শায়খ ছালেহ বিন মুহাম্মাদ আল-লুহাইদান (রহঃ)
যহুরুল ইসলাম
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 361 বার পঠিত
[আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়ার বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও সংস্কারক ছিলেন আবুবকর গুমী (রহঃ)। তিনি নাইজেরিয়ায় হাদীছের প্রচার-প্রসার এবং ইসলামের বিশুদ্ধ দাওয়াত তথা সালাফী/আহলেহাদীছ আন্দোলনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি বিদ‘আত, ভ্রান্ত আক্বীদা এবং পূর্ববর্তীসূরীদের অন্ধ তাক্বলীদ বর্জন করেছিলেন। দাওয়াতী ময়দানে একনিষ্ঠ প্রচেষ্ঠার কারণে আল্লাহ তঁাকে স্বদেশে এবং আন্তর্জাতিকভাবে উচ্চমর্যাদা দান করেছিলেন। নিম্নে সংক্ষিপ্ত জীবন ও কর্ম উল্লেখিত হ’ল-সহকারী সম্পাদক।]
নাম ও পারিবারিক অবস্থান : তঁার পূর্ণ নাম আবু বকর বিন মাহমূদ বিন মুহাম্মাদ বিন আলী বারা আল-বাদাবী। তার দাদা আলী বারা ছিলেন এক আরব বেদুঈন, যিনি গবাদিপশু চরাতেন। তঁার ৩ সন্তানের মধ্যে অন্যতম মুহাম্মাদ। যিনি ১১টি সন্তান জন্ম দিলেও একটি মাত্র সন্তান মাহমূদ (আবু বকর গুমী) ব্যতীত কেউ জীবিত ছিল না। আবু বকর গুমী ১৯২৪ সালের ৭ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।
তঁার ৭টি সন্তান : (১) আহমদ আবু বকর গুমী (২) হামজা গুমী (৩) মোস্তফা গুমী (৪) আব্দুল কাদির গুমী (৫) আববাস গুমী (৬) সাদিয়া গুমী (৭) বাদিয়া গুমী। তাঁর অনেক সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বড় সন্তান ডা. আহমদ আবুবকর গুমী, যিনি তঁার পিতার উত্তরসূরী হিসাবে কেন্দ্রীয় মসজিদ কাদুনা (সুলতান বেলো)-এর ইমাম। তিনি নাইজেরিয়ার কাদুনা শহরের আহমেদু বেলো ইউনিভার্সিটি জারিয়া থেকে একজন মেডিকেল ডাক্তার হিসাবে ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। তিনি একজন প্রাক্তন সামরিক অফিসারও ছিলেন। পরে তিনি সামরিক বাহিনী ছেড়ে মক্কার উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিকহ অধ্যয়নের জন্য যান এবং সেখানে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন : তিনি পিতা-মাতার কাছেই পরম স্নেহে বেড়ে উঠেছেন। তিনি পিতাকে স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে পিতার জ্ঞান, শিষ্টাচার এবং বিভিন্ন উপকারী বিষয় থেকে উপকৃত হওয়ার কারণে তিনি আত্মবিশ্বাসী ও সহনশীলতা অর্জন করেছিলেন। তার শৈশবকাল বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের অধীনে কাটিয়েছিলেন।
লেখনী : ১. হাউসা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ। ২. শরী‘আতের আলোকে বিশুদ্ধ আক্বীদা। ৩. কুরআনের অর্থ অনুধাবনে মন ফিরিয়ে আনুন।
কর্মজীবন : ১৯৪৭ সালে আবুবকর গুমী ‘কানো ল স্কুলে পড়াতে যান, যেখানে তিনি আগে পড়েছিলেন। কানোতে থাকাকালীন তিনি শেখ সাঈদ হায়াতুর সাথে সাক্ষাত করেছিলেন, যিনি ঔপনিবেশিক শাসনের সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার। সাঈদ হায়াতু ছিলেন মাহদিয়া আন্দোলনের নেতা এবং সবেমাত্র ক্যামেরুনে জোরপূর্বক নির্বাসন থেকে ফিরেছিলেন। আবু বকর মাহদিয়া আন্দোলনের শিক্ষায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। পরে তিনি সাঈদ হায়াতুর মেয়ে মরিয়মকে বিয়ে করেন। ১৯৪৯ সালে গুমী সোকোটোতে একটি স্কুলে শিক্ষকতার চাকুরী নেন। স্কুলটির একজন বিখ্যাত শিক্ষক ছিলেন আমিনু কানো। যিনি নর্দান টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং কয়েকটি মুসলিম স্কুলের মালিক ছিলেন। আমিনু এবং গুমী ইসলামী বিশ্বাসের সাথে ঐতিহ্যবাহী সমাজের প্রভাব এবং ছুফীদের বিরুদ্ধে দাওয়াতী কাযক্রম পরিচালনা করতেন।
তিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত উত্তর নাইজেরিয়ার প্রধান বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি এ অঞ্চলে ইসলামী শরী‘আ আইন বাস্তবায়ন করেন। বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা আহমাদউ বেলোর সাথে তার ভাল সম্পর্ক ছিল। যিনি ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকে এই অঞ্চলের মূখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
