জ্ঞান আবদ্ধ নয়, সবার জন্য উন্মুক্ত
মুহাম্মাদ আরীফুল ইসলাম
উপস্থাপনা : মাতৃভাষা বাংলায় আমরা সাবলীলভাবে কথা বলতে পারি, মনের ভাব পূর্ণভাবে প্রকাশ করতে পারি। আমরা অনেকেই মাতৃভাষার পাশাপাশি বিদেশী ভাষা শেখার ইচ্ছা পোষণ করি, প্রশংসার দাবিদার। অধিক ভাষা জানা থাকলে যোগাযোগ ও নতুন নতুন জ্ঞানার্জনে সহায়ক হয়। কিন্তু কোন বিদেশী ভাষার নাম শুনলেই অনেকের মধ্যে অজানা ভীতি কাজ করে। কেন এই ভীতি, তার উৎস আমাদের অজানা। বিদেশী ভাষা বাংলার মতোই আরেকটি ভাষা। মন দিয়ে শিখলে খুব একটা কঠিন নয়। প্রয়োজন হয় শুধু চর্চার। চর্চার অভাবেই বিদেশী ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠতে পারছেন না অনেকেই। তাই এই প্রবন্ধে বিদেশী ভাষা চর্চার কিছু পদ্ধতি আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
বিদেশী ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা : বিদেশী ভাষা বলতে মাতৃভাষার বাইরের সব ভাষা। জন্মের পর থেকে মায়ের মুখের ভাষাটাই হয়ে যায় আমাদের ভাষা। ওটাকেই অনেক বেশী আপন করে নেয় মানুষ। তাই একজন মানুষের প্রথম ভাষা হিসাবে ধরে নেওয়া হয় তার মাতৃভাষাকে। যা সে আপনাআপনি শিখে যায়। অন্যদিকে বিদেশী একটি নতুন ভাষা রপ্ত করা অনেক সময় ও সাধনার বিষয়। কিন্তু বিশ্বায়নের এ যুগে শুধু মাতৃভাষায় পারদর্শী কোনো ব্যক্তির ভিনদেশে ঘুরতে যাওয়ার মতো সাধারণ ব্যাপার থেকে শুরু করে পেশাগত জীবনে ভালো কিছু করা অনেক বেশী কঠিন। শুধু তাই নয়, একাধিক ভাষায় কথা বলতে পারলে নিজের মনের ভাব, চিন্তা, গবেষণা সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরা যায়। উচ্চশিক্ষার জন্য আমাদেরকে সাহায্য করে বাড়তি শিখে নেওয়া ভাষাগুলো। কারণ তখন বিভিন্ন ভাষার বই ও তথ্যভান্ডার থেকে ইচ্ছা মত জ্ঞান আহরণ করা যায়। এছাড়াও গবেষকদের দেয়া তথ্যানুযায়ী, একের অধিক ভাষায় কথা বলতে পারা মানুষগুলো অন্যদের চাইতে পাঁচ বছর দেরীতে স্মৃতিহীনতায় ভোগেন। সুতরাং মস্তিষ্ককে আরো বেশী সতেজ রাখতে, মনযোগী করে তুলতে এবং কর্মক্ষম রাখতেও ভাষা সাহায্য করে থাকে।
যে কোন ভাষায় দক্ষতা অর্জনের জন্য আমাদেরকে মূলত ৪টি বিষয়ে দক্ষ হ’ত হবে। আর তাহ’ল ১. শোনা ২. বলা ৩. পড়া ও ৪. লেখা। যার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপসমূহ নিম্নরূপ :
১. বর্ণমালা শেখা : প্রথমত যে কোনো ভাষা শেখার জন্য সেই ভাষার বর্ণগুলো কীভাবে যখাযথভাবে উচ্চারণ করতে হয় সেটা জানা দরকার। বর্ণগুলো উচ্চারণ করতে না পারলে আপনি শুদ্ধ উচ্চারণে কোনোকিছু পড়তে পারবেন না। বলার পরে সেটা লিখতেও পারবেন না। বর্তমান সময়ে বিদেশী ভাষা শেখার জন্য অনেক এ্যাপ, অডিও-ভিডিও টিউটরিয়াল পাওয়া যায়। যার মাধ্যমে খুব সহজে পসন্দের ভাষা শেখা সম্ভব।
