সফল কর্মীর আচরণবিধি
অধ্যাপক আকবার হোসাইন
আসাদুল্লাহ আল-গালিব 373 বার পঠিত
উপস্থাপনা : রামাযান নেকী অর্জনের একটি তাক্বওয়াপূর্ণ মাস। এই মাসের ছিয়াম, ক্বিয়াম ও ক্বদরের রাত্রিতে জাগরণের মধ্যদিয়ে বিগত সকল ছগীরা গুনাহ ক্ষমা হয়। এছাড়াও এ মাসে নানাবিধ আমল দিয়ে অসংখ্য নেকী অর্জন করা যায়। তবে এমন কর্মকান্ড থেকে বেঁচে থাকতে হবে যা আমলগুলো বরবাদ করে দেয়। আলোচ্য প্রবন্ধে রামাযানে কতিপয় ভুল কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাল্লাহ। এ মাসের পূর্ণ ছওয়াব অর্জনের জন্যই বিষয়টি নির্বাচন। কেননা হুযায়ফা (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে অকল্যাণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। এই ভয়ে যেন, অকল্যাণ তাকে পেয়ে না বসে’।[1]
১. নিয়তের সাথে ছওয়াব প্রাপ্তির আশা না রাখা : জানা আবশ্যক যে, সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভর করে। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[2] আর নিয়তের সাথে ছওয়াব প্রাপ্তির আশা রাখতে হবে। নচেৎ ছওয়াব অর্জিত হবে না। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَمَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের ছিয়াম পালন করে, তার পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়। যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রামাযানের রাত্রি ইবাদতে কাটায় তার পূর্বের গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় কদরের রাত্রি ইবাদাতে কাটায় তার পূর্ববর্তী গুনাহ সমূহ মাফ করে দেয়া হয়’।[3]
সুতরাং ছিয়াম পালনের মাধ্যমে ছওয়াব লাভের আশা না থাকলে এবং সাথে লৌকিকতা যুক্ত হলে, তাহ’লে ঐ ব্যক্তির শুধু না খেয়ে থাকাই হবে। কোন নেকী বা ছওয়াব হবে না। আর এজন্য রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, رُبَّ صَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ صِيَامِهِ إِلَّا الْجُوْعُ، وَرُبَّ قَائِمٍ لَيْسَ لَهُ مِنْ قِيَامِهِ إِلَّا السَّهَرُ- ‘কতক ছিয়াম পালনকারীর ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটেনা। আর কতক তাহাজ্জুদ ছালাত আদায়কারীর কেবল রাত্রি জাগরণ ছাড়া আর কিছু জোটে না’।[4]
আর লৌকিকতা এড়িয়ে ছিয়াম পালনের দৃষ্টান্ত স্বরূপ দাঊদ ইবনু আবী হিন্দের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তিনি চল্লিশ বছর নফল ছিয়াম পালন করেছেন। কিন্তু তার পরিবার বা অন্য কেউ জানতে পারেনি। তিনি একজন রেশম ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি বাজারে আসার সময় দুপুরের খাবার সাথে নিয়ে আসতেন এবং পথিমধ্যে তা ছাদাক্বা করে দিতেন। আর সন্ধ্যায় এসে পরিবারের সাথে ইফতার করতেন। ফলে পরিবারের সদস্যরা মনে করত তিনি বাজারে খেয়েছেন এবং বাজারের লোকেরা মনে করত তিনি বাড়িতে খেয়ে থাকেন’।[5]
২. ফজরের পূর্বে ছিয়ামের নিয়ত না করা : রামাযানের ফরয ছিয়ামের জন্য ফজরের পূর্বে নিয়ত করতে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ لَمْ يُبَيِّتِ الصِّيَامَ قَبْلَ الْفَجْرِ، فَلَا صِيَامَ لَهُ- ‘যে ব্যক্তি ফজরের পূর্বে (ফরয ছিয়ামের) নিয়ত করবে না, তার কোন ছিয়াম নেই’।[6]
