মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহতা

আব্দুর রহীম 1989 বার পঠিত

মৃত্যু এমন এক সত্য যা অস্বীকারের কোন সুযোগ নেই। মৃত্যু যন্ত্রণার মুখোমুখি সবাইকে হ’তে হবে। কারো বেশী হবে কারো কম। কারো মৃত্যু যন্ত্রণা হবে শাস্তি হিসাবে। আবার কারো হবে পরীক্ষা স্বরূপ। সেজন্য মৃত্যু যন্ত্রণা হ’লেই যে সে খারাপ মানুষ এমন ধারণা করা ঠিক নয়। তবে মুমিনদের মৃত্যু সাধারণত সহজ এবং কাফেরদের কঠিন হয়। মৃত্যু যন্ত্রণা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُوْرَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فَمَنْ زُحْزِحَ عَنِ النَّارِ وَأُدْخِلَ الْجَنَّةَ فَقَدْ فَازَ وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا مَتَاعُ الْغُرُوْرِ- প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। আর ক্বিয়ামতের দিন তোমরা পূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে ও জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সেই-ই সফলকাম হবে। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন ধেঁাকার উপকরণ ছাড়া কিছুই নয়। (আলে ইমরান ৩/১৮৫)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيْدُ- ‘আর মৃত্যু যন্ত্রণা আসবেই সুনিশ্চিতভাবে। যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’ (ক্বাফ ৫০/১৯)

মৃত্যু যন্ত্রণা থেকে পলায়ন : আমরা মৃত্যু থেকে যত দূরেই পালানোর চেষ্টা করি না কেন মৃত্যু আমাদের পাকড়াও করবে। আল্লাহ বলেন,فَلَوْلَا إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُوْمَ- وَأَنْتُمْ حِيْنَئِذٍ تَنْظُرُوْنَ- وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْكُمْ وَلَكِنْ لَا تُبْصِرُوْنَ- ‘তাহ’লে কেন তোমরা ফিরাতে পারো না যখন তোমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়? আর তখন তোমরা কেবল তাকিয়ে তাকিয়ে দেখ। অথচ আমরা তোমাদের চাইতে তার অধিক নিকটবর্তী থাকি। কিন্তু তোমরা তা দেখতে পাওনা’ (ওয়াক্বি‘আহ ৫৬/৮৩-৮৫)। আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, كَلَّا إِذَا بَلَغَتِ التَّرَاقِيَ- وَقِيْلَ مَنْ رَاقٍ- وَظَنَّ أَنَّهُ الْفِرَاقُ- وَالْتَفَّتِ السَّاقُ بِالسَّاقِ- إِلَى رَبِّكَ يَوْمَئِذٍ الْمَسَاقُ ‘কখনই না। যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত হবেএবং বলা হবে, কে আছ ঝাড়-ফুঁককারী (অর্থাৎ চিকিৎসক)? সে বিশ্বাস করবে যে, বিদায়ের ক্ষণ এসে গেছে। আর তার পায়ের নলার সাথে নলা জড়িয়ে যাবে। সেদিন হবে তোমার প্রতিপালকের নিকট ফিরে যাওয়ার দিন (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২৬-৩০)

পাপী ওকাফেরদের মৃত্যু যন্ত্রণা : আল্লাহ তা‘আলা কাফেরদের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দৃশ্য অবলোকন করে বলেন,وَلَوْ تَرَى إِذِ الظَّالِمُوْنَ فِيْ غَمَرَاتِ الْمَوْتِ وَالْمَلَائِكَةُ بَاسِطُوْ أَيْدِيْهِمْ أَخْرِجُوْا أَنْفُسَكُمُ الْيَوْمَ تُجْزَوْنَ عَذَابَ الْهُوْنِ بِمَا كُنْتُمْ تَقُوْلُوْنَ عَلَى اللهِ غَيْرَ الْحَقِّ وَكُنْتُمْ عَنْ آيَاتِهِ تَسْتَكْبِرُوْنَ ‘যদি তুমি দেখতে যখন কাফেররা মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করে, আর ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলে, এবার তোমাদের আত্মাগুলিকে বের করে দাও (কারণ কাফেরের আত্মা দুনিয়া ছাড়তে চায় না)। আজ তোমাদের নিকৃষ্টতম আযাব দেওয়া হবে। কারণ তোমরা আল্লাহর উপরে অসত্য কথা বলতে এবং তোমরা তঁার আয়াতসমূহে অহংকার প্রদর্শন করতে’ (আন‘আম ৬/৯৩)

বারা ইবনু আযেব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, একবার আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে এক আনছারীর জানাযায় কবরের কাছে গেলাম। (তখনো কবর তৈরী শেষ হয়নি বলে) লাশ কবরস্থ করা হয়নি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এক জায়গায় বসে থাকলেন। আমরাও তঁার আশেপাশে (চুপচাপ) এমনভাবে বসেছিলাম, যেন আমাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে একটি কাঠ ছিল। তা দিয়ে তিনি (নিবিষ্টভাবে) মাটি নাড়াচাড়া করছিলেন। তারপর তিনি মাথা উঠালেন এবং বললেন, ‘কবরের আযাব থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। এ কথা তিনি দুই-তিনবার বললেন’।

...‘আর কোন কাফের ব্যক্তির দুনিয়াবী জীবন শেষে যখন আখেরাতে পদার্পণের সময় হয়, তখন আসমান থেকে আযাবের ফেরেশতা নাযিল হন। তঁাদের চেহারা নিকষ কালো। তঁাদের সাথে কঁাটাযুক্ত কাফনের কাপড় থাকে। তঁারা ঐ ব্যক্তির দৃষ্টিসীমায় এসে বসেন। তারপর মালাকুল মাওত আসেন ও তার মাথার কাছে বসে বলেন, ‘হে নিকৃষ্ট আত্মা! আল্লাহর আযাবে পতিত হওয়ার জন্য দেহ হ’তে বের হও’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কাফেরের রূহ এ কথা শুনে তার সমগ্র দেহে ছড়িয়ে পড়ে। তখন মালাকুল মাওত তার রূহকে শক্তি প্রয়োগ করে টেনে হেঁচড়ে বের করে নিয়ে আসেন, যেভাবে লোহার গরম শলাকা ভেজা পশম হ’তে টেনে বের করা হয় (আর এতে পশম আটকে থাকে)’।

মালাকুল মাওত রূহ বের করে আনার পর অন্যান্য ফেরেশতারা এ রূহকে মালাকুল মাওতের হাতে এক পলকের জন্য থাকতে দেন না। তঁারা তাকে নিয়ে কাফনের কাপড়ে মিশিয়ে দেন। এ রূহ হ’তে মরা লাশের ন্যায় দুর্গন্ধ বের হয় যা দুনিয়াতেও পাওয়া যেত’।[1]

নবী-রাসূলগণের মৃত্যু যন্ত্রণা : পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী সকল প্রাণীই মৃত্যুবরণ করেছে এবং ক্বিয়ামত পর্যন্ত করবে। নবী-রাসূলগণও এই প্রক্রিয়ার বাইরে নন। তঁারা মৃত্যু যন্ত্রণাও ভোগ করেছেন। তবে নবী-রাসূলগণের মৃত্যু যন্ত্রণা হওয়া তাদের গুনাহগার হওয়ার লক্ষণ নয়। বরং তঁাদের জন্য পরীক্ষা ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করলেন। তখন তিনি প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন এবং তঁার শরীরে একটি চাদর জড়ানো ছিল। আবু সাঈদ (রাঃ) তার দেহে হাত রাখলেন এবং চাদরের উপর দিয়েই উত্তাপ অনুভব করলেন। আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার শরীরে তো ভীষণ জ্বর! তিনি বললেন, إِنَّا كَذَلِكَ، يَشْتَدُّ عَلَيْنَا الْبَلاءُ، وَيُضَاعَفُ لَنَا الأَجْرُ ‘আমাদের এরূপ হয়ে থাকে। আমাদের উপর কঠিন বিপদ আসে এবং আমাদের দ্বিগুণ প্রতিদান দেয়া হয়’। আবু সাঈদ (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! মানুষের মধ্যে সবচেয়ে কঠিন বিপদের সম্মুখীন হন কারা? তিনি বললেন, الأَنْبِيَاءُ، ثُمَّ الصَّالِحُونَ، وَقَدْ كَانَ أَحَدُهُمْ يُبْتَلَى بِالْفَقْرِ حَتَّى مَا يَجِدُ إِلا الْعَبَاءَةَ يَجُوبُهَا فَيَلْبَسُهَا، وَيُبْتَلَى بِالْقُمَّلِ حَتَّى يَقْتُلَهُ، وَلأَحَدُهُمْ كَانَ أَشَدَّ فَرَحًا بِالْبَلاءِ مِنْ أَحَدِكُمْ بِالْعَطَاءِ- ‘নবী-রাসূলগণ, অতঃপর আল্লাহর অন্যান্য সৎকর্মশীল বান্দাগণ’। তঁাদের কাউকে এমন দারিদ্র্য দিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে যে একটি জুববা ছাড়া তঁার পরার মত কিছুই ছিল না। কেউ উকুনের মাধ্যমে পরীক্ষিত হয়েছেন। অবশেষে তা তঁাকে হত্যা করেছে। নিঃসন্দেহে তোমাদের কেউ পুরস্কার লাভে যত খুশি হয়, তঁাদের কেউ বিপদে পতিত হ’লে ততোধিক খুশি হ’তেন’।[2]

ইব্রাহীম (আঃ)-এর মৃত্যু যন্ত্রণা : ইব্রাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে,لَمَّا تُوُفِّيَ إِبْرَاهِيْمُ عَلَيْهِ السَّلَامُ لَقِيَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ فَقِيلَ لَهُ: يَا إِبْرَاهِيمُ، كَيْفَ وَجَدْتَ الْمَوْتَ؟ قَالَ: يَا رَبِّ، وَجَدَتُ نَفْسِي تَنْزِعُ بِالْبَلَاءِ، فَقِيلَ: فَقَدْ هَوَّنَّا عَلَيْكَ ‘যখন ইব্রাহীম (আঃ) (মৃত্যুর পর) আল্লাহ তা‘আলার সাথে সাক্ষাত করলেন, তখন তাকে বলা হ’ল, হে ইব্রাহীম, তুমি মৃত্যুকে কীরূপ পেয়েছ? তিনি বললেন, হে রব, আমি নিজেকে দুঃখ-কষ্টে পরাস্ত পেয়েছি। তখন বলা হ’ল, আমরা তোমার জন্য সহজ করেছি’।[3] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ওহে বন্ধু, তুমি মৃত্যুকে কীভাবে পেলে? তিনি বললেন, ভেজা পশমে রাখা উত্তপ্ত কম্বলের মত, তারপর তিনি তা টেনে বের করলেন এবং বললেন, হে ইব্রাহীম, আমরা তোমার জন্য সহজ করে দিয়েছি’।[4]

