বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ-এর বার্ষিক ক্যালেন্ডার ২০২৪ পরিচিতি
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 290 বার পঠিত
[ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা চারটি সামরিক বিজয় সাধিত হয়েছিল বদর, হিত্তীন, আইনে জালূত ও কনস্টান্টিনোপল যুদ্ধের প্রান্তরে। এর প্রতিটিই ইসলামের ইতিহাসে কেবল নতুন অধ্যায়ই রচনা করেনি, বরং বিশ্ব ইতিহাসেই নতুন যুগের সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। মুসলমানদের বিশ্ববিজয়ী শক্তির হওয়ার পিছনে এই চারটি বিজয় ছিল মূল নিয়ামক। ইসলামের ইতিহাসের এই প্রাতঃস্মরণীয় চারটি যুগান্তকারী রণাঙ্গন নিয়েই প্রকাশিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর বার্ষিক ক্যালেন্ডার ২০২৪।]
১. বদর রণাঙ্গন :
ইসলামের ইতিহাসে ‘কুফর ও ইসলামের মধ্যে ফায়ছালাকারী’ প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় মদীনা থেকে ১৬০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে ঐতিহাসিক বদর ময়দানে। এই যুগান্তকারী যুদ্ধ হয় হিজরতের প্রায় ১৯ মাস পর ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান মোতাবেক ৬২৪ খৃষ্ঠাব্দের ১১ই মার্চ শুক্রবার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সরাসরি নেতৃত্বে এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ছিলেন প্রসিদ্ধ মতে ৩১৩ জন। যারা সবাই আল্লাহর পক্ষ থেকে জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত। পুরো মুসলিম বাহিনীতে ছিল মাত্র ২টি ঘোড়া ও ৭০টি উট। অপরপক্ষে কুরায়েশ বাহিনীতে ছিল ১০০০ প্রশিক্ষিত সৈন্যসহ ২০০ ঘোড়া ও অসংখ্য উট। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১৪ জন শহীদ হন এবং কাফেরদের পক্ষে সেনাপতি আবু জাহল সহ ৭০ নিহত হয়। ইসলামের ইতিহাসের প্রথম এই যুদ্ধ ছিল মুসলিম বিজয়ের মাইলফলক এবং পরবর্তীকালে ইসলামের বিশ্ববিজয়ী শক্তি হিসাবে আবির্ভাবের শুভ সূচনা।
২. হিত্তীন রণাঙ্গন :
বর্তমান ইস্রাঈলের গালীলী হরদের নিকটবর্তী ফিলিস্তীনের প্রাচীনতম তাবারিয়া শহর, যা আল-কুদস শহর থেকে ১৯৮ কি.মি. উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এই শহরেরই হিত্তীন নামক স্থানে সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় যুদ্ধ, যা হিত্তীনের যুদ্ধ হিসাবে খ্যাত। এই যুদ্ধক্ষেত্রে দুই চূড়াবিশিষ্ট একটি পাহাড় রয়েছে। মুসলিম-খৃষ্টান দু’শ বছরব্যাপী দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ইতি ঘটে ঐতিহাসিক এই রণাঙ্গনে। ১৫ হিজরী মোতাবেক ৬৩৭ খৃষ্টাব্দে খলীফা ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে প্রায় ৫ হাযার নবীর কর্মস্থল বলে খ্যাত ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী ১০,১৬২ বর্গমাইল জুড়ে প্রতিষ্ঠিত জেরুযালেম সর্বপ্রথম মুসলমানদের অধিকারে আসে। অতঃপর দীর্ঘ প্রায় পাঁচশত বছর মুসলিম শাসনাধীনে থাকার পর তৎকালীন মুসলিম শাসকদের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে ১০৯৯ সালে খৃষ্টান ক্রসেডাররা জেরুযালেম দখল করে। এসময় তাদের নির্মম হত্যাকান্ডে জেরুযালেমের মুসলিম জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মুসলমানদের ১ম ক্বিবলা আল-আক্বছা জামে মসজিদকে গীর্যায় পরিণত করা হয়।