২. শিশুর মতো শিখুন : আপনারা হয়তো শুনে থাকবেন, শিশুরা কেবল ভালো শিক্ষার্থীই নয়, তারা দ্রুত শিখতেও সক্ষম। কারণ, শিশুদের দৈনন্দিন কাজকর্মের ঝক্কি-ঝামেলা নিয়ে ভাবতে হয় না; সেকারণ তাদের মন সক্রিয় থাকে। হ্যাঁ, এটা সত্য। কারণ তারা শেখার প্রক্রিয়া উপভোগ করে এবং তারা ভুল করলে উপহাসের পাত্র হওয়ার ভয় করে না। বড়রা অবশ্য সেই ভয় কাটাতে পারে না। কেন? কারণ তারা এমনভাবে বিদেশী ভাষা শেখার চেষ্টা করে, যা আনন্দদায়ক নয়। অন্যদিকে শিশুদের ভাঙা কিংবা শুরু করার মতো এমন কোনও অভ্যাস থাকে না। তাহলে শিশুরা কীভাবে ভাষা শিখতে পারে? তারা মূলত দেখে ও শুনে শিখে থাকে। আপনার প্রাত্যহিক শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় এই পরিবর্তনটি আনতে হবে। অর্থাৎ নিয়মিত ঐ ভাষা শুনতে হবে এবং কিছু পড়তে হবে।
৩. শব্দ ভান্ডার শেখা : নতুন ভাষার নতুন শব্দ শেখা বেশ কঠিন বিষয়। বারবার দেখে, লিখে আর মুখস্থ করেও আয়ত্তে আনা যায় না। ‘মেমোরাইজ’ এর চিফ এক্সিকিউটিভ এড কুক বলেন, ভোকাবুলারী (শব্দভান্ডার) শেখার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হ’ল পরিস্থিতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো শেখা। অতঃপর পরিস্থিতি অনুযায়ী সেগুলো ব্যবহার করা। সরাসরি ব্যবহার সম্ভব না হ’লে অন্তত মনে মনে শব্দগুলো উচ্চারণ করুন।
৪. নতুন শব্দ শিখতে চিরকুট ও ফ্ল্যাশকার্ড : ধরুন, প্রতিদিন বাসা থেকে বের হওয়ার আগে ছোট্ট একটা চিরকুটে বা মোবাইল নোটে ১০টি শব্দ লিখে সঙ্গে নিয়ে বের হলেন। লক্ষ্য ঠিক করলেন, নতুন এই ১০টি শব্দ আপনি আয়ত্ত করবেন। পথে যেতে যেতেই মনে মনে শব্দগুলো ব্যবহার করে বাক্য গঠন করুন। সারা দিনের ক্লাস বা কাজ শেষে ফেরার পথে আবার ঝালাই করে দেখুন, শব্দগুলো আপনার মনে আছে কি না। একইভাবে নতুন ভাষা শেখার সময় একটি চিরকুট বা মোবাইল নোট/ফ্ল্যাশকার্ড সবসময় আপনার বন্ধু হবে। ভাষা শেখার সময় আপনি যে সমস্যাযুক্ত শব্দভান্ডারের মুখোমুখি হন তারই ফ্ল্যাশকার্ড তৈরী করুন। এতে আপনার শব্দভান্ডার সমৃদ্ধ হবে।
৫. বিদেশী ভাষার বই পড়ুন : প্রচুর বই পড়ুন। বইয়ে থাকা শব্দগুলো নদীর মতো প্রবাহিত হবে। এটি সহজ কাজ নয়। তাই গল্পের বই দিয়ে পড়া শুরু করুন। কারণ এটি আপনার পড়ার প্রতি আগ্রহ তৈরী করবে। প্রথম মাসে শুধু ছোট গল্প পড়ুন। শুধু পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য এমনটা করুন। আপনি যদি পরিবর্তন করতে চান তবে অবশ্যই কমফোর্ট জোনের বাইরে কিছু করতে হবে। সুতরাং সমস্ত অলসতা ঝেড়ে আজ থেকে শুরু করুন!
