অশুভ শক্তির হিংস্র থাবা : স্মৃতিময় ৯টি দিন
বযলুর রহমান
তাওহীদের ডাক ডেস্ক 245 বার পঠিত
আমি প্রাইমারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর আমার প্রথম পোস্টিং হয় বরগুনা যেলার পরীরখাল নামক সরকারী এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই আমি ঢাকা শহরে থাকার দরুণ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের জীবন রীতি সম্পর্কে আমার ধারণাই ছিল না। শহরের ইট পাথরের দালানকোঠা পেরিয়ে গ্রামের মনোরম আবহাওয়া আর খেটে খাওয়া মানুষের সরল ভালোবাসা আমি স্বপ্নেও অনুভব করিনি। প্রথমদিন যখন গেট পেরিয়ে স্কুলের সীমানায় প্রবেশ করি, তখনি দেখতে পাই স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলোর উচ্ছ্বসিত সম্ভাষণ ও আনন্দ। ছাত্র-শিক্ষক সকলের উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়ে সেদিনই মনে হয়েছিল শিক্ষকতা একটি মহান পেশা।
গ্রামের ছেলে-মেয়েগুলোর ড্রেস নামক আস্তরণগুলোতে শহুরে ছেলেমেয়েদের মতো চাকচিক্য না থাকলেও তাদের চোখে-মুখে চকচক করে শিক্ষকের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ও সম্মান। বেশ কিছুদিন পর একদিন আমি তৃতীয় শ্রেণীর ইংরেজী ক্লাস নিতে যাই। স্কুলে আসার পর থেকে যতবার তৃতীয় শ্রেণীর ক্লাসে গিয়েছি প্রতিবারই শেষ বেঞ্চে একটি ছেলেকে চুপচাপ মুখভারী করে বসে থাকতে দেখেছি। সেদিনও তার ব্যতিক্রম ছিল না। তাই অনেকটা কৌতুহলবশত আমি ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেলাম। তার সামনে আসতেই সে হকচকিয়ে উঠে দঁাড়াল। আমি ওকে কিছু ইংরেজী শব্দার্থ জিজ্ঞেস করলাম ও সে সাবলীলভাবে সব সঠিক উত্তর দিল। আমি কিছুটা অবাক হলাম। কারণ সামনের বেঞ্চে বসা ছেলেমেয়েগুলোও ওর মতো এত সুন্দরভাবে পড়া বলতে পারে না।
আমি ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে নরম স্বরে বললাম, তুমি সব সময় পিছনে বসো কেন? কাল থেকে আমি তোমাকে সামনের বেঞ্চে দেখতে চাই। ছেলেটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেও ওর মধ্যে আমি তেমন উৎফুল্লতা দেখতে পেলাম না। এরপর প্রতিদিনই ছেলেটি আমার ক্লাসে প্রথম বেঞ্চে বসত। একদিন খেয়াল করলাম, আমি ব্লাকবোর্ডে কিছু লিখলে ছেলেটি তা ওর খাতায় লিখে না।
বেশ কিছুদিন বিষয়টি খেয়াল করার পর একদিন আমি রাগান্বিত স্বরে জিজ্ঞেস করলাম, সবাই লিখছে আর তুমি লিখছ না কেন? অনেক মেধাবী হয়ে গেছ নাকি? ছেলেটির মুখ লাল হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বলল, স্যার! আসলে আমার খাতাটা শেষ হয়ে গেছে। পাশ থেকে আরেকটি ছেলে বলল, স্যার! ও প্রত্যেক দিন খাতাই নিয়া স্কুলে আসে’। পাশের ছেলেটির কথায় পুরো ক্লাস জুড়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। সকলকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে দেখতে পাই সে মাথা নিচু করে বেঞ্চের দিকের তাকিয়ে আছে।
ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে আমি শান্ত স্বরে বললাম, যাই হোক, কাল থেকে তুমি নতুন খাতা নিয়ে স্কুলে আসবে। এরপর যদি দেখি যে আমি লেখা সত্ত্বেও তুমি কিছু লিখছনা তবে তোমাকে শাস্তি দিব, বুঝেছো? ছেলেটি সায় দিয়ে হ্যাঁ-বোধক ইঙ্গিত দিল। অতঃপর আমি পুনরায় পড়ানোর দিকে মনোযোগ দিলাম।
পরদিন ক্লাসে প্রবেশ করে সামনের বেঞ্চে দৃষ্টি দিতেই দেখি ছেলেটি আসেনি। পুরো ক্লাস জুড়ে নিজের অক্ষিগোলকের দৃষ্টিরেখা বিচরণ করার পরও ছেলেটিকে খুঁজে পেলাম না। মনে মনে ভাবলাম, হয়তো বাড়িতে কোনো সমস্যার কারণে আজ স্কুলে আসেনি। এভাবে এক এক করে তিনদিন চলে যাওয়ার পরও যখন স্কুলে ছেলেটির দেখা পেলাম না, তখন ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কি জানো ছায়েমের কি হয়েছে? ও স্কুলে আসছে না কেন? কিন্তু কোন উত্তর এলো না। সকলের নীরবতাই আমাকে জানিয়ে দিল যে, ওরা ছায়েমের সম্পর্কে কিছুই জানেনা। তৎক্ষণাৎ আবার বললাম, কেউ কি তার বাসা চেনো? পিছন থেকে একটি ছেলে হাত উঁচু করে বলল, জ্বী স্যার! আমি চিনি।
বিকালে ছেলেটির সাথে ছায়েমের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে দেখতে পাই একটি জরাজীর্ণ ছোট্ট ঘরের দরজায় বসে এক মধ্যবয়স্কা মহিলা খুব যত্ন সহকারে কঁাথা বুনছে। মহিলাটি আমাকে দেখেই মাথার ঘোমটা একটু টেনে দিল। আমার সাথে থাকা ছেলেটি মহিলাটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, খালাম্মা! আমাগো স্কুলের স্যার উনি। ছায়েম স্কুলে যায় না দেইখা উনি খেঁাজ নিতে আইছে’। আমি ছায়েমের শিক্ষক শুনে মহিলাটি তাড়াহুড়া করে আমাকে একটি মোড়া এগিয়ে দিলেন। তাঁর আতিথেয়তায় আমি মুগ্ধ হলাম। তবে বসলাম না। বললাম, জ্বী, আমি বসার জন্য আসিনি। ছায়েম স্কুলে যাচ্ছে না কেন?
মহিলাটি কিছুটা ইতস্তত করে বললেন, স্যার! কি আর কমু কষ্টের কথা! পোলাডার অনেক পড়ালেখার শখ। কিন্তু ওরে একটা খাতা কিইন্না দেওয়ার সামর্থ্যও আমার নাই। ওর জন্মের এক বছরের মাথায় ওর বাপে নদীতে মাছ ধরতে যাইয়া আর ফিরা আসেনি। কোন স্যারে নাকি ওরে নতুন খাতা নিয়া স্কুলে যাইতে কইছে, কিন্তু আমার কাছে কোনো টাকা না থাকায় ওরে কিইন্না দিতে পারি নাই। তাই ও খালে মাছ ধরতে গেছে। ও নাকি ঐ মাছ বেইচ্চা খাতা কিনব। আপনেই বলেন স্যার, এই গরমে মাছ আইব ক্যামনে? বর্ষাকাল হইলেও একটা কথা আছিল। কিন্তু ছ্যামড়ায়তো আমার কথা একটাও শুনলোনা। পাশের বাড়ির ভাবী আমারে এই কঁাথাটা সেলাই করতে দিছে। চিন্তা করছি এই কঁাথা দিয়া যেই টাকা পামু সেইডা দিয়াই ওরে খাতা কিন্না দিমু, স্যার। তারপর দেখমুনে ও স্কুলে না যাইয়া কেমনে পারে’।
মহিলার কথা শুনে আমার হাতগুলো কেমন যেন খুব করে কঁাপছিল। মানুষ কতটা অভাবে থাকতে পারে সেটা ছায়েমের বাড়িতে না আসলে আমি দেখতে পেতাম না। সামান্য একটি স্কুলের খাতা কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও তার নেই, কতটা অসহায় তারা। তখনই ছায়েম কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল, মা এই দেখো কত বড় একটা কাতলা মাছ পাইছি। এইটা বেইচ্চা খাতা কিনমু আমি’।
পরমুহূর্তে আমাকে তার বাড়িতে উপস্থিত দেখে উৎফুল্ল মুখখানা চুপসে গেল। সেদিন আমি ছায়েমের ধরা মাছটি পাঁচশত টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম। জানি মাছটির দাম বাজারের ভিত্তিতে একশত টাকাও হবেনা। তবে ছেলেটির মুখে একটুখানি হাসি ফুটানোর জন্যই এমনটা করেছিলাম। সে তখন স্বভাবতই হতবিহবল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। এরপর থেকে ছায়েমের প্রতি আমার আলাদা একটা মায়া ও দায়িত্ববোধ কাজ করত। সেটা ছেলেটির মেধার কারণে হোক বা ওর অসহায়ত্বের কারণে।
এভাবেই কেঁটে যায় দু’টি বছর। ছায়েমের পড়ালেখার যাবতীয় খরচ আমিই দেওয়ার চেষ্টা করতাম। স্কুলের একমাত্র ছাত্র হিসাবে ছায়েম যেদিন পঞ্চম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সেদিন সে ভরা স্কুলের সামনেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। স্কুলের সকল শিক্ষক-ছাত্ররাও সেদিন অনেক আনন্দ করেছিল। আমি তখন দূর থেকে ছায়েমের মায়ের অঁাচল দিয়ে অশ্রু মোছার দৃশ্য খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। এই জীবনে আমার যতগুলো সার্থকতার চিহ্ন আমি বয়ে বেড়িয়েছি তার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় সার্থকতা ছিল ছায়েমের এই সফলতার পেছনে আমার করা সামান্য সাহায্যটুকুই।
