কাওয়ারাঈ নাকাতা (জাপান)-এর ইসলাম গ্রহণ

তাওহীদের ডাক ডেস্ক 255 বার পঠিত

এক আধ্যাত্মিক আকর্ষণ আমাকে টেনে নিল মসজিদের ভেতরে। আমি ধীরে ধীরে পা ফেলছিলাম। আমার কানে ভেসে আসছিল এক বিশেষ আহবান বা সুসংবাদ। তাতে বলা হ’ল যে, তুমি শিঘ্রই সত্যকে খুঁজে পাবে। কথাগুলো বলেছেন জাপানি নওমুসলিম নারী ‘কাওয়ারাঈ নাকাতা’।

জাপানি নারী কাওয়ারাঈ নাকাতা জীবনের একটা সময় পর্যন্ত স্রষ্টা সম্পর্কে তেমন মনোযোগ দিয়ে ভাবনা-চিন্তা করেননি। এমন ভাবনার দরকার আছে বলেও মনে করেননি কখনো। তিনি বলেছেন, ‘আমার জীবনযাত্রা বেশ ভালোভাবেই চলছিল। আমি সৌভাগ্য অনুভব করতাম। কখনো স্রষ্টার পরিচয় বা অস্তিত্ব জানার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করিনি। কিন্তু হঠাৎ আবিস্কার করি যে, আমার জীবন পরিক্রমা একঘেয়ে হয়ে আছে, যার কোনো অর্থ নেই। জীবনের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য নেই। তখন থেকেই সত্যকে খুঁজতে থাকি। নানা ধর্মের প্রচারকরা আমার বাসায় এসেছেন বেশ কয়েকবার। সে সময় খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য একজন মহিলা নিয়মিত আমার বাসায় আসতেন। তিনি আমাকে বাইবেল শেখাতেন। আমিও খুব আগ্রহ নিয়ে তা শিখতাম। কিন্তু আমি যার খেঁাজ করছিলাম তা পেলাম না’।

মিসেস নাকাতা আরো বলেছেন, ‘আমি বসবাস করতাম কিয়েটো নামক ঐতিহাসিক শহরে। এই শহরে রয়েছে নানা ধরনের উপাসনালয়। আমাদের বাসভবনের কাছেই ছিল একটি উপাসনালয়। আমি প্রতিদিন সকালে সেখানে যেতাম ও প্রার্থনা করতাম। তিন মাস ধরে প্রতিদিন এই প্রার্থনা অব্যাহত রাখি। সত্যের সন্ধানে আমি এই প্রার্থনা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু প্রার্থনায় মনোযোগ নিবিষ্ট করা ছিল বেশ কঠিন। কিছুদিন পর অনুভব করলাম, আমার ভিতরের আকাঙ্খা ও বাইরের বাস্তবতার মধ্যে ব্যাপক ব্যবধান। তাই আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। অথচ আমি উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে জীবন যাপন করতে আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমার প্রচেষ্টায় কোনো ফল হচ্ছিলাম’।

এর কিছুকাল পর আমি আমার জীবনের গতিপথ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিই। পড়াশোনা অব্যাহত রাখার জন্য তিনি ফ্রান্সে যাই। আর এখানেই ঘটে আমার জীবনের গতিপথ। ফ্রান্সে আমি এক মুসলিম মহিলার সাথে পরিচিত হই। তিনি নিজের ধর্ম ইসলামকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন ও সমস্ত শক্তি আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে এর পক্ষে কথা বলতেন। তার দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস দেখে আমার নিজের জন্য অনুশোচনা হ’ত। কারণ আমি দীর্ঘ বহু বছর ধরে আত্মিক প্রশান্তি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। আর এজন্য অনেক গবেষণা ও পড়াশুনার পর যখন হতাশায় ডুবে ছিলাম তখন দেখলাম, একজন মুসলমান ইসলামকে কত গভীরভাবে ভালোবাসেন ও এর ছায়াতলে মানসিক প্রশান্তি অনুভব করেন। তাই আমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে গবেষণার সিদ্ধান্ত নিলাম। যাতে এ ধর্মের অনুসারীদের এত গভীর আত্মিক প্রশান্তির উৎস সম্পর্কে জানতে সক্ষম হই। সে সময় পর্যন্ত অনেক ধর্ম আমাকে আকৃষ্ট করলেও ইসলামের প্রতি একবারও আকৃষ্ট হইনি’।

অতঃপর আমি ফরাসি ভাষায় অনূদিত পবিত্র কুরআনের একটি কপি সংগ্রহ করি ও তা পড়তে থাকি। এ মহাগ্রন্থ পড়ার সময় আমি অনুভব করি, এ আসমানী গ্রন্থ পড়ার জন্য কারো সাহায্য নেয়া যরূরী। ফলে আমি মুসলমানদের ইবাদতকেন্দ্র তথা মসজিদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অবশেষে একদিন আমি মসজিদে গেলাম। মসজিদের পরিবেশ ছিল আমার জন্য এক অচেনা ও অপরিচিত জগত। কিন্তু বিস্ময়কর এক প্রশান্তি অনুভব করলাম। মসজিদটি ছিল এক বিশেষ আধ্যাত্মিক সুরভিতে ভরপুর। নীরবতা সেই পরিবেশকে করেছিল আরো প্রাণস্পর্শী ও মধুর। প্রাণ জুড়ানো সেই আধ্যাত্মিক পরিবেশের আকর্ষণ আমাকে টেনে নিল মসজিদের ভেতরে। ধীরে ধীরে পা ফেলছিলাম। আমার কানে ভেসে আসছিল এক বিশেষ আহবান। তাতে আমি শুনতে পাচ্ছিলাম, তুমি শিগগিরই সত্যকে খুঁজে পাবে।

এ সময় মসজিদের আঙিনায় বই-পুস্তকের একটি ছোট্ট দোকান দেখলাম। কাছে গিয়ে বিক্রেতাকে বললাম, আমি এমন একজনকে খুঁজছি যে ইসলামকে আমার কাছে পরিচিত করবে। সে আমাকে মসজিদের লাইব্রেরীতে নিয়ে গেল। সেখানে পেঁŠছে দেখলাম, একদল মুসলিম মহিলার জন্য ধর্ম বিষয়ক ক্লাস চলছিল এবং তা মাত্র কিছুক্ষণ আগে শেষ হ’ল। আমি তাদেরকে আমার কথা খুলে বললাম। তঁারা খুব খুশি হয়ে আমাকে স্বাগত জানালেন। তারা ছিলেন সবাই সক্রিয়, প্রফুল্ল ও প্রাণোচ্ছ্বল। তাদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী প্যারিসে যে কয়েকটি বৈঠক হ’ত তাতে আমি উপস্থিত হতাম। এইসব বৈঠকে আলোচনা শুনে ধীরে ধীরে আমার মানসিকতা বদলে যায় এবং বেশ কিছু বই পড়ার পর ইসলাম সম্পর্কে আমার মোটামুটি একটা ধারণা হয়। আমি বুঝতে পারলাম যে, ইসলামে কোনো কিছুই জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় না। ইসলাম জীবন যাপনের যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পথ দেখায়। কোনো কোনো ধর্ম বা মতবাদ সব ধরনের বস্ত্তগত, জৈবিক বা পার্থিব চাহিদাকে উপেক্ষা করে কেবল পারলৌকিক বিষয়কে গুরুত্ব দেয়। কিন্তু ইসলাম আত্মা ও শরীরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে বলে। অর্থাৎ ইসলাম আত্মিক ও শারীরিক উভয় চাহিদাকেই গুরুত্ব দেয়। ইহকাল ও পরকাল উভয় জগতে কল্যাণের পথ নির্দেশ করে’।