তবে নফল ছিয়ামের জন্য ফজরের পূর্বে নিয়ত করা শর্ত নয়। যেমন আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার নিকটে এসে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে কি কোন খাবার আছে? আমি বললাম, না। তিনি বললেন, فَإِنِّيْ صَائِمٌ ‘তাহ’লে আজ আমি ছিয়ামপালনকারী’।[7]
৩. ছোটদের ছিয়াম পালনে উৎসাহ না দেওয়া : অনেক পিতামাতা বা অভিভাবক আছেন যাদের সন্তানদের ছিয়াম পালনে আগ্রহ থাকলেও তারা তাদের নিরুৎসাহিত করেন। অথচ ছাহাবায়ে কেরাম তাদের সন্তানদের ছিয়াম পালনে উৎসাহ দিতেন। যেমন আশূরার ছিয়াম সম্পর্কে রুবাই বিনতু মুআউবিয (রাঃ) বলেন,وَنُصَوِّمُ صِبْيَانَنَا الصِّغَارَ مِنْهُمْ إِنْ شَاءَ اللهُ، وَنَذْهَبُ إِلَى الْمَسْجِدِ، فَنَجْعَلُ لَهُمُ اللُّعْبَةَ مِنَ الْعِهْنِ، فَإِذَا بَكَى أَحَدُهُمْ عَلَى الطَّعَامِ أَعْطَيْنَاهَا إِيَّاهُ عِنْدَ الْإِفْطَارِ- ‘আমরা আমাদের ছোট ছোট সন্তানদেরকেও আল্লাহ চাহে তো ছিয়াম পালনে অভ্যস্ত করে তুলতাম। আমরা তাদেরকে মসজিদে নিয়ে যেতাম এবং তাদের জন্য পশমের খেলনা বানিয়ে দিতাম। যখন তারা খাওয়ার জন্য কাঁদত, তখন আমরা তাদেরকে সে খেলনা প্রদান করতাম। এমনি করে ইফতারের সময় হয়ে যেত’।[8]
৪. ছিয়াম অবস্থায় দো‘আ না করা : ছিয়ামরত অবস্থায় সারাদিন কর্ম ব্যস্ততার মধ্যেই আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে হবে। তারপরও এমন অনেক আছেন যারা সারাদিন ব্যস্ততার কারণে দো‘আ করতে পারেন না। আবার ইফতারের পূর্ব মুহূর্তেও ইফতার তৈরীসহ নানাবিধ ছোট ছোট কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন। বরং দো‘আ কবুলের এই দীর্ঘ সময়ে সার্বিক জীবনের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আল্লাহর নিকটে চাইতে হবে। কেননা ছিয়ামপালনকারীর দো‘আ আল্লাহ কবুল করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তিন ব্যক্তির দো‘আ আল্লাহ কবুল করে থাকেন। (১) ছিয়াম পালনকারীর দো‘আ। (২) মযলূমের দো‘আ (৩) মুসাফিরের দো‘আ’।[9]
৫. মাথায় পানি না ঢালা : কখনও দেখা যায় অধিক পিপাসার্ত বা ক্লান্তিবোধ হলেও অজ্ঞতার কারণে অনেকেই মাতায় পানি ঢালা থেকেও বিরত থাকেন। অথচ এতে কোন সমস্যা নেই। নবী করীম (ছাঃ)-এর কিছু ছাহাবী হ’তে বর্ণিত, একজন ছাহাবী বলেন, আমি নবী (ছাঃ)-কে ‘আরজ’-এ (মক্কা-মদীনার মাঝখানে একটি জায়গার নাম) ছিয়াম অবস্থায় পিপাসা দমনের জন্য অথবা গরম কমানোর জন্য মাথায় পানি ঢালতে দেখেছি’।[10]
৬. ছিয়াম অবস্থায় মিসওয়াক না করা : এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা ছিয়ামপালনকালে মিসওয়াক করেন না। অথচ মিসওয়াক করাতে কোন সমস্যা নেই। কেননা ইমাম বুখারী বাব বেঁধেছেন,باب سِوَاكِ الرَّطْبِ وَالْيَابِسِ لِلصَّائِمِ ‘ছায়েমের কাঁচা ও শুকনা মিসওয়াক ব্যবহার করা’। আমের বিন রাবেআ বলেন, আমি নবী করীম (ছাঃ) কে অসংখ্যবার ছিয়ামরত অবস্থায় মিসওয়াক করতে দেখেছি’।[11]
৭. চূড়ান্তঅসুস্থ হলেও ছিয়াম পালন করা :এমনও অনেক ব্যক্তি আছেন, বিশেষকরে অনেক মা-বোন যারা চূড়ান্ত অসুস্থ হলেও ছিয়াম পালন করে থাকেন। আবার কেউ কষ্টকর সফরে থাকলেন ছিয়াম পালন করেন। অথচ আল্লাহ তাদেরকে পরবর্তীতে ছিয়াম পালনের সুযোগ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَى سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ اللهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ، ‘তবে যে ব্যক্তি পীড়িত হবে অথবা সফরে থাকবে, সে এটি অন্য সময় গণনা করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। আর রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى رُخَصُهُ كَمَا يُحِبُّ أَنْ تُؤْتَى عَزَائِمُهُ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন তার দেওয়া ছাড় গ্রহণকারীকে এবং তিনি পসন্দ করেন তার ফরয সমূহ পালন করাকে’।[12]
