শায়খ রবী‘ আল-মাদখালী

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 478 বার পঠিত

[শায়খ রবী আল-মাদখালী (৯১) সউদী আরবের একজন বিখ্যাত সালাফী আলেম, যিনি আক্বীদা ও হাদীছ শাস্ত্রে অবদানের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন। সালাফী নীতির অনুসরণ ও বিদ‘আত পরিহারে দৃঢ়তার জন্য তিনি অধিক পরিচিত। তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আস-সুন্নাহ অনুষদের শিক্ষক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের চেয়ারম্যান ছিলেন। হাদীছ, আক্বীদা ও বিভিন্ন ফের্কার বিরুদ্ধে তাঁর লিখিত গ্রন্থসমূহ জাতিকে অনেক বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দিয়েছে। নিম্নে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী ও কর্ম তুলে ধরা হ’ল]

জন্ম ও পরিচয় : শায়খ রবী‘ আল-মাদখালী সউদী আরবের জাযান প্রদেশের রাজধানী ছামাতা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে জারাদিয়াহ নামক এক ছোট্ট গ্রামে ১৩৫১ হিজরী মোতাবেক ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্ণ নাম রবী‘ বিন হাদী বিন মুহাম্মাদ ওমায়ের আল-মাদখালী। দেড় বছর বয়সে তাঁর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। এরপর থেকে তিনি মায়ের কাছে লালিত-পালিত হন।

শিক্ষা ও কর্মজীবন : তিনি স্থানীয় আলেমদের কাছে জ্ঞানার্জন শুরু করেন। যাদের মধ্যে আহমাদ বিন মুহাম্মাদ মাদখালী ও মুহাম্মাদ জাবের মাদখালী অন্যতম। তাদের কাছে তিনি আট বছর বয়স পর্যন্ত শিক্ষালাভ করেন। অতঃপর তিনি স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ছামাতা শহরের বিজ্ঞান ইন্সটিটিউট থেকে ১৯৬১ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি রিয়াদের মুহাম্মাদ বিন সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আ অনুষদে ভর্তি হয়ে প্রায় দেড় মাস পড়ালেখা করেন। সে বছরই মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হ’লে তিনি সেখানে চলে যান এবং শরী‘আ অনুষদে চার বছর অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি শায়েখ বিন বায, নাছিরুদ্দীন আলবানী, মুহাম্মাদ আমীন আশ-শানক্বীতী, আব্দুল মুহসিন আববাদসহ অনেক বিজ্ঞ আলেমের ছাত্রত্ব লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রশংসনীয় ফলাফলের সাথে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন।

অতঃপর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি মক্কার কিং আব্দুল আযীয বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯৭৭ সালে ‘ইমাম মুসলিম ও ইমাম দারাকুৎনীর মাঝে’ শিরোনামে থিসিস প্রণয়নের মাধ্যমে তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে হাফেয ইবনু হাজার আসক্বালানীর ‘আন-নুকাতু আলা কিতাবি ইবনে ছলাহ’ এর তাহকীক সম্পন্ন করে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।

শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আস-সুন্নাহ অনুষদে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন এবং অনুষদের উচ্চতর ডিগ্রী পর্যায়ের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৯০ সালে তিনি এই পদ থেকে অব্যাহতি নেন।

অবদান : শায়েখ রবী‘ আল-মাদখালী ধর্মীয় সংস্কারের দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেন। ২০১২ সালে ‘The Royal Aal al-Bayt Institute for Islamic Thought’ তাকে ইসলামী চিন্তাধারার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০০ জনের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করে।

তিনি হাদীছ, ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপর ৩০টির অধিক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। যার অধিকাংশ ‘শায়েখ রবী বিন হাদী ওমায়ের আল-মাদখালীর কিতাব, চিঠিপত্র ও ফৎওয়া সংকলন’ নামে ১৫ খন্ডে সংকলন করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে তিনি ‘মানহাজুল আম্বিয়া ফী দাওয়াহ ইলাল্লাহ’ (আল্লাহর পথে দাওয়াতের ক্ষেত্রে নবীদের পদ্ধতি) নামক গ্রন্থটি প্রণয়নের পর সউদী আরবসহ মুসলিম বিশ্বে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন। মিসরের সাইয়েদ কুতুবের ভ্রান্ত মতবাদকে খন্ডন করার জন্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে তিনি অন্যতম। সাইয়েদ কুতুবের বিপক্ষে তিনি ৪টি গ্রন্থ রচনা করেন। যার মধ্যে ‘আযওয়া ইসলামিয়্যাহ ‘আলা আক্বীদাতিস সাইয়েদ কুতুব ওয়া ফিকরিহি’ (সাইয়েদ কুতুবের আক্বীদা ও চিন্তাধারা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসাবে বিবেচিত হয়। এছাড়া তাঁর রচিত ও তাহকীককৃত গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল :

(১) মানহাজুল ইমাম মুসলিম ফী তারতীবি ছহীহিহী : মুযাক্কিরাতুন ফীল হাদীছ আন-নববী। (২) ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর ‘কিতাবুত তাওয়াস্সুল ওয়াল অসীলাহ’ গ্রন্থের তাহকীক। (৩) কাশফু মাওক্বিফুল গাযালী মিনাস সুন্নাতি ওয়া আহলিহা (৪) মাকানাতু আহলিল হাদীছ।

তিনি বিভিন্ন বাতিল ফের্কার বিপক্ষে বিতর্কে অংশ নেন এবং পরবর্তীতে সেগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এছাড়া ভ্রান্ত আক্বীদা ও মতবাদের বিরুদ্ধেও তিনি অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। যার কয়েকটি উল্লেখ করা হ’ল :

(১) আহলুল হাদীছ হুম আত-ত্ব-ইফাতুল মানছূরাতুন নাজিয়াহ (সালমান আল-আওদাহর সাথে তাঁর বিতর্ক)। (২) আল-হাদ্দুল ফাছেল বায়নাল হক্ব ওয়াল বাতিল (আবু বকর আবু যায়েদের সাথে বিতর্ক)। (৩) আল-মুহাজ্জাতুল বায়যা’ ফী হিমায়াতিস সুন্নাতিল গার্রা’ (৪) আল-‘আওয়াছিমু মিম্মা ফী কুতুবি সাইয়েদ কুতুব মিননাল ক্বাওয়াছিম (৫) আন-নাছরুল ‘আযীয ‘আলার রদ্দিল ওয়াজীয। (৬) আত-তানকীল বিমা ফী তাওযীহিল মালীবারী মিনাল আবাতীল। (৭) ইনক্বিযাযুশ শুহবিস সালাফিইয়াহ ‘আলা আওকারি ‘আদনান আল-খলফিইয়াহ। (৮) ছদ্দু ‘উদওয়ানিল মুলহিদীন ওয়া হুকমিল ইসতি‘আনাহ বিগায়রিল মুসলিমীন।

বিভিন্ন সাময়িকীতে প্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : (১) আন-নছীহাতু হিয়াল মাস’ঊলিইয়াতুল মুশতারিকাহ ফীল ‘আমালিদ দা‘বী (২) আল-কিতাবু ওয়াস-সুন্নাতু ওয়া আছারুহুমা ওয়া মাকানাতুহুমা ওয়ায যরূরাতু ইলাইহিমা ফী ইক্বামাতিত তা‘লীম ফী মাদারিসা। এছাড়া তাঁর মাস্টার্স-এর থিসিস গ্রন্থটি সঊদী আরবের উচ্চ পর্যায়ের আলেমদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে।

শায়খ রবী আল-মাদখালী সম্পর্কে আলেমদের মতামত :

শায়খ বিন বাযকে মুহাম্মাদ আমান ও রবী‘ আল-মাদখালী সম্পর্কে জিজ্ঞস করা হ‘লে তিনি বলেন, তঁারা দুজনই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের অনুসারী। আমি তাদেরকে জ্ঞানী, মর্যাদাবান ও বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণকারী হিসাবে জানি’। তিনি তাদের বই থেকে উপকার লাভের পরামর্শ দেন।

শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী তাঁর সম্পর্কে বলেন, ‘বর্তমান সময়ে সত্যিকার অর্থে ইলমুল জারাহ ওয়া তা‘দীল-এর ঝান্ডাবাহী হচ্ছেন ড. রবী‘ বিন হাদী আল মাদখালী। যারা তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলেন কিংবা তাঁর উপর বিভিন্ন অভিযোগ আনয়নের চেষ্টা করেন, তারা তা নিজেদের অজ্ঞতার কারণেই করে থাকেন। আমি ড. রবী‘র লেখা বই-পুস্তকে যা দেখেছি তা জাতির জন্য উপকারী’।

শায়খ ছালেহ আল ওছায়মীন বলেন, ‘শায়খ রবী‘ সম্পর্কে আমি ভালো ছাড়া কিছু জানি না। তিনি হাদীছ ও সুন্নাহর অনুসারী।

শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব আল-বান্না বলেন, ‘শায়খ রবী‘ সর্বদাই সুন্নাত, সালাফে ছালেহীনের নীতি ও পন্থা অনুযায়ী চলা এবং সীরাতে মুস্তাক্বীমের দিকে মানুষকে দা‘ওয়াত দেওয়ার প্রতি আগ্রহী’।

শায়খ ওবায়দুল্লাহ মুবারাকপুরী বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে শায়খ রবী‘ গভীর জ্ঞানের অধিকারী, সঠিক ধীসম্পন্ন, বিশ্বাস ও কাজে সালাফে ছালেহীনের সঠিক নীতি ও পন্থা অবলম্বনকারী, কুরআন ও সুন্নাহর অনুসারী ও সাহায্যকারী এবং এগুলোর প্রহরী। বিদ‘আতী ও প্রবৃত্তি পূজারীদের বিরুদ্ধে কঠোরতা অবলম্বনকারী একজন সরল প্রকৃতির লোক। আল্লাহ তাঁর ইলমে বরকত দান করুন’।