এর কিছুমাস পর আমি ঢাকাতে ট্রান্সফার হই। পরবর্তীতে ছায়েমের সাথে দেখা করার আগ্রহ মনে উঁকি দিলেও তা আর সম্ভব হয়নি। একটি দু’টি করে প্রায় ত্রিশটি বছর কেঁটে যায়, ইতোমধ্যে আমি রিটায়ার্ড করেছি। এমনকি বহু ব্যস্ততা এবং বিভিন্ন বিষয়ের কারণে ছায়েমের কথাও আমার মন থেকে পুরোপুরি মুছে গিয়েছিল।
ইদানিং বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে আমার শরীরে বেশ কিছু মারাত্মক রোগ বাসা বেঁধেছে। রিটায়ার্ড হয়ে যত টাকা পেয়েছিলাম তা নিজের জন্য রেখে না দিয়ে ছেলেমেয়েদের ভাগ করে দিয়েছিলাম, এই ভেবে যে তারা যদি আমার একটুখানি খেয়াল রাখে। কিন্তু হ’ল তার উল্টা। ছেলেমেয়েরা টাকা নিয়ে যে যার মতো জীবন গুছিয়ে নিল। এই নিয়ে আমার স্ত্রী মাঝেমধ্যেই ওদেরকে বদ দো‘আ দেয়। কিন্তু আমি বলি, ছেলেমেয়েদের জন্য কখনো খারাপ কামনা করতে নেই। তারা যদি ভালো থাকে তবে থাকুক না যার যার মতো।
এদিকে শরীরের অবস্থা দিন দিন অবনতির দিকে যাওয়াতে আমার স্ত্রী জোরপূর্বকই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। যদিও আমি টাকা খরচের ভয়ে একদমই যেতে রাযী ছিলাম না। বিভিন্ন পরীক্ষা করার পর জানা গেল আমার পিত্তথলিতে পাথর হয়েছে এবং কিডনীর কার্যক্ষমতাও প্রায় শেষ বললেই চলে। ডাক্তারের কাছে জিজ্ঞেস করার পর তিনি জানান, সবমিলিয়ে আমার চিকিৎসার জন্য তিন লক্ষ টাকা খরচ হবে। আমার স্ত্রীর নিকট একটি পুরোনো আমলের স্বর্ণের দুল ছিল, কিন্তু সেটা বিক্রি করলেও কোনো ভাবেই এক লক্ষ টাকার বেশী হবার কথা নয়। আমার স্ত্রী তখন ডাক্তারের নিকট অনেকটা আকুতির স্বরেই বলল, আচ্ছা কোনো ভাবে কি টাকার অঙ্কটা একটু কমানো যায় না? ডাক্তার ছাহেব বললেন, আমি কিছু করতে পারবো না। আপনি বরং হাসপাতালের পরিচালক ডা. ছায়েম শাহরিয়ারের সাথে কথা বলুন।
ছায়েম নামটি শুনেই আমার কিছু একটা মনে আসতে গিয়েও যেন আসলোনা। অতঃপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আমরা ডা. ছায়েমের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলাম। উনার চেম্বারে প্রবেশ করতেই দেখি তিনি একমনে কোনো ফাইল দেখছেন। আমাদের দিকে না তাকিয়ে তিনি বললেন, বসুন আপনারা। বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি? আমার স্ত্রী বেশ ইতস্তত ভঙ্গিতে বলল, আসলে আমার স্বামীর দুইটা অপারেশনের জন্য তিন লক্ষ টাকা চাচ্ছে। কিন্তু আমাদের এত টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই। যদি একটু কমাতেন এই আরকি। ডা. ছায়েম এই কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়েই আছে। তাকে দেখে আমার বেশ চেনা লাগলেও কোনোভাবেই অঁাচ করতে পারছিলাম না।
হঠাৎ সে দঁাড়িয়ে বলল, স্যার! আপনি কি পরীরখাল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন? আমি ওর কথায় বেশ অবাক হয়ে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ ছিলাম তো একসময়। পরক্ষণেই সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে আমার সামনে এসে সালাম করেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমার আর এক মুহূর্ত বুঝতে বাকি রইলনা এ আর কেউ নয় বরং আমারই সেই প্রিয় ছাত্র ছায়েম। যে আমাকে এভাবেই জড়িয়ে ধরেছিল সেই ছোট্ট অবস্থায় যখন সে স্কুলের প্রথম ছাত্র হিসাবে বৃত্তি পেয়েছিল।
কিছু কিছু সার্থকতার প্রাপ্তি এবং সম্মান মনে হয় যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও এর তীক্ষ্মতা একটুও কমে না বরং বেড়েই চলে। এটা হয়তো তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
[সূত্র : ইন্টারনেট]