৮. ইচ্ছাকৃতভাবে তারাবীহর ছালাত ছেড়ে দেওয়া : তারাবীহর ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা বিগত দিনের (ছগীরা) গুনাহ মাফ করে দেন’।[13] এরপরও অনেকে তারবীহর ছালাত আদায় করে না। বরং জাহান্নাম থেকে নিজেকে মুক্তি পেতে রামাযানের দিবারাত্রিকে কাজে লাগানো উচিত। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ لِلَّهِ عُتَقَاءَ فِى كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ لِكُلِّ عَبْدٍ مِنْهُمْ دَعْوَةٌ مُسْتَجَابَةٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রয়েছে (রামাযান মাসে) প্রত্যেক দিনে ও রাতে (জাহান্নাম থেকে) মুক্তিপ্রাপ্ত বান্দাগণ। আর নিশ্চয়ই একজন মুসলিমের রয়েছে প্রতি দিনে ও রাতে কবুলযোগ্য দো‘আ’।[14]
৯. জামা‘আতে তারাবীহর ছালাত ছেড়ে দেওয়া : ছাহাবায়ে কেরামগণ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে জামা‘আতে তারাবীহর ছালাত আদায় করতেন। যেমন হাদীছে এসেছে, قُمْنَا مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ لَيْلَةَ ثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ إِلَى ثُلُثِ اللَّيْلِ الْأَوَّلِ، ثُمَّ قُمْنَا مَعَهُ لَيْلَةَ خَمْسٍ وَعِشْرِينَ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ، ثُمَّ قُمْنَا مَعَهُ لَيْلَةَ سَبْعٍ وَعِشْرِينَ حَتَّى ظَنَنَّا أَنْ لَا نُدْرِكَ الْفَلَاحَ، وَكَانُوا يُسَمُّونَهُ السُّحُورَ-আমরা একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে রামাযান মাসের ২৩তম রাতে প্রথম এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত (তারাবীহর) ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর ২৫তম রাতে তার সাথে অর্ধেক রাত পর্যন্ত (তারাবীহর) ছালাত আদায় করলাম। আবার তার সাথে ২৭তম রাতে (তারাবীহর) ছালাত আদায় করতে লাগলাম। এমনকি আমরা আশংকা করলাম যে, ‘ফালাহ’ বা সাহারী পাব না’।[15]
সুতরাং রামাযান মাসে প্রথম রাত্রির তারাবীহর ছালাত ইমামের সাথে জামা‘আতে আদায় করা যরূরী। কেননা যে ব্যক্তি ইমামের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করবে সে সারারাত্রি ছালাত আদায়ের ছওয়াব লাভ করবে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ الرَّجُلَ إِذَا صَلَّى مَعَ الْإِمَامِ حَتَّى يَنْصَرِفَ حُسِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ- ‘নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি ইমানের সাথে তারাবীহর ছালাত আদায় করে বাড়ী ফিরে যায়, আল্লাহ তার জন্য পূর্ণ রাত্রির ছালাত আদায়ে ছওয়াব দেন’।[16]