কতিপয় ফৎওয়ার ক্ষেত্রে তার কিছু সমালোচনা রয়েছে। বিশেষ করে অত্যাচারী সরকার বর্জনে সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণের বিপক্ষে তাঁর বক্তব্যের জন্য শৈথিল্যবাদী আলেমরা তাঁর সমালোচনা করেছেন। তবে প্রখ্যাত আলেমদের মতে, তিনি আহলে সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত একজন হকপন্থী আলেম।

শায়েখ রাবী‘ আল-মাদখালী সংকলিত গ্রন্থের একটি নছীহাহ : ‘তোমরা তোমাদের পারস্পরিক আচরণে হিকমাহ বা প্রজ্ঞা অবলম্বন করো। আর এমন প্রশ্ন করা বর্জন করো যেগুলো বিদ্বেষ তৈরি করে এবং পরচর্চা বা পরনিন্দার পথে নিয়ে যায়। আল্লাহর শপথ এ বিষয়টি ক্ষতি করেছে। আমি এখন আমার ফোন বন্ধ করে রেখেছি। আমি কোন প্রশ্ন নিচ্ছি না। কারণ আমি দেখেছি, এসব প্রশ্নই অনেক সমস্যার কারণ হয়েছে। অমুক-তমুক সম্পর্কে প্রশ্ন! তুমি (কারো সম্পর্কে) ভালো বল বা মন্দ যাই বল না কেন, এসব প্রশ্নের দ্বারা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে ফিৎনাহ সৃষ্টি করা।

ভাইয়েরা! বর্তমান সময়কার এই ঘোলাটে পরিবেশে পরচর্চা বা অমুক-তমুককে নিয়ে সমালোচনা বর্জন করো। তুমি কারও প্রশংসা করবে এবং তার পক্ষপাতিত্ব করে গোঁড়ামী করবে, আবার আরেকজন আসবে যে তুমি যার গোঁড়া পক্ষপাতিত্ব করছ, তার প্রতিপক্ষ কিংবা তার বিরোধী একজনের পক্ষপাতিত্বে গোঁড়ামী করবে। এভাবে একের পর এক ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে!

অথচ বর্তমানে কি দেখা যাচ্ছে! ফিৎনাবাজ কোন কোন নগণ্য ছাত্র, সে আহলুস সুন্নাহর অনুসারীদের পরস্পরের মধ্যে ফিৎনা উস্কে দেয়ার অপচেষ্টা করছে। আর এতে করে সকাল-সন্ধ্যার মধ্যেই সে ইমাম হয়ে যাচ্ছে। দুইদিন পাঠদান করতে বসেই খালাছ, সে উসতায হয়ে যাচ্ছে। তার ঘনিষ্ঠ অনুসারী একদল লোক থাকে, যারা তার পক্ষে দল পঁাকায়। তারা তার সম্পর্কে কোন সমালোচনা তা যতই দলীল-প্রমাণ সহকারে করা হোক না কেন, তা সহ্য করতে পারে না। যখনই কোন ব্যক্তি দালীল-প্রমাণসহ তার সমালোচনা করে, তখন যেন দুনিয়া তোলপাড় হয়ে যায়। আর ঐসব লোক তার পক্ষে দলাদলি করে এবং কট্টরভাবে তার পক্ষাবলম্বন করে।

আল্লাহর শপথ! আমাদের চোঁখের সামনেই মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিন বায (রহঃ) ও আলবানী (রহঃ) পরস্পর (কোন কোন ফিক্বহী বিষয়ে) মতবিরোধ ও তর্ক-বিতর্ক করেছেন, কিন্তু আল্লাহর শপথ! তাদের এরূপ মতবিরোধ ও বিতর্কের বিন্দুমাত্র বিরূপ কোন প্রভাব-প্রতিক্রিয়া (সালাফীদের মধ্যে) দেখা যায়নি।

অতএব ভাইয়েরা! এসব বিষয়ে সাবধান হও। এরূপ বিষয়গুলো বর্জন করো। গোঁড়ামীমূলক অমুক-তমুকের পক্ষাবলম্বন করো না। যে কারু পক্ষপাতিত্বে গোঁড়ামী করো না। নতুবা এগুলো সালাফী দাওয়াহকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে দেবে। তোমরা একে অপরের প্রতি সহনশীল হবে এবং একে অপরকে প্রজ্ঞার সাথে নছীহাহ দেবে। আমি আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করছি, তিনি যেন তোমাদের অন্তরে প্রীতি সঞ্চার করে দেন এবং তোমাদের থেকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার ফিৎনা দূরীভূত করে দেন। হে ভাইয়েরা! ফিরে এস সেসব বিষয়ের দিকে, যুগে যুগে যেসব বিষয়ের উপরে ছিলেন তোমাদের সালাফগণ; প্রজ্ঞার সাথে পরস্পর নছীহাহ করা, সুন্দর সদুপদেশ প্রদান ও মহৎ চরিত্র অবলম্বন করা।

[আল বায়ান ওয়াল ঈযাহ লি আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ ফী রু‘ইয়াতিল্লাহি ইয়াওমাল ক্বিয়ামাহ’ গ্রন্থ অবলম্বনে; সূত্র : ইন্টারনেট]



বিষয়সমূহ: বিবিধ
আরও