খোদা প্রাপ্তির জন্য পীর-মুর্শিদের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজন নাই
মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী 220 বার পঠিত
পাক-হিন্দ ভূভাগের মুসলিম জাতির আযাদী আন্দোলন কোনকালেই একটি বিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা ছিলোনা। শুরু থেকেই মুসলিম জাতির আযাদী আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলো বিদেশী সামাজ্যবাদীর শাসনমুক্ত ইসলামী শরীয়াতের (আইন) বিধান অনুযায়ী পরিচালিত একটা সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করা। এই মূল লক্ষ্যে পৌঁছবার জন্যে মুসলিম জাতির আযাদী আন্দোলনের বীর মুজাহিদ দল কখনো সশস্ত্র অভ্যুত্থান দ্বারা কখনওবা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন দ্বারা আযাদী হাসিল করতে চেয়েছেন। এই আযাদী আন্দোলন তাদের নিকট ছিলো ইসলামী জীবনধারাকে প্রতিষ্ঠিত করবার সামগ্রিক জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। তাই মুসলিম মুজাহিদদের কেউ কেউ অধ্যয়ন ও ইজতিহাদকেই জীবনের ব্রত করে নিয়েছিলেন। কেউ কেউ আল-কুরআনের ভাষ্যরচনা ও প্রচারকার্যে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, কেউবা হাদীছের অধ্যাপনায় জান কোরবান করে দিয়েছিলেন। এক কথায় বলা যায়, পাক-হিন্দ ভূভাগের মুসলিম জাতির আযাদী আন্দোলন তখন প্রাথমিক প্রস্ত্ততিপর্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। এই প্রস্ত্ততিপর্বের অগ্রনায়ক ছিলেন শাহ ওলীউল্লাহ দেহলভী। এই পর্বের একটা স্তরে মুসলিম আযাদী আন্দোলন সশস্ত্র জিহাদে রুপান্তরিত হয়। হযরত সৈয়দ আহমদ বেরেলবী এবং হযরত শাহ ইসমাইল শহীদ ছিলেন এই সশস্ত্র জিহাদের কর্ণধার। শিখ, বৃটিশ ও হিন্দু অর্থ্যাৎ ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চরম বিরোধী ত্রয়ীশক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মুসলিমদের জিহাদ আন্দোলন কিছু দিনের জন্যে ব্যাহত হয়ে পড়ে। কিন্তু মুসলিম জিহাদী শক্তি কোনদিনই নিষ্ক্রিয় থাকেনি। কেননা জিহাদ অর্থাৎ ইসলাম বিরোধী পরিবেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম মুসলিম জাতির প্রতিদিনের কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকে।
জিহাদ আন্দোলন তথা মুহাম্মদী আন্দোলন
আদর্শের দিক থেকে পাক-হিন্দ ভূভাগের প্রথম জিহাদ আন্দোলনটিকে বলা হয়েছে ‘তরীকা-ই মুহাম্মদী’ আন্দোলন। কেননা আন্দোলনকারীগণ মুহাম্মাদের (দঃ) তরীকা (পথ) তথা বাণী ও আচরণের ভিত্তিতে নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আন্দোলনের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এই আন্দোলনকে হাদীছের দিকে প্রত্যাবর্তনের আন্দোলন বা আহ্ল-ই-হাদীছ আন্দোলন বলা চলে। এই আন্দোলনের একটা সামগ্রিক কর্মসূচী ছিলো। এই কর্মসূচীটি মোটামুটিভাবে নিম্নরূপ-
(ক) আল-কুরআন ও হাদীছের ভিত্তিতে ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবন গড়ে তোলা।
(খ) ইসলামী চিন্তাস্বাধীনতাকে (ইজতিহাদ) সব যুগের জন্য উন্মুক্ত রাখা।
(গ) ইসলামের শাশ্বত আর্দশের ভিত্তিতে বিশ্ব মুসলিমের সার্বজনীন ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করা। এই জন্যেই এ আন্দোলন গণভিত্তিতে গড়ে উঠতে পেরেছিলো।
(ঘ) ইসলামবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সামগ্রিক জিহাদ পরিচালনা করা এবং খিলাফতে-রাশিদার আদর্শে একটি সমাজ ও রাষ্ট্র কায়েম করা (এজন্যেই এই আন্দোলনকারীরা বৃটিশ, শিখ ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হ’তে বাধ্য হয়েছিলেন।)
