শেষ সুযোগ

আব্দুল কাদের 416 বার পঠিত

আমার বয়স মোটামুটি আটাশ হবে। সুঠামদেহী একজন যুবক। অনেকদিন যাবৎ ঢাকার মুহাম্মাদপুরে আছি। এলাকায় বেশ পরিচিতিও আছে। তবে সেটা কোন ভালো গুণের জন্য নয়। লোকে আমায় চিনে আশিক মাস্তান বলে। আল্লাহর পরম কৃপায় মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছি। তথাপি ইসলামের ছিটেফেঁাটা আমার মধ্যে নেই। ছালাত-ছিয়াম পালন তো অনেক দূরের বিষয়। জীবনের রোজনামচায় সামান্যতম ভালো কাজ খুঁজতে গেলেও দীর্ঘ একটা শ্বাস নিয়ে লম্বা সময় ভাবতে হয়।

ছিনতাই, চঁাদাবাজি, টেন্ডারিং, ইভটিজিং আমার নিত্য দিনের কাজ। এমন কোন দিন খঁুজে বের করা কষ্টকর, যেদিন আমি কোন খারাপ কাজ করিনি। কেবল টাকার জন্য অনেককে পিটিয়ে আহত করেছি। নিজের বয়সের চেয়ে বড়দের প্রতি হাত তুলতেও সামান্য হাত কঁাপেনি। রাস্তার পাশে ক্ষুধার তাড়নায় কাতরানো শিশুগুলি যখন ‘ভাই দশটা টাহা দেন, দুইদিন ধরে কিচ্ছু খাইনাই’ বলে আমার পায়ে গড়িয়ে পড়েছে, তখন সজোরে লাথি দিয়ে তাদের দূরে ঠেলে দিয়েছি। একবারও ভাবিনি তাদের অসহায়ত্বের কথা। এতসব পাপ কাজের জন্য কোন দিন আমার হৃদয়ে সামান্য অনুশোচনাও হয়নি।

দ্বীন-ধর্মের কথা ভুলে আমি এক সংশয়বাদীতে পরিণত হয়েছিলাম। আমাকেও যে একদিন মরতে হবে, মালাকুল মাউত এসে আমার দুর্গন্ধময় আত্মাকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাবে, সেকথা একটি বারও ভাবিনি। সব সময় দুনিয়ার পিছনে ছুটেছি। টাকা-পয়সাকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়েছি। ভোগ-বিলাসিতাই যেন জীবনের সব প্রাপ্তি।

আমার নাফসে মুত্বমাইন্নার (প্রশান্ত হৃদয়) মৃত্যু ঘটেছে অনেক আগেই। নাফসে লাওয়ামাও (খারাপ কাজে বাধা দানকারী হৃদয়) প্রায় মুমূর্ষু। নাফসে আম্মারাই (খারাপ কাজে প্ররোচনা দানকারী হৃদয়) যেন আমার সর্বেসর্বা, দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় তার আধিপত্য। তাইতো হাযার খারাপ কাজ করেও আমি রাতে আরামে ঘুমিয়ে পড়ি। আজকের রাতটা হ’তে পারে আমার জীবনের শেষ রাত ভেবে কখনও নির্ঘুম রাত কাটেনি। কখনও মনে হয়নি এবার নিজেকে শুধরানো উচিত।

আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা খুব বেশী নয়। আছে বলতে কেবল মা আর ছোট ভাই। তারা গ্রামে থাকে। বাল্যকালেই আববাকে হারিয়েছি। চরম সংকটাপন্ন অবস্থায় পরিবারের হাল ধরতে এসেছিলাম রাজধানীর বুকে। বন্ধুদের খপ্পরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করেছি এই অন্ধকার জগতে। গড়ে তুলেছি নিজের আধিপত্য। অর্জন করেছি অগাধ সম্পদ ও ক্ষমতা। মুহাম্মাদপুরের একটা চকচকে দোতলা বাসায় থাকি। রাতের শেষ থেকে সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত আমি এখানে থাকি। প্রায় পুরো সময়টাই ঘুমে কেটে যায়।

