উটের মহানুভবতা

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 290 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। একদা এক শিয়াল একটি গ্রাম থেকে পালিয়ে জঙ্গলের পথ ধরে অন্য গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে সে একটি নেকড়েকে যেতে দেখল। শিয়াল নেকড়ের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। তাতে সে বুঝতে পারল, ঐ গ্রামের মানুষের ভেড়ার পাল পাহারা দেয়া কুকুরগুলো নেকড়েকে ভেড়ার কাছে ঘেষতে দেয় না। সেকারণে নেকড়ে মনের দুঃখে দূরে কোন গ্রামে চলে যেতে চাচ্ছে।

কিছুদূর যাওয়ার পর পেরেশান হয়ে ঘুরতে থাকা একটি উট দেখতে পেল। বিনা পরিশ্রমে উটের কাছে গিয়ে বলল, তুমি না গৃহপালিত পশু? মানুষ তো তোমাকে খাবার খাওয়ায়, তারপরেও এই জঙ্গলে ভবঘুরের মত ঘুরছো কেন? উট জবাব দিল, কেউ কাউকে বিনা পরিশ্রমে এমনিতেই খাবার দেয় না। যদি মানুষ কাউকে মাগনা খাবার দিত তবে সেটা পশুকে না দিয়ে মানুষকেই দিত। তাহ’লে আর পৃথিবীতে এত ক্ষুধার্ত মানুষ থাকত না। তোমরা যে আমাকে শুকনা খড় দিতে দেখ, সেটা আমার পশমের জন্য, দুধের জন্য, গোশতের জন্য এবং আমাকে দিয়ে বোঝা বহন করানোর জন্য। তোমরাও যদি এরকম বোঝা বহনের কাজ করতে চাও তাহ’লে সে খাদ্য তোমাদেরও দেবে। বাস্তবে আমি গৃহপালিত পশু। কিন্তু যতক্ষণ গৃহের মানুষের সাথে কাজ আছে ততক্ষণ। যখন বেইনছাফি আর জোর-যবরদস্তির মুখোমুখি হব, তখন আমিও ভয়ংকর রূপ ধারণ করব। তোমরা উটের প্রতিশোধের কথা শোনো নি? আসলে যতক্ষণ আমি মানুষের মধ্যে ইনছাফ দেখব ততক্ষণ শান্ত, সহনশীল ও অনুগত পশু। যদি একটা ইঁদুরও আমার লাগাম ধরে টানে তখন সে যেদিকে নিয়ে যাবে আমি তার সাথে সেদিকেই যাব। দিন-রাত কাজ করব, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় থাকব, পানি ও ঘাস ছাড়া মরুভূমি পদদলিত করব, বোঝা বহন করব, কাঁটার আঘাত খাব কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলব না। কিন্তু এখন আমার এই ভবঘুরের মত বেড়ানোর কারণ হ’ল, আমার মনিবের ভেতর কোন ইনছাফ নেই। আমাকে দিয়ে বোঝা বহন করায়, চাবুক মারে এবং একটুও বিশ্রামের সুযোগ দেয় না। তাই আমিও রেগে গিয়ে বনে চলে এসেছি। কাজের তো একটা সীমা আছে। যখন সীমা ছাড়িয়ে গেছে তখন এরকম ছোটলোকের জোর খাটানো কেন সহ্য করব? আমিও উট, সবার বড়।

নেকড়ে বলল, এটা কোন কথা না। হয়ত তোমার চেয়ে কেউ ছোট হ’তে পারে কিন্তু তার জ্ঞান-বুদ্ধি তোমার থেকে বেশী। অথবা সে এমন কোন কাজ পারে যা তুমি পার না। তখন তোমার এই বিশাল মাংসল দেহ থেকে লাভ কী?

উট বলল, বিশাল মাংসল দেহ বোঝা বহনের জন্য, কারও জোর-যবরদস্তি কথা শোনার জন্য নয়।

শিয়াল বলল, উট ঠিক বলেছে। এখন এসব কথা বাদ দাও। এখন আমরা কোথায় যাব, কি করব সেটা ভাবা যাক। বোঝাই যাচ্ছে আমাদের কারও সাথে কোন খাবার নেই। আমাদের দুপুরের ও রাতের খাবার কোথায় থেকে পাব?

নেকড়ে বলল, চিন্তা কর না। যার মুখ আছে সে কখনো অভুক্ত থাকবে না। যেখানেই হোক কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।

শিয়াল বলল, তাহ’লে আমরা কথা দেই যে, গ্রামে না পৌঁছা পর্যন্ত আমরা এই সফরে পরস্পরের বন্ধু হয়ে থাকব।

