সিপাহী জিহাদউত্তর মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমি [শেষ কিস্তি]

অধ্যাপক আশরাফ ফারুকী 305 বার পঠিত

ভারতীয় কংগ্রেস ও সৈয়দ আহমদ খান

সিপাহী জিহাদের পর থেকে বৃটিশ এদেশীয় অধিবাসীদের মধ্যে রাজনীতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে, তাকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার শুরু করে। বৃটিশের এই পলিসি Divide and Rule নামে পরিচিত। তবে হিন্দু-মুসলমানকে বৃটিশ শক্তি পৃথক করেনি। পার্থক্য তাদের মধ্যে পূর্ব থেকেই ছিল। ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস থেকেই তা সুস্পষ্ট। বৃটিশ প্রথমে হিন্দুসমাজকে পৃষ্ঠপোষকতা দান করতে থাকে এবং তাদের সহযোগিতায় মুসলমানদেরকে দমিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করতে চায়। এই বৃটিশ নীতি বহু সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের গোপনীয় চিঠিপত্রাদি থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়। প্রসঙ্গতঃ সিপাহী জিহাদের অব্যবহিতকাল পর লেখা মুরাদাবাদের বৃটিশ লেফটেন্যান্ট কর্ণেল জন কোকের চিঠির উল্লেখ করা যেতে পারে। বোম্বের গভর্ণর লর্ড এলফিনস্টোন এর সমর্থনে ১৮৫৯ সালের ১৪ই তারিখে লিখেন যে, Divide et Impera was the old Roman Motto and it Should be ours.

১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে লর্ড উফরিন ভারতের বড়লাট হয়ে আসেন। তিনি এই নীতিকে সাফল্যের সঙ্গে পরীক্ষা করবার জন্য কাজে লেগে যান। তিনি Allon Octovian Hume নামক এক বৃটিশ সিভিলিয়ানকে এই সাধুকার্যে নিয়োযিত করলেন। ভারতীয় সরকারের সঙ্গে হিন্দু সমাজের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করবার জন্যে হিউমের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গঠন হলো, ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর তারিখে বোম্বেতে এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলো। বৃটিশ শাসন যে ভারতের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ তা পূনঃ পূনঃ ঘোষণা করে কংগ্রেস বৃটিশের নিকট থেকে হিন্দু সমাজের জন্য অধিকতর রাজনীতিক অধিকার পাবার চেষ্টা করতে থাকে। প্রথম অধিবেশনের সভাপতি উমেশ চন্দ্র ব্যানার্জি তাঁর ভাষণে বলেন- Much has been done by Great Britain for the benefit of India, and the whole country was truly grateful to her for it. She had given them order, she had given them railways and above all she had given them the inestimable blessing of western eduction.

কংগ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনে সভাপতি দাদাভাই নৌরোজী বলেন-'It is under the civilizing rule of Queen and people of England that we meet here together, hindered by none, and are freely allowed to speak our minds without the least fear and without the least hasitation such a thing is possible under British rule and British rule only. এভাবে বৃটিশ পৃষ্ঠপোষকতায় বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের ভিত্তিপ্রস্ত্তর দৃঢ়কৃত করবার সুমহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ভারতীয় কংগ্রেসের জন্ম হলো।

কংগ্রেস সুচতুরভাবে ভারতীয় হিন্দু সমাজের স্বার্থ ও দাবী দাওয়া আদায় করতে শুরু করলো। কংগ্রেস ভারতের জন্য প্রতিনিধিমূলক সরকারের সম্প্রসারণ এবং সরকারী চাকরীতে সরাসরি প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মারফৎ ব্যাপক ভারতীয় লোকের নিযুক্তি দাবী করলো। একটুখানি চিন্তা করলেই দেখা যাবে যে, কংগ্রেস মুসলিম স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। কেননা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে যে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার কায়েম হবে, তাহবে আসলে হিন্দুরাজ। অন্যদিকে সরকারী চাকুরীতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মারফৎ যে নিযুক্তি হবে তাতে হিন্দুদের একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। কেননা মুসলমানরা তখনো ইংরেজী শিক্ষার ক খ পর্যন্ত শিখে উঠেনি।

সৈয়দ আহমদ খান প্রবলভাবে কংগ্রেস নীতির বিরোধিতা করলেন এবং তিনি মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যোগদান করতে নিষেধ করলেন। হিন্দু কংগ্রেস বোম্বের মুসলিম নেতা বদরুদ্দীন তায়েবজী এবং রহমাতুল্লাহ এম, সায়ানীকে সম্মুখে রেখে মুসলিম সমাজকে আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে তাদের কিছুমাত্র প্রভাব ছিলোনা। অপরপক্ষে ভারতীয় মুসলিম সমাজে সৈয়দ আহমদ খানের প্রভাব ছিলো অপরিসীম। তিনি কংগ্রেসের বিরোধীতার জন্য ‘মুশ্তারেকা জামাতে মুহিববানে হিন্দ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোললেন এছাড়া ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দে তিনি ‘মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮৮৮ খৃষ্টাব্দে কংগ্রেস যখন কলকাতায় চতুর্থ অধিবেশন আহবান করেন, তখন তিনি একই শহরে মুসলিম শিক্ষা সম্মেলনের অনুষ্ঠান করেন। এর উদ্দেশ্য ছিলো মুসলিম সমাজের দৃষ্টিকে কংগ্রেসের অধিবেশন থেকে ফিরিয়ে আনা। সৈয়দ আহমদ এতে সাফল্য অর্জন করেন। পাক-ভারতের বহুস্থানে ‘মুসলিম শিক্ষা সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় এবং স্যার সৈয়দ আহমদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষা এবং ব্যবসায় ক্ষেত্রে এগিয়ে যাবার জন্যে আহবান জানাতে থাকেন। সৈয়দ আহমদের ব্যাপক চেষ্টার ফলে মুসলিম জাতির মধ্যে রাজনীতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ পুরোপুরিভাবে রূপ পরিগ্রহ করে।

আমরা স্পষ্টই দ্বিজাতিতত্ত্বের উপলব্ধির পরিচয় পাচ্ছি। তমদ্দুনিক, শিক্ষাগত এবং রাজনীতিক যেকোনো দিক থেকে দেখিনে কেন মুসলিম পুণর্গঠন অধ্যায়ের শ্রেষ্ঠতম নায়ক হিসেবে সৈয়দ আহমদের অবদান পাক-ভারতীয় মুসলিম জাতির হৃদয়ে চিরকাল জাগরুক থাকবে। অপর কথায় সৈয়দ আহমদকে পাকিস্তানের অন্যতম জনক বললে অত্যুক্তি হয় না। ১৮৯৮ খৃষ্টাব্দে সৈয়দ আহমদ মৃত্যুবরণ বরণ করেন।

ইসলামী রেনেসাঁ ও আমীর আলী

মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমিতে ‘স্পিরিট অব ইসলাম’ এবং হিস্ট্রি অব দি সেরাসিন্স এর লেখক জাষ্টিস আমীর আলীর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ আহমদ ছিলেন মূলতঃ কর্মবীর। তাই শিক্ষা সংগঠনের মারফৎ তিনি জাতির জন্যে জাগরণের সাড়া যুগিয়েছেন। আমীর আলী ছিলেন মূলত চিন্তাবীর, তাই মৌলিকগ্রন্থ প্রকাশনার মারফৎ তিনি জাতির চিন্তাজগতে বিপ্লব সাধনে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

১৮৯১ খৃষ্টাব্দে আমীর আলী Spirit of Islam প্রকাশিত হয়। এই পুস্তকের প্রথম খন্ডের মারফৎ তিনি বিশ্বনবী হযরত মুহম্মদের (ছ.) চারিত্রিক মাধুর্য ও বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের পরিচয় বিশ্ববাসীর চোখের সামনে তুলে ধরেন। দ্বিতীয় খন্ডের মারফৎ বিশ্ব নবীর সর্বজনীন শিক্ষা ও সুমহান আদর্শের পরিচয় প্রাচ্যের শিথিল বিশ্বাস মুসলিম সমাজ এবং প্রতীচ্যের ইসলাম অনভিজ্ঞ খৃষ্টীয় সমাজের নিকট অত্যন্ত বলিষ্ঠ যুক্তি সহকারে উপস্থিত করেন। স্পিরিট অব ইসলাম পাক-ভারতের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মুসলিম সমাজের যে ব্যাপক আদর্শ-সচেতনতা জন্ম দেয় তার সুদূরপ্রসারী প্রক্রিয়াতেই পরবর্তী স্বাধীন ভারতের স্বাধীন ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সক্রিয় হয়ে উঠে। তাই ‘স্পিরিট অব ইসলাম’কে পাকিস্তান আন্দোলনের একটি সুদৃঢ় ভিত্তিপ্রস্ত্তর বল্লে কিছুমাত্র অত্যন্তি করা হয়না। ইসলামের সর্বজনীন ধর্মীয় মতবাদ, ইসলামের মহান যুদ্ধনীতি, পরমত সহিষ্ণুতা দাস প্রথার বিলোপ, সাধন-প্রচেষ্টা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, ব্যাপক গণশিক্ষার সম্প্রসারণ নীতি, বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদের প্রয়োগ এবং সর্বোপরি ইসলামী গণতন্ত্রের সার্বিকতা ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক ও সামগ্রিক আলোচনা দ্বারা আমীর আলী প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে, ইসলাম প্রগতির ধর্ম, শান্তির ধর্ম ও মানবতার ধর্ম।

‘স্পিরিট অব ইসলাম’ গ্রন্থে আমীর আলী ইসলামের মতবাদগত দিকটি আলোচনা করেছেন আর History Of The Saracens গ্রন্থের মারফৎ তিনি শিখিয়েছেন যে, ইসলাম গ্রহণকারী আরবজাতি কিভাবে বিশ্বের প্রগতি, শিক্ষা ও তমুদ্দুনকে সমুন্নত করবার জন্যে সাধনা করে গিয়েছেন।

আমীর আলী মুসলিম জাতির অতীত গৌরবকে এই গ্রন্থে জাজ্জ্বল্যমান করেছেন। সমৃদ্ধ অতীতের ঐতিহ্যকে অবলম্বন করে পাক-ভারতীয় মুসলিম জাতি নতুন বর্ত্তমানকে গড়ে তোলবার প্রেরণা যে বহুলাংশে আমীর আলীর নিকট লাভ করেছে, মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমিতে সেকথা আমাদেরকে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে। আমীর আলী যে শুধুমাত্র ইসলামী আদর্শ ও তমদ্দুনের পুঁথিগত অনুশীলন করে গিয়েছেন তাই নয়। জাতির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি জাতির বৃহত্তর রাজনীতিক স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যে রাজনীতি ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন। যে আমীর আলী কংগ্রেসের দ্বিতী কোলকাতা অধিবেশনে যোগদান করে জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত হন। সেই আমীর আলীরই নেতৃত্বে মুসলিম সমাজ ১৯০৯ খৃষ্টাব্দে ভারত-সচিব লর্ড মর্লিকে মুসলমানদের জন্যে পৃথক নির্বাচন প্রথা প্রবর্ত্তন করতে বাধ্য করেন। সৈয়দ আহমদ এবং আমীর আলী উভয়েই প্রধানতঃ শিক্ষা এবং তমদ্দুনের অনুশীলন করতে চেয়েছেন। কিন্তু মুসলিম জাতি রাজনীতির অধিকার সংরক্ষণ ছাড়া যে ইসলামী শিক্ষা এবং তমদ্দুনের বিকাশসম্ভব নয় এই বোধের ফলে উভয়েই রাজনীতি আন্দোলনের পর্যায়ে নেমে এসেছেন।

ইসলামী রেনেসাঁ ও ইকবাল

শুধু সৈয়দ আহমদ বা আমীর আলী নন, পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা মহাদার্শনিক কবি ইকবালের সম্পর্কে ও একই কথা খাটে। ইকবাল ছিলেন প্রধানতঃ কবি এবং দার্শনিক। কিন্তু পাক ভারতীয় মুসলিম জাতির রাজনীতিক সংস্থা সংগঠনের কার্যেও তাকে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এ কথাটাই সুইস্পষ্ট যে, রেনেসাঁর মারফৎ মুসলিম চিন্তা পূর্ণ গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম রাজনীতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেও মুসলিম জাতি অধিকত সচেতন হ’তে থাকে। আলোচ্য মুসলিম রেনেসাঁর পটভূমিতে ইকবালের অবদান যে কত সুদুপ্রসারী, তা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান প্রবন্ধে যে আলোচনার সুযোগও সীমাবদ্ধ। এক কথায় বলা যায়, ইকবালের কাব্য পাক-ভারতীয় মুসলিম জাতির রেনেসাঁ আন্দোলনের সর্বশেষ তরঙ্গ। তাই ব্যাপকতার দিক থেকে তার সবের্বাপ্লাবী সয়লাব মুসলিম জাতির নবজীবন লাভের গভীরতম প্রেরণাস্থল হ’তে পেরেছে। ইকবালের ধর্মীয় চিন্তার পুর্ণগঠন বক্তৃতামালাতে সমসাময়িক ইসলামী চিন্তাধারায় চূড়ান্ত রূপের পরিচয় পাওয়া যায়।

রেনেসাঁর আলোকে রাজনীতিক সংগঠন

বিংশ শতাব্দীর প্রথম প্রভাতে রেনেসাঁর নবালোকে পাক-ভারতীয় মুসলিম জাতি তার স্বকীয় স্বাতন্ত্রে¿্যর সাথে বাঁচাবার অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলো। রেনেসাঁ আন্দোলন জাতির তমদ্দুনিক স্বাতন্ত্রকে সুস্পষ্ট করে তুলবার সঙ্গে সঙ্গেই মুসলিম জাতি নিজেদের রাজনীতিক সংগঠন গড়ে তুলবার অনুপ্রেরণা লাভ করে। অপরপক্ষে ভারতীয় কংগ্রেসের হিন্দু স্বার্থকেন্দ্রিক সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে পাক ভারতীয় মুসলিম জনসাধারণ দিনের পর দিন অধিকতর ওয়াকিফহাল হ’তে থাকে। ঠিক এই সময়টাতেই হিন্দু কংগ্রেসের তথাকথিত জাতীয়তার স্বরূপটি মুসলিম জনগণের নিকট স্পষ্টভাবে উদঘাটিত হয়ে পড়ে।

পূর্বেল্লিখিত হিন্দুধর্ম সংস্কার আন্দোলনসমূহের প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবেই সুস্পষ্ট হিন্দু রাজনীতিক সংগঠনের পরিবেশ রচনা করেছিলো। কেননা দু’একটি আন্দোলন ছাড়া অধিকাংশ হিন্দু আন্দোলন সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষকে ভিত্তি করে পরিচালিত হয়েছিলো। আর হিন্দুরা গণশক্তিকে (Mass) আকৃষ্ট করেছিলো। হিন্দুসমাজ কংগ্রেসকে পরিপূর্ণভাবে হিন্দু সংগঠনরূপে গড়ে তোলাবার পক্ষপাতী ছিলো। হিন্দুসমাজের এই মনোভাবকে বাস্তবায়িত করবার জন্যে এগিয়ে এলেন বালগঙ্গাধর তিলক নামক একজন মারাঠী। ইনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটি চরমপন্থী দল তৈরী করলেন। হিন্দু জনগণের মধ্যে চরম মুসলিম বিদ্বেষ সৃষ্টিকরা এবং গোহত্যা বিরোধী ব্যাপক আন্দোলন পরিচালনা করাই ছিল তিলক এবং তাঁর অনুসারীদের মুখ্য উদ্দেশ্য। হিন্দু জনগণের মধ্যে তিলকেরই একচ্ছত্র নায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। পন্ডিত নেহরু বলেন, The real symbol of the new age was Bal Gangadhar Tilak from Maharashtra. The old leadership was represneted also by a Maratha, a very able and younger man, Gopal krishna Gokhle. কংগ্রেসের নেতৃত্ব যাতে তিলকপন্থীদের হাতে চলে না যায়, সে জন্য বৃদ্ধ মধ্যমপন্থী দাদাভাই নেরোজিকে পূর্ণবার কংগ্রেস নেতৃত্বে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু পন্ডিত নেহেরুর মধ্যপন্থীদের এই বিজয় সম্বন্ধে বলেন- But this had been won because of organisational control and the narrow franchise of the congress, There was no doubt that the vast majority of politically minded people in India favoured Tilak and his group the discovery of India.

সুতরাং একথা আলোচনার অপেক্ষা রাখে না যে, কংগ্রেস কেন আর মুসলিম জনগণকে মিলনের সুমধুর স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯০৫ সালের কংগ্রেসের বেনারস অধিবেশনে ২৫৬ জন প্রতিনিধির মধ্যে মুসলমান প্রতিনিধি সংখ্যা দাঁড়িয়ে ছিলো মাত্র ১৭ জন। মুসলিম সমাজের রাজনীতিক প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবার অনুকূল পরিবেশ ঠিক এই সময়েই গড়ে উঠেছিলো। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুসলমানদেরকে স্বতন্ত্র সংগঠন গড়ে তুলতে প্রয়াসী করে তোলে। বাংলার মুসলমানরা চাকরী-বাকরী ব্যবসার-বাণিজ্য, শিক্ষা-দীক্ষা এবং শাসনতান্ত্রিক ক্ষমতা হাসেল ইত্যাদি সকল বিষয়ে হিন্দুদের দ্বারা প্রবঞ্চিত হয়ে আসছিলেন। কোলকাতার হিন্দু নেতৃত্বের নাগপাশ থেকে নাজাত পাবার উদ্দেশ্যে মুসলমানরা বাংলা ও আসামকে পৃথক প্রদেশে পরিণত করবার দাবী তুলেন। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন শাসনকার্যের সুবিধার্থে বাংলা প্রদেশকে ভাগ করে পূর্ব বাংলাকে আসামের সঙ্গে যুক্ত করে একটি নতুন প্রদেশ সৃষ্টি করেন। ঢাকাতে এর রাজধানী স্থাপিত হয়। কোলকাতার বন্ধন মুক্ত হয়ে মুসলমানরা মসজিদে মসজিদে নফল শোকরিয়া নামায আদায় করেন। কিন্তু উচ্চ শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদী হিন্দুদের এ ব্যবস্থা মনঃপুত হলোনা। তারা বঙ্গভঙ্গ রহিত করবার আন্দোলন শুরু করলেন। তিলক এই আন্দোলনকে সর্বভারতীয় আন্দোলনে পরিণত করেন। দুঃখ এবং ক্ষোভের সঙ্গে মুসলমানরা উপলব্ধি করল যে, মুসলমান জাতির স্বার্থ রক্ষা করা কংগ্রেসের দ্বারা সম্ভব নয়। সুতরাং মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষণের তাকিদে মুসলিম রাজনীতিক দলের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভূত হলো।

এই সময়ে ইংল্যান্ডে উদারনীতিক দল ক্ষমতাসীন হলো। সরকার ঘোষণা করলো যে, ভারতের শাসন বিধিতে প্রয়োজনের সংস্কার সাধন করা হবে। তখন মুসলমানরা স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করলেন যে, প্রস্তাবিত শাসন সংস্কারে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের সম্প্রসারণ নীতি গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা এও উপলব্ধি করলেন যে, সাম্প্রদায়িক হিন্দু সংস্কার আন্দোলন এবং তিলকপন্থীদের মুসলিম বিদ্বেষ প্রচারের ফলে এ দেশে এমন এক বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে যে, প্রকৃত মুসলিম স্বার্থের রক্ষণাকারী মুসলমান প্রার্থীর পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুর ভোটে নির্বাচিত হওয়া অসম্ভব। এজন্যই মুসলিম নেতৃবৃন্দ মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন দাবী করলেন। এই দাবী তদানীন্তন বড়লাট লর্ড মিন্টোর নিকট পেশ করবার জন্যে একটি প্রতিনিধি দল প্রেরিত হয়। লর্ড মিন্টো পৃথক-নির্বাচন দাবীর যৌক্তিকতা স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং পরবর্তী ১৯০৯ খৃষ্টাব্দের মলি-মিন্টো শাসন-সংস্কারে পৃথক নির্বাচন প্রথা কবুল করা হয়।

মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচনের সরকারী স্বীকৃতি আদায় করা মুসলিম-রাজনীতি ক্ষেত্রে যে একটি সুষ্পষ্ট পদক্ষেপ তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু মুসলি­ম স্বার্থ-সংরক্ষণ এবং দাবীদাওয়া আদায় করবার জন্য একটি রাজনীতিক দলের প্রয়োজন ছিলো সর্বাধিক। জাতির এই বিরাট প্রয়োজন মিটানোর জন্য এগিয়ে এলেন ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহু এবং নওয়াব ভিকার-উল-মূল্ক। তাঁদের আহবানে ১৯০৬ খৃষ্টাব্দের ৩০শে ডিসেম্বর ঢাকায় পাক-ভারতের মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন আহুত হয়। এই সম্মেলনেই মুসলিম জাতির আশা আকাংখার প্রতীক ‘নিখিল ভারত মুসলিম- লীগ’ নামক এক রাজনীতিক সংগঠনের জন্ম হয়। নানা ঘাতপ্রতিঘাত এবং আশা-নিরাশার দোদুল্যমানতার মধ্য দিয়ে এই রাজনীতিক সংগঠনই মুসলিম জাতির রাজনীতিক আশা আকাংখাকে চরিতার্থ করতে সক্ষম হয়। রেনেসাঁর দীপ্ত আলোকে মুসলিম জাতির যে আদর্শিক স্বাতন্ত্র দেদীপ্যমান হয়ে উঠে, মুসলিম রাজনীতিক সংগঠন তাকেই ভিত্তি করে কায়েদে আযমের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে মুসলিম আত্মনিয়ন্ত্রণা ধিকারকে ‘পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হাসেলের মারফত সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়।

[আলোচ্য নিবন্ধটি ‘তর্জমানুল-হাদীছ’ পত্রিকার অষ্টম বর্ষের ৩য়-৭ম সংখ্যার আগস্ট-সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ থেকে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ১৯৫৯ইং প্রকাশিত]



আরও