ষড়রিপু সমাচার
লিলবর আল-বারাদী
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 369 বার পঠিত
উপস্থাপনা : ফিলিস্তীন একসময় ছিল ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয়রা পরাজয়ের পর ব্রিটেন ফিলিস্তীনের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ফিলিস্তীনে যারা থাকত তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল আরব, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু ইহূদী। কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্রিটেনকে দায়িত্ব দিল ইহূদী জনগোষ্ঠীর জন্য ফিলিস্তীনে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। তখন থেকেই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করল। ইহূদীরা এই অঞ্চলকে তাদের পূর্বপুরুষদের দেশ বলে দাবী করে বসল। ১৯২০ থেকে ১৯৪০ দশকের মধ্যে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহূদীরা ফিলিস্তীনে যেতে শুরু করলে এবং তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকল। ইউরোপে ইহূদী নিপীড়ন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভয়ংকর ইহূদী নিধনযজ্ঞের পর সেখান থেকে পালিয়ে এরা নতুন এক মাতৃভূমি তৈরীর স্বপ্ন দেখছিল। বিশেষ করে ১৯৩০ এর দশকে ইহূদীরা ইউরোপ থেকে এসে কৃষি খামার গড়ে তুলতে থাকে। বিশেষত ১৯৩৩ সালের পর যখন জার্মানির শাসক হিটলারের কঠোরতার প্রেক্ষিতে হাযার হাযার ইহূদী সেখানে আসতে শুরু করে। প্রাথমিকভাবে ইহূদীদের সাথে ফিলিস্তীনী আরবদের মোটামুটি ভাল সম্পর্ক থাকলেও ধীরে ধীরে মুসলিমরা বুঝতে থাকে যে ইহূদীরা এসে জমি ক্রয় করছে আর তারা তাদের জমি হারাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তীনকে ইহূদী ও আরবের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভোট দেয় ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ব্রিটেন যখন ফিলিস্তীন ছেড়ে যায়, সেদিনই ইহূদীরা নিজস্ব রাষ্ট্র ইস্রাঈলের ঘোষণা দেয়। ফলে দিনটিকে ফিলিস্তীনীরা ‘আল-নাকবা’ (النكبة) বা বিপর্যয়ের দিন হিসাবে দেখে।
হামাস প্রতিষ্ঠা : حماس ‘হামাস’ আরবী শব্দ। শাব্দিক অর্থ উদ্যম, সাহস, উদ্দীপনা, বীরত্ব। আর এর পূর্ণ রূপ হ’ল حركة المقاومة الاسلامية ‘হারাকাতুল মুকাওয়ামাহ আল-ইসলামিয়াহ’ বা ‘ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন’। হামাসের প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৮৭ সালে। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমাদ ইয়াসীন (১৯৩৬-২০০৪)। এ গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছিল যখন প্রথম ইন্তিফাদা বা সংগ্রামের অংশ ও মুসলিম ব্রাদারহুডের ফিলিস্তীনী শাখা হিসাবে।
ফিলিস্তীনে হামাসের অবস্থান ও হামাস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য : সংগঠনটির সনদ অনুযায়ী তারা ইস্রাঈলকে ধ্বংস করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আর তাদের চাওয়া হ’ল, ফিলিস্তীন রাষ্ট্র হবে বর্তমান ইস্রাঈল, গাযা ও পশ্চিম তীর নিয়ে গঠিত একক ইসলামী রাষ্ট্র। এজন্য হামাস গোষ্ঠীর প্রতি ফিলিস্তীনীদের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। কারণ হামাস কট্টর ইস্রাঈল বিরোধী। হামাসের জনহিতকর কর্মসূচীর জন্যও গোষ্ঠীটি ফিলিস্তীনীদের কাছে জনপ্রিয়।
ইন্তিফাদা কী : আরব-ইস্রাঈলী যুদ্ধের ২০ বছর পর ১৯৮৭ সালের শেষদিকে শুরু হয় ফিলিস্তীনীদের এক সংগ্রাম। সে সময় থেকে ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তির মধ্য দিয়ে সে দফায় ইন্তিফাদার অবসান ঘটে। হামাস অবশ্য তখন থেকেই সেই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। এটিই ‘প্রথম ইন্তেফাদা’ বা প্রথম গণজাগরণের আন্দোলন হিসাবে পরিচিত। ২০০০ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় দফা ইন্তিফাদা। প্রেক্ষাপট ছিল ইস্রাঈলের বিরোধী দল লিকুদ পার্টির তৎকালীন নেতা অ্যারিয়েল শ্যারনের আল-আকসা মসজিদে সফরকে কেন্দ্র করে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে হঠাৎ করে কড়া নিরাপত্তায় তার আল-আকসা কম্পাউন্ডে সফরকে উস্কানি হিসাবে দেখা হয়। এর ফলে চরম প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং হাযার হাযার ফিলিস্তীনী পথে নেমে আসে। পুরো ফিলিস্তীনেই সেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় সে ইন্তিফাদায় মারা যায় ৩৩৯২ জন ফিলিস্তীনী আর ৯৯৬ জন ইস্রাঈলী। এবারের হামাসের হামলার প্রেক্ষাপট দেখে তৃতীয় ইন্তিফাদার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