১০. ছালাতে উচ্চ স্বরে কান্নাকাটি করা : রামাযান মাসে অনলাইনে এমন অনেক ক্বারীর তেলাওয়াত শোনা যায়, যারা উচ্চ স্বরে কান্নাকাটি করেন। এটা বাড়াবাড়ী। অথচ ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর কান্না সম্পর্কে হাদীছে এসেছে। আব্দুল্লাহ ইবনে শিখখীর হ’তে বর্ণিত, তিনি তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন,أَتَيْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهُوَ يُصَلِّي وَلِجَوْفِهِ أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الْمِرْجَلِ- ‘একদা আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে উপস্থিত হয়ে দেখতে পেলাম তিনি ছালাত আদায় করছেন। এমতাবস্থায় তাঁর বক্ষদেশ হ’তে কান্নার এমন শব্দ বের হচ্ছে, যেমন চুলার উপর রাখা পাত্র হ’তে টগবগ শব্দ শোনা যায়’।[17]
১১. ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে ছালাত আদায় করা : ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে ছালাত আদায় করা নিষেধ। বরং ঘুম আসলে ঘুমিয়ে যেতে হবে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِذَا نَعَسَ أَحَدُكُمْ وَهُوَ يُصَلِّي فَلْيَرْقُدْ حَتَّى يَذْهَبَ عَنْهُ النَّوْمُ ; فَإِنَّ أَحَدَكُمْ إِذَا صَلَّى وَهُوَ نَاعِسٌ لَا يَدْرِي لَعَلَّهُ يَسْتَغْفِرُ فَيَسُبَّ نَفْسَهُ- ‘ছালাতরত অবস্থায় তোমাদের কারো ঘুম আসলে, সে যেন প্রথমে ঘুমিয়ে নেয়। তাতে তার ঘুমের আবেশ কেটে যাবে। কেননা সে যদি তন্দ্রাবস্থায় ছালাত আদায় করে, তবে এরূপ হওয়া মোটেই অসম্ভব নয় যে, সে গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে গিয়ে নিজেকে গালি দিবে’।[18]
১২. দীর্ঘ ক্বিরাআত না করে অধিক রাকা‘আত পড়া : খতম তারাবীহর নামে অনেক সমাজে ১১ রাক‘আতের অধিক ছালাত আদায় করে। যেখানে রুকূ, সিজদা, ক্বিরাআত কোন কিছুই পরিপূর্ণভাবে আদায় হয় না। অথচ ছাহাবীদের আমল ভিন্ন ছিল। যেমন সায়িব ইবনু ইয়াযীদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ওমর (রাঃ) উবাই ইবনু কা‘ব ও তামীম আদ্ দারীকে আদেশ দিলেন যেন তারা লোকেদেরকে নিয়ে রামাযান মাসের রাতের এগার রাক‘আত তারাবীহর ছালাত আদায় করে’। অতঃপর তিনি (রাবী) বলেন,كَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ بِالْمِئِينَ حَتَّى كُنَّا نَعْتَمِدُ عَلَى الْعَصَا مِنْ طُولِ الْقِيَامِ فَمَا كُنَّا نَنْصَرِفُ إِلَّا فِي فُرُوعِ الْفَجْرِ ‘এ সময় ইমাম তারাবীহর ছালাতে এ সূরাগুলো পড়তেন, যে সূরার প্রত্যেকটিতে ১০০-এর বেশী আয়াত ছিল। বস্ত্তত ক্বিয়াম বেশী লম্বা হওয়ার কারণে আমরা আমাদের লাঠির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে (ফজরের) নিকটবর্তী সময়ে ছালাত শেষ করতাম’। [19]
১৩. চার রাকা‘আত তারাবীহ পড়ার পর না বসা : রাসূল (ছাঃ) ৪ রাকা‘আত ছালাত আদায় করার পর তিনি অল্প কিছু সময়ের জন্য বসতেন। এ বিষয়ে মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ، ثُمَّ يُصَلِّى أَرْبَعًا فَلاَ تَسَلْ عَنْ حُسْنِهِنَّ وَطُولِهِنَّ- তিনি চার রাকা‘আত ছালাত আদায় করতেন, তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি চার রাকা‘আত পড়েন।
তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না’।[20]
১৪. ইচ্ছাকৃত বিতর ছালাত ছেড়ে দেওয়া : কিছু ব্যক্তি আছেন যারা বিতর ছালাতকে গুরুত্ব দেন না। এমনকি ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর ছালাত ছেড়ে দেন। তাদের সম্পর্কে ইমাম আহমাদ বলেন,مَنْ تَرَكَ الْوِتْرَ عَمْدًا فَهُوَ رَجُلُ سَوْءٍ، وَلَا يَنْبَغِي أَنْ تُقْبَلَ لَهُ شَهَادَةٌ- ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর ছালাতক ছেড়ে দেয়, তাহ’লে সে মন্দ ব্যক্তি। আর তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হবে না’।[21]
