চলমান শিক্ষানীতির ভ্রান্ত গতিপথ ও আমাদের করণীয়
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 1029 বার পঠিত
গাযার অবরুদ্ধ জনপদে সভ্য দুনিয়ার চোখের সামনে দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা রকেট-মিসাইলের আঘাতের শব্দ। কয়েক টুকরো শুকনো রুটি আর সামান্য পানি গাযাবাসীর সারাদিনের খাবার। সোলার প্যানেল থেকে হালকা বিদ্যুতের ব্যবস্থা। পানির অভাবে তিনদিন পর একবার করে গোসল। সেই গোসলের পানিই ব্যবহার হয় কাপড় পরিষ্কারে, তারপর টয়লেটে। প্রতিটি ঘুম তাদের হয় শেষ ঘুমের প্রস্ত্ততি নিয়ে। জীবিত শিশুর সকালটা হয় বিস্ময়ের সাথে যে, সে এখনও জীবিত! আসন্ন মৃত্যুর জন্য স্ব স্ব পালার অপেক্ষায় প্রতিটি নারী-পুরুষ। এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে গাযাবাসী মুসলমানদের প্রতিটি দিন।
বিশ্ব সভ্যতার ধারক ও বাহকদের যোগসাজশে ইসরাঈলের পাশবিক নিষ্ঠুর তান্ডবে আজ সাক্ষাৎ মৃত্যুপুরীতে পরিণত গাযা। অথচ ২৩ লক্ষ জনগোষ্ঠীর উপর এই বর্বর আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী হাযারো মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কোন একটি এখনও পর্যন্ত জোর গলায় নিন্দা জানিয়েছে- এমন কোন সংবাদ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়নি। বৈশ্বিক জোটগুলো অবশ্য ইসরাঈলের ‘আত্মরক্ষা’র অধিকারের কথা স্মরণ করাতে গিয়ে মাঝে মাঝে মিহি রবে সাময়িক যুদ্ধবিরতি চেয়ে গাযাবাসীকে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। এরই মাঝে গত একমাসে প্রাণ হারিয়েছে ১২ হাযার মানুষ। যার ৬৫ শতাংশই নারী ও শিশু। গৃহহীন হয়েছে ১৫ লাখ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির- কিছুই বাদ যায়নি। প্রায় ২ বছর পূর্বে ইউক্রেনে শুরু হওয়া রাশিয়ার সামরিক অভিযানে এখনও পর্যন্ত নিহত হয়েছে ১০ হাযার বেসামরিক নাগরিক। অর্থাৎ ২ বছরে রাশিয়া যতজন ইউক্রেনীয় হত্যা করেছে, ইসরায়েল মাত্র এক মাসেই হত্যা করেছে তার চেয়ে বেশী ফিলিস্তীনী!
আন্তর্জাতিক বিশ্বের এই ডামাডোলের মাঝে বাংলাদেশেও এখন নির্বাচনকালীন এক গুমোট অস্থিরতা বিরাজ করছে। গণতন্ত্রের নামে চলমান স্বৈরতন্ত্রের অসহিষ্ণুতা এতটাই সীমা ছাড়িয়েছে যে, শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর নির্বিচারে গুলি ছুড়তে প্রশাসন দ্বিধা করছে না। গুমের শিকার হয়ে হারিয়ে গেছে হাযারো মানুষ, যাদের পরিণতি কেউ জানে না। দিন-দুপুরে অতর্কিত ভাবে খুন করা হয়েছে বহু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, যার কোন বিচার নেই। গণগ্রেফতারের ফাঁদে পচিত হচ্ছে বহুমানুষের মূল্যবান জীবন ও সময়। রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে পিটিয়ে মারা হয়েছে পুলিশ। বাছ-বিচারহীনভাবে পোড়ানো হয়েছে গাড়ি-পরিবহন। ভাংচুর হয়েছে দোকানপাট বাড়ি-ঘর। যে ইসরাঈলের নৃশংসতায় আমাদের হৃদয় দলিত-মথিত, স্বয়ং সেই ইসরাঈলী হায়নার বসবাস তো আমাদের মাঝেও!