হামাসের ক্রমবিকাশ : মুসলিম ব্রাদারহুডের ‘মুজাম্মা আল-ইসলামিয়া’ সমাজসেবামূলক সংগঠনের নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসীন প্রায় দুই দশকের দমন পীড়নের পর ১৯৭৮ সালে প্রথম খোলামেলাভাবে কাজ করতে সচেষ্ট হয়। ফলে সংগঠনটি সমাজসেবা, মসজিদ নির্মাণ, ইসলামিক শিক্ষা প্রদানকারী স্কুল প্রতিষ্ঠার মধ্যেই কর্মসূচী সীমাবদ্ধ রাখে। ১৯৮০-র দশকে ফিলিস্তীন, বিশেষ করে গাযায় ফাতাহ বা পিএলও-এর মত সংগঠনের পরিবর্তে ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়। গাযায় ব্রাদারহুডের এই সাফল্য লাভের আরও একটি কারণ ছিল। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফিলিস্তীনের মুসলিম ব্রাদারহুড যেখানে শুধুই ফিলিস্তীনী সমাজের ইসলামীকরণের প্রচেষ্টার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছিল, কিন্তু গাযাতে ধীর স্থিরভাবে সংগঠনগুলি মূল জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের রাজনৈতিক ধারাতেও অংশগ্রহণ করছিল। তাই ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ইন্তিফাদার সময় গাযা শাখায় প্রথম সামাজিক সংগঠন থেকে সরাসরি রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার পদক্ষেপ নেয়। শেখ আহমাদ ইয়াসীন, মাহমুদ আল-যাহারের মত নেতাদের হাত ধরে জন্ম নেয় হামাস।
ফাতাহ, পিএলও ও পিনও : পঞ্চাশের দশকে গঠন হওয়া ফিলিস্তীনের গুরুত্বপূর্ণ এক রাজনৈতিক দল ফাতাহ। দলটি গঠনে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। এখানে আরেকটি নাম আসে আরব রাষ্ট্রদের গঠিত পিএলও বা প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন। এটি গঠন হয়েছিল ১৯৬৪ সালে যার উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তীনীদের অধিকার আদায়ে কাজ করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরা। ইয়াসির আরাফাত চেয়ারম্যান হিসাবে যোগ দেন ১৯৬৯ সালে। ফিলিস্তীনের মুক্তির উদ্দেশ্যে সশস্ত্র প্রতিরোধ দিয়ে ফাতাহ দলটির শুরু হলেও পরবর্তীতে তাদের দ্বিরাষ্ট্র তত্ত্বে সমর্থন ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা আপস করতে দেখা যায়। যা মানতে পারেনি হামাস। এমনকি আশির দশকেই পিএলও থেকে কিছু অংশ বের হয়ে যায়। কারণ তাদের দৃষ্টিতে ফাতাহ অনেকটাই অকার্যকর, দুর্নীতিগ্রস্ত বা অতি মধ্যপন্থী হিসাবে ধরা দিচ্ছিল। ফাতাহ, পিএলও এবং ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষ অনেকটাই একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষ যাদের বলা হচ্ছে তারা প্যালেস্টাইন অথরিটি বা প্যালেস্টিনিয়ান ন্যাশনাল অথরিটি (পিএনএ) নামেও পরিচিত। যদিও কোনো পক্ষই ফিলিস্তীনের জন্য খুব কার্যকর বা জনপ্রিয় কিছু করতে পারেনি।
হামাস, ফাতাহ ও ইস্রাঈল দ্বন্দ্ব : ইয়াসির আরাফতের মৃত্যু পরবর্তী যে বিশাল রাজনৈতিক শূন্যস্থান সৃষ্টি হয়েছিল, তা কাজে লাগিয়েই হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তীনের সংসদ নির্বাচনে ১৩২টি আসনের মধ্যে ৭৪টি আসনে বিশালভাবে জয়লাভ করে অতি অপ্রত্যাশিতভাবে। শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয় চির প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতাহ গোষ্ঠী। প্রথমবারের মত নির্বাচনে জয়লাভের দুই মাস পরে ইসমাইল হানিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রীসভা গঠন করে। হামাসের এই বিজয় প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘ চার দশকের ফিলিস্তীনী ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রধান চালিকাশক্তি পিএলওর জন্য ছিল এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক, আদর্শগত ও নৈতিক পরাজয়।