প্রতিবাদী গুমী : ঔপনিবেশিক যুগে গুমী একজন সোচ্চার নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। যেখানে তিনি অনুভব করেছিলেন যে বৃটিশদের পরোক্ষ শাসনের অনুশীলনে নাইজেরীয় সুলতানরা ধর্মীয় শক্তিকে দুর্বল করেছে এবং পাশ্চাত্যকরণকে উৎসাহিত করেছে। এছাড়াও ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে ছুফী নেতাদের সাথে তঁার প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। ১৯৭০ এবং ১৯৮০-এর দশকে টেলিভিশন প্রোগ্রামে তিনি বিরোধীদের বিরুদ্ধে বিতর্ক শুরু করেছিলেন। তিনি কাদুনা সেন্ট্রাল মসজিদের (সুলতান বেলো মসজিদ) শুক্রবারের বক্তৃতায় তঁার আক্বীদা-বিশ্বাস মানুষের সামনে উপস্থাপন করতেন। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সেমিনার-সম্মেলনে বিশুদ্ধ ইসলামের দাওয়াত দিতেন এবং ছুফীদের কঠোর সমালোচনা করেন। বিশেষকরে তিজানিয়া এবং কাদিরিয়ার মত প্রভাবশালী ছুফীদের বিরোধিতা তাকে ক্রমাগত সমালোচনার মুখে ফেলেছিল এবং তার ব্যাখ্যার জন্য কিছু মুসলমানের দ্বারা আক্রমণ হ’তে হয়েছিল।
নির্ভিকচেতা গুমী : আবুবকর গুমীর উত্তর নাইজেরিয়াতে রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের প্রশাসনিক ও ধর্মীয় নির্দেশনা ইসলামের বিপক্ষে গেলে তিনি নির্ভিকচিত্তে আপত্তি জানাতেন। যেমন কর্তৃপক্ষের সাথে তায়াম্মুমের অনুশীলন নিয়ে তার প্রথম দ্বন্দ্ব ছিল মারুতে। মারুর মসজিদের প্রধান ইমাম ছালাতের আগে বালি দিয়ে তায়াম্মুম করার কাজটি অনুশীলন করেছিলেন। গুমী যুক্তি দিয়েছিলেন যে, তায়াম্মুম শুধুমাত্র তখনই প্রযোজ্য যখন পানি পাওয়া না যায়। অথচ মারুতে যথেষ্ট পানি পাওয়া যায়। ইমাম তায়াম্মুম অনুশীলনে প্রত্যাখ্যান না করা পর্যন্ত ছাত্রদের ছালাতে উপস্থিত না হওয়ার জন্য তিনি নির্দেশনা দেন। যাইহোক গুমী সুলতানের নিকট ইমামের বিরুদ্ধে একটি পত্র প্রেরণ করেন। সুলতান পত্রটি আমলে নিয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা করেন। বিশুদ্ধ ইসলামী শরী‘আ সম্পর্কে গুমী গভীর জ্ঞান রাখতেন। ফলে কমিশন গুমীর পক্ষে রায় দেয়।
অনন্য কৃর্তি : আবু বকর গুমী ১৯৫৫ সালে মক্কায় প্রথম হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে গিয়েছিলেন। আহমদউ বেলোও তার সাথে যোগ দিয়েছিলেন। মক্কায় থাকাকালীন তিনি ও বেলো বাদশাহ সঊদের নির্দেশনায় ইসলামী বই অনুবাদ করেন। এর ফলে তিনি সঊদী আরবের উচ্চ পর্যায়ের অনেক ব্যক্তির সাথেও সাক্ষাৎ এবং বন্ধুত্ব হয়। নাইজেরিয়ায় ফিরে এসে তিনি কানোতে আরবী শিক্ষা স্কুলে এবং কাদুনা মহানগরীর কাছে অবস্থিত জামাআতু নাছরিল ইসলাম (জেএনআই) দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কিছু মুসলিম স্কুলে পড়াতে শুরু করেন। তিনি সর্বদা বিশুদ্ধ ইসলামের প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেন। তিনি সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে কুরআনের ব্যাখ্যাও লিখেছিলেন। তঁার অনন্য কৃর্তির মধ্যে অন্যতম হ’ল কুরআনকে হাউসা ভাষায় অনুবাদ। ফলে তঁার বক্তৃতা, লেখনী ও অনুবাদ কুরআনের মাধ্যমে বৃহত্তর উত্তর নাইজেরিয়ান শ্রোতা ও পাঠক মহল ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
তিনি এই দাওয়াতকে আরো বেগবান ও সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তঁার পুরানো ছাত্রদের মাধ্যমে একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেন। এই আন্দোলনই হ’ল ‘ইজালাতুল বিদআ‘হ ওয়া ইকামাতুল সুন্নাহ’ বা সুন্নাহের পুনরুজ্জীবনের জন্য আন্দোলন। যাকে ‘ইজালা’ বলা হয়।
পুরস্কার ও সম্মাননা : আবুবকর গুমী ১৯৮৭ সালে ইসলামের খেদমত ও হাউসা ভাষায় পবিত্র কুরআনের অনুবাদ করার কারণে ‘কিং ফয়সাল’ আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ফেডারেল রিপাবলিকের ‘কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার’ পেয়েছিলেন। তিনি মসজিদ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সুপ্রিম কাউন্সিল, মক্কার ফিকহ একাডেমী, কায়রোতে ইসলামিক রিসার্চ একাডেমী, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপ্রিম কাউন্সিল এবং নাইজেরিয়ার সিনিয়র স্কলার কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। এছাড়াও তিনি ‘রাবেতাতুল আলম আল-ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং নাইজেরিয়ান শিক্ষা কেন্দ্র কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন।
মৃত্যু : আবু বকর গুমী ১৯৯২ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর শুক্রবার সকালে লিউকেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে ৬৯ বছর বয়সে লন্ডনের একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। আল্লাহ তঁাকে জান্নাত উচ্চ মাকাম দান করুন।-আমীন!