নোমোফোবিয়ার ভয়াল থাবা ও বাঁচার উপায়

শো‘আইব বিন আসাদ 548 বার পঠিত

উপস্থাপনা : ছোটবেলায় আমরা একটা রচনা পড়েছিলাম, ‘বিজ্ঞান মানব জীবনে আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ’। সেই ভাবনা দিয়ে বর্তমানে মোবাইল ফোনকে নিয়ে চিন্তা করা সময়ের দাবী। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও নতুন নতুন ডিভাইসের প্রতি শিশু-কিশোরদের আকর্ষণ থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ এই বয়সে তাদের নতুন কিছু জানার আগ্রহ থাকে; কিন্তু এই সকল শিশু যখন মোবাইল গেমসসহ নানা ক্ষতিকর বিষয়ে আসক্ত হয়, তখন তা তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে তারা খেলাধুলা করতে চায় না, খেতেও চায় না। বরং মোবাইল ফোন ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। এটা একটি মানসিক রোগ। যাকে নোমোফোবিয়া বলা হয়, যা লেখাপড়া, ক্যারিয়ার ও উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে এক ভয়ংকর প্রতিবন্ধক। নিম্নে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হ’ল।

নোমোফোবিয়া : No Mobile Phobia শব্দটির সংক্ষিপ্তরূপ Nomophobia। কোনো জিনিসের উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি যখন মানসিক অস্থিরতা, ভয় বা উদ্বেগ তৈরী করে, তখনই সেটিকে Phobia ‘ফোবিয়া’ বলা হয়। আর ফোন হারিয়ে গেলে বা ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে বা যে কোন কারণে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারলে যদি অনেক বেশী অস্থিরতা ও মানসিক চাপ তৈরি হয় তাকে ‘নোমোফোবিয়া’ বলা হয়।

নোমোফোবিয়ার করাল ছোবল : সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গবেষণায় দেখা গেছে, নোমোফোবিয়ার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত এক-তৃতীয়াংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। এর মধ্যে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের মধ্যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক পড়ুয়া ও স্নাতকোত্তর শ্রেণীর ৫৮৫ জন স্মার্টফোন ব্যবহারকারী শিক্ষার্থী এ জরিপে অংশ নেন। গবেষণায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৃদু নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, মাঝারি নোমোফোবিয়ায় ৫৬ দশমিক ১০ শতাংশ এবং গুরুতর নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীর হার ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

২০১৩ সালে করা একটি পরীক্ষায় দেখা যায় যে, মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে অন্তত ৯ শতাংশ মানুষ প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর নিজেদের মোবাইল দেখেন। বাকীরাও যে খুব একটা পিছিয়ে আছেন তা নয়। এছাড়াও এই পরীক্ষাটিতে আরো জানা যায় যে, বাড়িতে ফোন ফেলে আসা মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৬৩ শতাংশ মানুষ ঐ দিনের পুরোটা সময় হতাশাগ্রস্থ অবস্থায় থাকেন। ইউগভ এবং হাফিংটন পোস্টের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, অধিকাংশ মানুষই রাতে ঘুমানোর সময় সাথে মোবাইল ফোন না থাকলে অস্বস্তি বোধ করেন এবং ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে শতকরা ৬৪ শতাংশ মানুষ মোবাইল ব্যবহার করতে করতেই ঘুমিয়ে পড়েন।

দক্ষিণ কোরিয়ার রেডিওলজির অধ্যাপক ইয়ুং সুক ছই এক গবেষণায় অভিমত দিয়েছেন যে, যেসব কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোনে বেশী সময় কাটায় তাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটার ফলে তাদের এ বিষয়ে আসক্তি রয়েছে বলে বাহ্যিক প্রতিয়মান হয়। এর ফলে তাদের মাঝে হতাশা ও উদ্বেগ কাজ করে। তাছাড়া মুঠোফোন সবসময় ঠিক জায়গায় আছে কিনা তা নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকে। মোবাইল হারানো বা চুরির ভয় থেকে মনের মধ্যে এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। বিশেষত মার্কেটে কিংবা বাইরে গেলে প্রায়ই আমরা পকেটে কিংবা ব্যাগে হাত দিয়ে দেখতে থাকি যে মোবাইল ফোনটা যথাস্থানে আছে কিনা।

২০১৯ সালে ব্রিটেনের ২১৬৩ জন মোবাইল ফোন ব্যবহারীর উপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, প্রায় ৫৩% ব্যবহারকারীর মধ্যে তাদের মোবাইলফোন হারানো, ব্যাটারী বা ব্যালেন্স শেষ হওয়া, বা নেটওয়ার্ক কভারেজ না থাকায় উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রায় ৫৮% পুরুষ ও ৪৭% মহিলার ফোবিয়া ছিল এবং ৯% তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলে অতিরিক্ত চাপ অনুভব করে। ৫৫% ব্যবহারকারী তাদের বন্ধু বা পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারায় উদ্বিগ্ন থাকে।

জার্মানির সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলের নোমোফোবিয়া সংক্রান্ত এক জরিপে প্রায় ৮০০ জন অংশগ্রহণ করেন। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই নোমোফোবিয়াতে ভুগছেন। এ থেকে উদ্বেগ ও বিষণ্ণতার মতো রোগের সৃষ্টি হতে পারে।

কীভাবে বুঝবেন আপনি নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত :

১. ঘন ঘন ফোন দেখতে থাকা। যেন একটা নোটিফিকেশনও বাদ পড়ে না যায়। কখনো বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকা। ২. অধিক সময় ফোন ছাড়া থাকতে না পারা এবং ক্রমাগত ব্যবহার করার প্রবণতা ও ইচ্ছা। এক কথায়, যে কোন মূল্যে মোবাইল ফোন হাতে, পকেটে বা কাছে রাখা নিশ্চিত করা। ৩. মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারলে দুশ্চিন্তা, ভয়, প্যানিক বোধ করা। এমনকি ফোন ছাড়া নিজেকে অসহায় মনে করা। ৪. মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারলে খিটখিটে মেজাজ, মানসিক চাপ বোধ করা এবং অস্থির আচরণ করা। ৫. অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের কারণে প্রাত্যহিক কর্মকান্ডে সমস্যা ও এই আসক্তির কারণে জীবনযাত্রার মান অথবা স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া। ৬. কেউ কেউ ফোন বিছানায় নিয়ে ঘুমায়, আবার বাথরুমেও নিয়ে যায়। ৭. অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের কারণে ঘুমের ক্ষতি।

নোমোফোবিয়া হওয়ার কারণ?

১. নিঃসঙ্গতা একটি বড় কারণ। ২. অন্যদের সঙ্গে মুখোমুখি দেখা করা বা যোগাযোগ কমে যাওয়া। ৩. আত্মবিশ্বাসহীনতা এবং সামাজিক পরিবেশে মুখোমুখি যোগাযোগের অদক্ষতা। ৪. দিনের বেশীরভাগ সময় মোবাইলের স্ক্রীনে সময় দেওয়া। এখানে স্ক্রীন থেকে নির্গত ব্লু লাইট অ্যাডিকশন তৈরির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৫. আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ মোবাইল ফোনের অগ্রহণযোগ্য ব্যবহারের মাধ্যমে সামাজিক মাধ্যমে স্বস্তি খোঁজা।

ক্ষতিকর দিক :

১. এটি উদ্বেগ তৈরী করে। ফোন থেকে দূরে থাকলে এই রোগে আক্রান্তরা উদ্বেগে ভোগেন। যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া এর ফলে মনোযোগও নষ্ট হয়। যার ফলে কর্মস্থলে উৎপাদনশীলতাও কমে আসে।

২. সময়ের অপচয় করে। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে মাল্টিটাস্কিং বা একই সময়ে একাধিক কাজ করা ক্ষতিকর। কারণ এভাবে তথ্য ধারণ ও প্রসেস করা যায় না। অনবরত ফোন চেক করলে সময়ের অপচয় হয় প্রচুর।

৩. ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ফোন থেকে যে নীল আলো নিঃসরণ হয় তা মস্তিষ্কে এই সংকেত দেয় যে, এখন ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময়। যা ঘুমের জন্য সহায়ক মেলাটোনিন হরমোনকে দমন করে। (দৈনিক কালের কণ্ঠ ৬ই এপ্রিল ২০১৭)

নোমোফোবিয়া থেকে আত্মরক্ষার উপায় :

১. দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় মোবাইলকে নিজের কাছ থেকে দূরে রাখুন। তার মানে এই নয় যে, সেই সময় আপনাকে ফোন করলে কেউ পাবে না। তবে মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ রেখে, সেটাকে একটু দূরে রেখে দিন যাতে করে কেউ আপনাকে ফোন করলে খুঁজে পায়। কিন্তু এর বেশী কিছু নয়।

২. ঘুমানোর সময় মোবাইল দূরে রাখুন। সম্ভব হলে বন্ধ কিংবা সাইলেন্ট করে রাখুন। কিছুদিন এই পদ্ধতি মেনে চললে আপনার চারপাশের মানুষ ব্যাপারটি বুঝতে পারবে এবং রাতের নির্দিষ্ট একটি সময়ের পর আপনাকে আর কল করবে না। ঘুমের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট সময় মেনে চলুন। অনেকেই রাতে ঘুম না আসার কারণে মোবাইল ব্যবহার করেন এবং খানিক পর ঘুম আসলেও আর মোবাইলের কারণে ঘুমাতে পারেন না। তাই ঠিক সময়ে প্রতিদিন ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হবে।

৩. কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে? কোনো কাজ করতে গেলে সময় কেটে যায়? এই মানুষ এবং কাজগুলোকে চিহ্নিত করুন এবং এই ব্যাপারগুলো নিয়েই নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। বিনা কারণে ফোনের দিকে মনোযোগ চলে যাওয়ার সমস্যা একটু হলেও কমে যাবে।

৪. বাসায় কিছুক্ষণের জন্য ফোন রেখে বাইরে বের হওয়ার অভ্যাস করুন। যখন আপনি হাঁটতে যাবেন অথবা গলির মোড়ের দোকান থেকে কিছু আনতে যাবেন তখন মোবাইল ছাড়াই বের হবেন।

৫. মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করুন। চেষ্টা করুন ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারের। বর্তমানে আমাদের মোবাইল আসক্তি এবং নোমোফোবিয়া নামক মানসিক সমস্যা তৈরি হওয়ার অন্যতম একটি কারণ এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। তাই এর ব্যবহার কমিয়ে ফেলুন। এতে করে সমস্যা একটু হলেও দূর হবে।

৬. নোটিফিকেশন অপশনগুলো বন্ধ রাখুন। অপ্রয়োজনীয় অ্যাপগুলো বন্ধ রাখুন। কারণ সেগুলোও মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।

৭. দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহারের পরিবর্তে দৈনিক কিছু বই পড়ার অভ্যাস করুন। চিঠি লেখা, হাঁটাহাঁটি বা বাইরে প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলুন।

৮. মসজিদে গিয়ে দীর্ঘ সময় যিকির-আযকার ও তেলাওয়াতের অভ্যাস করুন। মোবাইলে অন্য কাজের পরিবর্তে কুরআন ডাউনলোড করে নিয়মিত পড়ুন। এতে মোবাইলের অপব্যবহার কমে আসবে।

৯. ফোনে সময় চেক করার বদলে হাতঘড়ি পরুন। হিসাবের জন্য ক্যালকুলেটর ব্যবহার করুন। প্রয়োজনে যরূরী কথা বলার জন্য বাটন ফোন ব্যবহার করুন।

১০. বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন বা প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিয়ে মুখোমুখি দেখা করার সুবিধাজনক নিয়ম তৈরি করুন। যদি তারা অন্য শহরে থাকেন তাহলে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে কথা বলার অভ্যাস করুন। অফলাইনে সামাজিক যোগাযোগ রাখার যে অভ্যাসটা করোনাকালীন সময় আমাদের চলে গিয়েছিল সেটিকে আবার সজীব করুন।

উপসংহার : নোমোফোবিয়ার কারণে শুধু দৃষ্টিশক্তি নয়, শ্রবণশক্তি, শরীরের অস্থিসন্ধিগুলো ও প্রজননতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফোনের হাই ফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশনের সাথে মস্তিষ্ক ক্যান্সারের যোগসূত্র রয়েছে। এর কারণে ঘুমের যে সমস্যা হয় তার নাম ইনসমনিয়া বা স্পিং ডিসঅর্ডার। মোদ্দাকথা, বিজ্ঞানের অনন্য আবিষ্কার মোবাইল ফোন এড়িয়ে চলার উপায় না থাকলেও এর অপব্যবহার যেন না হয়, দিন দিন যাতে ছেলেমেয়েরা এর প্রতি আসক্ত না হয়ে পড়ে, সেজন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতা খুবই যরূরী।

শো‘আইব বিন আসাদ

[লেখক :অধ্যায়নরত, আল-হাদীছ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া।]



বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও