অন্যায় দন্ড

মুহাম্মাদ আব্দুর রঊফ 316 বার পঠিত

অনেক দিন আগের কথা। এক অত্যন্ত দুর্বল, রুগ্ন বৃদ্ধ লোক প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তারকে বলল, আমি অসুস্থ আমার চিকিৎসা করেন। ডাক্তার রোগীর পাল্স ও জিহবা দেখে বললেন, গতরাতে কী খেয়েছেন? বলল, কিছুই না। তিনি বললেন, সকালে কী খেয়েছেন? রোগী আবার বলল কিছুই না। ডাক্তার দেখলেন, লোকটি অতিশয় বৃদ্ধ, অসুস্থ, এমনকি তার ভরণ-পোষণ দেয়ার মতও কেউ নেই। অভাবের তাড়নায় প্রতিদিন ক্ষুধার্ত থেকে তার এমন অবস্থা হয়েছে যে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হয়ে গেছে এবং মাত্র অল্প কিছুদিন আয়ু অবশিষ্ট রয়েছে। এ অবস্থা দেখে ডাক্তার মর্মাহত হ’লেন। লোকটি যাতে কষ্ট না পায় সেজন্য বললেন, আপনার যে অসুখ হয়েছে তার কোন চিকিৎসা নেই এবং ওষুধের প্রয়োজনও হয় না। আপনাকে কিছুদিন মন যা চায় তাই করতে হবে। আপনার যা খেতে ইচ্ছা হয় খাবেন, যে কাজ করতে ইচ্ছা হবে সেটাই করবেন। আশা করা যায় তাতে আপনি ভাল হয়ে যাবেন।

বৃদ্ধ বলল, আপনার কথা ঠিক আছে। কিন্তু আমি যা ইচ্ছা তা খেতে পারি না। কারণ আমার খাবারই থাকে না।

এ কথা শুনে ডাক্তার আরও দুঃখিত হ’লেন। জীবনের শেষলগ্নে তিনি বৃদ্ধকে দুঃখ দিতে চাননি। তাই বললেন, এগুলো নিয়ে আপনাকে এত চিন্তা করতে হবে না। যে অবস্থাতেই থাকেন যতটা সম্ভব মনের ইচ্ছা পূরণ করবেন, যতটা পারেন খাবেন এবং নিজের ইচ্ছা পূরণ করার জন্য যেটা প্রয়োজন সেটাই করবেন।

বৃদ্ধ বলল, আল্লাহ আপনার কল্যাণ করুন। আমার জন্য সহজ করে দিলেন। আমি জানি কখনো আমার সব ইচ্ছা পূরণ হওয়ার নয়। ডাক্তার বলল, এটা ঠিক, সব ইচ্ছা পূরণ হয় না। তবে আমি দো‘আ করি আল্লাহ আপনাকে সুস্থ করুন। এখন যেখানে যেতে চান চলে যান। আমি আশা রাখি আল্লাহ আপনার ইচ্ছা পূরণ করবেন।

অসুস্থহ বৃদ্ধ সবুজ প্রকৃতি ও প্রবাহিত জলস্রোত দেখার ইচ্ছা পোষণ করে ডাক্তারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। ডাক্তারের পরামর্শ পেয়ে সে আনন্দিত ছিল। এক সবুজ মাঠের কোল ঘেষে বয়ে চলা স্রোতধারার পাশ দিয়ে হঁাটতে শুরু করল। যেতে যেতে সে দেখতে পেল এক দরবেশ পানির ধারে মাথা নিচু করে বসে হাত-মুখ ধৌত করছে। বৃদ্ধ লোকটি দরবেশের ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখল, ঘাড় ও কানের পিছনের অংশটি মসৃণ এবং চড় মারার জন্য একটি উপযুক্ত জায়গা। হঠাৎ তার মনে দরবেশের ঘাড়ে সজোরে চড় মারার ইচ্ছা উদয় হ’ল। তিনি জানতেন অযথা কাউকে মারতে হয় না। কিন্তু তার মনে আছে ডাক্তার বলেছিলেন, তার রোগের চিকিৎসা হ’ল যা ইচ্ছা তাই করা। সে তার এই ইচ্ছা সংবরণ করতে পারল না। দরবেশের দিকে এগিয়ে গিয়ে জামার হাতা উপরে তুলে জোরে তার ঘাড়ে থাপ্পড় দিল এবং থাপ্পড়ের শব্দ শুনে হাসতে লাগল। দরবেশ থাপ্পড় খেয়ে পানিতে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেখান থেকে নিজেকে বঁাচিয়ে আতঙ্কিত অবস্থায় বৃদ্ধকে ধরার জন্য উঠে দঁাড়ালেন। বৃদ্ধের দিকে চোখ পড়তেই দেখলেন, সে এমন ঘাটের মরা যে, প্রতিশোধ নিতে গেলে সে মরেই যাবে। দরবেশ তার হাত ধরে বললেন, দুর্ভাগা! তোমার শরীরে কী মাথা বেশী হয়ে গেছে যে, অযথা আমাকে মারলে? তোমার তো থাপ্পড় সহ্য করার শক্তিও নেই। আবার এমন রোগা যে, মারাও যাবে না। কেন এ কাজ করলে? আর কেনইবা পাগলের মত হাসছ?