৬. সংবাদপত্র পাঠ করুন: বিশ্বাস করুন, যদি আপনি ধারাবাহিকভাবে সংবাদপত্র পড়েন তবে এটি আপনার জন্য বিদেশী ভাষা শিখতে অনেক কাজে দিবে। কেননা সংবাদপত্রে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া ঘটনা লেখা হয়। ফলে প্রয়োজনীয় কিছু শব্দ বারবার ব্যবহার হয়। ফলে সেগুলো আয়ত্ত হয়ে যায়। অল্প সময়ের ব্যবধানে আপনি নিজের মধ্যে পরিবর্তন দেখতে শুরু করবেন। শুরুতে কিছুটা পানসে মনে হ’তে পারে। কিছুই বুঝতে পারছেন না এমন মনে হতে পারে। তবে পড়তে শুরু করার কিছুদিন পরই পড়ার আনন্দ বুঝতে পারবেন। নতুন নতুন শব্দ তো শিখবেন, সাথে সাথে ভাষার নানা ব্যবহারও আয়ত্ত করতে পারবেন।
৭. শিশুদের বই পড়ুন : যে কোনো দেশের শিশুদের বইতে স্মারকলিপি বা অক্ষরগুলো সাধারণত সহজবোধ্যভাবে লেখা হয়। যারা ভাষা শিখতে সবে শুরু করেছেন, তাদের জন্য এটা বেশ কার্যকর উপায়। কেননা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে প্রধান সহায়ক হয় শিশুদের সাথে কথা বলা ও শিশু সাহিত্য। ভাষা শিখতে চাইলে শিশুদের সাথে আপনার বেশী কথা বলা উচিত। কারণ শিশুরা সব সময় সরল ও সহজ শব্দ ভান্ডার দিয়ে তাদের ভাব প্রকাশের বাক্যগুলো সাজায়। তাছাড়া শিশুদের জন্য লেখা সাহিত্য পাঠ করেও আপনি ভাষার শব্দ ও বাক্য গঠনের কৌশলগুলো রপ্ত করতে পারেন।
৮. লিখুন : যে ভাষা শিখতে চাচ্ছেন, সে ভাষায় প্রতিদিন অল্প পরিমাণ হলেও লিখুন। নিজের পরিচয়, কী করতে পসন্দ করেন, কী কী খেতে ভালোবাসেন, আজ কী কী কাজ করবেন ইত্যাদি বিভিন্ন ছোট ছোট বিষয়ে লিখুন। আবার বন্ধুদেরকে ইমেইল বা মেসেজ করতে ও চিঠি লিখতে পারেন। এতেও লেখার চর্চা হবে। আস্তে আস্তে লেখার পরিমাণ বৃদ্ধি করুন। বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ ও আর্টিকেল লেখার চেষ্টা করুন।
৯. জোরে বলার চেষ্টা করুন : নতুন একটি ভাষায় কথা বলা অনেক কঠিন। কেননা শুধু শিখলে হয় না শেখার সঙ্গে সঙ্গে সেটা ব্যবহারও করতে হয়। তাই প্রচুর চর্চা করতে হবে। আপনার যদি কোনো সঙ্গী না থাকে তাহলে যে ভাষা শিখতে চান, সে ভাষায় নিজেই জোরে জোরে নিজের সঙ্গে কথা বলুন। ভাষা শেখার সময় আপনাকে প্রতিটি বাক্য একেবারে ব্যাকরণের নিয়ম মেনেই বলতে এমনটি নয়। কেননা শিশুরা তাদের কথা শেখার সময় অধিকাংশ বিশেষ্য বা নাম শব্দ দিয়েই প্রকাশ করে। যা অভিভাবকরা খুব সহজেই বুঝতে পারে। যেমন তারা পানি বললে, তাদেরকে পানি খেতে দেওয়া হয়।
১০. অডিও বা ভিডিও রেকর্ড করুন : যে কোন একটি বিষয় নির্বাচন করুন এবং আপনার নোটবুকে সেই বিষয় সম্পর্কে লিখুন। তারপর আপনি যা লিখেছেন তা দিয়ে আপনার ভিডিও রেকর্ড করুন। বলার আগে ভাবুন। না বুঝেই কোন কথা বলবেন না। প্রথমে থেমে মনে মনে ভাবুন এবং তারপর কথা বলুন। আপনি যখন বলার আগে চিন্তা করবেন, তখন মনে মনে কথাগুলো গুছিয়ে নিতে পারবেন। কী বললে ভুল হবে এবং কী বললে ঠিক তা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন। এভাবে প্রথমদিকে এক মিনিট বলতেই হয়তো কষ্ট হবে। তবে চর্চা করতে করতে তিন চার মিনিট বক্তব্য দিতে পারবেন।
এরপর আপনার করা অডিও বা ভিডিও রেকর্ডটি ভালো করে অনুসন্ধান করুন। বলার ক্ষেত্রে আপনি কোথায় কোথায় ভুল করেছেন। আপনার ভুলগুলো বিশ্লেষণ করুন। প্রতিদিন এভাবে করুন। তাহ’লে আপনি নিজেই নিজের ভুল ধরতে পারবেন এবং বুঝতে পারবেন কোথায় কোথায় আপনার আরো উন্নতি করতে হবে। এভাবে চর্চা করতে করতে দেখবেন আপনার নতুন শেখা ভাষায় বেশ সুন্দর ও সাবলীলভাবে আপনার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন। এটি আপনার আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে তুলবে। এই চর্চার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে যে কোন বিদেশী ভাষা রপ্ত করা সম্ভব।
১১. অনুবাদকে অবহেলা নয় : ভাষার নানা স্তরে নানা পদ্ধতি কার্যকর হয়ে ওঠে। কিছু পর্যায়ে খুব মনোযোগের সঙ্গে শিখতে হয়, আবার কিছু অংশ মোটামুটি সহজেই শিখে ফেলা যায়। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটির জার্মান ভাষা বিষয়ক শিক্ষক রেবেকা ব্রাউন বলেন, ভাষা শেখার যে কোন স্তরে যে কোন সমস্যা জয়ের মোক্ষম উপায়টি হ’ল অনুবাদ। তাই অনুবাদ করে নতুন শব্দ ও ভাষার অর্থ বুঝে বুঝে এগোতে থাকুন।
১২. বাকপটুতায় ধ্যান দিন : নতুন যে ভাষাটি শিখছেন তা হড়হড় করে না বলতে পারলেও অন্তত টানা বলে যেতে হবে। তাই আপনার বাকপটুতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। এ জন্য আপনাকে নিয়মিত চর্চা চালিয়ে যেতে হবে। অনেকে সব কিছু খুব দ্রুত শিখে ফেলতে চান। কিন্তু ভাষা এমন এক বিষয় যা শিখতে হবে সময় দিয়ে। কোন বিষয় না বোঝা পর্যন্ত তাতে সময় দিতে থাকুন। উচ্চারণে সহজ না হওয়া কথা বলতেই থাকুন।
১৩. ভাষাভাষিদের সঙ্গে থাকুন : যে ভাষা শিখছেন তা যাদের মাতৃভাষা অথবা যারা এ ভাষায় কথা বলতে পটু, তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। তাদের সাথে ঐ ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করুন। এই উপায়ে আপনার দক্ষতা ব্যাপক বেড়ে যাবে।
১৪. প্রযুক্তির সাহায্য গ্রহণ করুন : বর্তমানে আমরা প্রায় সবাই মোবাইল, ফোন, ল্যাপটপ ও কম্পিউটার ব্যবহার করে থাকি। আপনার ভাষা শেখার কাজে এসব প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। আপনি হয়তো ইংরেজী ভাষা শিখতে চান, তাহলে আপনি আপনার ফোনের লেখার সেটিংস ইংরেজী করে রাখুন কিংবা মোবাইল বা কম্পিউটারের ভাষাই ইংরেজী করে রাখুন। এতে প্রতিদিন আপনি যত সময় কম্পিউটার বা মোবাইল ব্যবহার করবেন, তত সময় আপনার ইংরেজী ভাষা চর্চা হবে। এভাবে যে ভাষা শিখতে চান, কম্পিউটার ও মোবাইল সে ভাষায় রূপান্তর করে রাখুন। এতে প্রযুক্তি ব্যবহার করে একদিকে আপনার প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করা হবে এবং পাশাপাশি আপনার ভাষা শেখার অনুশীলন করাও হয়ে যাবে।
১৫. সংস্কৃতিকে ধারণ করুন : বহু ভাষায় কথা বলতে পারা মানুষদের মতে, প্রত্যেকটি ভাষারই রয়েছে নিজস্ব একটা আচরণবিধি। কোনটা অনেক বেশী আন্তরিক, কোনটা তা নয়। আর তাই প্রত্যেকটি ভাষা কেবল কিছু অক্ষর বা শব্দ নয়, তুলে ধরে নতুন একটা সংস্কৃতি, নতুন মূল্যবোধ আর ভাবনা। অনেকে নতুন কোন ভাষা শিখতে গিয়ে এই ভিন্নতাটা আমলে নেন না। ফলে শেখার প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। তাই কোন ভাষা শেখার সময় এর ব্যবহার সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকুন। অন্য কোন ভাষার সঙ্গে একদমই যেন মিশে না যায় সেটা খেয়াল রাখুন। সেই সঙ্গে ভাষাগুলো কেবল পড়ে বা শুনে রপ্ত করার চেষ্টা না করে বাস্তব অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শেখার চেষ্টা করুন। মস্তিষ্ককে ভাষাটি শেখার কিছু স্মৃতি সংগ্রহের সুযোগ দিন। এতে করে খুব দ্রুত রপ্ত করতে পারেন ভাষাটি। সেই সঙ্গে সেটি বলার সময় মস্তিষ্কের কোণে জমে থাকা স্মৃতিগুলো আপনাকে সাহায্য করবে আরো ভালোভাবে, মাতৃভাষার মতো করে ভাষাটিকে প্রকাশ করতে।
১৬. মাতৃভাষাকে আলাদা রাখুন : মাতৃভাষা সবসময়ই আমাদের হৃদয়ের অনেক বেশী কাছের। অনেকে চান খুব তাড়াতাড়ি যেন অন্য ভাষাটিকেও মাতৃভাষার মতো করে বলতে পারা যায়। তবে সত্যিটা হচ্ছে এই যে, আপনি যত চেষ্টাই করুন না কেন, মাতৃভাষায় যেভাবে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারবেন অন্য কোন ভাষাতেই সেটা পারবেন না। রাশিয়ান লেখক ভ্লাডিমির নাবোকোভ নিজের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রথমে ইংরেজীকে ভাষা হিসাবে বেছে নেন। পরবর্তীতে রাশান ভাষায় সেটাকে অনুবাদ করতে গিয়ে তিনি টের পান আরো অনেক কিছু বলার আছে তার, যেটা কিনা কেবল তার ভাষাতেই বলা সম্ভব। বিদেশী ভাষায় নয়। শেষ পর্যন্ত নতুন করেই একটা বই লিখে ফেলেন তিনি রাশান ভাষায় আর অনুবাদ করেন বিদেশী ভাষায়।
তাই বলে নতুন ভাষাকে রপ্ত করা ছেড়ে দিবেন সেটা নয়। চেষ্টা করুন মাতৃভাষাকে আলাদা করে রাখতে। যে ভাষাতে কথা বলছেন সেটার নিজস্ব সুরকে অনুসরণ করুন। লজ্জা পাবেন না। হয়তো আপনার নিজের কানে সেটা শুনতে প্রথমটায় একটু অদ্ভুত আর হাস্যকর শোনাবে। তবে মনে রাখবেন, আপনি যেটা হাস্যকর ভাবছেন, সামনের মানুষগুলোর কাছে সেটাই কিন্তু আসল উচ্চারণভঙ্গী।
১৭. প্রতিদিন অনুশীলন করুন : নতুন ভাষাটিতে দক্ষ হ’তে হলে আপনাকে প্রতিদিন অনুশীলন করতে হবে। একদিন অনেকক্ষণ অনুশীলন করে এক সপ্তাহ কিছু না করার চেয়ে প্রতিদিন ১০ মিনিট অনুশীলন করা শ্রেয়। অনুশীলনটি করবেন নতুন শেখা শব্দ, বাক্য আপনার প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহারের মাধ্যমে। যত অনুশীলন করবেন তত দ্রুত ভাষাটি আয়ত্ত করতে পারবেন। এজন্যই বলা হয় Practice makes a man perfect ‘অনুশীলন একটি মানুষকে নিখুঁত করে তোলে’. এক্ষেত্রে যদি আপনি অনুশীলনের কোনো সঙ্গী পেয়ে যান, তাহলে আপনার ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমে যাবে অনেকাংশে। নাহ’লে আপনার উচিত হবে নিজের সাথে নিজেই অনুশীলন করা। প্রথমে শুধু ৫০ টি নতুন শব্দ শিখে নিন এবং দৈনন্দিন জীবনে তাদের ব্যবহার শুরু করুন। তারপর ব্যাকরণ ও অন্যান্য বিষয়াদি। তাহ’লে তা আপনার জন্য যেমন কষ্টকর হবে না, তেমনি আবার একঘেয়েমিও হবে না। ঠিক Slow and Steady Wins the Race ‘ধীরগতি এবং দৃঢ়রাই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়’ প্রবাদটির মতো।
টেম্পল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাভেলনকো বলেন, কোন একটি ব্যাপার যদি আমাদের ভাষা শেখার পথে বাঁধা সৃষ্টি করে সেটা হচ্ছে স্থানীয়দের মতো করে দ্রুত বলতে চাওয়ার ইচ্ছা। আপনি অবশ্যই পারবেন স্থানীয়দের মতো স্বতস্ফূর্তভাবে নতুন ভাষাটিতে কথা বলতে। কিন্তু তার জন্য দরকার অনুশীলনের। আরেক বহুভাষাবিদ অ্যালেক্স রওলিং-এর মতে, প্রতিদিন অন্তত ১৫ মিনিট করে দিনে চারবার ভাষাটিকে অনুশীলন করা উচিত। কে না জানে, অনুশীলনের চাইতে ভালো এক্ষেত্রে আর কিছু হতেই পারে না!
১৮. আয়নার সামনে অনুশীলন করুন : বেশীরভাগ মানুষই নিজেকে এড়িয়ে চলে, নিজের মুখোমুখি হ’তে ভয় পায়। এ ধরনের মানুষের ক্যামেরা ভীতিও থাকে প্রবল। তাই আত্মবিশ্বাস বাড়াতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলুন। আপনি কীভাবে উচ্চারণ করছেন, আপনার অঙ্গভঙ্গি, হাসি ও শারীরিক ভাষাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। নিজেকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে শিখুন। শুদ্ধভাবে ইংরেজী বলতে ও বুঝতে পারা অন্যতম যোগ্যতা। এটি রপ্ত করার চেষ্টা করুন।
১৯. ভুলগুলো মেনে নেওয়া : নতুন ভাষা শিখতে গেলে প্রথম দিকে আপনার অনেক ভুল হবে। সেই ভুল উচ্চারণ থেকে শুরু করে বানান সবক্ষেত্রেই হ’তে পারে। সেই ভুলগুলোতে ভেঙ্গে পড়লে বা লজ্জায় অনুশীলন থামিয়ে দিলে চলবে না। বরং আপনাকে ভুলগুলো শুধরিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে কাজ চালিয়ে যেতে হবে। একটি নতুন ভাষা শেখা যতটা কষ্টসাধ্য, সেই ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা ততটাই আনন্দের।
২০. শেখার ক্ষেত্রে নতুনত্ব আনুন : আপনি যা শিখছেন, নিত্য নতুন উপায়ে তা ব্যবহার করার চেষ্টা করুন। যমজ দুই ভাই কম্পিউটারে, অ্যাপে বা বই পড়ে তুর্কি ভাষা শেখার পাশাপাশি তুর্কি রেডিয়ো স্টেশন, তুর্কি ভাষায় খেলার ধারাভাষ্য শোনা এগুলো নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করতেন। এর ফলে ভাষার রকমারি ব্যবহার তাঁদের বোধগম্য হতে শুরু করে। কোন ভাষা শেখার বিশেষ কোন পদ্ধতি নেই। কোন শিক্ষকও আপনাকে কোন ভাষা গুলে খাইয়ে দিতে পারবেন না। কোন বিদেশী ভাষা জানা, বলা, পড়া ও লেখার জন্য চাই একাগ্রতা ও অনুশীলন। সেই অনুশীলনের জন্য নিত্য নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করুন। আর যান্ত্রিক সহযোগিতা পেতে অবশ্যই ইন্টারনেটের সুবিধা নিন। প্রায় প্রত্যেকের কাছে এটি সহজলভ্য হলেও, আমাদের বেশীরভাগই বিনোদনের জন্য নেটের ব্যবহার করে থাকেন। এর শিক্ষণীয় দিকটিও যে অপরিসীম, সেদিকে নযর দেন না।
২১. ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ নিন : নিজের টার্গেট পূরণের ক্ষেত্রে একটা দৃষ্টান্ত বা মোটিভেশন খুব যরূরী। ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেও এটা করা যেতে পারে। যমজ দুই ভাই-ও গোটা সপ্তাহ ধরে প্রচুর ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ নিতেন। প্রথম দিন একজন টার্কিশ বন্ধুকে বাড়িতে ডেকে তাঁর ভাষাতেই তাঁকে আপ্যায়নের চেষ্টা করেন তাঁরা। এরপর একে একে ফল ও সংখ্যার তুর্কি প্রতিশব্দ শিখে তুরস্কের বাজারে গিয়ে কেনাকাটা করার চেষ্টা করেন। আপনিও এধরনের চ্যালেঞ্জ নিন।
২২. অবসরকে কাজে লাগান : অবসরে কী করতে ভালোবাসেন আপনি? বই পড়তে, আড্ডা দিতে কিংবা ঘুরতে যেতে? তাহলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সিইও ডেভিড বেইলির ফ্রেঞ্চ ভাষা শেখার পদ্ধতিটি কাজে লাগতে পারে আপনার। ডেভিড সেবার ছুটিতে ১৭ দিনের জন্য ফ্রেঞ্চ বন্ধুর সঙ্গে তার গ্রামে বেড়াতে যান। সঙ্গে নিয়ে যান ফ্রেঞ্চ গল্পের কিছু বই। এরপর? টানা ১৭ দিন ফ্রেঞ্চ ভাষার বই পড়ে সেখানকার দৈনন্দিন জীবন যাপন করে বেশ ভালোভাবে ভাষাটিকে আয়ত্তে এনে ফেলেন। কী ভাবছেন? সামনের ছুটিতে কী পরিকল্পনা করছেন তাহলে?
২৩. আত্মবিশ্বাস রাখুন : এতকিছুর কোনটাই কোন কাজে আসবে না যদি না আপনি বিশ্বাস করেন যে আপনি পারবেন। আর তাই নিজের ওপর আস্থা রাখুন। ভাবছেন বয়স বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে? একদমই না! সম্প্রতি হাইফা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বয়স্করা ভাষা সংক্রান্ত নিয়মের ক্ষেত্রে ছোটদের চাইতে অনেক বেশী ভালো বোঝেন। এছাড়া একটা ধারণা থাকলেও পুরোপুরিভাবে কেউ এখনো সরাসরি বয়স বাড়ার সঙ্গে ভাষা শেখার ক্ষমতা কমে যাওয়ার সম্পর্ক দেখাতে পারেনি। সুতরাং, নিজেকে বলুন, আমি পারব। আর এগিয়ে যান নতুন ভাষার জগতে খুব সহজেই।
শেষ কথা : কথায় আছে, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। অন্তত ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে এটি পুরোপুরি সত্য। উপরে উল্লিখিত পদ্ধতিগুলো আপনার কতটা কাজে আসবে তা নির্ভর করে আপনি ভাষাটি শিখতে কতটা আগ্রহী তার উপর। আপনার প্রবল আগ্রহ থাকলে আপনি নিজেই নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারবেন। আপনার ইচ্ছাশক্তি ও চর্চার উপরেই নির্ভর করে আপনি কত দ্রুত ও ভালোভাবে ভাষাটি রপ্ত করতে পারবেন। মনে রাখবেন চেক প্রবাদটি- Those who know many languages live as many lives as the languages they know.
ওমর ফারুক
[লেখক : শিক্ষার্থী, ৩য় বর্ষ, সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনিস্টিটিউট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]