রাত্রি জাগরণ
এ. এইচ. এম. রায়হানুল ইসলাম
ভূমিকা : ইসলাম শুধু একটি ধর্মের নাম নয়, একটি সভ্যতার স্রষ্টাও। ইসলামী সভ্যতা অজ্ঞতা ও মূর্খতার যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও কর্ম উদ্দীপনার যে দাবাগ্নি প্রজ্বলিত করেছিল, তারই ঔজ্জ্বল্য সুপ্ত মানবতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে, বিপণ্ণ মানুষ্য-হৃদয়ের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে, বিবর্ণ বুদ্ধিবৃত্তির বিশীর্ণ বিশুষ্ক বিবরে, মানবীয় জীবনের প্রত্যন্ত ক্ষেত্রে, সৃষ্টি ও সংস্কারের অন্বেষা ও অভিযানে প্রগতি ও সমৃদ্ধির বিদ্যুৎকেন্দ্র সৃষ্টি করে দিয়েছিল। আধুনিক বিজ্ঞান পৃথিবীকে মানুষের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বিজ্ঞানের বদান্যতায় মানুষ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের অবস্থা দেখলে মনে হয় তারা ধনে এবং জ্ঞানে দরিদ্র। কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা নয়। যে জাতির সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল মানবকল্যাণ (আলে ইমরান ৩/১১০) এবং সমগ্র পৃথিবীতে তারা জ্ঞানের মহিমা প্রচার করবে, পৃথিবীকে শাসন করবে, আল্লাহর অসামান্য ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে, কিন্তু তারা কেন আজ এমন অসহায়? তারাই আজ সবচেয়ে বেশী অত্যাচারিত? কেন তারাই আজ জ্ঞান বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণায় সবচেয়ে পশ্চাৎপদ। এই পশ্চাৎপদতা থেকে ফিরে আসতে বিজ্ঞানে মুসলমানদের অতীত ইতিহাস নিজেকে নতুন উদ্দীপনায় জাগ্রত করতে হবে।
বিজ্ঞানের উৎস আল-কুরআন : আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, যারা জানে আর যারা জানে না তারা সমান নয়’ (যুমার ৩৯/০৯)। ইসলামে বিদ্বান ব্যক্তির বহু মর্যাদার কথা বলা হয়েছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে মুসলমানদের যে ওতপ্রোত সম্পর্ক ছিল তা মুসলমানরাই কয়েক শতাব্দীব্যাপী বিজ্ঞানের মশালকে জ্বালিয়ে রেখেছিলেন। জন্ম দিয়েছিলেন মানব ইতিহাসের একটি অনন্য সাধারণ অধ্যায়ের, যে অধ্যায়ের ইতিহাস লিখতে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিলেন কট্টরপন্থী অনেক ইসলাম বিদ্বেষীও’।[1]
দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রযুক্তিকে ইসলাম নে‘মত ও রহমত বিবেচনা করে। মানবকল্যাণে গবেষণা, চিন্তা এবং মননশীলতাকে ইবাদত ভাবে। কুসংস্কারে কিলবিল ধর্মবিশ্বাস ইসলামে নেই। গবেষণা করে ভুল সিদ্ধান্তে পৌঁছালেও এখানে পুরস্কারের নিশ্চয়তা দেয়। আর সঠিক সিদ্ধান্তের জন্য পুরস্কারের ঘোষণা তো রয়েছেই। সভ্যতা দাঁড়াতে হ’লে, সংস্কৃতি ভাল করতে হ’লে প্রযুক্তির উৎকর্ষ এগিয়ে নিতে হ’লে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রেরণা দানকারী বিশ্বাস যরূরী যা শুধু অখন্ডভাবে ইসলামই দিয়েছে’।[2]
আধুনিক বিজ্ঞানের এখন চলছে চরমোৎকর্ষকাল। আজও পবিত্র কুআনের কোন বক্তব্যকে এই বিজ্ঞান অসার প্রমাণ করতে পারেনি। বরং এ বিষয়ে ফ্রান্সের প্রখ্যাত গবেষক ডা. মরিস বুকাইলি বলেন, ‘কুরআনে এমন একটি বর্ণনাও নাই আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে যার বিরোধিতা করা যেতে পারে’।[3]
তাই আমরা বিজ্ঞানের আলোকে কুরআন নয়; বরং কুরআনের আলোকে বিজ্ঞানকে বুঝার চেষ্টা করব। কারণ বিজ্ঞানের লক্ষ্য হ’ল অজানাকে জানা। বর্তমানে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তকে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ফলাফলের আলোকে পুনঃপুনঃ পর্যবেক্ষণ। কিন্তু বিজ্ঞান কখনো চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না। কারণ মানবীয় জ্ঞান কখনো সম্যক ও সর্বব্যাপক জ্ঞান হ’তে পারেনা। অথচ কুরআন এমন এক ঐশী বাণী যা অজানাকে জানার এবং অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সকল তথ্যের এক বিপুল সমাহার। এ অর্থে বিজ্ঞান কুরআনের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কারণ কুরআনের অন্যতম মোজেযা হ’ল সমানভাবে প্রযোজ্য হওয়া’।[4]
বিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উৎকর্ষতার সাথে সাথে পবিত্র ইসলামের শাশ্বত পয়গাম আরো বেশী করে প্রমাণিত হচ্ছে। আধুনিক যুগের মানুষ ঝুঁকে পড়ছে সর্বাধুনিক ধর্ম ইসলামের প্রতি। উল্লেখ্য আজকালকার বৈজ্ঞানিক সমাধান যাই হৌক না কেন, ইসলাম তার আনুগামী নয়, বরং বিজ্ঞানকেই বারবার ফিরে আসতে হয়েছে ইসলামের কাছে। বিজ্ঞান আজ যা শত বছরের গবেষণায় প্রমাণ করছে, তা কোন গবেষণা ব্যতীত ইসলাম তথ্যগত বুৎপত্তিসহ বর্ণনা করেছে। ফলে আজকের বিজ্ঞান কুরআনের কাছে বারংবার হার মানছে। এতেই প্রমাণিত হয় যে, ইসলামের দর্পণ ‘কুরআন’ সকল সময়ের সর্বাধুনিক বিজ্ঞান গ্রন্থ।’[5]
অথচ পবিত্র কুরআনের নাযিলকৃত প্রথম পাঁচটি আয়াতে প্রথমে পড়ার কথা বলা হ’ল এবং তারপর কলমের কথা কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয় কোটি কেটি মুসলিম জনগোষ্ঠী আজও কলম ব্যবহার করতে জানে না। কুরআনের বহু জায়গায় ‘ইল্ম’ এর কথা বলা হয়েছে। ‘ইলম’ অর্থ জ্ঞান, আবার ‘اقرأ’ এর আরবী অর্থ পড়ো।[6]
মহাগ্রন্থ আল কুরআনের প্রথম অহি হ’ল সূরা আলাক্বের প্রথম ৫ আয়াত। মূলত এ ৫টি আয়াতের মাধ্যমেই বিজ্ঞান চর্চার নানাবিধ মূলনীতি বর্ণিত হয়েছে। ১ম আয়াত اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ- ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/১)। আলোচ্য আয়াতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার আদেশ দেওয়া হয়েছে।
২য় আয়াতে خَلَقَ الْإِنْسَانَ مِنْ عَلَقٍ- ‘সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড হ’তে’ (আলাক্ব ৯৬/২)। আলোচ্য আয়াতে মানব সৃষ্টির সাথে সাথেই বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে। ৩য় আয়াত اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ- ‘পড়। আর তোমার পালনকর্তা বড়ই দয়ালু’ (আলাক্ব ৯৬/৩)। আলোচ্য আয়াত দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, বিজ্ঞান চর্চার ফলে নাস্তিক হয়ে যেয়ো না; বরং সঠিক পথে বিজ্ঞানচর্চায় রত থেকে একত্ববাদ স্বীকার কর।
৪র্থ আয়াত الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ- ‘যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দান করেছেন’ (আলাক্ব ৯৬/৪)। আলোচ্য আয়াত দ্বারা হাতে-কলমে শিক্ষা তথা Laboratory গবেষণাকে বুঝানো হয়েছে। ৫ম আয়াত عَلَّمَ الْإِنْسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ- ‘শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানতো না’(আলাক্ব ৯৬/৫)। আলোচ্য আয়াত দ্বারা সর্বশেষ কথাই বুঝানো হয়েছে যে, অজানাকে জানার নামই হ’ল বিজ্ঞান।[7]
বিজ্ঞান শব্দটির বিশ্লেষণ : বিজ্ঞান শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বি + জ্ঞান’ যার অর্থ দাঁড়ায় বিশেষ জ্ঞান বা অনুপুঙ্খ জ্ঞান। অর্থাৎ কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানকে বলা হয় বিজ্ঞান। মহান আল্লাহ নিন্মোক্ত শব্দ দ্বারা বিজ্ঞান, বিশেষ জ্ঞান বা অনুপুঙ্খ জ্ঞানকে বুঝিয়েছেন। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনেيَفْقَهُونَ শব্দটি এসেছে ১৩ বার, يَفْقَهُوهُ শব্দটি এসেছে ৩ বার,يَفْقَهُوا শব্দটি এসেছে ১ বার,نَفْقَهُ শব্দটি এসেছে ১ বার। لَا تَفْقَهُونَ শব্দটি এসেছে ১ বার,لِيَتَفَقَّهُوا শব্দটি এসেছে ১ বার,تَتَفَكَّرُونَ শব্দটি এসেছে ৩ বার, يَتَفَكَّرُوا শব্দটি এসেছে ২ বার,يَتَفَكَّرُونَ শব্দটি এসেছে ১০ বার, يَعْلَمُ শব্দটি এসেছে ৭১ বার, عِلْم শব্দটি এসেছে ৫৮ বার, الْعِلْم শব্দটি এসেছে ২৮ বার, تَعْلَم শব্দটি এসেছে ৯ বার, تَعْلَمُوا শব্দটি এসেছে ৫ বার,يَعْلَمُوا শব্দটি এসেছে ৫ বার। এছাড়াওالنّظْرُ، الحِكْمَةُ الرُّؤيَةُ، التَّفَكّرُ، التَّدَبُّرُ ইত্যাদি শব্দযোগে মোট ৭৫৬টি আয়াতে ‘বিজ্ঞান’ মূলক শব্দ ব্যবহার করে মানবজাতিকে বিজ্ঞান চর্চার প্রতি অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়েছে’।[8]
অন্য এক গবেষণায় দেখা যায় যে, পবিত্র কুরআনে নিম্নোক্ত বিষয় সমূহে নিম্নসংখ্যক আয়াত সমূহ রয়েছে। যেমন : (১) মেডিসিনে ৩৫৫টি (২) বায়োলজী ও বোটানিক ১০৯টি (৩) এ্যাস্ট্রোনমী ও এ্যাস্ট্রোফিজিক্সে ৮২টি (৪) কেমিস্ট্রিতে ৪৩টি (৫) মেটেরিওলজীতে ৩৪টি (৬) জিওলজীতে ৩৩টি (৭) ওসীয়ানোগ্রীতে ৩১টি (৮) জুয়োলজীতে ২৮টি (৯) জিওগ্রাফীতে ১৭টি (১০) আর্কিওলজীতে ৮টি (১১) এয়ারোনটিক্সে ৮টি এবং (১২) সোশিওলজীতে ৩০০টি, সর্বোমোট ১০৪৮টি আয়াত’।[9]
আরেকটি হিসাবে জানা যায় যে, কুরআনের শতকরা ১১টি আয়াত বিজ্ঞান বহন করে। প্রকৃত অর্থে কুরআন ও হাদীছের প্রতিটি শব্দ ও বাক্যই বিজ্ঞান বহন করে’।[10]
বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান :
বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় মুসলমানদের অবদান ছিল অসাধারণ ও চমকপ্রদ। বিজ্ঞানের এমন কোন অঙ্গন ছিলনা যেখানে মুসলমানরা বলিষ্ঠ ও সাবলীল পদচারণা ও অসাধারণ সাফল্যের স্বাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়নি। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মুসলমানরা দীর্ঘ এক হাযার বছর পর্যন্ত বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে। জর্জ সাটন যথার্থই উল্লেখ করেছেন, ‘সে যুগে মানবজাতির প্রধান কর্তব্য মুসলমানরাই সম্পাদন করে’। যারা বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানকে অস্বীকার করে তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, কয়েকটি মাত্র নাম উল্লেখ করে দিও। তাদের সকল প্রতিবাদ স্তব্ধ হয়ে যাবে। সকল সন্দেহের নিরসন ঘটবে। আর সেই নামগুলি হচ্ছে, জাবির ইবনু হাইয়ান আল-কিন্দি, আল-খাওয়ারিজমী, আল ফারাগানী, আল-রাযী, সাবিত ইবনু কুররা, আল-বাত্তানী, হুনাইন ইবনু ইসহাক, আল-ফারাবী ইব্রাহীম ইবনু সিনান, আল-মাসুদী, আত্ব-ত্বাবারী, আবুল ওয়াদা, আলী ইবনু আববাস, আবুল কাশেম, আল-বিরুনী, ইবনু সিনা, ইবনু ইউনুস, আল-কারখী, আল-হাইছাম, আলী ইবনু ঈসা, আল-গাজ্জালী, আয-যারকালী ও ওমর খৈয়াম। বিজ্ঞান গগনে এই অত্যুজ্জল জ্যোতিষ্ক সমূহের আবির্ভাব ঘটে মাত্র ৩৫০ বছরের পরিসরে। ৭৫০-১১০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে’।[11]
উইলিয়াম ড্রেপার (১৮১১-১৮৮২) স্বীয় Intelectual development of Europe গ্রন্থে বলেন, খুবই পরিতাপের বিষয় যে, পাশ্চাত্যের জ্ঞানীগণ বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদানকে ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাদের এ বিদ্বেষ বেশী দিন চাপা থাকেনি। নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আরবদের অবদান আকাশের নক্ষত্রের ন্যায় উজ্জ্বল’। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের জনক বলে পরিচিত রজার বেকন (১২১৪-১২৯৪) বলেন, তিনি আরব বিজ্ঞানীদের দ্বারা লাভবান হয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে, মুসলমানরাই আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃত’।[12]
মুসলিম বৈজ্ঞানিক উন্নয়নের ৩টি যুগ : (১) হিজরী ২য় শতাব্দীর শুরু থেকে ৩য় শতাব্দী পর্যন্ত। এই যুগে বাগদাদের বিজ্ঞানাগারে বিভিন্ন বিদেশী ও ইউনানী বিজ্ঞানের গ্রন্থ সমূহ অনুদিত হয়। মি. হাউড বলেন, সমস্ত ইউনানী বিদ্যার এক বিরাট অংশ যা আমাদের নিকট পৌঁছেছে, তার সবটুকুই আরবীয় মুসলমানদের অবদান। (২) হিজরী ৩য় শতাব্দী হ’তে ৪র্থ শতাব্দী পর্যন্ত। এই যুগে মুসলমানগণ গ্রীক, মিসর, ভারতবর্ষ ও পারস্যের বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞান আহরণ করে তার উপর গবেষণামূলক পর্যালোচনা শুরু করে।
(৩) হিজরী ৪র্থ শতাব্দী হ’তে। এই যুগে মুসলমানগণ আবিষ্কার কার্য শুরু করেন এবং বিজ্ঞানের নতুন নতুন শাখা সৃষ্টি করে আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই যুগে আবু বকর আল-রাযী (২৫০-৩১১ হি.) আবুল কাসেম আয-যাহরাবী (৩২৪-৪০০), ইবনুল হাইছাম (৩৫৪-৪৩০ হি.), আবু আলী ইবনু সীনা (৩৭০-৪২৮), ওমর খৈয়াম (৪৩৯-৫২৫ হি.) প্রমুখ বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়। এরপর থেকে মুসলমানগণ ক্রমে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেন। প্রখ্যাত ফরাসী বৈজ্ঞানিক মাঁসিয়ে সাদিও তার History of Arab গ্রন্থে বলেন, বাগদাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বর্তমান যুগে নতুন নতুন আবিষ্কারের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। সে সকল পদ্ধতি আগে থেকেই বাগদাদে ছিল’।[13]
স্টেনলি জর্জ মাকিন (১৮৯১-১৯৫২ খৃ.) History of science গ্রন্থে বলেন, খ্রিষ্টীয় ৯ম শতাব্দী ছিল মুসলমানদের গৌরবের যুগ।... সেই যুগের মুসলমানগণ সভ্যতা ও কষ্টের ধারক ও বাহক ছিলেন। কিমস্টন Medical science সম্পর্কে বলেন, ‘আরব বিজ্ঞানীগণ শুধু গ্রীক বিজ্ঞানকে জমা করে অনুবাদ করলেই তাদের গৌরবের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু তারা এছাড়াও সাহিত্য ও বিজ্ঞানের নতুন নতুন গ্রন্থাবলী রচনা করে স্মরণীয় কীর্তি সমূহ রেখে গিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ‘রজার বেকনের (১২১৪-১২৯৪ খৃ.) বহুপূর্ব থেকেই আরব বিজ্ঞানীগণ অনুসন্ধানী গবেষণা পদ্ধতি জানতেন’।[14]
আল কিন্দী একাধারে বারোটি স্বতন্ত্র বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার পরও ছয়টি ভাষাতে অসাধারণ বুৎপত্তি অর্জন করেন এবং প্রায় ২৬৫টি গ্রন্থ রচনা করেন। আল-রাযী প্রায় ২০০টি গ্রন্থ রচনা করেন। তাঁর ‘আল জুদারী ওয়াল হাসাবাহ’ নামক পুস্তকটি শুধু ইংরেজী ভাষাতেই চল্লিশবার মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। জ্ঞানার্জনে তার আগ্রহ তার নিম্নে বর্ণিত বক্তব্য হতেই বুঝা যায়, জ্ঞান সাধনায় আমার আদম্য উৎসাহের ফলেই মাত্র এক বছরে আমি কুড়ি হাযার পৃষ্ঠার মৌলিক রচনা লিখেছি। (প্রতিদিন প্রায় ষাট পৃষ্ঠা করে)। দিবা-রাত্র এমন কঠোর পরিশ্রম করেছি যে, শেষে আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। তবু আজও আমি অন্যকে দিয়ে বই পড়িয়ে-শুনিয়ে কিংবা আমার রচনা লেখাই’।[15]
আত্ব-ত্বাবারী জ্ঞানানুশীলনে তার জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি ক্রমাগত চল্লিশ বৎসর যাবৎ দৈনিক চল্লিশ পৃষ্ঠা করে মৌলিক রচনা লিখেছেন (প্রায় পাঁচ লক্ষ চুরাশি পৃষ্ঠা)। আল ফারাবী দশটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন এবং ৬টি স্বতন্ত্র বিষয়ে তার অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তিনি প্রায় ৭০টি বিরাট নোটবুকে দর্শন শাস্ত্রের সারাংশ লিপিবদ্ধ করেছিলেন। ফারাবী এরিস্টটলের আত্মা সম্বন্ধীয় গ্রন্থটি ১১৩ এবং পদার্থবিদ্যা বিষয়টি ৪০ বার পাঠ করেছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, প্রাচ্যের সুধী সমাজে এরিস্টটল মুয়াল্লিম আওয়াল বা ১ম শিক্ষক ও ফারাবী মুয়াল্লিম ছানী বা ২য় শিক্ষক হিসাবে পরিচিত’।[16]
উপসংহার : এক সময় আত্মোন্নয়নের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অমুসলিমরাও মুসলমানদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ত। আমরা সেই সময়ের কথা বলছি যখন ইউরোপে খৃষ্টানদের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরীটি ছিল রাণী ইসাবেলার। যাতে বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ২১০টি। অপরদিকে তৎকালীন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী কায়রোতে মুসলমানদের পাঠাগারে জমা ছিল ১০ লক্ষ বই। ঠিক সেই সময়ে অসভ্য ইউরোপে মুসলমানদের আবিষ্কার- ‘পৃথিবী গোল’ বলার অপরাধে মি. ব্রুণোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, গ্যালিলিওকে বিজ্ঞানের প্রচারের জন্য কারাগারে আটক করা হয়। অবশেষে অন্ধ, বধির হয়ে তিনি সেখানেই মারা যান। কাঁচ, ঘড়ি, বারূদ, মানচিত্র, ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা এমনকি আমেরিকার আবিষ্কর্তা মুসলমানরা। দুর্ভাগ্য আজ তারাই বিশ্বে সবচেয়ে পশ্চাদপদ জাতি হিসাবে পরিগণিত। কারণ একসময় পৃথিবীর শিক্ষক হলেও এখন তারাই সবচেয়ে কম লেখাপড়া করে।
সম্মানিত পাঠক, জ্ঞান-বিজ্ঞান গবেষণায় এবং প্রযুক্তির উন্নয়নে মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ফলেই বর্বর, অশিক্ষিত, অমার্জিত, মরুচারী বেদুঈনগণ মুসলমান হওয়ার পরপরই বিজ্ঞান চর্চা করে তৎকালীন বিজ্ঞান জগতের পুরোধায় পরিণত হয়। তারা উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ আসনে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে এবং পরবর্তী ৩৫০ বছর ধরে বিজ্ঞানের স্বর্ণ শিখরে আটুট থাকে’।[17] হে আল্লাহ আপনি আমাদেরকে পুনরায় আমাদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে পাওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন!
সাইফুর রহমান
[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, দিনাজপুর-পূর্ব সাংগঠনিক যেলা]
[1]. মুহাম্মাদ নুরুল আমীন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, (ঢাকা : প্রথম প্রকাশ জুন ২০০২), ৯ পৃ.।
[2]. মাসুদ মজুমদার, মাসিক রহমত ‘ইসলাম বিরোধী সভ্যতা-সংষ্কৃতির প্রভাব এবং আমরা’ (ঢাকা : মে ২০০৪), ১১ পৃ.।
[3]. ডা. মুরিস বুকাইলি, অনুবাদ ওসমান গনি, বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান (ঢাকা : আল-কোরআন একাডেমী ২য় মুদ্রণ মে ২০০১), ১৬ পৃ.।
[4]. আল-কুরআন ও প্রাণীবিজ্ঞান, ১৩ পৃ.।
[5]. মুহাম্মাদ রুহুল আমিন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান (ঢাকা : ৪র্থ প্রকাশ, ফেব্রুয়ারী ২০০৮), ১৭ পৃ.।
[6]. মুহাম্মাদ নুরুল আমীন, বিজ্ঞানে মুসলমানদের অবদান, (ঢাকা : প্রথম প্রকাশ জুন ২০০২) ০৯ পৃ.।
[7]. মুহাম্মাদ নাছের উদ্দীন, সাইন্টিফিক আল-কুরআন (ঢাকা : দারুস সালাম বাংলাদেশ ৩য় প্রকাশ ২০১৮) ১৬-১৭ পৃ.।
[8]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ নুরুল আমিন ও মুহাম্মাদ নাজিম, আল-কুরআন ও প্রাণবিজ্ঞান (ঢাকা : দারুস সালাম বাংলাদেশ ১ম প্রকাশ জুন ২০২৩) ১৪ পৃ.।
[9]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রস্তাবনা সমূহ (রাজশাহী : হাফাবা ১ম প্রকাশ ফেব্রুয়ারী ২০২২) ৬২ পৃ.।
[10]. প্রাগুক্ত।
[11]. সৈয়দ আশরাফ আলী, মাসিক ইতিহাস অন্বেষা ‘ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞানের জনক’ জুলাই ২০১১, ৪৩ পৃ.।
[12]. প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রস্তাবনাসমূহ ৬২-৬৩ পৃ.।
[13]. শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রস্তাবনাসমূহ ৬৩ পৃ.।
[14]. শিক্ষা ব্যবস্থা : প্রস্তাবনাসমূহ ৬৩-৬৪ পৃ.।
[15]. আহসান হাবীব ইমরোজ, মোরা বড় হতে চাই ৪ পৃ.।
[16]. আহসান হাবীব ইমরোজ, মোরা বড় হতে চাই ৪-৫ পৃ.।
[17]. প্রফেসর ড. আব্দুল জলিল, বিজ্ঞান তথ্য ও প্রযুক্তি (ঢাকা : ইফাবা ১ম প্রকাশ ২০১৬) ১৯ পৃ.।