কিছুদিনের মধ্যেই ফাতাহ-এর সঙ্গে উত্তেজনা চরমে ওঠে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ইস্রাঈলের কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বয়কটের কারণে। হামাসের নেতৃত্বাধীন এই সরকারকে পশ্চিমা বিশ্ব কখনও স্বীকৃতি দেয় নি। পশ্চিমারা ফিলিস্তীনী এই ইসলামী আন্দোলনকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে গণ্য করে। পশ্চিমারা হামাসকে তার হিংসাত্মক তৎপরতা পরিত্যাগের দাবি করে। পশ্চিমারা আরো দাবি করে ইস্রাঈলকে স্বীকৃতি দিতে হবে হামাসকে এবং অতীতের কয়েকটি শান্তি চুক্তি মেনে নিতে হবে। কিন্তু হামাস তা প্রত্যাখ্যান করে।
প্যালেস্টাইনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাসের ফাতাহ গোষ্ঠী র সঙ্গে হামাসের উত্তেজনা এক পর্যায়ে এমন অবস্থায় পৌঁছে যে শেষ পর্যন্ত হানিয়া পদত্যাগে বাধ্য হন। এই পরিস্থিতিতে ২০০৭ সালের ১৫ জুন হামাস গাযার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ফাতাহ সমর্থকদের বিতাড়িত করে। এর তিন মাস পর ইস্রাঈল গাযা ভূ-খন্ডকে হিংসাত্মক এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে। শুরু হয়ে যায় ইস্রাঈল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষ। এক সময় দুই পক্ষের মাঝে অস্ত্র-বিরতি ঘটে। কিন্তু তার মেয়াদ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই আবারো ইস্রাঈল ও হামাসের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
হামাসের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা
১. শেখ আহমাদ ইয়াসীন : শেখ আহমাদ ইয়াসীন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৬ সালে। পাঁচ বছর বয়সে হারান স্নেহময়ী পিতাকে। এতিম অবস্থায় বেড়ে উঠেন মাতৃভূমি জুরা আসকালানে। সেখানেই সমাপ্ত করেন প্রাথমিক শিক্ষা। এ সময় তিনি দেখেন ফিলিস্তীনে ইহূদী অভিবাসন চিত্র। প্রত্যক্ষ করেন প্রতিরোধ আন্দোলনের নানা প্রেক্ষাপট। দেখেন ১৯৪৮ সালের আরব-ইস্রাঈল যুদ্ধের ব্যর্থতার চিত্র। এসব ঘটনা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। হামাসের প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইয়াসীন ছিলেন পঙ্গু। তিনি ১৬ বছর বয়সে বন্ধুদের সাথে খেলার সময় বেকায়দায় পড়ে ভেঙে যায় ঘাড়ের হাড়। এতে আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ব্যাধি পক্ষাঘাতে। এটি তার জীবনে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তবুও চালিয়ে যান জীবন সংগ্রাম। চালিয়ে যান পড়াশোনা। অবশেষে ১৯৫৮ সালে সমাপ্ত করেন শিক্ষার পর্ব। মন দেন অধ্যাপনায়।
১৯৫৬ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সেই রাজনীতিতে যুক্ত হন। তিনি বলিষ্ঠ ভাষণ ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে গাযার বিশেষ নেতা হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মুসলিম ব্রাদারহুড দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ১৯৬৭ সালে ইস্রাঈলের কাছে পরাজিত হয় আরববিশ্ব। তারা দখলে নেয় ফিলিস্তীনের গাযা, সিরিয়ার গোলান ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপ। এ সময় তিনি জ্বলে উঠেন আপন মূর্তিতে। তখন মসজিদুল আববাসির খতীব তিনি। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করেন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে। মেহনত শুরু করেন জনে জনে ও ঘরে ঘরে। এ সময় তিনি নানা স্থান থেকে অনুদান সংগ্রহ করতেন। তা দিয়ে সহযোগিতা করতেন শহীদ ও বন্দী পরিবারকে। তিনি ১৯৭৮ সালে ফিলিস্তীনীদের সাহায্যের জন্য ‘আল-মুজাম্মা আল ইসলামী’ নামে একটি ইসলামী সংগঠন গড়ে তুলতে অধিকৃত ইস্রাঈলী কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেন। ইস্রাঈল তা মঞ্জুর করে।
১৯৮২ সালে বন্দী হন তিনি। অভিযোগ আনা হয়, তার কাছে অস্ত্র আছে। গঠন করেছেন প্রতিরোধ আন্দোলন। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন ইস্রাঈলকে মিটিয়ে দেয়ার প্রতি। এসব অভিযোগে তার ১৩ বছরের কারাদন্ড দেওয়া হলেও ১৯৮৫ সালেই তিনি মুক্তি লাভ করেন। ইস্রাঈল ও পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অফ ফিলিস্তীনের বন্দী বিনিময়ের সময় তিনি মুক্তি পান। অবশেষে এলো ১৯৮৭ সাল। গঠন করেন ফিলিস্তীনের ঐতিহাসিক ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন। হামাস নামে আজ যা পরিচিত। এ সময় তিনি সঙ্গী হিসাবে নেন মুসলিম ব্রাদারহুডে প্রভাবিত গাযার কয়েকজন মুসলিম নেতাকে। এরপর তিনি শুরু করেন ‘মিম্বার বিদ্রোহ’। মসজিদের ইমামদের মাধ্যমে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন দখলদারবিরোধী আন্দোলনে। এভাবে দেশব্যাপী জ্বালিয়ে দেন প্রতিরোধের আগুন।
পরে ১৯৮৯ সালে আবার বন্দী হন দখলদার বাহিনীর হাতে। এ সময় বন্দী হয়েছিলেন হামাসের কয়েক শ’ নেতা। ইসরাইলের আদালত তাকে ১৫ বছরের জেল দেয়। এভাবে তিন বছর পার হয়। ১৯৯১ সালে নতুনভাবে আবারও সাজা দেয় ইস্রাঈলের একটি আদালত। তখন হামাস প্রতিষ্ঠা ও দখলদার বাহিনীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়া হয়। পরে ১৯৯৭ সালে তিনি মুক্তি পান। হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরো প্রধান খালেদ মেশালকে হত্যাচেষ্টার পর জর্ডান ও ইস্রাঈলের মধ্যে একটি চুক্তির অধীনে তিনি মুক্তি পান। এভাবে কখনো সমরে, কখনো জেলে সময় পার করেন তিনি। পরে ২০০৪ সালের ২২ শে মার্চ ফজর পর হঠাৎ বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠল গাযা উপত্যকা। মুহূর্তে পাল্টে গেল সব। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন তিনি। ইহলোক ত্যাগ করলেন ঘনিষ্ঠ সাত সহচরসহ। রেখে যান প্রতিরোধ আন্দোলনের জন্য সোচ্চার দল হামাসকে। পদচিহ্ন রেখে যান হামাসের আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে।
২. ইসমাইল হানিয়ে : ইসমাইল হানিয়ে হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তীন সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী। আবু আল-আবদ ডাকনামের ইসমাইল আবদুস সালাম হানিয়ে ১৯৬২ সালে জন্মেছিলেন ফিলিস্তীনী শরণার্থী শিবিরে। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ফিলিস্তীনের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইস্রাঈল ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছর বন্দী করে রাখে। এরপর তাকে ইস্রাঈল এবং লেবাননের মধ্যকার একটি নো-ম্যানস-ল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়। সেখানে তিনি ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকজন হামাস নেতার সাথে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে কয়েকটি বছর কাটিয়েছেন। নির্বাসন থেকে ফিরে ১৯৯৭ সালে হামাস আন্দোলনের নেতা শেখ আহমাদ ইয়াসীনের অফিসের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন, যা তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করে। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী হামাস তাকে ফিলিস্তীনের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হয়। এক বছর পর ফিলিস্তীনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাস হানিয়েকে তার পদ থেকে বরখাস্ত করেন। কারণ ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডস গাযা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আববাসের ফাতাহ আন্দোলনের প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করে।
ইস্রাঈল হানিয়ে তার বরখাস্তকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তার সরকার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে এবং ফিলিস্তীনী জনগণের প্রতি তাদের জাতীয় দায়িত্ব ছেড়ে যাবে না’। হানিয়ে এর পর বেশ কয়েকবার ফাতাহ আন্দোলনের সাথে সমঝোতার আহবান জানিয়েছেন। ২০১৭ সালের ৬মে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর হানিয়েকে সন্ত্রাসী হিসাবে আখ্যায়িত করে।
অন্যদিকে হামাসের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা এবং সংগঠনটির প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন ইসমাইল হানিয়ে। ২০২১ সালে তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে চার বছরের জন্য হামাসের প্রধান হিসাবে নির্বাচিত হন। গাযায় হামাসের প্রতিষ্ঠাতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের ডানহাত ছিলেন ইসমাইল হানিয়ে। বর্তমানে ইসমাইল হানিয়ে কাতারে বসবাস করছেন বলে জানা গেছে। হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ দেইফের সাথে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই গোষ্ঠীর বেশিরভাগ পাবলিক মেসেজিংয়ের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন তিনি।
৩. মাহমুদ যাহার : মাহমুদ যাহার ১৯৪৫ সালে গাযার একজন ফিলিস্তীনী বাবা এবং একজন মিশরীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিশরের ইসমাইলিয়া শহরে তার শৈশব কাটান। গাযাতেই তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। স্নাতকের পর তার রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ইস্রাঈলী কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত তিনি গাযা এবং খান ইউনিসের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসাবে কর্তব্যরত ছিলেন।
যাহারকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর ১৯৮৮ সালে মাহমুদ যাহারকে ছয় মাস ইস্রাঈলী কারাগারে রাখা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ইস্রাঈল থেকে মারজ আল-জুহুরে নির্বাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যেখানে তিনি পুরো এক বছর কাটিয়েছেন।
২০০৫ সালে হামাস আন্দোলন আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আববাস ফিলিস্তীন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াহর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন যাহার। ইস্রাঈল ২০০৩ সালে গাযা শহরের রিমাল এলাকায় যাহারের বাড়িতে এফ-১৬ বিমান থেকে অর্ধটন ওজনের একটি বোমা ফেলে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। হামলায় তিনি সামান্য আহত হলেও তার বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয়।
২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারী গাযার পূর্বে ইস্রাঈলী অভিযানে নিহত ১৮ জনের একজন ছিলেন তার দ্বিতীয় ছেলে হোসাম। হোসাম কাসাম ব্রিগেডের সদস্যও ছিলেন। ‘দ্য প্রবলেম অফ আওয়ার কনটেম্পরারি সোসাইটি... আ কোরআনিক স্টাডি’, বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লেখা বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ‘নো প্লেস আন্ডার দ্য সান’ এবং ‘অন ফুটপাথ’ নামের উপন্যাসসহ যাহারের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক এবং সাহিত্যিক কাজ রয়েছে।
৪. খালেদ মেশাল : মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য। খালেদ মেশাল ‘আবু আল-ওয়ালিদ’ ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিম তীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারসহ কুয়েতে চলে যাওয়ার আগে তিনি সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। আর কুয়েতে যাবার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন।
১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এর নেতা নিযুক্ত হন। ইস্রাঈলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৭ সালে মেশালকে হত্যার জন্য গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানকে নির্দেশ দেন। তিনি এই হত্যাকান্ড চালানোর জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্ত্তত করতে বলেছিলেন। মোসাদের দশজন এজেন্ট কানাডার জাল পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে। সেই সময়ে জর্ডানের নাগরিক খালেদ মেশালকে রাজধানী আম্মানের একটি রাস্তায় হাঁটার সময় বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ইনজেকশন দেওয়া হয়। জর্ডানের কর্তৃপক্ষ হত্যা প্রচেষ্টার সন্ধান পায় এবং জড়িত দুই মোসাদ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
জর্ডানের প্রয়াত রাজা হুসেইন ইস্রাঈলী প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেশালকে যে বিষাক্ত পদার্থের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল তার প্রতিষেধক চান, কিন্তু নেতানিয়াহু প্রথমে সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করায় এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক মাত্রা নেয়।
মেশাল ২০১২ সালের সাত ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গাযা উপত্যকায় যান। ১১ বছর বয়সে তিনি চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তীনী অঞ্চলে এটাই তার প্রথম সফর ছিল। রাফাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দল ও জাতীয় পর্যায়ের ফিলিস্তীনী নেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং গাযা শহরে পৌঁছানো পর্যন্ত ফিলিস্তীনীদের তাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার ধারে ভিড় করে। ২০১৭ সালের ৬ মে আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল খালেদ মেশালকে রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করে।
৫. ইয়াহইয়া ইব্রাহীম আল-সিনওয়ার : ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনওয়ারের নাম ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। হামাস আন্দোলনের নেতা এবং গাযা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইয়াহিয়া ইব্রাহীম আল-সিনওয়ার ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ‘মাজদ’ নামে পরিচিত হামাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত সন্দেহভাজন ইস্রাঈলী এজেন্টদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা এবং ইস্রাঈলী গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের টার্গেট করার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় পরিচালনা করে। সিনওয়ারকে তিনবার গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৮২ সালে প্রথমবার আটকের পর ইস্রাঈলী বাহিনী তাকে চার মাস প্রশাসনিক কারাগারে রাখে।
১৯৮৮ সালে সিনওয়ারকে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হয় এবং চারটি যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেওয়া হয়। সিনওয়ার যখন কারাবাসে ছিলেন, তখন ইস্রাঈলী সৈনিক গিলাদ শালিতের ট্যাঙ্কটি হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয় এবং ওই ইস্রাঈলী সৈন্যকে জিম্মি করা হয়। শালিতকে বলা হত ‘সবার মানুষ’, তাই ইস্রাঈলকে তার মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হয়েছিল।
‘মুক্তির আনুগত্য’ নামে একটি বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এটা ঘটে, যেখানে ফাতাহ এবং হামাস আন্দোলনের অনেক বন্দীদের সঙ্গে ইয়াহিয়া সিনওয়ারও ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি মুক্তি পান। ইসমাইল হানিয়ের উত্তরসূরী হিসাবে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারী সিনওয়ার গাযা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন।
৬. আব্দুল্লাহ বারঘৌতি : বারঘৌতি ১৯৭২ সালে কুয়েতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের পর জর্ডানে চলে যান। জর্ডানের নাগরিকত্ব পাবার আগে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন, যার ফলে তিনি বিস্ফোরক তৈরী করতে শিখেছিলেন। ফিলিস্তীনে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করেননি।