বৃদ্ধ বলল, আমি জানি না। ডাক্তার বলেছিল তাই করেছি। তবে থাপ্পড়ের শব্দটা তোমার ঘাড়ের ছিল নাকি আমার হাতের ছিল এটা ভেবে হাসছি। দরবেশ বলল, জানো না? দঁাড়াও তোমাকে মজা দেখাচ্ছি।

এ কথা বলে দরবেশ লোকটিকে টানতে টানতে বিচারকের কাছে নিয়ে গেল। সমস্ত ঘটনা বলে অভিযোগ পেশ করল। বলল, যদি প্রতিশোধ নিতে বলেন তবে নেব। আর যদি না বলেন, তবে তার কী বিচার হওয়া উচিত? আমি তাকে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মারা যাবে ভেবে মারি নি। তাছাড়া শহরে বিচারক থাকতে কাউকে মারাও ঠিক নয়।

বিচারক বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে দেখলেন কিছাছ গ্রহণ করার মত শারীরিক অবস্থা তার নেই। তাই দরবেশকে উপদেশ দিয়ে বললেন, দেখুন প্রিয় বন্ধু! এই বৃদ্ধকে আঘাত করা যাবে না। হয়ত সে মারা যাবে। একজন সুস্থ-সবল মানুষকে মারা যায়, বেঁধে রাখা যায়, কিন্তু এ ব্যক্তির ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব নয়। তাকে ক্ষমা করে দেন। ক্ষমার মধ্যে আনন্দ রয়েছে। প্রতিশোধে কোন আনন্দ নেই।

দরবেশ বলল, কোনটা ক্ষমা করব? এ কেমন অন্যায় বিচার করছেন? এ বিচারের কথা কাল যখন মানুষ শুনবে তখন কাউকে অন্যায় করা থেকে থামানো যাবে না। সব খারাপ কাজের শাস্তি হওয়া উচিত। ৩০ বছর পর হ’লেও আমি তাকে মাফ করব না। আপনাকে অবশ্যই তাকে শাস্তি দিতে হবে। বিচারক বললেন, আমি যা বলেছি তাই হবে। এই লোকটি অসুস্থ, কষ্ট পাচ্ছে, মারা যাওয়ার মত অবস্থা। আপনার অভিযোগ প্রত্যাহার করা উচিত।

দরবেশ বলল, আমি কখনো এ কাজ করব না। বিচারক বৃদ্ধকে বললেন, তোমার কত টাকা আছে? সে বলল, কিছুই নাই। বিচারক বলল, সকালে কী খেয়েছ? বলল, কিছুই না।

বিচারক এবার দরবেশকে বললেন, দেখুন লোকটা ক্ষুধার্তও বটে। একটা থাপ্পড় না হয় আপনাকে মেরেছে তাতে তো আপনার কিছুই হয় নি। ছেড়ে দিন। তবে আপনার কাছে কত টাকা আছে? বলল, ৬ দিরহাম। বিচারক বললেন, টাকাটা দু’ভাগ করে ৩ দিরহাম বৃদ্ধকে দিন। সে অন্তত একটা রুটি কিনে খাবে। আল্লাহ আপনাকে অনেক ছওয়াব দিবেন।

দরবেশ প্রতিবাদ করে বললেন, আমি অবাক হয়ে গেলাম। মার আমি খেলাম, আবার আমিই টাকা দেব? এটা কোন ধরনের বিচার? এটা অন্যায়, যুলুম, নিষ্ঠুর বিচার। তাহ’লে চড়েরও মূল্য আছে? এভাবে দরবেশ ও বিচারক কথা কাটাকাটি শুরু করল। এবার বৃদ্ধ ভাবল একটা চড়ের দাম তাহ’লে ৩ দিরহাম। এ সময় সে খেয়াল করে দেখল বিচারকের ঘাড় থাপ্পড় মারার জন্য দরবেশের ঘাড়ের চেয়েও উপযুক্ত। তার মারার ইচ্ছা আবার জাগ্রত হ‘ল। দেরি না করে বিচারকের ঘাড়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বলল, এবার আমাকে একটা চড়ের দাম ৩ দিরহাম দিন।

বিচারক অত্যন্ত রাগান্বিত হ’ল। কিন্তু দরবেশ খুশি হয়ে বলল, এই নিন ৬ দিরহাম। ৩ দিরহাম আমাকে মারার জন্য আর বাকি ৩ দিরহাম আপনাকে মারার জন্য। বিচারক বললেন, এটা কেমন কথা? আপনি আমাকে মারার জন্য টাকা দিচ্ছেন?

দরবেশ বলল, হ্যঁা, একটা চড় ভাল হ’লে সবার জন্য ভাল, খারাপ হ’লে সবার জন্য খারাপ। দুঃখের বিষয় হ’ল, আমার কাছে আর টাকা নেই, নইলে এই দ্বিতীয় থাপ্পড়টার মূল্য একশ’ দিরহাম হ’ত। কারণ বিচারটা অন্যায় ছিল কিন্তু আপনার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত ছিল। যাতে আপনি বুঝতে পারেন যেটা নিজের জন্য খারাপ, সেটা অন্যের জন্যেও খারাপ।

শিক্ষা : প্রথমত, কারও বিচার করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তার বয়স ও শারীরিক সক্ষমতা দেখা উচিত। প্রত্যেক অপরাধের একটা খারাপ প্রভাব রয়েছে। সেজন্য অপরাধী শিশু কিংবা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি হ’লেও শৃঙ্খলার স্বার্থে তাকে মৃদু হলেও শাস্তি দিতে হয়। দ্বিতীয়ত, বিচারে পক্ষপাতিত্ব অথবা স্বজনপ্রীতির কারণে শিথিলতা করা যুলুমের পর্যায়ভুক্ত। সেজন্য মনে রাখতে হবে, যেটা নিজের জন্য খারাপ সেটা অন্যের জন্যেও খারাপ। এটাই এই গল্পের প্রধান শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের ব্যক্তিজীবনে এ গল্প শিক্ষা গ্রহণের তাওফীক দান করুন।-আমীন!

[গল্পটি ফারসী ভাষা থেকে অনূদিত।]

[অনুবাদক : শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহী]



আরও