বাবার শেখানো লাইফলাইন
আব্দুল কাদের
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 374 বার পঠিত
(১)
৩রা সেপ্টেম্বর’২৩ রবিবার, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা চিলাহাটি গামী আন্তঃনগর চিলাহাটি এক্সপ্রেস (৮০৫) ট্রেনে বরাবরের মতই পিছন থেকে টিকিট চেকিং শুরু করি। সাথে ছিলেন জনাব বেলাল হোসেন (টিটিই, পার্বতীপুর)। সকাল থেকেই মনটা আজ খুব ভাল। অনেকদিন পর রেল ভবনে প্রিয় স্যারের সাথে দেখা হ’লে প্রায় ৩৪ মিনিট আলাপ-আলোচনা হ’ল। তিনি মন থেকে অনেক বিষয়ের সন্দেহ দূর করে দিলেন। যথারীতি আমরা টিকিট চেক করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ‘জ’ কোচে আসার পর এক ভদ্রলোক জানালেন যে, ‘ঘ’ কোচের একটি রোগী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সাথে সাথে আমার পেছনের গার্ড সিফাত হোসেনকে জানালাম যে, দ্রুত পিএ অপারেটরকে এনাউন্সমেন্ট করতে বলেন। যরূরী ভিত্তিতে ‘ঘ’ কোচের জন্য একজন ডাক্তার প্রয়োজন। সিফাত ভাই দ্রুত মাইকিং এর ব্যবস্থা করলেন। ‘জ’ কোচ থেকে একজন ডাক্তারকে দ্রুত সামনের দিকে যেতে দেখলাম। ‘চ’ কোচ থেকে একজন শিক্ষানবিশ মহিলা ডাক্তার এবং দু’জন নার্স পাওয়া গেল। সবাই দ্রুত ‘ঘ’ কোচের দিকে গেলেন। ডাক্তার ছাহেব রোগীর রক্তপাত দেখে যরূরীভাবে হাসপাতালে নেওয়ার কথা জানিয়ে রাখলেন। দ্রুত এক যাত্রী ৯৯৯-এ কল দিলেন। ৯৯৯ আমাদের অ্যাম্বুলেন্সের নম্বর দিলেন। অ্যাম্বুলেন্সের সাথে কথা হ’ল উনারাও রেডি।
মহিলা যাত্রীটি গর্ভবতী ছিলেন। ট্রেনেই তার রক্তপাত শুরু হ’লে চার মাসের বাচ্চাটা গর্ভেই মারা যায়। ‘ঘ’ কোচের মহিলা যাত্রীরা সম্পূর্ণ জায়গাটা কাপড় দিয়ে ঘিরে রেখেছিলেন। মহিলা ডাক্তার, নার্সরা ডাক্তার ছাহেবের পরামর্শ মেনে কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিন সিটের চেয়ারের সারিটা সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল অপারেশন থিয়েটার। স্বামী বেচারা হতচকিত হয়ে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিলেন। একজন যাত্রী জানালেন উনার পকেটে মাত্র ১২০০ টাকা আছে। তৎক্ষণাৎ সব যাত্রীরা যে যার মত ফান্ড সংগ্রহ করা শুরু করলেন। প্রায় ৫ হাযার টাকা রোগীর স্বামীর হাতে তুলে দেয়া হ’ল। বেশ কিছুক্ষণ পর শুনলাম, আল্লাহর রহমতে মহিলার পেট থেকে মৃত বাচ্চাটি বের করা হয়েছে।
ডাক্তার ছাহেব সবাইকে আশ্বস্ত করে বললেন, রোগী এখন অনেকটা বিপদমুক্ত। কিন্তু রক্তপাত বন্ধ করতে হবে। মহিলা যাত্রীরা নিজেদের ব্যাগ থেকে কাপড় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে সহযোগিতা করলেন। রোগীকে স্যালাইন খাওয়াতে হবে। সেই স্যালাইন, হেক্সিসল, ডেটল সবই যাত্রীরা যার কাছে যা ছিল তাই দিয়ে সাহায্য করলেন। আমার চাকুরি জীবনে এটি চতুর্থ ঘটনা। কিন্তু অন্য ঘটনাগুলোর চেয়ে এই ঘটনায় যাত্রীদের এমন সহযোগিতা অভূতপূর্ব মনে হ’ল। প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। একটি বারও রোগী ও তার স্বামীকে মনে করতে দেয়া হয় নি যে, তারা তাদের বিপদে নিকটজনের সাথে নেই। ট্রেনের সব যাত্রীই যেন আজ তার আপনজন।
সবকিছু যখন অনেকটা স্থিতিশীল। তখন দুশ্চিন্তা শুরু হ’ল আর একটি বিষয় নিয়ে। যরূরী ভিত্তিতে কিছু ওষুধ প্রয়োজন। ডাক্তার ছাহেব ওষুধ লিখে দিলেন। হঠাৎ মনে পড়ে গেল মানবদরদি ঈশ্বরদীর টিটিই জনাব আব্দুল আলীম ভাইয়ের কথা। সেদিন রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। তবুও তিনি প্রেসক্রিপশন পেয়ে নিজেই ওষুধের দোকানে গিয়ে সব ওষুধ কিনে রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে ঈশ্বরদী বাইপাস কেবিন স্টেশন মাস্টারকে দিয়ে পাঠালেন। ঈশ্বরদী বাইপাস স্টেশনে ট্রেন থামলে ওষুধ নিয়ে ডাক্তার ছাহেবের হাতে পৌঁছে দেয়া হ’ল। তরুণ এই ডাক্তার অনেকবার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। পুরো রেলওয়েকে তিনি ধন্যবাদ জানালেন। ডাক্তার ছাহেব সমস্ত পথ রোগীর পাশেই ছিলেন। তখন আমার মনে পড়ল প্রিয় স্যারের একটি কথা। যা সদ্যই তাঁর মুখ থেকে শুনে আসলাম, ‘টিটিইদের কাজের অনেক প্রভাব পড়ে যাত্রীদের উপর। সেটা মন্দ কাজই হোক, কিংবা ভাল কাজ’।