প্রতিদিনের ন্যায় সেদিনও রাতের কাজ সেরে এসে শুয়ে পড়েছি। প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম। হঠাৎ মুঠোফোনের শব্দে তন্দ্রায় ছেদ পড়ল। ফোনের রিংটোনটা একটু বিকট ধরনের। তাই রিসিভ না করে শান্তিতে ঘুমানোর কোনো উপায় নেই। বার বার বাজতে থাকলে খুব বিরক্ত লাগে। ঘুমঘুম চোখে ফোনের স্ক্রীনে তাকালাম। স্ক্রীনের তীব্র আলোর রেখা ভেদ করে চোখে ভেসে উঠল আতীকের নাম। আতীক আমার ছোট ভাই। ফোনটা রিসিভ করে কানে রাখলাম। আতীক কঁাদো কঁাদো গলায় বলল, ‘ভাইয়া! আম্মু অসুস্থ। খুব জ্বর। তোমাকে দেখতে চাচ্ছে। তুমি কালকেই বাড়ি আসো’। আমি বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এখনই বের হচ্ছি’।

আম্মুর অসুস্থতার কথা শুনে দুচোখ থেকে ঘুম চলে গেল। আম্মুকে বড্ড ভালোবাসি আমি। জীবনে ভাল কাজ বলতে এটাই আছে আমার। পৃথিবীতে আপন বলতে আম্মু আর ছোট ভাইটাই তো আছে।

সে রাতে আর ঘুম হ’ল না। বাসা থেকে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মোটামুটি শীত পড়তে শুরু করেছে। আবছা কুয়াশায় তখনও চারিদিক ঢেকে আছে। কতদিন এমন সকাল দেখি না! নব উদিত সূর্যের আলো আমার গায়ে লাগে না কয়েক বছর। যখন ঘুম থেকে উঠি তখন সূর্যের মিষ্টি আলো অসহ্য তাপে পরিণত হয়। তখন আর তা উপভোগ্য থাকে না। যাহোক বাসস্ট্যান্ডে পেঁŠছে টিকিট সংগ্রহ করে বাসে উঠলাম। আমার সিটটা ঠিক মাঝ বরাবর, পিছনের চাকা থেকে একটু সামনে। কাউন্টার থেকে বলল, অল্পক্ষণের মধ্যেই ছাড়বে। আমি নির্ঘুম রাতের ক্লান্ত দেহ সিটে এলিয়ে দিলাম।

প্রায় মিনিট দশেক পরে বাস ছাড়ল। পাশের সিটে বসেছেন মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর হবে হয়তো। তিনি সিটটা পিছনে হেলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। আমার চোখেও তখন ঘুম ভর করতে শুরু করেছে। বাস কিছুদূর যেতেই আমিও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম।

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানিনা। অকস্মাৎ একটা বিকট শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। প্রচন্ড গতিতে ধাক্কা খেলাম সামনের সিটের সাথে। ডান পায়ে একটা প্রচন্ড চাপ অনুভব করলাম। আমাদের বাসটা মুখোমুখি এক্সিডেন্ট করেছে। কোন কিছু ভালোভাবে বুঝে উঠার আগেই পিছন দিক থেকে সজোরে আরেকটা ধাক্কা লাগল বাসে। কুয়াশায় দেখতে না পেয়ে আরেকটা বাস পিছনে লাগিয়ে দিয়েছে। পিছনের দিক থেকে শোনা গেল কিছু মানুষের গগন বিদারী আর্তনাদ। আমার পাশের সিটের লোকটা ছিটকে সামনে চলে গেল মুহূর্তেই। আমিও সামনের সিটের সাথে আরেকটা ধাক্কা খেলাম। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি হয়তো। পরক্ষণে পায়ের নিচ দিয়ে বয়ে চলা রক্তস্রোত ও ডান পায়ের প্রচন্ড ব্যথা জানান দিল নির্মম বাস্তবতা।