বিস্ফোরক যন্ত্র এবং বিষাক্ত পদার্থ তৈরীতে কাজ করেছিলেন এই ইঞ্জিনিয়ার। একদিন চাচাতো ভাই বিলাল আল-বারঘোতিকে পশ্চিম তীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যান এবং তার দক্ষতা দেখানোর আগ পর্যন্ত তার আশেপাশের কেউই বিস্ফোরক তৈরীর বিষয়ে তার দক্ষতা সম্পর্কে জানত না। বিলাল তার কমান্ডারকে এবিষয়ে বলার পর আব্দুল্লাহ বারখোতিকে কাসাম ব্রিগেডসের দলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। বারঘৌতি তার শহরের একটি গুদামে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য বিশেষ কারখানা স্থাপন করেছিলেন। ইস্রাঈলী বিশেষ বাহিনী ২০০৩ সালে আকস্মিকভাবে তাকে গ্রেপ্তার করার পর তিন মাস জিজ্ঞাসাবাদে রাখা হয়।
বারঘৌতিকে কয়েক ডজন ইস্রাঈলীর মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করা হয়। আর তার দ্বিতীয়বার বিচারের সময় অনেক নিহতদের পরিবারের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। তাকে ৬৭ টি বছর যাবজ্জীবন এবং ৫ হাজার ২০০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়, যা ইস্রাঈলের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাজা। এটি সম্ভবত মানব ইতিহাসেও সর্বোচ্চ। তাকে কিছু সময়ের জন্য নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার অনশনে যাবার কারণে এটি বন্ধ করা হয়। বারঘৌতিকে ‘ছায়ার রাজপুত্র’ নামে ডাকা হয়। কারণ কারাগারে থাকার সময় তিনি এই নামে এই বই লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি তার জীবন এবং অন্যান্য বন্দীদের সাথে যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কীভাবে তিনি ইস্রাঈলী সামরিক চেকপোস্টের মাধ্যমে বিস্ফোরক পেয়েছিলেন, কীভাবে অনেক দূরে বোমা হামলা পরিচালনা করেছিলেন সে বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন।
৭. মোহাম্মদ দেইফ : গাযা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইস্রাঈলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন দেইফ। তিনি মোহাম্মদ দিয়াব আল-মাসরি, যার ডাক নাম ‘আবু খালেদ’ এবং ‘আল-দেইফ’। ‘দ্য ক্লাউন’ নামক একটি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ‘আবু খালেদ’ ডাকনামে পরিচিত হন, যেখানে তিনি মধ্যযুগের প্রথম দিককার উমাইয়া এবং আববাসীয় আমলের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ‘আবু খালেদের’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আরবী দেইফ শব্দটির অর্থ ‘অতিথি’। এই ডাকনামটি বেছে নেয়ার কারণ ছিল তিনি ইস্রাঈলীদের হাত থেকে বাঁচতে তিনি একটি জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। আর প্রতি রাতে নতুন কোন জায়গায় ঘুমাতেন।
তিনি হামাস আন্দোলনের সামরিক শাখা ‘ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডে’র নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৬৫ সালে গাযায় জন্মগ্রহণ করেন। ফিলিস্তীনীদের কাছে তিনি ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসাবে এবং ইস্রাঈলীদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসাবে পরিচিত। তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাযা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। হামাস প্রতিষ্ঠা ঘোষণা পর তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইস্রাঈলী কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেপ্তার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন। কারাবাসের সময় জাকারিয়া আল-শোরবাগী এবং ছালাহ শেহাদেহর সাথে মিলে ইস্রাঈলী সৈন্যদের বন্দী করার লক্ষ্যে হামাস থেকে আলাদা একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মত হন দেইফ যা পরে ‘আল-কাসাম ব্রিগেডস’ হয়ে ওঠে।
দেইফ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ‘ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডস একটি সামরিক সংগঠন হিসাবে আবির্ভূত হয়, যেখানে অন্যান্য কাসাম নেতাদের সাথে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে দেইফ অগ্রভাগে ছিলেন। দেইফ গাযা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইস্রাঈলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন এবং একইসঙ্গে বড় সংখ্যক রকেট উৎক্ষেপণের কৌশল গ্রহীতাদের একজন ছিলেন।
ইস্রাঈল তাকে ২০০০ সালে গ্রেপ্তার ও বন্দী করে, কিন্তু ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’র শুরুতে তিনি বন্দীদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন, আর তারপর নিজের খুব সামান্য ছাপই তিনি ফেলে গেছেন। তাকে হত্যা করার সবচেয়ে গুরুতর প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০০২ সালে, যেটা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নিজের একটি চোখ হারান।
ইস্রাঈলের তথ্যমতে, তিনি তার একটি পা এবং একটি হাতও হারিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার পর বেঁচে থাকলেও তার কথা বলতে অসুবিধা হয়। গাযা উপত্যকায় ২০১৪ সালে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা ইস্রাঈলের আক্রমণে দেশটির সেনাবাহিনী দেইফকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেও তার স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে হত্যা করে। সম্প্রতি ৭ অক্টোবর ২০২৩ ইস্রাঈলে হামাসের অবিশ্বাস্য হামলার পিছনে মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে তাকে বিবেচনা করা হয়।
৮. মারওয়ান ঈসা : ইস্রাঈল মারওয়ান ঈসাকে ‘কথা নয়, কাজের লোক’ হিসাবে বর্ণনা করে আর বলে তিনি এতটাই চালাক যে কোন প্লাস্টিককে ধাতুতে পরিণত করতে পারেন’। ‘ছায়া মানুষ’ এবং মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত নামে পরিচিত মারওয়ান ঈসা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডসের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ এবং হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোর সদস্য।
ফিলিস্তীনের স্বাধীনতার প্রশ্নে হামাস :
ফিলিস্তীনের স্বাধীনতার প্রশ্নে হামাস সর্বদাই আপোষহীন থেকেছে এবং রাজনৈতিক সমাধানের চেয়ে সামরিক সমাধানকেই পথ ভেবেছে। এজন্য পশ্চিম তীরের ফাতাহের অহিংস আন্দোলনের বিপরীতে তারা সশস্ত্র তৎপরতার মাধ্যমে হানাদার ইহুদীদের অপতৎপরতার জবাব দিয়ে আসছে। ফিলিস্তীনী জনগণ সর্বাত্মকভাবে না হলেও তাদের একটা বড় অংশ হামাসকে সমর্থন করে। সর্বশেষ ৭ অক্টোবর ২০২৩ হামাস ইস্রাইলের বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে সর্ববৃহৎ হামলা চালায়, যাতে মাত্র ২০ মিনিটে পাঁচ সহস্রাধিক মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। সর্বব্যাপী এ হামলায় নিহত হয় বহু ইসরাঈলী সেনাসহ প্রায় দেড় হাযার ইসরাঈলী। বন্দী হয় কয়েক শত। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরাঈলের মাসাধিককাল টানা বর্বরোচিত হামলায় নিহত হয়েছে দশ সহস্রাধিক ফিলিস্তীনী।
হামাস কি শী‘আ?
একথা সুপরিজ্ঞাত যে, ইরান এবং লেবাননের শী‘আ হিযবুল্লাহদের পৃষ্ঠপোষকতায় হামাস সামরিক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। ফলে অনেকেই ধারণা করেন যে, হামাস শী‘আ প্রভাবিত। তবে বাস্তবতা এই যে, শীআরা নিজ স্বার্থে এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ইসরাঈলকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে হামাসকে ব্যবহার করে এবং সীমিতভাবে সহযোগিতা করে। শীআ হওয়ার কারণে হিযবুল্লাহকে তারা যেভাবে সরাসরি পরিচালনা করে, সেটা সুন্নী হামাসের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তদুপুরি সিরিয়ায় সুন্নীদের পক্ষ নেওয়ার কারণে ইরান হামাসের প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট নয়। এজন্য কাতার, তুরষ্ক প্রভৃতি দেশ থেকেই হামাস মূল সহযোগিতা পায় বলে ধারণা করা যায়।
উপসংহার : ফিলিস্তীন মুক্তি আন্দোলন বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা। এই আন্দোলন বেগবান হোক এবং বৈধ পন্থায় ফিলিস্তীনী জনগণের স্বাধিকার আদায় হোক-এটাই আমাদের কামনা। সর্বোপরি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা, তিনি যেন নিরীহ ফিলিস্তীনীদের উপর নিপীড়নকারী যালিমদের দুনিয়ার বুকে দৃষ্টান্তমূলক বিচারের ব্যবস্থা করেন। আর মাযলূম ফিলিস্তীনীদের উপর তঁার রহমত বর্ষণ করেন।-আমীন!