১৫. হায়েয বা নিফাস অবস্থায় ছিয়াম পালন : এমন অনেক মহিলা আছেন যারা চোখ লজ্জার কারণে হায়েয বা নিফাস অবস্থায় ছিয়াম পালন করেন। অপবিত্র কিছু খাওয়া যাবেনা মনে করে সারাদিন না খেয়ে থাকেন। অথচ এটি ভুল সিদ্ধান্ত। কেননা মুআযাহ নামক এক মহিলা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার যে, ঋতুমতী মহিলা ছিয়াম কাযা করবে অথচ ছালাত কাযা করবে না? মা আয়েশা (রাঃ) প্রত্যুত্তরে বললেন, তুমি কি (ইরাকের) হারুরার (খারেজীপন্থী) মহিলা? মহিলাটি বলল, না, আমি তা নই। আমি জিজ্ঞাসা করে (কারণ) জানতে চাই। মা আয়েশা (রাঃ) বললেন, আল্লাহর আসূল (ছাঃ)-এর কাছে থেকে আমাদের মাসিক হত। আমরা (তাঁর পক্ষ থেকে) ছিয়াম কাযা করতে আদিষ্ট হতাম এবং ছালাত কাযা করতে আদিষ্ট হতাম না’।[22]
১৬. সময়ের পূর্বেই ইচ্ছাকৃত ছিয়াম ভঙ্গ করা : বিনা ওযরে সূর্যাস্তের পূর্বেই ছিয়াম ভঙ্গ করা একটি মারাত্মক ধরণের অপরাধ। যেমন হাদীছে এসেছে, আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, একদা আমি ঘুমিয়ে ছিলাম; এমন সময় (স্বপ্নে) আমার নিকট দুই ব্যক্তি উপস্থিত হলেন। তারা আমার উভয় বাহুর উপরাংশে ধরে আমাকে এক দুর্গম পাহাড়ের নিকট উপস্থিত করলেন এবং বললেন, আপনি এই পাহাড়ে চড়ুন। আমি বললাম, এ পাহাড়ে চড়তে আমি অক্ষম। তারা বললেন, আমরা আপনার জন্য চড়া সহজ করে দেব। সুতরাং আমি চড়ে গেলাম। অবশেষে যখন পাহাড়ের চূড়ায় গিয়ে পৌঁছলাম তখন বেশ কিছু চিৎকার-ধ্বনি শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এ চিৎকার-ধ্বনি কাদের? তারা বললেন, এ হ’ল জাহান্নামবাসীদের চীৎকার-ধ্বনি। পুনরায় তারা আমাকে নিয়ে চলতে লাগলেন। হঠাৎ দেখলাম একদল লোক তাদের পায়ের গোড়ালির উপর মোটা শিরায় (বাঁধা অবস্থায়) লটকানো আছে, তাদের কেশগুলো কেটে ও ছিঁড়ে আছে এবং কশবেয়ে রক্তও ঝরছে। নবী করীম (ছাঃ) বলেন, আমি বললাম, ওরা কারা? তারা বললেন, ওরা হ’ল তারা; যারা সময় হওয়ার পূর্বে ইফতার করে নিত’।[23]
১৭. সাহারী ছেড়ে দেওয়া : অনেক সময় মায়েদের রান্না যথা সময়ে না হলে অনেক পরিবার কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। বরং তাদের সামান্য খেজুর বা পানি হলেও খেতে হবে। কেননা সাহারীতে বরকত রয়েছে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, السَّحُورُ أَكْلُهُ بَرَكَةٌ فَلاَ تَدَعُوهُ وَلَوْ أَنْ يَجْرَعَ أَحَدُكُمْ جَرْعَةً مِنْ مَاءٍ فَإِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ وَمَلاَئِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى المُتَسَحِّرِينَ- সাহারী হ’ল একটি বরকতময় খাবার। তাই তোমরা ছেড়ে দিয়ো না। এক ঢোক পানি দ্বারা হলেও সাহারী করো। কেননা আল্লাহ ও ফেরেশাতগণ সাহারীতে অংশগ্রহণকারীদের জন্য দো‘আ করেন’।[24]
১৮. দেরীতে ইফতার করা : আধুনিক যুগে সূর্য ডোবার নির্দিষ্ট সময় জানার পর আরও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ৩ মিনিট অপেক্ষা কোন নিরন্তর বোকামী। কেননা বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা প্রতিটি এলাকায় কোথায় কত মিনিট সূর্য অস্তমিত হচ্ছে এটা জানা খুবই সহজ। আর সূর্যাস্তের সাথে সাথে ইফতার করা রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশও বটে। তিনি বলেন, إِذَا أَقْبَلَ اللَّيْلُ مِنْ هَا هُنَا، وَأَدْبَرَ النَّهَارُ مِنْ هَا هُنَا، وَغَرَبَتِ الشَّمْسُ، فَقَدْ أَفْطَرَ الصَّائِمُ- ‘যখন রাত্রি (পূর্ব) দিক থেকে আগমন করবে এবং দিন এ (পশ্চিম) দিক থেকে প্রস্থান করবে এবং সূর্য ডুবে যাবে, তখন অবশ্যই ছিয়ামপালনকারী ইফতার করবে’।[25]
রাসূল আর দ্রুত ইফতার করা কল্যাণের উপর টিকে থাকার শামিল। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ يَزَالُ النَّاسُ بِخَيْرٍ مَا عَجَّلُوا الْفِطْرَ ‘যতদিন পর্যন্ত মানুষ শীঘ্র ইফতার করবে, ততদিন তারা কল্যাণের মধ্যে থাকবে’।[26] আর দ্রুত ইফতার করা নবীদের স্বভাব সুলভ বৈশিষ্ট্য। যেমন হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,ثَلَاثٌ مِنْ أَخْلَاقِ النُّبُوَّةِ: تَعْجِيلُ الْإِفْطَارِ وَتَأْخِيرُ السُّحُورِ وَوَضْعُ الْيَمِينِ عَلَى الشِّمَالِ فِي الصَّلَاةِ- ‘তিনটি বিষয় নবী স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। (১) ইফতারে দ্রুত করা। (২) শেষ সময়ে সাহারী খাওয়া। (৩) ছালাতে ডান হাত বাম হাতের উপরে রাখা’।[27]
১৯. রাত্রে খেল-তামাশায় কাটানো ও দিনে ঘুমানো : এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা রামাযান মাসে রাত্রে অযথা বিভিন্ন মাধ্যমে সময় কাটান। আর দিনের বেলায় ঘুমান। যা শারঈ বিধানের সম্পূর্ণ বিপরীত। মহান আল্লাহ দিনকে জীবিকা অর্জনের জন্য এবং রাত্রিতে ঘুমের মাধ্যমে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য তৈরী করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا- وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا- ‘আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ। এবং দিবসকে করেছি জীবিকা অন্বেষণকাল (নাবা ৭৮/১০-১১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ- ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদের জন্য রাত্রি সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমরা তাতে বিশ্রাম নিতে পার’ (ইউনুস ১০/৬৭)।
২০. সাহারী খাওয়ার পর ফজর না পড়ে ঘুমানো : এমন কিছু মানুষ আছেন যারা সাহারী খাওয়ার পরপরই ফজর ছালাত না পড়ে ঘুমিয়ে পড়েন। অথচ সাহারীর সময়টি মুসলিম উম্মাহর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এ সময় আল্লাহ শেষ আসমানে নেমে আসেন এবং বান্দার ফরিয়াদ কবুল করে থাকেন। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْآخِرُ، يَقُولُ: مَنْ يَدْعُونِي فَأَسْتَجِيبَ لَهُ؟ مَنْ يَسْأَلُنِي فَأُعْطِيَهُ؟ مَنْ يَسْتَغْفِرُنِي فَأَغْفِرَ لَهُ- ‘প্রতি রাত্রে শেষ তৃতীয়াংশে আমাদের মর্যাদাবান বারাকাতপূর্ণ রব দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং বলেন, ‘কে আমাকে ডাকবে আমি তার ডাকে সাড়া দেব। যে আমার নিকট কিছু প্রার্থনা করবে আমি তাকে তা দান করব। যে আমার নিকট মাফ চাইবে আমি তাকে মাফ করে দেব’।[28] সুতরাং সাহারীর পূর্ব বা পরবর্তী এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গল্প-গুজব, ফেসবুক, ইউটিউব না চালিয়ে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে।
উপসংহার : ছিয়াম থেকে ছওয়াব লাভে ব্যর্থ ব্যক্তি যথার্থই ব্যর্থ। সুতরাং ছওয়াব অর্জনের এই মহা সুযোগটা যেন প্রকৃতই আমাদের জন্য ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির উপায় হয়, সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন।-আমীন!
[1]. বুখারী হা/৩৬০৬; মুসলিম হা/১৮৪৭; মিশকাত হা/৫৩৮২।
[2]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১; রাবী ওমর (রাঃ)।
[3]. বুখারী হা/৩৮, ২০১৪; মুসলিম হা/৭৬০; মিশকাত হা/১৯৫৮।
[4]. ইবনু মাজাহ হা/১৬৯০।
[5]. জামালুদ্দীন জাওযী (মৃ. ৫৯২ হি.) ছিফাতুছ ছফওয়া ২/৭৮।
[6]. নাসাঈ হা/২৩৩১; দারেমী হা/১৬৯৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৫৩৪।
[7]. মুসলিম হা/১১৫৪; নাসাঈ হা/২৩২৭; তিরমিযী হা/৭৩৩।
[8]. বুখারী হা১৯৬০; মুসলিম হা/১১৩৬।
[9]. ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩০; মাজমাউয যাওয়ায়দ হা/১৭২২৮।
[10]. আবুদাউদ হা/২৩৬৫; আহমাদ হা/১৫৯৪৪; মিশকাত হা/২০১১।
[11]. বুখারী ৭/২৩৪ পৃ.।
[12]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৫৪; ছহীহ হা/১০৬০।
[13]. বুখারী হা/৩৭; মুসলিম হা/৭৫৯; মিশকাত হা/১২৯৬।
[14]. আহমাদ হা/৭৪৪৩; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৭৬৩৩; ছহীহুত তারগীব হা/১০০২।
[15]. নাসাঈ হা/১৬০৬; ছহীহ ইবনু খুযুাইমা হা/২২০৪।
[16]. আবু দাউদ হা/১৩৭৫; তিরমিযী হা/৮০৬; মিশকাত হা/১২৯৮।
[17]. আবু দাউদ হা/৯০৪; নাসাঈ ১২১৪; মিশকাত হা/১০০০।
[18]. বুখারী হা/২১২; মুসলিম হা/৭৮৬; মিশকাত হা/১২৪৫।
[19]. আবু দাউদ হা/১৩২৫; মালেক হা/২৫৩; মিশকাত হা/১৩০২।
[20]. বুখারী হা/৩৫৬৯; মুসলিম হা/৭৬৮।
[21]. ইবনু কুদাম, মুগণী ২/১৬১পৃ.।
[22]. মুসলিম হা/৩৩৫; আবুদাঊদ হা/২৬৩; মিশকাত হা/২০৩২।
[23]. হাদীছ সম্ভার ১০৬৬।
[24]. আহমাদ হা/১১৪১৪; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৬৮৩।
[25]. বুখারী হা/১৯৫৪; মুসলিম হা/১১০০; মিশকাত হা/১৯৮৫।
[26]. বুখারী হা/১৯৫৭; মুসলিম হা/১০৯৮; মিশকাত হা/১৯৮৪।
[27]. মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/২৬১১; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩৮।
[28]. বুখারী হা/৬৩২১; মুসলিম হা/৭৫৮; মিশকাত হা/১২২৩।