(ঙ) মুসলিম জাতির অন্তুর্ভুক্ত মাযহাবী (দলীয়) অনুশাসনের বাধ্যবাধকতা অস্বীকার করা এবং কোরআন ও হাদীছের আলোকে ইজতিহাদের মারফৎ ব্যক্তিগত ও সমাজ জীবনের বিবিধ সমস্যার সমাধান করা।
(চ) ইসলামি তমদ্দুনের সংরক্ষণ ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা কার্যকরী করণ।
(ছ) ‘শিরক’ (বহুত্ববাদ) ও বিদ্আত তথা সামাজিক কুসংস্কার ও গতানুগতিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করা।
এই সামগ্রিক আন্দোলনের কর্মসূচীতে জিহাদ আন্দোলন একটি দিকমাত্র। সাধারণভাবে সেদিকটা সম্পর্কেই আমরা কিছুটা ওয়াকিফহাল। আমাদের নিকট এই দিকটি বৃটিশ কথিত ‘ওয়াহাবী আন্দোলন’ নামে পরিচিত। কিন্তু আজ পাকিস্তানে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার তাকিদে এই আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ভূমিকা সম্পর্কে সামগ্রিক আলোচনা প্রয়োজন। বক্ষ্যমান প্রবন্ধে সে সম্পর্কে আলোচনা করার অবকাশ সামান্য। তবু আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে এই আন্দোলনের সাময়িক প্রচেষ্টা সাফল্যমন্ডিত হয়েছিলো। পরবর্তী সমস্ত আযাদী আন্দোলনেই তার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ১৮৩১ সালের বালাকোটের প্রথম সশস্ত্র অভ্যূত্থানই যে ১৮৫৭ সালের সিপাহী জিহাদের অগ্রদূত, ইতিহাসের সন্ধানী পাঠকের নিকট তা অবিদিত নয়।
জিহাদ আন্দোলন বনাম সিপাহী জিহাদ
সিপাহী জিহাদ যে দাবদাহের সৃষ্টি করে, তার উত্তাপ পূর্ববর্তী জিহাদ আন্দোলনের তুলনায় প্রচন্ড মনে হলেও প্রকৃতবিচারে সিপাহী আন্দোলন জিহাদ পূর্বোক্ত মুসলিম জিহাদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সাফল্য অর্জন করেছে। কেননা প্রথমোক্ত জিহাদটি পরিচালিত হয়েছিলো ‘খিলাফতে রাশিদার’ আদর্শে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিয়ে। জিহাদ পরিচালনাকারী নেতৃত্ব যদি আদর্শস্থির এবং অবিচল না হতেন, তাহলে হয়তো পাক-হিন্দ ভূভাগের পশ্চিমপ্রান্তে বৃটিশ প্রভাবাধীন একটি তথাকথিত মুসলিম রাষ্ট্র আমরা আজ পর্যন্ত বিরাজমান দেখতে পেতাম। কিন্তু জিহাদকারীরা চেয়েছিলেন পূর্ণাংগ আযাদ খিলাফত। তাই তঁারা আপাততঃ ব্যর্থ হলেও আদর্শনিষ্ঠার যে অতুলনীয় দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, তা পরবর্তী কালের ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সেনানীদের প্রেরণা স্বরূপ হতে পেরেছে। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহ সুস্পষ্ট আদর্শিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিচালিত হয়নি। পূর্ববর্তী জিহাদ আন্দোলনের ব্যর্থতায় সমগ্র দেশব্যাপী যেসব মুজাহিদ অসহিষ্ণু এবং ধৈর্যহীন হয়ে পড়েছিলেন, তঁাদের এক বৃহত্তর অংশ এই সিপাহী জিহাদের বিভিন্ন পর্যায়ে শামিল হয়েছিলেন। তঁাদের লক্ষ্য নিঃসন্দেহে ছিলো সিপাহী সংগ্রামের মারফত পাক-হিন্দ ভূভাগে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সিপাহী জিহাদের নেতৃত্বের এক অংশ ভেঙ্গে পড়া পুরানো মোগল ‘সাম্রাজ্যের’ পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখতেন। এই অংশই দিল্লীর নামমাত্র গোদ্দিনশীন বাহাদুর শাহকে পাক হিন্দের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। সিপাহী বিদ্রোহ সফল হলে এই দু’ধরণের মনোভঙ্গীর মধ্যে হয়তো একটা সামঞ্জস্য বিধান করা সম্ভব হতো। কেননা পূর্ববর্তী ইসলামী আন্দোলন দেশের জনগণের মধ্যে ইসলামী চেতনা অনেকাংশে জাগ্রত করতে পেরেছিলো।
এই চেতনা মোগল রাজতন্ত্রের ধ্বংসের ভিত্তিতে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অনুকূল ছিলো। কিন্তু সিপাহী বিদ্রোহে আরো কতিপয় ধরণের মুক্তিসেনানীর সমাবেশ ঘটেছিলো। এদের মধ্যে বিশেষভাবে মারাঠা শক্তির কথা বলা যেতে পারে। এই শক্তির লক্ষ্য ছিল মুসলিম শক্তির সহযোগিতায় বৃটিশ বিতাড়ন করে দেশের ‘শিবাজী মতবাদের’ ভিত্তিতে বৃহত্তর মারাঠা রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করা। সিপাহী জিহাদে বিভিন্ন ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন ব্যক্তিদের বৃটিশ বিতাড়ন নীতির নূন্যতম কর্ম্মসূচীর ভিত্তিতে এক আশ্চর্য মিলনক্ষেত্র রচিত হয়েছিলো। এই ‘আশ্চর্য মিলনই’ প্রকৃতপ্রস্তাবে সিপাহী জিহাদের ব্যর্থতার মূল কারণ। কারণ এতে করেই আন্দোলনের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারেনি। আদর্শগত দৃষ্টিভংগি এবং নেতৃত্বের ঐক্যের দিক থেকে নিঃসন্দেহে সিপাহী জিহাদের পূর্ববর্তী মুসলিম সশস্ত্র অভ্যুত্থান অধিকতর স্বার্থকতা হাসিল করে।
সিপাহী জিহাদের স্বার্থকতা
কিন্তু তাহলে সিপাহী জিহাদ একেবারে ব্যর্থ হয়েছে এ কথা বলা চলেনা। আযাদী-পাগল মুসলিমগণের যে অভিব্যক্তি সিপাহী জিহাদের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে, তা শুধুমাত্র মুসলিম সিপাহীদের মধ্যেই। সাম্রাজ্যবাদীর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার দুর্বার আকাংখায় তারা ব্যাপকভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। পরাধীনতার গ্লানি মুসলিম জীবন ও মানসিকতাকে যেভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো, হিন্দু সমাজকে ততখানি আলোড়িত করতে পারেনি। কারণ হিন্দু সমাজ বৃটিশ আবির্ভাবকে আশীর্ববাদ স্বরূপ ধরে নিয়েছিলো। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, পাঞ্জাবের শিখরাও সিপাহী সংগ্রামের যোগদান করেনি। লর্ড ডালহৌসী ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবের স্বাধীন শিখরাজ্য ইংরেজ রাজ্যভুক্ত করলেন। মাত্র আট বৎসরের মধ্যেই যে শিখ জাতির মধ্যে স্বাধীনতাস্পৃহা বিদূরিত হয়ে গিয়েছিলো, তা বিশ্বাস করা মুশকিল। এর কারণ অনুসন্ধান করলে আমরা সিপাহী সংগ্রামের পূর্ববর্তী মুজাহিদ আন্দোলনের মধ্যেই এর কারণ নিহিত পাই। শিখদের নিকট বৃটিশ কথিত ওয়াহাবীরাই বৃটিশ অপেক্ষা অধিকতর বড় শত্রু ছিলো। আর সিপাহী বিপ্লবেও সেই পূর্বতন জিহাদপন্থীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। এজন্যই শিখরা সিপাহী সংগ্রামে শামিল হয়নি। যাহোক সিপাহী বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু এ কথাই বলতে চাই যে, জাতি হিসেবে সিপাহী জিহাদ মুসলমানরাই পরিচালনা করেন এবং জিহাদের অবসানে সামগ্রিকভাবে মুসলমানরাই এর ফল ভোগ করেন। কিন্তু জিহাদ বৃথা যায়নি। মুসলিম জাতি হিন্দু এবং শিখদের পশ্চাতপসারণ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পেরেছে। হিন্দু সমাজ যেখানে রাজশক্তির পরিবর্ত্তনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছিল, মুসলমানরা তা না পারলেও পরিবর্ত্তনকে গ্রহণ করে আযাদীর জন্য নতুন অধ্যায় রচনা করবার কাজে তঁারাও এগিয়ে এলেন। সুতরাং জিহাদোত্তর কালকে মুসলিম রেনেসাঁর যুগ বলা যেতে পারে। নতুন উদ্যোগ, নতুন আয়োজন, শিক্ষার পুনর্গঠন, ইসলামী ইতিহাসের অনুশীলন, চিন্তাধারার পুনর্ববিন্যাস- মুসলিম স্বাতন্ত্রবোধ এবং মুসলিম জাতীয় সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি- এসবই হচ্ছে সিপাহী জিহাদোত্তর কালের মুসলিম রেনেসাঁর অবদান। বক্ষমান প্রবন্ধে আমি সে বিষয়েই আমার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখবো।