এর প্রায় একশ’ বছর পর ১১৮৭ খৃষ্টাব্দে মিসরের বিখ্যাত সেনাপতি ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনী হিত্তীন ময়দানে সম্মিলিত খৃষ্টান ক্রসেডার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করে জেরুযালেম উদ্ধারের পথ সুগম করেন। এই যুদ্ধে বিজয়ী মুসলিম বাহিনী পরাজিত খৃষ্টান বাহিনীর প্রতি মানবতার যে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা বিশ্বের ইতিহাসে নযীরবিহীন। এরপর থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত জেরুযালেম প্রায় ৭৩০ বছর মুসলিম শাসনাধীনে ছিল। অতঃপর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের কূটচালে ©র্ফলিস্তীনের বুকে ‘ইস্রাঈল’ নামক অবৈধ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই থেকে ফিলিস্তীনী ভূখন্ডে মুষ্টিমেয় মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলছে নিয়মিত রক্তের হোলিখেলা। অদ্যাবধি জেরুযালেমে মুসলমানদের কর্তৃত্ব ফিরে আসেনি। বরং ফিলিস্তীন ভূখন্ড এখন বিশ্বের বৃহত্তম কারাগারে পরিণত হয়েছে। যা মুসলিম বিশ্বের হৃদয়ে এক স্থায়ী ক্ষতচিহ্ন হয়ে নিয়মিত রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে।
৩. আইনে জালূত রণাঙ্গন :
৩রা সেপ্টেম্বর ১২৬০। ক্রসেডারদের বিরুদ্ধে হিত্তীনের মহাবিজয়ের অর্ধশত বছর পর ফিলিস্তীনের মাটিতে সাধিত হয় আরেক যুগান্তকারী বিজয়, যা মোঙ্গলদের অপ্রতিরোধ্য হামলা থেকে মুসলমানদের রক্ষা করেছিল। এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বর্তমান ফিলিস্তীনের নাবলুস ও বীসান শহরের মধ্যবর্তী আইনে জালূত নামক স্থানে। ১২০৬ সালে মোঙ্গলিয়ায় সূচিত মোঙ্গল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চেঙ্গিস খান সমগ্র সাইবেরিয়া ও চীন দখল করার পর বিশ্বজয়ের নেশায় পশ্চিমের দেশগুলো দখল করার জন্য সৈন্য পরিচালনা করেন। মোঙ্গলবাহিনী ঝড়ের গতিতে একের পর এক মধ্যএশিয়া ও পারস্যের বহু শহর জয় করার পর বাগদাদে উপনীত হয়। ১২৫৮ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের তান্ডবে আববাসীয় খেলাফতের পতন ঘটে। নিহত হন শেষ আববাসীয় খলীফা মু‘তাছিম বিল্লাহ। এরপর তারা ঝড়ের গতিতে সিরিয়ার আলেপ্পো, দামেশকসহ বিভিন্ন শহর দখল করে মিসর অভিমুখে রওয়ানা হয়।
তখন মিসরের শাসক ছিলেন মামলূক সুলতান সাইফুদ্দীন কুতুয। তিনি আত্মসমর্পণ না করে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়োগ করে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করলেন। এই যুদ্ধে সিরিয়া থেকে তাঁর সাথে যোগ দেন দুঃসাহসী সেনাপতি ও পরবর্তী মামলূক সুলতান রুকনুদ্দীন বাইবার্স আল-বুন্দুক্বদারী। মোঙ্গলরা জর্ডান নদী পার হ’লে সাইফুদ্দীন কুতুয ফিলিস্তীনের জাযরীল উপত্যকার আইনে জালূত নামক স্থানে তাদেরকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ফাঁদে ফেলে ঘেরাও করে ফেলেন। রুকনুদ্দীন বাইবার্স অসামান্য বীরত্ব প্রদর্শন করে মোঙ্গল বাহিনীকে তছনছ করে দেন এবং তাদের পিছু পিছু প্রায় ৩০০ কি.মি. ধাওয়া করে পুরো বাহিনীকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেন। মুসলমানদের এই বিজয়ের ফলে মোঙ্গলদের জয়যাত্রা পুরোপুরি থেমে যায়। এই যুদ্ধেই মুসলমানরা ইতিহাসে প্রথমবারের মত বারুদ ব্যবহার করে। পরবর্তীতে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে হালাকু খান পুনরায় মিসর ও সিরিয়া আক্রমণ করতে আসলে দুর্ধর্ষ বীর রুকনুদ্দীন বাইবার্স প্রতিটি যুদ্ধে তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করেন। ফলে মুসলিম দেশগুলি মোঙ্গলদের বিধ্বংসী অপতৎপরতা হ’তে রক্ষা পায়। এজন্য রুকনুদ্দীন বাইবার্সকে ‘দ্বিতীয় ছালাহুদ্দীন’ বলা হয়।
৪. কনস্টান্টিনোপল রণাঙ্গন :
কনস্টান্টিনোপল (কুসতুনতুনিয়া) দুর্গের অবস্থান ছিল বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহরে। ১৪৫৩ খৃষ্টাব্দের ২৯শে মে ৭ম ওছমানীয় সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতেহ (১৪৩২-১৪৮১ খৃ.)-এর নেতৃত্বে এই দুর্গ জয়ের মাধ্যমে তৎকালীন পরাশক্তি রোমান তথা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং মুসলমানদের বিশ্বব্যাপী একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই জয় এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এর মধ্যে কেবল তুরস্ক নয়, বরং সমগ্র পাশ্চাত্যের দ্বার মুসলমানদের জন্য খুলে যায় এবং পশ্চিম ইউরোপের বসনিয়া পর্যন্ত মুসলিম শাসন প্রলম্বিত হয়। ভৌগলিক ও অন্যান্য কারণে খৃষ্টান ক্রসেডারদের কাছে কনস্টান্টিনোপল ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত নগরী। ত্রিভুজাকৃতির এই নগরীর উত্তরে গোল্ডেন হর্ণ, পূর্বে বসফরাস প্রণালী, দক্ষিণে মর্মর সাগর শহরটিকে দিয়েছিল প্রাকৃতিক সুরক্ষা। সেই সাথে শহরের চারিদিকে ৪০ ফুট উঁচু আর ৬০ ফুট পুরু দেওয়াল শহরটিকে দিয়েছিল অজেয় অবস্থান। ফলে এই শহর অবরোধের পর সুলতান মুহাম্মাদ যখন বাইজেন্টাইন সম্রাট কন্সটানটাইনকে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন, তখন স্বভাবতই তিনি উদ্ধতভাবে সেটি প্রত্যাখ্যান করেন।
যুদ্ধ শুরু হ’লে মুসলমানরা তৎকালীন সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যাসিলিকা কামান দিয়ে আক্রমণ শুরু করেও সুবিধা করতে পারল না। অবশেষে সুলতান মুহাম্মাদ এক অবিশ্বাস্য সিদ্ধান্ত নিয়ে পাহাড়ের উপরে গাছের গুড়ি রেখে তার উপর দিয়ে এক রাতে ৭০টি জাহায বসফরাস থেকে অপরপ্রান্তে গোল্ডেন হর্ণে পার করলেন। যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল। অবশেষে টানা ৫৩ দিনের যুদ্ধ শেষে মুসলিম বাহিনী কনস্টান্টিনোপলের দুর্ভেদ্য প্রাচীর ভেদ করতে সক্ষম হ’ল। মাত্র ২১ বছর বয়সী সুলতান মুহাম্মাদ বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করেই সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন। শহরের নতুন নাম দিলেন ‘ইসলামবুল’ বা ‘ইসলামের শহর’। তাঁর নামের সাথে যুক্ত হ’ল আল-ফাতেহ বা বিজয়ী। এভাবেই ঐতিহাসিক কনস্টান্টিনোপল বিজয় ওছমানীয় খেলাফতকে যেমন স্থায়িত্ব দিয়েছিল, তেমনি সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদেরকে এক দুর্জয় পরাশক্তিতে পরিণত করেছিল।