মূসা (আঃ)-এর মৃত্যুর সময়কার অবস্থা : মূসা (আঃ)-এর রূহ যখন কবয করা হ’ল তখন আল্লাহ তা‘আলা তাকে বললেন,يَا مُوْسَى كَيْفَ وَجَدْتَ الْمَوْتَ قَالَ وَجَدْتُ نَفْسِيْ كَالْعُصْفُوْرِ حِيْنَ يُقْلَى عَلَى الْمِقْلَاةِ لَا يَمُوْتُ فَيَسْتَرِيْحُ وَلَا يَنْجُوْ فَيَطِيْرُ ‘হে মূসা, তুমি মৃত্যুকে কীরূপ পেলে? তিনি বললেন, আমি নিজেকে একটি জীবন্ত চড়ুই পাখির মত পেয়েছি। যখন এটি একটি উত্তপ্ত কড়াইয়ে ভাজা হয়, এটি মরে না যে সে বিশ্রাম নিবে। আবার মুক্তিও পায় না যে সে উড়ে যাবে’।[5] অন্য বর্ণনায় রয়েছে, মূসা (আঃ) বললেন, وَجَدْتُ نَفسِي كَشَاة تَسلخُ بِيَدِ القَصَّاب وهِيَ حَيٌّ- ‘আমি নিজেকে একটি জীবন্ত ভেড়ার মত খুঁজে পেয়েছি, কসাই দ্বারা যার চামড়া তুলে নেওয়া হচ্ছে (আত-তাযকিরাহ ১/২০)

মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মৃত্যু যন্ত্রণা : আল্লাহ যাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছিলেন তঁাকেও মৃত্যু যন্ত্রণার মুখোমুখি হ’তে হয়েছে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘আমার ওপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ হ’ল এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার ঘরে, আমার নিকটে থাকার দিনে এবং আমার বুক ও গলার মধ্যবর্তী স্থানে হেলান দেয়া অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। আর (তঁার ইন্তেকালের আগ মুহূর্তে) আল্লাহ তা‘আলা আমার মুখের লালার সাথে তঁার মুখের লালাও মিশিয়ে দিয়েছেন।

আব্দুর রহমান ইবনু আবুবকর মিসওয়াক হাতে আমার কাছে আসলেন। তখন নবী করীম (ছাঃ) আমার সাথে হেলান দেয়া অবস্থায় ছিলেন। আমি দেখলাম, তিনি ঐ মিসওয়াকটির দিকে তাকাচ্ছেন। আমি বুঝতে পারলাম তিনি মিসওয়াক করতে চাচ্ছেন। অতএব আমি বললাম, আমি কি মিসওয়াকটি আপনার জন্য নিব? তিনি মাথা নেড়ে হ্যঁা-বাচক ইঙ্গিত করলেন। অতঃপর আমি মিসওয়াকটি নিয়ে তঁাকে দিলাম। কিন্তু তা দিয়ে মিসওয়াক করা তঁার জন্য কষ্টকর হ’ল। তখন বললাম, আমি কি এটাকে আপনার জন্য নরম করে দিব? তিনি মাথা হেলিয়ে হ্যঁা-বাচক ইঙ্গিত করলেন। তখন আমি সেটা নরম করে দিলাম। অতঃপর তিনি তা ব্যবহার করলেন।

অতঃপর তঁার সামনে একটি পাত্রে পানি রাখা ছিল, তাতে তিনি উভয় হাত ডুবিয়ে হাত দু’টি দ্বারা আপন চেহারা মাসাহ করলেন। এ সময় তিনি বলছিলেন, ‘লা ইল্লাহা ইল­াল্লাহ’, অবশ্যই মৃত্যুর যন্ত্রণা ভীষণ কঠিন। অতঃপর তিনি হাত উঠিয়ে আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে বলতে থাকলেন, ‘ফীর-রফীক্বিল আ‘লা’ (উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন বন্ধুর সাথে আমাকে মিলিত কর)। এ কথা বলতে বলতে তিনি ইন্তেকাল করেন এবং তঁার হাত নিচে নেমে আসে’।[6]

অপর এক বর্ণনায় আয়েশা (রাঃ) বলেন, مَاتَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم وَإِنَّهُ لَبَيْنَ حَاقِنَتِى وَذَاقِنَتِى، فَلاَ أَكْرَهُ شِدَّةَ الْمَوْتِ لأَحَدٍ أَبَدًا بَعْدَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم ‘নবী করীম (ছাঃ) আমার বুক ও চিবুকের মাঝে মাথা রেখে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাই নবী করীম (ছাঃ)-এর পর আর কারু মৃত্যু যন্ত্রণাকে আমি খারাপ মনে করি না’।[7]

রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুযন্ত্রণা সম্পর্কে তঁার ১০ বছরের খাদেম আনাস (রাঃ) বলেন,لَمَّا وَجَدَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِنْ كَرْبِ الْمَوْتِ مَا وَجَدَ، قَالَتْ: فَاطِمَةُ وَا كَرْبَ أَبَتَاهُ، فَقَالَ: رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا كَرْبَ عَلَى أَبِيكِ بَعْدَ الْيَوْمِ، إِنَّهُ قَدْ حَضَرَ مِنْ أَبِيكِ مَا لَيْسَ بِتَارِكٍ مِنْهُ أَحَدًا، الْمُوَافَاةُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মৃত্যুযন্ত্রণা তীব্রভাবে অনুভব করছিলেন, তখন ফাতেমা (রাঃ) বলেন, হায় আমার আববার কত কষ্ট! তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আজকের দিনের পরে তোমার আববার আর কোন কষ্ট থাকবে না। তোমার আববার নিকট এমন জিনিস উপস্থিত হয়েছে, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত কাউকে ছাড়বে না’।[8]

অপর এক বর্ণনায় আনাস (রাঃ) বলেন, ‘যখন নবী করীম (ছাঃ) বেশী অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং তাকে কষ্ট ঘিরে ফেলল, তখন (তঁার কন্যা) ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায়! আববাজানের কষ্ট! তিনি এ কথা শুনে বললেন, আজকের দিনের পর তোমার পিতার কোন কষ্ট হবে না। অতঃপর যখন তিনি দেহত্যাগ করলেন, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, হায়! আববাজানের প্রভু যখন তঁাকে আহবান করলেন, তখন তিনি তঁার ডাকে সাড়া দিলেন। জান্নাতুল ফিরদাউস তাঁর বাসস্থান। হায় আববাজান! আমরা জিব্রীলকে আপনার মৃত্যু সংবাদ দিব। অতঃপর যখন তঁাকে সমাধিস্থ করা হ’ল, তখন ফাতেমা (রাঃ) বললেন, يَا أَنَسُ، أَطَابَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوا عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم التُّرَابَ- ‘হে আনাস! আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর উপর মাটি ফেলতে কি তোমাদের ভাল লাগল?[9]

আবুবকর (রাঃ)-এর অনুভূতি : যখন আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) মারা যাচ্ছিলেন, তখন আয়েশা (রাঃ) বললেন, আপনার জীবনের কসম, একজন যুবকের জন্য সম্পদের কোন কাজ নেই... যেদিন সে (মৃত্যু) তার কাছে ভিড় করে এবং যার দ্বারা বক্ষ সংকীর্ণ হয়ে যায়। তখন আবুবকর (রাঃ) বললেন, لَيْسَ كَذَلِكَ وَلَكِنْ وَجَاءَتْ سَكْرَةُ الْمَوْتِ بِالْحَقِّ ذَلِكَ مَا كُنْتَ مِنْهُ تَحِيْدُ- ‘এমনটা বলো না। বরং বল, ‘আর মৃত্যু যন্ত্রণা আসবেই সুনিশ্চিতভাবে। যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে’ (ক্বাফ ৫০/১৯)। অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেছেন, যখন আবুবকর (রাঃ)-এর মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তখন আমি নিম্নের পঙক্তিটি আবৃত্তি করলাম, ‘যার অশ্রুমালা ছিল সর্বদা আবৃত মস্তক... খুব শিগ্রই তা সজোরে নির্গত হবে’। তখন আবুবকর (রাঃ) বললেন, ‘এমনটা বলো না। বরং বল, আর মৃত্যু যন্ত্রণা আসবেই সুনিশ্চিতভাবে। যা থেকে তুমি পালিয়ে বেড়াতে (ক্বাফ ৫০/১৯)। তখন তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কয়টি কাপড়ে কাফন দেওয়া হয়েছিল? আয়েশা (রাঃ) বললেন, তিনটি মসৃণ সাদা কাপড়ে। আবুবকর (রাঃ) তঁার পরনে যে কাপড় ছিল সেটার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, আয়েশা! এই কাপড়টি ধর এবং যাতে গেরুয়া রং অথবা জাফরান লেগেছিল সেটাকে ধৌত কর। তারপর দু’টি কাপড়ের সাথে মিলিয়ে এ কাপড়ে আমাকে তোমরা কাফন দিও। এটা শুনে আয়েশা (রাঃ) বললেন, এটা কীজন্য! নতুন কাপড় কি পাওয়া যাবে না? আবুবকর (রাঃ) বললেন, الْحَيُّ أَحْوَجُ إِلَى الْجَدِيدِ مِنْ الْمَيِّتِ وَإِنَّمَا هَذَا لِلْمُهْلَةِ- ‘মৃত ব্যক্তি অপেক্ষা জীবিত লোকেরই নতুন কাপড়ের প্রয়োজন বেশী, আর মৃতের পুঁজের জন্য এই কাপড়ই যথেষ্ট’।[10]

ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর অনুভূতি : মৃত্যু চিরন্তন সত্য। একে সবাই ভয় পায়। সেজন্য একদিন ওমর (রাঃ) কা‘বকে বললেন, حَدِّثْنَا عَنِ الْمَوْتِ قَالَ: نَعَمْ يَا أَمِيرَ الْمُؤْمِنِينَ غُصْنٌ كَثِيرُ الشَّوْكِ أُدْخِلَ فِي جَوْفِ رَجُلٍ فَأَخَذَتْ كُلُّ شَوْكَةٍ بِعِرْقٍ ثُمَّ جَذَبَهُ رَجُلٌ شَدِيدُ الْجَذْبِ فَأَخَذَ مَا أَخَذَ وَأَبْقَى مَا أَبْقَى- ‘আমাদেরকে মৃত্যুর ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করুন। তিনি বললেন, জী হে আমীরুল মুমিনীন! একজন মানুষের পেটে অনেক কঁাটাযুক্ত একটি ডাল প্রবেশ করানো হ’ল। অতঃপর যখন প্রতিটি কঁাটা একটি করে রগ ধরে নিল, তখন লোকটি তা সজোরে টেনে নিল। এতে যেগুলো আসার সেগুলো ছিঁড়ে চলে আসল আর বাকীগুলো সেভাবেই রয়ে গেল’।[11]

ওমর (রাঃ) আবু লূলূ কর্তৃক ছুরিকাঘাত প্রাপ্ত হওয়ার পর মুমূর্ষু অবস্থায় দুধ পান করতে চাইলেন। তাকে দুধ এনে দেওয়া হ’লে তিনি তা পান করলেন। এরপর ক্ষত স্থান দিয়ে দুধ বেরিয়ে পড়ে গেল তখন তিনি মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতর হয়ে বললেন, الْآنَ لَوْ أَنَّ لِيَ الدُّنْيَا كُلَّهَا لَافْتَدَيْتُ بِهَا مِنْ هَوْلِ الْمَطْلَعِ، ‘এখন যদি আমার কাছে পুরো বিশ্ব থাকত তবে আমি মৃত্যুর যন্ত্রণা থেকে বঁাচতে এর সম্পূর্ণটা মুক্তিপণ দিতাম’।[12]

ওমর (রাঃ)-এর মৃত্যু যন্ত্রণা সম্পর্কে তার সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,كَانَ رَأْسُ عُمَرَ عَلَى فَخِذِي فِي مَرَضِهِ الَّذِي مَاتَ فِيهِ، فَقَالَ لِي: ضَعْ رَأْسِي عَلَى الْأَرْضِ. فَقُلْتُ: وَمَا عَلَيْكَ كَانَ عَلَى فَخِذِي أَمْ عَلَى الْأَرْضِ؟ قَالَ: ضَعْهُ عَلَى الْأَرْضِ لَا أُمَّ لَكَ، ‘ওমরের মাথা আমার উরুর উপর ছিল তার ঐ অসুস্থতার সময় যাতে তিনি মারা গেছেন। তিনি আমাকে বললেন, আমার মাথা মাটিতে রাখ। আমি বললাম, এটা আমার উরুর উপর থাক বা মাটিতে থাক তাতে আপনার কী অসুবিধা আছে? তিনি বললেন, মাটিতে রাখো, তোমার মা ধ্বংস হৌক’। তিনি বললেন, অতঃপর আমি তঁার মাথা মাটিতে রেখে দিলে তিনি বললেন,وَيْلِي وَوَيْلٌ أُمِّي إِنْ لَمْ يَرْحَمَنِي رَبِّي عَزَّ وَجَلَّ ‘আফসোস আমার জন্য এবং আমার মায়ের জন্য, যদি আমার প্রভু আমার প্রতি দয়া না করেন’।[13]

ওছমান ইবনুল আফফান (রাঃ)-এর অনুভূতি : আ‘লা ইবনুল ফযল তার পিতার সূত্রে বলেন, যখন ওছমান বিন আফফান (রাঃ)-কে হত্যা করা হ’ল, তখন তারা তার ধনভান্ডারগুলি তল্ল­­াশি করল এবং সেগুলোর মধ্যে একটি তালাবদ্ধ বাক্স দেখতে পেল। অতঃপর তারা এটি খুললে এর ভিতরে একটি কাগজের টুকরো পেল। যাতে লেখা ছিল, এটি ওছমান ইবনু আফফানের অছীয়ত। পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে ওছমান ইবনু আফফান সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তার কোন শরীক নেই, এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তঁার বান্দা ও রাসূল। আল্লাহ তঁার উপর রহম বর্ষণ করুন এবং তাঁকে শান্তি দান করুন। জান্নাত সত্য এবং জাহান্নাম সত্য, যারা কবরে আছে তাদেরকে আল্লাহ তা‘আলা এমন একটি দিনে পুনরুত্থিত করবেন, যাতে কোন সন্দেহ নেই। নিশ্চয়ই আল্লাহ তঁার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন না। তিনি এর উপর জীবিত থাকবেন এবং এর উপরেই তিনি মৃত্যুবরণ করবেন এবং এর উপরেই তিনি পুনরুত্থিত হবেন ইনশাআল্লাহ’।[14]

আব্দুল্ল­াহ ইবনু সালাম হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, ‘আমি ওছমানের কাছে এসেছিলাম তাকে সালাম জানাতে যখন তিনি অবরুদ্ধ ছিলেন। যখন আমি তঁার কাছে প্রবেশ করলাম তিনি বললেন, ‘স্বাগতম, আমার ভাই! আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে স্বপ্নে দেখেছি। আজ রাতে এই খাওখায় তিনি বললেন, ‘হে ওছমান! তারা কি তোমাকে অবরোধ করেছে?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, ‘তুমি কি পিপাসিত?’ আমি বললাম, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি এক বালতি পানি নিয়ে এলেন এবং আমি পান করলাম যতক্ষণ না আমার তৃষ্ণা নিবারণ হ’ল। আমি আমার বুকে এবং আমার কঁাধের মধ্যে এর শীতলতা অনুভব করলাম এবং তিনি আমাকে বললেন, ‘যদি তুমি চাও, তবে তুমি বিজয়ী হবে। তুমি চাইলে আমাদের সাথে ইফতার করতে পারবে। তাই আমি তার সাথে আমার ইফতার করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আর সেদিনই তাকে শহীদ করা হয়’।[15]

আলী (রাঃ)-এর অনুভূতি : শা‘বী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, যখন আলী ইবনু আবু তালেব (রাঃ) খারেজী কর্তৃক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে বলেছিলেন, আমার আক্রমণকারী কী করছে? তারা বলল, আমরা তাকে পাকড়াও করেছি। তিনি বললেন, ‘আমার খাবার থেকে তাকে খেতে দাও এবং আমার পানি থেকে তাকে পান করাও। কারণ আমি বেঁচে থাকলে আমি তার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারব। আর যদি আমি মারা যাই তবে তাকে এক আঘাতে শেষ করে দিও। তার চেয়ে বেশী করো না। এরপর তিনি হাসান (রাঃ)-কে তঁাকে গোসল করানোর ব্যাপারে ও কাফনের কাপড়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি না করতে অছীয়ত করেন। তিনি বললেন, আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তোমরা কাফনের কাপড়ের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করবে না। কারণ এটি দ্রুত ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আমাকে দুইজন পায়দলের মধ্যে নিয়ে হঁাটবে। আমাকে নিয়ে তাড়াহুড়া করবে না এবং ধীরগতিও করবে না। কারণ আমি যদি ভাল হই তবে তোমরা আমাকে কবরে নিতে ত্বরান্বিত করবে। আর যদি খারাপ হই তবে তোমরা নিজেদের কঁাধ থেকে আমাকে (কবরস্থ করার মাধ্যমে) নিক্ষেপ করবে’।[16] (ক্রমশ)

আব্দুর রহীম

[লেখক : গবেষণা সহকারী, হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ]


[1]. আহমাদ হা/১৮৫৫৭; মিশকাত হা/১৬৩০; ছহীহুত তারগীব হা/৩৫৫৮।

[2]. আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫১০; ছহীহুত তারগীব হা/৩৪০৩।

[3]. ইমাম আহমাদ, আয-যুহুদ হা/৪১০ পৃ.।

[4]. কুরতুবী, আত-তাযকিরাহ ১/১৫১ পৃ.।

[5]. আত-তাযকিরাহ ১/১৫২ পৃ.; গাযালী, ইহইয়াহ ৪/৪৬৩ পৃ.; ইবনুল জাওযী, বুস্তানুল ওয়ায়েযীন হা/২৫৫ পৃ.।

[6]. বুখারী হা/৪৪৪৯; মিশকাত হা/৫৯৫৯।

[7]. বুখারী হা/৪৪৪৬; মিশকাত হা/১৫৪০।

[8]. ইবনু মাজাহ হা/১৬২৯; ছহীহাহ হা/১৭৩৮।

[9]. বুখারী হা/৪৪৬২; মিশকাত হা/৫৯৬১।

[10]. মুয়াত্ত্বা মালেক হা/১০১২; ইবনু হিববান হা/৩০৩৬, সনদ ছহীহ।

[11]. ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৫৬৪৩; আল-আকিবাতু ফী যিকরিল মাউত ১/১১৪ পৃ.।

[12]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৪৪৬৩; ইবনুল জাওযী, আত-তাবছিরাহ ২/২১১ পৃ.।

[13]. মুসনাদু ইবনুল জা‘দ হা/৮৭০; হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/৫২ পৃ.।

[14]. আবু সুলায়মান রিবাঈ, ওয়াছাইয়াল ওলামা ১/৩৯ পৃ.।

[15]. ইবনু হিববান হা/৬৯১৯; হাকেম হা/৪৫৫৪; আল-বিদায়াহ ৭/১৮৩ পৃ.; ইবনু হাজার, আল-মাতালিবুল আলিয়াহ ১৮/৪২ পৃ.।

[16]. আবু সুলায়মান রিবাঈ, ওয়াছাইয়াল ওলামা ১/৪০ পৃ.।



বিষয়সমূহ: মৃত্যু
আরও