ইসলাম সম্পর্কে আমি ব্যাপক গবেষণার পর এ ধর্ম সম্পের্ক নানা বাস্তবতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হই যে, ইসলাম অর্থ আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মানুষের মূল্য নির্ভর করে তার ঈমান ও সৎকর্ম সম্পাদনের উপর। যখন খ্রিস্ট ধর্মের পেছনে ছুটতাম তখন এ ধর্মের পক্ষ থেকে বলা হ’ত যে, আমাদের পাপগুলো জন্মগত। অথচ একথা আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে মোটেই যৌক্তিক বা বোধগম্য নয়। কিন্তু ইসলাম বলে, সব মানুষ জন্মগতভাবে পবিত্র ও নিরপরাধ। পরবর্তীকালে প্রত্যেক মানুষ নিজেই তার পাপের জন্য দায়ী। আর এ কথা খুবই যৌক্তিক। ইসলাম খুবই সহজ ও স্বচ্ছ ধর্ম। এ ধর্মে কোনো জটিল তত্ত্ব নেই’।

দিনে দিনে আমি মুসলিমদের সমাবেশে উপস্থিত হয়ে বেশ আনন্দ ও স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করছিলান। যেসব মুসলিম মহিলা আমাকে গাইড করছিলেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখি নাকাতা এবং মুসলিমদের প্রথা ও রীতিগুলো রপ্ত করে নিই। আমি তাদের সঙ্গে মসজিদে যাওয়া ও তাদের চাল-চলন ও গতিবিধি খুব আগ্রহ নিয়ে লক্ষ্য করতাম। অনেক সময় তাদের সম্মান দেখানোর জন্য তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছালাতের অঙ্গভঙ্গিগুলো করে যেতাম। যদিও নিজেও বুঝতাম না যে আমি ছালাত আদায় করছি। ধীরে ধীরে অনুভব করলাম যে বহু বছর ধরে আমি যে সত্যের সন্ধান করছি তা পেয়েছি। অবশ্য এ জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে।

যতই ইসলাম সম্পর্কে বেশি তথ্য জানছিলাম ততই এ ধর্মকে গ্রহণের ইচ্ছা আমার মধ্যে জোরদার হচ্ছিল। অবশেষে এই সাক্ষ্য দিলাম যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল’।

ছালাত আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। আমি আশা পোষণ করি, ছালাত মানুষের বিশ্বাস বা ঈমানকে সুদৃঢ় করে। মুসলমান হওয়ার পর প্রথম ছালাত আদায়ের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে নাকাতা বলেছেন, ‘যখন প্রথমবার সিজদার উদ্দেশ্যে কপাল মাটিতে রাখলাম এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে, তখন আমার মধ্যে দেখা দিয়েছিল অসাধারণ অনুভূতি এবং নিজের মাথা যমীন থেকে উঠাতে পারছিলাম না। যখনই সিজদায় যেতাম, তখনই আল্লাহর অস্তিত্বকে ও ঈমান বা বিশ্বাসের অর্থকে বেশি মাত্রায় অনুভব করতাম। আর এটা ছিল এক অন্যরকম অভিজ্ঞতা যা আমি অন্য কোন ধর্মগুলোর মধ্যে পাইনি’।

ইসলাম গ্রহণের কিছুকাল পর আমি মিশরে যাই আরবী ভাষা ও ইসলামী শিক্ষা আরো ভালোভাবে রপ্ত করার জন্য। আরবী ভাষা ভালোভাবে বোঝার পর আমি কুরআনের বাণীর অর্থগুলো আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করতে থাকি এবং কুরআনের সৌন্দর্য আমাকে বিমুগ্ধ করে। কুরআনের বিষয়বস্ত্তগুলো ছাড়াও এর সুরও অশেষ সৌন্দর্যে ভরপুর। কুরআন বার বার পড়লেও ক্লান্ত হওয়া তো দূরের কথা বরং আমার অন্তর যেন সৌভাগ্যের সাগরে অবগাহন করতে থাকে। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এই সৌভাগ্য নছীব করেছেন বলে আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ এবং আমি ইসলামকে আমার দেশের জনগণের কাছে তুলে ধরছি। যে সৌভাগ্য কেবল এক আল্লাহ্কে চেনা ও জানার মাধ্যমে পাওয়া যায় সে সৌভাগ্য তারাও অর্জন করুক। -এটাই আমার প্রার্থনা। আমি সুনিশ্চিত যে, আল্লাহর উপর ভরসার সুবাদে সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

[তথ্য সূত্র : ইন্টারনেট]



আরও