প্রিয় পাঠক, প্রচলিত রাজনীতি ও মানবরচিত সংবিধান যে মানবজাতির মুক্তির সনদ কখনই হ’তে পারে না, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। নতুবা যে যুগে এসে আমরা সভ্যতার আভিজাত্য, গর্ব নিয়ে চলাফেরা করি সে যুগে এসে কখনও এই পশুত্বের নির্বরাম মহড়া আমাদের দেখতে হ’ত না। আমরা সুদৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মানবিক পৃথিবী গড়ে তুলতে হ’লে, মানুষের প্রাপ্য হক মানুষকে বুঝিয়ে দিতে হ’লে, সত্যিকারের সভ্য সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে ইসলাম এবং ইসলামই একমাত্র সমাধান। ইসলামে ক্ষমতার লড়াইবিহীন রাজনীতি, যুক্তিসঙ্গত পরামর্শব্যবস্থা এবং আল্লাহর আইন ও বিচারব্যবস্থা যে ভারসাম্য ও আদর্শিকতার সুসমন্বয় ঘটাতে পারে, পৃথিবীর অন্য কোন মতবাদ বা সংবিধান তার ধারেপাশেও দঁাড়ানোর সক্ষমতা রাখে না।
প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার এই ব্যর্থতা দেখার পরও একজন মুসলিম হিসাবে সোচ্চার কণ্ঠে যদি আমরা ইসলামী ইমারত ও খেলাফতের পক্ষে কথা বলতে না পারি, তবে এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে? বরং আমাদের হীনমন্যতা এমনই নিম্নতর পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, নিজের শ্রেষ্ঠ সম্পদ ফেলে দিয়ে অন্যের উচ্ছিষ্টকে অমৃত ভেবে গলধঃকরণ করে উল্টো তার গুণগান করছি! পশ্চিমের পায়রবী আমাদের এতটাই অন্ধ করে ফেলেছে যে গণতন্ত্র নামক ধেঁাকাতন্ত্র আর যুলুমতন্ত্রের বাস্তবায়নের জন্য রাজপথে জীবন দিয়ে শাহাদতের মর্যাদা খঁুজছি! ইসলামের পক্ষে লড়াইকারীদের সীমাহীন আপোষকামী নীতির কারণে পশ্চিমা পুজিবাদী রাজনীতি আমাদের মাঝে এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, এর কোন বিকল্প চিন্তাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
প্রিয় পাঠক, আদর্শিক ও বৈষয়িক স্বচ্ছতা ছাড়া কখনও আমাদের মাধ্যমে ইসলামের বিজয় সাধন হবে না। কেননা বিজয়ের আবশ্যিক শর্ত হ’ল বিশ্বাসের শুদ্ধতা এবং সৎকর্মের উপর পরিচালিত হওয়া (সূরা নূর ৫৫)। এজন্য একজন সচেতন মুসলিম হিসাবে সর্বাবস্থায় আমাদেরকে করণীয় এভাবে নির্ধারণ করতে হবে, যেন কোন পরিস্থিতিতেই আমাদের আদর্শিক কিংবা বৈষয়িক অবস্থানের নড়চড় না ঘটে। সেই নিরিখে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমাদের আবশ্যিক কর্তব্য হবে-
(১) সর্বাবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা রক্ষা করা : দেশের পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, সমাজে যেন ফিতনা ছড়াতে না পারে সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। কেননা ফিতনা ছড়ানো হত্যার চেয়েও কঠিন অপরাধ (বাক্বারাহ ১৯১)। খারেজীরা মুসলমানদের মধ্যে ফিতনা ও বিশৃংখলা সৃষ্টির মাধ্যমে সবচেয়ে বড় ক্ষতিসাধন করেছিল।
(২) কোন অবস্থাতেই কারো উপর যুলুম না করা : কেননা যুলুম যালিম ও মাযলূম উভয়ের জন্য ভীষণ ক্ষতি বয়ে আনে। কারো উপকার করতে না পারলেও অন্ততঃপক্ষে নিজের মাধ্যমে কারো ক্ষতি যেন না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। একজন ঈমানদার ব্যক্তি হরতাল-অবরোধের নামে জনগণের উপর যুলুম করা তো দূরে থাক, সামান্য ঢিল ছোড়ার কথাও ভাবতে পারে না। আর অন্যায়ভাবে গুম-খুন-হত্যার মাধ্যমে প্রতিপক্ষ দমনের নীতি যারা গ্রহণ করেছেন, আল্লাহর আদালতে তাদের চেয়ে বড় অপরাধী আর কেউ নেই (মায়েদাহ ৩২)।
(৩) সর্বদা ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করা : কোন অবস্থাতেই অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়া আমাদের বৈষয়িক স্বচ্ছতার মানদন্ড। এমনকি ইসলাম নিজের একান্ত শত্রুর প্রতিও অন্যায় আচরণ করার অনুমতি দেয়নি (মায়েদাহ ৮)।
(৪) শাসকদের প্রতি নছীহত করা : শাসক যেমনই হোক তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য চেষ্টা করা ইসলামের নীতি নয়। বরং তাকে নছীহত করা, পরামর্শ দেয়ার মাধ্যমে সংশোধনের চেষ্টা করাই অন্যদের দায়িত্ব। বর্তমান যুগে প্রচলিত ক্ষমতার রাজনীতি এবং শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহমূলক অবস্থান ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না।
(৫) ইসলামী খেলাফতের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলা : ইসলামী খেলাফত একদিকে যেমন ক্ষমতা চেয়ে নেয়া থেকে মানুষকে বিরত রাখে, তেমনি একদল যোগ্য মানুষের পরামর্শের ভিত্তিতে সঠিক নেতৃত্ব নির্বাচনে উৎসাহ প্রদান করে। ফলে এখানে ক্ষমতার জন্য কোন লোভ ও লড়াইয়ের সুযোগ নেই। আর ক্ষমতার লড়াই না থাকায় দুর্নীতি, অনাচার ঘটারও কোন অবকাশ নেই। ফলে এই আদর্শভিত্তিক রাজনীতি মানবতার জন্য চূড়ান্ত কল্যাণের ধারক ও বাহক। একজন মুসলিম হিসাবে দেশের জনগণকে ইসলামী খেলাফতের কল্যাণকারিতা বোঝানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে প্রচলিত রাজনীতির বিষবাষ্প থেকে এ দেশকে উদ্ধার করে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠার তাওফীক দান করুন- আমীন!