلاَثًا وَالتَّسْلِيمُ عِنْدَ الآخِرَةِ- আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, জানাযার ছালাতে সুন্নাত হ’ল প্রথম তাকবীর চুপেচুপে সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করবে। অতঃপর আরো তিনটি তাকবীর দিবে; শেষ তাকবীরে সালাম ফিরাবে’।[25] বুখারী, মুসলিমের শর্তে হাদীছটি ছহীহ। আলবানী ও শু‘আইব আরনাউত্ব ও জুবায়ের আলী যাঈ (রহঃ) হাদীছটির সনদ ছহীহ বলেছেন।
এছাড়াও রাসূল (ছাঃ)-এর আম হাদীছ সূরা ফাতিহা ছাড়া ছালাত নেই’।[26] আর জানাযাও একটি ছালাত। যেমনটি ইবনু ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, ‘জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়া রুকন। নবী করীম (ছাঃ)-এর এ কথার জন্য যে, لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘যে ব্যক্তি ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার ছালাত হ’ল না’। আর ছালাতুল জানাযা হ’ল ছালাত। যেমন আল্লাহ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে বলেছেন, وَلَا تُصَلِّ عَلَى أَحَدٍ مِنْهُمْ مَاتَ أَبَدًا، ‘তাদের কেউ মারা গেলে তুমি কক্ষণই তাদের জন্য ছালাত পড়বে না’ (তওবা ৫/৮৪)। আল্লাহ তা‘আলাও এর নাম বলেছেন, ছালাত’।[27]
ছাহাবীদের মধ্যে ইবনু আববাস, মিসওয়ার, যাহহাক ইবনু কায়েস, আবু দারদা, ইবনু মাসঊদ ও আনাস (রাঃ)।[28] ইবনু যুবায়ের ও উবাইদ ইবনু উমাইর (রাঃ) প্রমূখ সূরা ফাতিহা পড়তেন বলে প্রমাণিত’।[29]
বিখ্যাত তাবেঈ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (১৫-৯৪ হি.) বলেন, السُّنَّةُ فِي الصَّلَاةِ عَلَى الْجَنَائِزِ أَنْ تُكَبِّرَ، ثُمَّ تَقْرَأَ بِأُمِّ الْقُرْآنِ ثُمَّ تُصَلِّيَ عَلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم ثُمَّ تُخْلِصَ الدُّعَاءَ لِلْمَيِّتِ، ‘জানাযার ছালাতে সুন্নাত হ’ল, তুমি তাকবীর দিবে অতঃপর উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়বে। তারপর নবী করীম (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করবে এরপরে তুমি মাইয়েতের জন্য ইখলাছের সাথে দো‘আ করবে’।[30]
মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব (মৃ. ১২৪ হি.) বলেন, القراءة على الميت في الصلاة في التكبيرة الأولى ‘মাইয়েতে জন্য ছালাতে প্রথম তাকবীরেই ক্বিরাআত পড়তে হয়’।[31] ইমাম মুজাহিদ (২১-১০৪ হি.) বলেছেন, ‘জানাযার ছালাতে তাকবীর দিবে। অতঃপর উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) পড়বে। তারপর নবী করীম (ছাঃ)-এর উপরে দরূদ পাঠ করবে অতঃপর তিনি দো‘আর কথা উল্লেখ করেন’।[32]
মিশকাতুল মাছাবীহ এর বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ মির‘আতুল মাফাতীহ এর লেখক ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, والحق والصواب أن قراءة الفاتحة في صلاة الجنازة واجبة، كما ذهب إليه الشافعي وأحمد وإسحاق وغيرهم؛ ‘হক এবং সঠিক কথা হ’ল, জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব, যেমনটি ইমাম শাফেঈ, আহমাদ, ইসহাক ও
অন্যান্যরা বলেছেন’।[33] শায়েখ মুহাম্মদ ইবনে ছালেহ আল ওছায়মীন (রহঃ) বলেছেন, والفاتحة في صلاة الجنازة ركن জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়া হ’ল রুকন’।[34] শায়েখ বিন বায (রহঃ) বলেছেন, জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পড়া ওয়াজিব’।[35]
আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী হানাফী (রহঃ) লিখেছেন,وهي جائزة عندنا أيضًا ‘আমাদের নিকটেও সূরা ফাতিহা পড়া জায়েয’।[36] মুহাম্মাদ নুরুদ্দীন সিন্ধী হানাফী (রহঃ) লিখেছেন, ينبغي أن تكونَ الفاتحةُ أولى وأحْسنَ من غيرها من الأدعية، ولا وَجْه للمَنْع عنها ‘অন্যান্য দো‘আর চেয়ে ফাতিহা পড়ায় বেশী ভাল, বেশী উত্তম, এটি থেকে নিষেধের কোন কারণ নেই’।[37]
পরিশেষে বলব, সূরা ফাতিহা হ’ল একটি শ্রেষ্ঠ দো‘আ। যদি ধর্মীয় গোঁড়ামী বাদ দিয়ে এই সূরাটির অর্থ ও মর্ম বুঝার চেষ্টা করি, তাহ’লে এই সূরাটিই আমাদের দো‘আ কবুলের অন্যতম মাধ্যম ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির অসীলা হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলা আমাদের সকলকে বিশুদ্ধ দ্বীন জানার ও তা মেনে চলার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
আশরাফুল ইসলাম
দক্ষিণ শালিকা, মেহেরপুর।
[1]. বুখারী হা/৭৫৬; মুসলিম হা/৩৯৪; মিশকাত হা/৮২২।
[2]. ছহীহুল বুখারীর পরিচ্ছেদ নং ৫৬।
[3]. মুওয়াত্ত্বা হা/১৯, ‘কিতাবুল জানায়েয’ অধ্যায়।
[4]. মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বা ৩/২৯৮ পৃ.।
[5]. কাশ্শাফুল ক্বেনা‘ ৬/৪১২ পৃ.।
[6]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৩৮১ পৃ.।
[7]. মুওয়াত্ত্বা হা/১৭।
[8]. ত্বাবারাণী, মু‘জামুল কাবীর হা/৯৪৯০।
[9]. মুনযির, আল-আওসাত্ব ৫/৪৩৮ পৃ.।
[10]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা ৩/৩৫৩ পৃ.।
[11]. প্রাগুক্ত ৩/৩৫৪ পৃ.।
[12]. আবুদাঊদ হা/৩১৯৯।
[13]. তিরমিযী ৩/৩০৫ পৃ.।
[14]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লাহ ৩/৩৫৩ পৃ.।
[15]. আয-যাওহারুন নাকি‘ ৪/৩৯ পৃ.।
[16]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৩৮১ পৃ.।
[17]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লাহ ৩/৩৫৩ পৃ.।
[18]. বুখারী (অধ্যায় ৬৫)।
[19]. বুখারী হা/১৩৩৫।
[20]. মা‘রিফাতুস সুনান ওয়াল আছার ৫/৩০০ পৃ.।
[21]. ইন‘আমুল বারী খ ৪/৫০১ পৃ.।
[22]. সুবুলুস সালাম ৩/২৯০ পৃ.।
[23]. তিরমিযী হা/১০২৬, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[24]. তিরমিযী হা/১০২৭, আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।
[25]. নাসাঈ হা/১৯৯৩।
[26]. বুখারী হা/৭২০; মুসলিম হা/৭৬০।
[27]. শারহুল মুমতি‘ ৫/৪০১ পৃ.।
[28]. ইবনু হাযম, আল-মুহাল্লা ৩/৩৫৪ পৃ.।
[29]. আল-মানহালুল আযবু ৯/৩৮ পৃ.।
[30]. প্রগুক্ত ৩৫৩ পৃ.।
[31]. যাখিরাতুল ওক্ববা ১৯/৩১৯ পৃ.।
[32]. আল-বাহরুল মুহীত ১৮/৪৪৭ পৃ.।
[33]. মির‘আতুল মাফাতীহ ৫/৩৮১ পৃ.।
[34]. শারহুল মুমতি‘ ৫/৪০১ পৃ.।
[35]. ইবনু বায, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া ১৩/১৪৩ পৃ.।
[36]. ফায়যুল বারী ৩/৫২ পৃ.।
[37]. হাশিয়ায়ে সিন্ধি আলান নাসাঈ ৪/৭৫ পৃ.।