আজ প্রথমবার মনে মৃত্যুর ভয় হচ্ছে। মৃত্যু যে ঠিক কতটা নিকটবর্তী, তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করলাম। নাফসে লাওয়ামাহ আজ আমার উপর বিজয়ী হয়েছে। বারবার বলছে, ‘তুই মরিস না, তুই মরিস না। তোকে বঁাচতে হবে। এভাবে মরলে তোর ঠিকানা কোথায় হবে সেটা তোর অজানা নয়’।

বাসে মুমূর্ষু লোকজনের আর্তনাদ শুনতে শুনতে জীবনের প্রতি মায়া সৃষ্টি হচ্ছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হচ্ছে আজ। জানিনা আল্লাহ কপালে কী লিখে রেখেছেন! নিজেকে শুধরানোর আকাঙ্ক্ষা মনের মধ্যে জেগে উঠছে বারবার। নানা রকম চিন্তাভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। পায়ের ব্যথাটা আস্তে আস্তে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যথায় ক্লান্ত চোখ দু’টি বারবার বন্ধ হ’তে চাচ্ছে। বেঁচে থাকার তীব্র চেষ্টায় উঠে দঁাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সামলাতে পারলাম না। তীব্র ব্যথায় জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম...।

ঠিক কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম জানিনা। মুখের উপর এক ঝাপটা ঠান্ডা পানির স্পর্শে জ্ঞান ফিরে পেলাম। চোখ খুলে দেখলাম চারিদিকে মানুষের ছোটাছুটি। অনেক মানুষ যাত্রীদের উদ্ধার করার চেষ্টা করছে। জীবিতদের এনে রাখা হচ্ছে রাস্তার পাশে একটা আম গাছের নিচে। সৌভাগ্যক্রমে আমিও আমগাছের নিচে জায়গা পেয়েছি। তবে অনেক যাত্রীরই জায়গা হয়েছে লাশের সারিতে।

আমাদের থেকে একটু দূরে খোলা জায়গায় মৃতদেহগুলো সারি সারি রাখা। পাশে থাকা লাশের সারিতে দৃষ্টি দিতেই আমি বিস্ময়ে অঁাতকে উঠলাম! আমার পাশের সেই মধ্যবয়সী ভদ্রলোকটার জায়গা হয়েছে লাশের সারিতে! দু’জন পাশাপাশি সিটে বসেছিলাম। কিন্তু এখন তিনি চোখ বন্ধ করে লাশের সারিতে শুয়ে আছেন আর আমি জীবিত; দিব্য চোখে তা দেখছি! অপলক তাকিয়ে রইলাম মধ্যবয়সী মৃতদেহের দিকে।

চারপাশে আহতদের আর্তনাদে বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। জীবিতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য আসা প্রতিটি এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ সবাইকে আরও ব্যস্ত করে তুলছে। দু’জন এসে আমাকেও এ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিল। পা থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে। হাতে-মুখে-বুকের কিছু ক্ষতচিহ্ন থেকেও রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমার সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ভাঙা পায়ের তীব্র ব্যথাটাও যেন আর অনুভব করতে পারছি না। শুধু মনে একটা ভয়ংকর ব্যথা উপলব্ধি হচ্ছে। আমার মনে তখন বয়ে চলেছে হাযারও প্রশ্ন। আমার জায়গাটাও তো আজ লাশের সারিতে হ’তে পারতো! আমি যদি এ অবস্থায় মারা যেতাম, তবে কি আমার কপালে তওবা জুটতো? আমি কি কখনও নিজেকে শুধরাতে পারতাম! যাদের প্রতি এত অন্যায় অত্যাচার করেছি, তাদের কাছে মাফ চাওয়ার শেষ সুযোগটা কি হত!

হাযার প্রশ্নবাণ এড়িয়ে সামনে এলো একটি মূল্যবান প্রশ্ন। তবে কি দয়াময় আল্লাহ তঁার পাপিষ্ঠ বান্দাকে নিজেকে শুধরানোর একটা শেষ সুযোগ দিলেন?

[লেখক : ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]




আরও