এরই মাঝে আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এসিও জনাব ফারহান মাহমূদ স্যারকে সমস্ত ঘটনা অবগত করে রাখলাম। পথে যদি রোগীর অবস্থা শঙ্কটাপন্ন হয় তাহ’লে যেন যরূরী কোন পদক্ষেপ নিতে পারি এবং গৃহীত সব পদক্ষেপ সম্পর্কে তাকে জানিয়ে রাখলাম। তিনি কোন রকম সমস্যায় পড়লে যোগাযোগ করার জন্য আশ্বস্ত করলেন। এত দ্রুত এভাবে একটি মায়ের জীবন বাঁচানোর জন্য যারা এগিয়ে আসলেন তারা হ’লেন, ঢাকার ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. ছানাউল্লাহ, রংপুর কমিউনিটি হাসপাতালের ৫ম বর্ষের ছাত্রী আফসানা ইসলাম, ফারজানা আক্তার (নার্স), মুন্নি খাতুন (স্টাফ নার্স, ওটি), রেবেকা সুলতানা (নার্সিং ইন্সট্রাক্টর), খাদিজা খাতুন নিশা (নার্সিং ইন্সট্রাক্টর), রুমী ইসলাম (নার্সিং ইন্সট্রাক্টর) এবং আব্দুল আলীম মিঠু (টিটিই, ঈশ্বরদী)।
-আমীরুল হক জাহেদী, টিটিই, দিনাজপুর।
(২)
রাত ২টা ৩০ মিনিটে রোগীটা মারা গেল। বয়স প্রায় ৭০ বছর। সাথে ছিল শুধু স্ত্রী। জিজ্ঞাসা করলাম, বাড়ীতে খবর দিয়েছেন? রোগী তো সন্ধ্যা থেকেই খারাপ ছিল। কেউ আসেনি? এরপর এক নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি হ’লাম যার জন্য আমার কোন মানসিক প্রস্ত্ততি ছিল না। রোগীর দুই ছেলে। বড় ছেলে সঊদী প্রবাসী আর ছোট ছেলে বাড়ীতে। বড় ছেলের জোরাজুরিতেই রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে আসা। ছোট ছেলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে কেন হাসপাতালে আনা হ’ল এই অপরাধে বৃদ্ধ বাবাকে একবারও দেখতে আসেনি সে। উল্টো তাকে বাবার খারাপ অবস্থা জানানো হ’লে তার ভাষ্য ছিল, ‘আমি তো হাসপাতালে নিতে বলি নি। সঊদী থেকে এসে বাবাকে দেখে যেতে বল’!
জিজ্ঞাসা করলাম, আত্মীয়-স্বজন? জানালে কেউ আসবে না। যখন তাদের প্রয়োজন ছিল তখন এসেছে। এখন লাশ নিতে আসলে যদি দুই পয়সা খরচ করতে হয়! রাত ২.৩০ টায় ষাটোর্ধ্ব নারী তার সদ্য প্রয়াত স্বামীকে নিয়ে একটি উপযেলা হাসপাতালের ওয়ার্ডে। সাথে নেই কোন চেনা মুখ! কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কয়টা বাজে? আযান দিতে আর কতক্ষণ? আমি বললাম, বেশীক্ষণ না, দুই-আড়াই ঘণ্টা! ভদ্রমহিলা আমার হাত চেপে ধরে বললেন, ‘আমাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েন না ডাক্তার! সকাল হ’লেই ভ্যান নিয়ে চলে যাব’!
শোকার্ত বৃদ্ধা পড়ন্ত বয়সে একমাত্র সুখ-দুঃখের সাথীকে হারিয়ে যেন ঠিকমত শোকপ্রকাশও করতে পারছেন না। একবার লাশের কাপড় ঠিক করছেন, কিছুক্ষণ দো‘আ পড়ছেন, কিছুক্ষণ আস্তে আস্তে কান্না করছেন, আবার একা একা এই লাশ বাড়ী পর্যন্ত কিভাবে নিয়ে যাবেন হয়ত সেটাও আনমনে ভাবছেন। আমি শুধু তার মাথায় হাত রেখে আস্তে করে বলতে পারলাম, ‘থাকেন, কোন সমস্যা নেই’।
ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে ৭০ বছরের বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, জীবন ঠিক কতটা নিষ্ঠুর হ’তে পারে। মৃত্যুর পর লাশটা নেওয়ার মানুষটাও নেই। আহারে জীবন! এই জীবন নিয়ে আবার কত বড়াই! অথচ ঠিকমত দাফন-কাফন পাব কিনা তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। -ডা. মুহাম্মাদ সেলীম।