হিন্দু পুনরুত্থান আন্দোলন
মুসলিম রেনেসাঁ আন্দোলনের পাশাপাশি হিন্দু-সমাজের মধ্যে ধর্মীয় পুনরুত্থান আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছিল। মুসলিম সমাজের পূর্বোক্ত মুহাম্মদী আন্দোলন ও পরবর্তী রেনেসাঁ আন্দোলন যেমন মুসলিম জাতিত্ববোধের অগ্রদূত, তেমনি হিন্দু সমাজের ধর্মীয় পুনর্জাগরণের আন্দোলন হিন্দু জাতিত্ববোধের অগ্রদূত। মুসলিম সমাজের জাতীয় স্বাতন্ত্রবোধের ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে তাই আমাদেরকে হিন্দু সমাজের ধর্মীয় আন্দোলন সম্পর্কেও আলোকপাত করা প্রয়োজন।
বৃটিশ শাসনের আওতায় ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দু সমাজের এক অংশে ইউরোপীয় সংস্কৃতির ধরণে হিন্দু সংস্কৃতির পুনর্গঠনের আকাংখা ফুটে উঠে। এ সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রত্যক্ষ সাহায্য প্রাপ্ত খৃষ্টান মিশনারীদের দ্বারা বহু হিন্দু ধর্মান্তরিত হচ্ছিলেন। এর রোধকল্পে রামমোহন রায় বাংলাদেশে ১৮২৮ খৃস্টাব্দে ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত করেন। কেশবচন্দ্র সেন ‘ব্রাহ্ম সমাজকে’ ‘খৃস্টবিহীন খৃস্টান সমাজে’ রূপান্তরিত করেন।
কিন্তু গেঁাড়া সনাতনী হিন্দু সমাজ নীরবে বসে ছিলেন না। তঁারা তঁাদের ‘সমাজ ও ধর্ম’ রক্ষা করবার জন্যে ১৮৩৮ সালে কালীপ্রসাদ ঘোষের নেতৃত্বে ‘ধর্ম সভা’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। এই প্রতিষ্ঠান হিন্দু সমাজকে সংস্কার আন্দোলনের নামে হিন্দু ধর্মকে বিনষ্ট করবার চেষ্টা সম্পর্কে হুঁশিয়ার করতে থাকেন। গেঁাড়া হিন্দু পুনরুত্থানের এই ধারারই ব্যাপক পরিচয় পাই সিপাহী জিহাদোত্তরকালে ১৮৬৫ খৃস্টাব্দে গুজরাটের স্বামী দয়ানন্দ স্বরস্বতী প্রতিষ্ঠিত ‘আর্য-সমাজ’-এর মধ্যে। আর্য-সমাজের সেলাগান ছিল ‘বেদের দিকে প্রত্যাবর্তন কর’। এই সমাজ খৃস্টধর্মের বিরোধী হলেও ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করাই ছিল এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। পাঞ্জাব ও যুক্ত প্রদেশে এই ‘আর্য-সমাজ’ ব্যাপক সমর্থন লাভ করে।
স্বামী দয়ানন্দের প্রায় সমসাময়িক সময়ে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস বাংলার ইংরাজী শিক্ষিত সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করেন। তা তঁার প্রধান শীর্ষ বিবেকান্দ বেদান্ত দর্শনের ভিত্তিতে হিন্দু সমাজকে পুনর্গঠন করবার জন্যে আহবান জানান। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত করেন। বহির্জগতে হিন্দু ধর্মের মর্যাদা বর্ধনার্থ তিনি ১৮৯৩ খৃস্টাব্দে ‘শিকাগোতে’ ‘বিশ্ব ধর্ম সম্মেলনে’ যোগদান করেন। হিন্দু সমাজকে বলিষ্ঠ জীবন দর্শনে উদ্বুদ্ধ করবার জন্যে তিনি তাদেরকে উপনিষদের শক্তিমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়ার উদাত্ত আহবান জানান। ১৯০২ খৃস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বিবেকানন্দ তঁার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে ধর্ম বিষয়ে হয়তো উদার ছিলেন। তঁার ধারণা ছিল- For our own motherland a junction of the two great system, Hindoism and Islam Vedanta brain and Islam body is the only hope. বিবেকানন্দের পত্রাবলী থেকে পন্ডিত নেহরুর ‘The discovery of India গ্রন্থে উদ্ধৃত একটি পত্রের অংশ বিশেষে আমরা বিবেকানন্দের উল্লিখিত আশির্বাদের পরিচয় পাই। তিনি আরো বলেন- I see in my minds eye the future perfect India rising out of this code and strife, glorious and invincable with Vedanta brain and Islam body.
ইসলাম সম্পর্কে সামান্য ধারণাও যার রয়েছে তিনি বিবেকানন্দের উদ্ধৃত উক্তির সঙ্গে একমত হতে পারেননা। কিন্তু তা পারুন আর নাই পারুন বিবেকানন্দ যেভাবে ইসলামকে হিন্দুত্ববাদের আওতায় টেনে নিতে চেয়েছিলেন, ভারতীয় পরবর্তী রাজনীতিতে তার প্রভাব অত্যন্ত প্রবলভাবে অনুভূত হয়। হিন্দু কংগ্রেস তথা মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির ক্ষেত্রে মুসলিম জাতিকে হিন্দু জাতির মধ্যে নিমজ্জিত করে দেওয়ার যে মতলব চালিয়েছিলেন, তঁার ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি কি, আমরা বিবেকানন্দ ও অন্যান্য হিন্দু সংস্কার-আন্দোলন গুলোর মধ্যেই পাচ্ছি। অন্যান্য সংস্কার আন্দোলনসমূহের মধ্যে ১৮৬৭ খৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত বোম্বের প্রার্থনা সমাজ, ১৮৮২ খৃস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাজের ব্রহ্মজ্ঞান সমিতি (Theosophical Society) প্রভৃতির নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
এই সমস্ত আন্দোলনই ভারতীয় হিন্দু রাজনীতির জন্মদাতা। এস, আর, শর্মা লিখিত 'The making of modern India'র একটা উদ্বৃতি দেওয়ার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তিনি বলেন- It is common knowledge that be establishment of important political powers like those of the Marathas and the Sikhs where preceded by by great religious movements. Hence it is not be wondered that the birth of modern. 'swaraj movement' too was preceded by a vigorous religious revial. P 571
এখানে একটা লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, সিপাহী জিহাদের পরবর্তী হিন্দু রাজনীতিকে এই হিন্দু সংস্কার আন্দোলন যতই প্রভাবান্বিত করতে থাকে, মুসলিম সমাজ ততই ইসলামী তমদ্দুনের প্রতি অধিকতর সচেতন হতে থাকে। উপরন্তু সিপাহী জিহাদপূর্ববর্তী যে ইসলামী আন্দোলনের কথা পূর্বে বলা হয়েছে, তার প্রভাবও মুসলিম সমাজে ততই কার্যকরী হতে থাকে। তদুপরি খৃস্টান মিশনারীদের মোকাবিলায় মুসলমান সমাজেও ধর্মীয় আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এতে করে হিন্দু সমাজ হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে এবং মুসলিম সমাজ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতি সচেতনতার ভিত্তিতে সংগঠিত হতে থাকে। পাক-ভারতের দ্বিজাতিতত্ত্ব প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ও মুসলিম ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল।
সিপাহী জিহাদের সমকালীন সামাজিক অবস্থা