উট হেসে বলল, যে সমস্ত পশুরা সারাক্ষণ গ্রামের চিন্তায় বিভোর থাকে তাদের জন্য আমার ঘৃণা হয়। গ্রাম আমার জন্য শুধু কুলিগিরির স্থান আর তোমাদের জন্য লাঠির আঘাত খাওয়ার স্থান। আল্লাহর সমস্ত নে‘মত বনে রয়েছে। গ্রামের মানুষ তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় সকল জিনিস বন-জঙ্গল ও পাহাড় থেকে সংগ্রহ করে। গ্রামে কিছুই নেই। তুমিও যদি মোরগ ও ভেড়া খাওয়ার চিন্তা না করে আমার মত লতা-পাতা খেতে তাহ’লে নিশ্চিন্তে থাকতে। আমার গ্রামের সাথে কোন কাজ নেই। এখন যেহেতু আমরা একই পথের পথিক সেহেতু এই সফরে এক সাথেই থাকছি।

অতঃপর তারা অনেক পথ হাঁটল। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করল। ক্ষুধা ও তৃষ্ণার্ত দেহ নিয়ে একটি টিলার গর্তে জমে থাকা পানির কাছে গেল। গর্তের কিনারায় পৌঁছানোর সাথে সাথে নেকড়ে পরিষ্কার একটি পাথরের উপর এক টুকরা রুটি দেখতে পেয়ে আনন্দে চিৎকার করে বলল, এই দেখ! বলেছিলাম না যার মুখ আছে সে অভুক্ত থাকে না? এই দেখ পানি আর রুটি পেয়ে গেলাম। শিয়াল ও উট গিয়ে দেখল কোন মুসাফিরের দল সেখানে তাবু গেড়েছিল বিধায় ভাঙ্গা পাত্র, খড়, ছাই ও এ জাতীয় জিনিসের সাথে এক টুকরা রুটি পড়ে আছে।

উট বলল, ভালই হ’ল। আমরা তিনজন কিন্তু মাত্র এক খন্ড রুটি। যদিও কম তবুও আগামীকাল পর্যন্ত যেন ক্ষুধায় মারা না যাই তার জন্য যথেষ্ট।

নেকড়ে বলল, এই রুটি প্রথমে আমি পেয়েছি তাই আমার।

শিয়াল বলল, এটা হবে না। এই রুটিকে অবশ্যই তিন ভাগ করব। প্রকৃতপক্ষে এই রুটি আমার খাওয়া উচিত। কারণ উট ঘাস খেয়ে থাকতে পারে, নেকড়ে শিকার ধরতে পারে। সব দিক থেকে আমার হক বেশী। কিন্তু যেহেতু আমরা বন্ধু তাই অবশ্যই রুটি তিন ভাগ হবে।

নেকড়ে বলল, শিয়ালের কথা ঠিক। আসলেই উট ঘাস খেয়ে থাকতে পারে। কিন্তু ইদানীং আমি শিকারই পাচ্ছি না। উটকেও শিকার করে খেতে পারি কিন্তু সেটা করতে চাই না। তাহ’লে লটারী করা যাক, যার নাম উঠবে সে একাই রুটি খাবে। তাতে অন্তত একজন পরিতৃপ্ত হবে। পূর্বপুরুষরা বলত, একশটা খারাপ শহরের চেয়ে একটা আবাদী গ্রাম শ্রেষ্ঠ।

এ পর্যায়ে উট রেগে উত্তর দিল, মুখ সামলিয়ে কথা বলো আর আমার সাথে সাহস দেখাতে এসো না। তোমার মত ছোট প্রাণীর উটকে শিকার করার মত ক্ষমতা নেই। যদি তোমার মাথায় এক লাথি মারি তাহ’লে মাটির সাথে মিশে যাবে। এক থাপ্পড় দেব তো সত্তর বার ঝুলতে থাকবা তারপর এই পাহাড় থেকে পড়ে যাবা। যাহোক আমি কিন্তু লটারীর বিরোধী। কারণ লটারী অন্ধ বিশ্বাস। এর মাধ্যমে প্রকৃত হকদার নির্বাচন করা যায় না। বোঝাই যাচ্ছে তোমাদের উদ্দেশ্য প্রতারণা করা। সুতরাং রুটি আমি খাব, কারণ আমি সবার বড় এবং বড়কে শ্রদ্ধা করা আবশ্যক।

নেকড়ে উটের কথায় ভয় পেয়ে বলল, ঠিক আছে তুমি বড়। কিন্তু আমরা কীভাবে বুঝবো তুমি বড়? বুদ্ধিতেই বড়’র পরিচয়।

উট বলল, না, বড়ত্ব দেহের গঠন ও উচ্চতায় প্রকাশ পায়। যখন কোন বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায় না তখন জোর যার মুল্লুক তার। আসলে আমি জোরাজুরি করে রুটি খেতে চাচ্ছি না।

শিয়াল বলল, ঝগড়া করো না। আমি আমার দাবি ছেড়ে দিচ্ছি। যদি বুদ্ধিমত্তায় বড়ত্ব প্রকাশ পায় তাহ’লে রুটি আমার হওয়া উচিত। কারণ আমার চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী কেউ নেই। এখন আমার মাথায় একটি পরিকল্পনা এসেছে যার মাধ্যমে রুটি কে পাবে সেটা নির্ধারণ করা যাবে। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের অতীতের সুন্দর ঘটনা বর্ণনা করব। যার ঘটনা সুন্দর হবে সে রুটি খাবে। এটা করলে কেমন হয়?

নেকড়ে বলল, এটা হবে না। কারণ প্রত্যেকের কাছে তার নিজের অতীত সুন্দর। সামান্যতম অংশ হ’লেও তার পসন্দের জায়গা থাকবে। যদি আমি আমার ঘটনাকে আনন্দদায়ক দাবি করি আর তুমি সেটা গ্রহণ না কর, তখন আবার নতুন বিতর্ক শুরু হবে। তাই ভাল হয় যে, আমরা উটের কথা সম্মানের সাথে মেনে নিয়ে নিজেদের জন্ম সাল বলি। যার বয়স বেশী হবে সে এই রুটি খাবে।

শিয়াল বলল, ভাল পরামর্শ। উট এই পরামর্শ গ্রহণ করে বলল, তাহ’লে শুরু কর। কে আগে জন্ম সাল বলবে?

শিয়াল তো ধোঁকাবাজির জন্য বিখ্যাত। সে প্রস্তাব দিল আগে নেকড়ে বলুক। সে মনে মনে ভাবল, এসবের মানেই হয় না। নেকড়ে যে বয়স বলবে আমি তার বেশী বলব। উটকে কথার প্যাঁচে ফেলে ধোঁকা দিয়ে রুটি খেয়ে ফেলব।

উট শিয়ালের কথায় সম্মতি দিল। এবার নেকড়ে বলল, আমার বাবা তার নিজের লেখা বইয়ের শেষ পাতায় যেদিন দো‘আমূলক কিছু বাক্য লিখেছিল, তার সাত দিন পূর্বে আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করেন। তখন আমার মা আমাকে জন্ম দেন!

এই কথা শুনে বিস্ময়ে উটের মুখ হা হয়ে গেল। কিন্তু শিয়াল এই কথাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। আমারও মনে পড়েছে। ঐ রাতে যখন তোমার মা তোমাকে জন্ম দেয় তখন আমি বাতি জ্বালিয়ে তোমাদের ঘর আলো করে দিয়েছিলাম। ঐ সময় আমার বয়স ছিল ১০ বছর।

উট নিজের বন্ধুদের এমন মিথ্যা আজগুবি কথা শুনে বুঝতে পারল তার আর কিছু বলার ভাষা নেই। সে তখন রুটির টুকরাটা মুখে নিয়ে এক লুকমা খেয়ে বলল, আমি প্রথমে রুটি খেতে চাইনি কারণ আমার খাবার হ’ল ঘাস। আমি চেয়েছিলাম তোমরা ইনছাফ কর এবং সত্য কথা বল। যদি আমি রুটি ভাগেও পেতাম তবুও তোমাদের দিয়ে দিতাম। কিন্তু যেহেতু এখন তোমরা প্রতারণা করেছ সেহেতু শুনে রাখ, আমার এই দেহ একদিনে তৈরী হয়নি। আমি গত রাতে জন্মগ্রহণ করিনি। তোমাদের বহুপূর্বে আমার জন্ম। দুনিয়ার বহু কিছু দেখেছি। সুতরাং কে বড় তা সহজেই স্পষ্ট হয়ে গেল।

[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]

শিক্ষা : গল্পটির মধ্যে বেশ কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় নিহিত রয়েছে। গল্পটি ঈষৎ হাস্যরসাত্মক হ’লেও বন্য পশুদের ভাষায় সমাজের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে। আমরা জীবনের প্রয়োজনে শক্তিশালী পশুকে বশে এনে গৃহস্থালি নানান কাজে ব্যবহার করি। অনেকাংশেই তাদেরকে সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা দেই, কারণে-অকারণে প্রহার করি, অভুক্ত রাখি এবং সঠিকভাবে পরিচর্যাও করি না। আমরা বেমালুম ভুলে যাই যে, অবলা পশু শক্তিশালী হ’লেও তার কষ্ট লাগা, অতিরিক্ত ভার সহ্য করতে না পারা, ক্লান্তিবোধ, বিশ্রাম, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ইত্যাদির অনুভূতি রয়েছে। ফলে বাস্তবে আমাদের দ্বারা এ সমস্ত গৃহপালিত পশু যুলুমের শিকার হয়। আসলেই তারা যদি কথা বলতে পারত তাহ’লে নিশ্চিত এই গল্পের উটের মতই আমাদেরকে যালেম বলত। সুতরাং গৃহপালিত পশুও আমাদের দ্বারা অত্যাচারিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সচেতন থাকা উচিত।

দ্বিতীয়ত, বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে মিথ্যাচারিতা, প্রতারণা এবং স্বার্থপরতা থাকা উচিত নয়। বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, স্বার্থহীনতা এবং সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা রাখতে হবে। যা এই গল্পের উটের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু তার অন্য দুই বন্ধুর মধ্যে এই গুণাবলী ছিল না বিধায় উট তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য গল্পের শেষাংশে নিজেই রুটিটি খেয়ে ফেলে।

আল্লাহ আমাদের এই গল্পের শিক্ষা বাস্তব জীবনে মেনে চলার তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী।]



আরও