আব্দুল্লাহিল কাফী আল-কুরায়শী (রহঃ) প্রদত্ত্ব ভাষণ
তাওহীদের ডাক ডেস্ক
অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী 128 বার পঠিত
ইংরেজ বর্বরতা ও সৈয়দ আহমদ খান :
মুসলিম সমাজের জন্যে সৈয়দ আহমদ খানের দরদের অন্ত ছিলো না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ইংরেজ শক্তি এদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। শক্তি এবং সংগঠন ভিন্ন তাদের সঙ্গে বিরোধিতা করার অর্থ নিজেদের জাতীয় জীবনকে বিপন্ন করা। সৈয়দ আহমদের মনোভঙ্গির সাথে সকলে একমত না হতে পারেন বটে, কিন্তু একথা স্বীকার করতে হবে যে, তাঁর এই ধারণার কারণেই ইংরেজ নির্যাতনে নির্যাতিত মুসলিম সমাজ যখন সিপাহী জিহাদে মাতোয়ারা হয়ে উঠেন, তখন সৈয়দ আহমদ এর প্রতিক্রিয়ার কথা ভেবে নিরতিশয় ব্যাকুল হয়ে পড়েন।
সিপাহী সংগ্রামের অবসানে মুসলিম জাতির জীবনে নেমে এলো দুর্যোগের করাল ছায়া। ইংরেজ শক্তির বর্বর-প্রতিশোধ বাসনা সমগ্রদেশে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করলো। সে সময়কার মুসলিম লিখিত ইতিহাস পাওয়া যায় কিনা, আমার জানা নেই। কিন্তু ইংরেজ লিখিত বর্ণনা থেকে আমার ইংরেজ পাশবিকতার যে পরিচয় পাচ্ছি তা চেংগিস ও হালাকুর নৃশংসতাকে একেবারেই নিষ্প্রভ করে দেয়। দিল্লীতে নর-রক্তে ইংরেজশক্তি হোলি-উৎসব করলো। এলাহাবাদে বৃদ্ধ নারী ও শিশুদের মস্তক নিয়ে খেললো, কানপুর, লক্ষ্ণৌর রাজপথে ইংরেজ বর্বরতার ইতিহাস রক্তের অক্ষরে লিখিত হলো। গোটা দেশের আকাশে-বাতাসে আর্তনাদের সুর বেজে উঠলো।
এসময়ে ‘নেটিভ’দের সর্বস্ব লুণ্ঠন করার কার্য এক সপ্তাহের জন্য সরকারী ঘোষণা দ্বারা অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে মাসাধিককাল সমগ্র দেশব্যাপী লুণ্ঠনের সঙ্গে ‘সার্বজনীন’ নরহত্যা চলতে থাকে। এ দুর্যোগের করালগ্রাসে তদানীন্তন মুসলমান সমাজই বিশেষভাবে পতিত হন। এই সময় সৈয়দ আহমদ খান মুসলমানদের রক্ষার জন্য এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করলেন।
১৯৫৮ খৃষ্টাব্দে তিনি উর্দুতে সিপাহী বিপ্লবের উপর একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এতে তিনি বিপ্লবের কারণ হিসেবে পাক-ভারতের জনগণের মনোভাব সম্পর্কে ইংরেজদের অজ্ঞতাকেই দায়ী করেন। তিনি বলেন যে, ভাইসরয়ের আইন পরিষদে দেশীয় প্রতিনিধত্ব দ্বারাই জনগণের ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের প্রতিকার করা সম্ভব। এ ছাড়া তিনি পাক-ভারতীয় মুসলমানদের উপকারার্থে ‘ভারতের রাজভক্ত মুসলমান’ নামক আর একটি পুস্তিকা রচনা করেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, দেশের হিন্দুসমাজ যখন ইংরেজী শিক্ষাকে পুরোপুরি গ্রহণ করে দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলেছেন, তখন মুসলমানদের নেতৃত্বে সিপাহী জিহাদ পরিচালনা করার কার্যকে সৈয়দ আহমদ অনুমোদন দান করতে পারেননি। সিপাহী জিহাদের পর ইংরেজরা মুসলামনদের প্রতিই প্রধাণত বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠল। সৈয়দ আহমদ বুঝেছিলেন যে, মুসলমানদেরকে ইংরেজী শিক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারলে মুসলমানদের কল্যাণ নেই। আর ইংরেজদের সঙ্গে সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করতে না পারলে ইংরেজরা চিরদিনই মুসলমানদেরকে অবহেলিত করে রাখবে। প্রতিবেশী হিন্দুসমাজ চিরদিনের জন্য পাক-ভারতের উন্নতিশীল জাতি হিসেবে পরিগণিত থাকবে। এই উপলব্ধির জন্যেই তিনি ইংরেজদের নিকট এদেশীয় মুসলমানদেরকে ‘রাজভক্ত’ বলে প্রতিপন্ন করতে চাইলেন। এজন্যেই তিনি উল্লিখিত বই লিখে ইংরেজরোষের কবল থেকে মুসলমানদেরকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। সিপাহী জিহাদের অব্যবহিত পর মুসলমানদের উপর ইংরেজ যুলুম এতই প্রচন্ড ছিল যে, সে সময়ে মুসলমান জনগণের নিকট একটুখানি সান্ত্বনাবাণীর মূল্যও ছিলো যথেষ্ট। এই জন্যই মুসলমানদের প্রতি যুলুম লাঘব করবার উদ্দেশ্যে সৈয়দ আহমদের কর্মতৎপরতা মুসলিম সমাজের জন্যে ভরসা স্বরূপ ছিলো।
সৈয়দ আহমদ ও মুসলিম শিক্ষার পুনর্গঠন :
কিন্তু সৈয়দ আহমদ খানের অবদান শুধুমাত্র সাময়িকভাবে মুসলিম ধন ও জীবনরক্ষার কাজেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। বরঞ্চ মুসলিম সমাজকে তিনি স্থায়ী ভাবে রক্ষা করার জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। তিনি ১৮৬৫ খৃষ্টাব্দে ‘বিজ্ঞান সমিতি’ নামক একটি তমদ্দুনিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং এর মারফত মুসলিম সমাজকে আধুনিক শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে তুলতে যত্নবান হন। ১৬৬৯ খৃষ্টাব্দে তিনি বিলেত গমন করেন এবং সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে এদেশীয় মুসলিম-সমাজকে জাগরণের বাণী শুনাতে থাকেন।
এই সময় তিনি ‘তাহযিবুল আখলাক’ নামক একটি সাময়িকী প্রকাশ করেন। এই পত্রিকা মারফৎ তিনি ইসলামের প্রগতিশীল রূপ সম্পর্কে দেশের শিক্ষিত সমাজকে ওয়াকিফহাল করতে থাকেন। তিনি প্রতিপন্ন করতে চান যে, পাশ্চাত্য শিক্ষা ইসলাম-বিরোধী নয়। সুতরাং সমাজকে ইসলামী জ্ঞানের সঙ্গে পাশ্চাত্যজ্ঞান মিশিয়ে মুসলিম সমাজকে প্রগতির পথে অগ্রসর হতে হবে। তাঁর এই মতবাদের পরিপেক্ষিতে তিনি মুসলিম শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন করতে বদ্ধপরিকর হলেন।
এইবার সৈয়দ আহমদ মুসলিম জাতির নবজীবনের দ্বার উদঘাটনের জন্য ব্রতী হলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, মুসলিম অভিভাবকগণ ছেলেদেরকে সরকারী কলেজে পড়াতে চান না এই ভয়ে যে, তাতে ছেলেরা নীতিভ্রষ্ট এবং ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়বে। অথচ ইংরেজী শিক্ষার অভাবে মুসলমানরা সরকারী চাকুরী এবং ব্যবসায় বাণিজ্যে পশ্চাৎপদ হয়ে পড়েছে। সৈয়দ আহমদ মুসলিম আভিভাবকদের আপত্তি বিদূরিত করবার উদ্দেশ্যে ১৮৭৫ খৃষ্টাব্দে আলীগড় কলেজ (পরবর্তীকালে বিশ^বিদ্যালয়) স্থাপন করলেন। এই কলেজে পাশ্চাত্য শিক্ষাসূচী গ্রহণ করা হলো, কিন্তু আরাবী ভাষা এবং ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হলো। অক্সফোর্ড ও কেমব্রীজের আদর্শে কলেজটি ছিল আবাসিক এবং এর প্রথম তিনজন অধ্যক্ষ ছিলেন ইংরেজ।
এই নূতন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে মুসলিম সমাজ শুধু যে সরকারী চাকুরী ও ব্যবসায় বাণিজ্যেই অগ্রসর হলেন তা নয়, বরঞ্চ ভাবীদিনের মুসলিম রাজনীতিকদের জন্মও এই নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়েই সূচিত হলো। পরবর্তী খিলাফত আন্দোলনের নেতা মওলানা মুহম্মদ আলী, পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্ণর জেনারেল খাজা নাযিম উদ্দীন ও গোলাম মোহম্মদ, শহীদে মিল্লাত লিয়াকত আলী খান প্রমুখ রাজনীতিবিদরা ছিলেন আলীগড় শিক্ষিত। সমগ্র পাক হিন্দু ভূভাগেই আলীগড়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত মুসলিম সমাজের প্রস্তাব বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছিলো একথা অনস্বীকার্য।
সৈয়দ আহমদের রাজনৈতিক চিন্তাধারা :
সৈয়দ আহমদ শুধুমাত্র শিক্ষার পুনর্গঠনের মারফতই মুসলিম রেনেসাঁর সূচনা করেননি, বরঞ্চ রাজনৈতিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রেও তাকে তরান্বিত করেছেন। সরকারী চাকুরী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ১৮৭৮ খৃস্টাব্দ থেকে ১৮৮৩ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত বড়লাটেব আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন। এই সময় লর্ড রিপন যে স্থানীয় স্বায়ত্বশাসনমূলক লোকাল বোর্ড ও জেলা বোর্ডের প্রবর্তন করেন, তাতে মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র মনোনয়নদানের জন্য সৈয়দ আহমদ দাবী তোলেন এবং শেষ পর্যন্ত তা গৃহীত হয়। সৈয়দ আহমদের জীবনের শেষ সময়ে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জন্ম পরিগ্রহ করে। এই পাক-ভারতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে সৈয়দ আহমদের দৃষ্টিভঙ্গি পরবর্তী পাক-ভারতীয় রাজনীতিকে প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করেছে বলে এটা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন। তারপূর্বে ১৮৫৮ থেকে কংগ্রেসের জন্মকাল অর্থাৎ ১৮৮৫ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতীয় শাসন-বিধানের যে কিঞ্চিৎ রূপান্তর ঘটেছে সে সম্পর্কে ওয়াকিফহাল থাকা প্রয়োজন। সিপাহী জিহাদের ফলে পাক-ভারতে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের অবসান ঘটে। বৃটিশ পার্লামেন্টে এদেশের শাসন সম্পর্কে একটি নতুন আইন’ Act for the better Government of India বিধিবদ্ধ হয়। এই আইনের ফলে পাক-ভারতের শাসন কোম্পানীর হাত থেকে ইংল্যান্ডের মহারাণী ভিক্টোরিয়ার হাতে ন্যস্ত হলো। বড়লাটের উপাধি হলো ভাইসরয় এবং গভর্ণর জেনারেল। এর ফলে ক্যানিং ভারতের প্রথম ভাইসরয় হলেন।
আসলে এর ফলে শাসনপদ্ধতিতে মৌলিক কোন পরিবর্তনই হলো না। শুধুমাত্র বোর্ড অব কন্ট্রোলের (Board of control) পরিবর্তে একজন ভারত সচিব (secretary of state for India) এবং তাঁহার একটি পরামর্শ সভা (Indian council) নিযুক্ত হলো। পাক-ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে রাণী ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ খৃষ্টাব্দের ১লা নভেম্বর তারিখে একটি ঘোষণাপত্র প্রচার করলেন। (Queen's proclamation) এই ঘোষণাপত্রে বলা হলো যে, দেশীয় রাজ্যসমূহ অধিকারের নীতি বর্জিত হলো। দেশীয় রাজাদের সঙ্গে সমস্ত সন্ধির শর্ত প্রতিপালিত হবে। দেশবাসীর ধর্ম ও সামাজিক ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করবেন না। জাতিধর্ম নিবির্বশেষে ভারতবাসীকে রাজকার্যে নিযুক্ত করা হবে। ভিক্টোরিয়ার এই ঘোষণা ভারতীয় জনগণের জন্য আপাত সান্ত্বনাদায়ক ব্যাপার। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সিপাহী বিপ্লবোত্তর বিশৃঙ্খলা সামলানোই ছিলো এর মুখ্য উদ্দেশ্যে। দেশীয় রাজ্যসমূহের মধ্যে অনেকেই সিপাহী সংগ্রামে শামিল হয়নি। তাই ঘোষণায় তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া হলো। উচ্চ সরকারী কার্যে দেশীয় কর্মচারী নিযুক্তির প্রতিশ্রুতি কার্যক্ষেত্রে সীমাবদ্ধই ছিলো। ভারতীয় পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করার সুযোগ প্রধানতঃ ইউরোপীয়দেরই ছিল। বরং ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ৭জন ভারতীয় প্রতিযোগী ছিলেন আর ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে ছিলেন ২জন। এর কারণ ছিলো এই যে, প্রতিযোগীদের বয়স কমিয়ে ২১ বৎসর থেকে ১৯ বৎসরে নিয়ে আসা হয়েছিলো। আর মাত্র ১৯ বৎসর বয়সে ভারতীয় তরুণদের পক্ষে বিলেতে গিয়ে পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা করা সহজ ব্যাপার ছিলোনা।
সর্বোপরি কথা হচ্ছে এই যে, মুসলিম সমাজ ইংরেজী শিক্ষায় এতই পশ্চাৎপদ ছিলো যে পাবলিক সার্ভিস তাদের আওতার বাইরে পড়ে গিয়েছিলো। প্রথম মহাযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে ভারতীয় পদস্থ অফিসার বড় একটা মিলতোনা। সুতরাং কি সিভিল, কি মিলিটারী সমস্ত দিক থেকেই ইউরোপীয়দের মোটা মোটা বেতন, ভাতা, পেনশন ইত্যাদি এদেশীয় জনগণকে নির্বাহ করতে হতো। এদেশীয় জনগণের শিক্ষিত সমাজের নিকট এর একটা প্রতিক্রিয়া স্বাভা বিক ছিল। তাই তাদের জন্য শাসনব্যাপারে কিছুটা পরামর্শ দেবার সুযোগ সৃষ্টি করা হলো। এরই ফলে ১৮৬২ খৃষ্টাব্দে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল এক্ট বিধিবদ্ধ হল। এর দ্বারা আইন প্রণয়নের ব্যাপারে বড়লাটের পরিষদে বেসরকারী সদস্য নিযুক্ত করার ব্যবস্থা করা হলো। ১৮৯২ খৃষ্টাব্দে এবং ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে পর পর আরো দুটো ইন্ডিয়ান কাউন্সিল এক্ট বিধিবদ্ধ হয়।
(ক্রমশঃ)