পাক-হিন্দের মুসলমান জাতি যখন মুহম্মাদী আন্দোলন ও সিপাহী জিহাদ নিয়ে ব্যস্ত, এ দেশের হিন্দু জনসাধারণ তখন ইংরাজী শিক্ষা গ্রহণ করবার জন্য ব্যাকুল। ১৮৩৫ খৃষ্টাব্দে মেকলে যখন ইংরেজীকে ভারতের শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে চালু করলেন, মুসলমানরা তখন ফারসীর মর্যাদা নষ্ট হওয়ার জন্য ক্ষুব্ধ। মিশনারী স্কুলসমূহে হিন্দু ছাত্ররা যখন ব্যাপকভাবে ভর্তি হচ্ছে, হিন্দু কলেজে যখন তারা উচ্চ ইংরাজী শিক্ষা গ্রহণ করছে, মুসলমানরা তখন ইংরেজী বর্জনের নীতি অবলম্বন করেছেন। এইভাবে অসহযোগিতার মারফত ইংরাজ শাসনকে বানচাল করাই ছিলো তাদের উদ্দেশ্য। ১৮৫৭ খৃষ্টাব্দে যখন পাক-হিন্দের মুসলিম জাতি সিপাহী জিহাদে মত্ত্ব তখন কোলকাতা, মাদ্রাজ এবং বোম্বেতে ইংরেজী বিশ্ববিদ্যালয় চালু হচ্ছে এবং হিন্দু সমাজ ইংরাজীতে সর্বোচ্চ শিক্ষাগ্রহণ গ্রহণের আয়োজন করছেন।
পাক-হিন্দের পূর্বতন শাসক সমাজকে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করাই ছিলো তদানীন্তন ব্রিটিশ নীতি। মোগল আমল থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বহু লাখেরাজ ভূ-সম্পত্তি প্রধানত: মুসলমানদের অধিকারভুক্ত ছিলো। ইংরেজ-শাসনে এই সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াফত করা হলো। তারপরে মুসলিম সমাজ দু’দিক থেকেই চরম দুর্গতির সম্মুখীন হলেন। প্রথমতঃ তাদের অনেকেই অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দের উপর নির্ভরশীল ছিলো। দ্বিতীয়ত সমস্ত সম্পত্তি প্রধানতঃ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্যই নির্ধারিত ছিল। সুতরাং এই সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াফত হওয়ায় মুসলিম সমাজ তাদের সাবেক শিক্ষা থেকেও চরমভাবে বঞ্চিত হলেন ।
এই বিপর্যয় মুসলমানদেরকে সিপাহী জিহাদের দিকে ঠেলে দেয়। তখনকার হিন্দু সমাজের চিত্রটি পন্ডিত নেহেরু সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন, হিন্দুরা তখন Looked up with admiration towards England and hoped to advance with her help and in cooperation with her (The discovery of India-p. 276).
সিপাহী জিহাদের প্রতি হিন্দু মনোভাবটি পন্ডিত নেহরুর বক্তব্যের মধ্য দিয়েই সুন্দর ফুটে উঠেছে, Not by fighting for a lost cause, the fendal order, mould freedom come. The making of Modern India গ্রন্থের লেখক এস, আর, শর্মা সিপাহী জিহাদে যারা যোগদান করেননি, তাদের সম্পর্কে বলেছেন- They were the indiret makers of modern India (P. 483).
সিপাহী বিপ্লবের পরবর্তী কালে ইংরাজরা স্বাভাবিক ভাবেই মুসলিম-নির্যাতন নীতি অবলম্বন করে এবং হিন্দু সমাজকে নিজেদের শাসন সুপ্রতিষ্ঠার বাহন হিসেবে পাওয়ার চেষ্টায় সার্থক হয়। সিপাহী জিহাদের পর সেনাবাহিনীতে মুসলিম প্রবেশ অসম্ভব হয়ে উঠে। সিপাহী যুদ্ধে ইংরেজদের সহযোগিতা করায় শিখ, অর্থারাজপুত প্রভৃতি শ্রেণী স্থায়ীভাবে সামরিক সম্প্রদায় বলে ইংরেজদের নিকট স্বীকৃতি লাভ করে। সরকারী চাকুরীর দ্বার মুসলমানদের জন্য অবরুদ্ধ হয়ে যায়। শিক্ষাবঞ্চিত, আর্থিক দুরবস্থায় নিপতিত, সরকারী কোপে নির্যাতিত মুসলিম সমাজ তার এই দুর্যোগ মুহূর্তে বলিষ্ঠ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে উপলব্ধি করছিলো। ঠিক এই সময়ে সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজে আবির্ভূত হলেন। (ক্রমশঃ)
অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী