মুহাম্মাদ মুখতার বিন আল-আমীন আশ-শানক্বীতী
ফরীদুল ইসলাম
[ড. ভি আব্দুর রহীম একজন ইন্ডিয়ান ভাষাবিদ ও গবেষক। কর্মজীবনের শুরুতে তিনি সুদানের উম্মে দুরমান ইসলামিক ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯ সালে তিনি মদিনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা বিভাগের শিক্ষক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি আরবী ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এছাড়া ১৯৯৫ সাল থেকে মৃত্যু অবধি তিনি মদীনার বিখ্যাত কুরআন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান কিং ফাহাদ কমপ্লেক্সের অনুবাদ বিভাগের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আরবী, ইংরেজী, উর্দু, ফার্সীসহ প্রায় ১৪টি ভাষার পন্ডিত ছিলেন। তিনি আরবী, ইংরেজীসহ কয়েকটি ভাষায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত দুরূসুল লুগাতিল আরাবিয়াহ ও মদীনা আরবী রিডার বই দু’টি সারা বিশ্বের আরবী ভাষার শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। আরবী ভাষা ও অনুবাদ সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৬ সালে তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন।]
জন্ম ও পরিচয় : ড. ভি. আব্দুর রহীম ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের ভানিয়ামাবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। সেকারণ তাঁর নামের শুরুতে জন্মস্থানের প্রথম অক্ষর ভি লেখা হয়। ইংরেজী ও আরবীতে একে ফানিয়ামাবাদী বলা হয়। ফলে তিনি এই দুই ভাষায় নিজের নাম লিখতেন ড. এফ. আব্দুর রহীম।
শিক্ষা জীবন : শায়খ আব্দুর রহীম নিজ গ্রামের মক্তবে কুরআন ও অন্যান্য প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তারপর তিনি ফানিয়ামাবাদি শহরের মুহাম্মাদিয়াহ এডুকেশনাল অ্যাসোসিয়েশনের সাথে অধিভুক্ত ইসলামিক স্কুলে শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তর অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে আরবী ভাষা বেছে নেন এবং পুরোপুরি নিজের তত্ত্বাবধানে তা পড়েন। তবে মুখস্থনির্ভর এমন ভাষা শেখার পদ্ধতি তাঁর পছন্দ ছিল না। ফলে নিজ ভাষাজ্ঞানকে শক্তিশালী করার জন্য তিনি কায়রো থেকে প্রচারিত নিদাউল-ইসলাম এবং মক্কা থেকে প্রচারিত ভয়েস অফ দ্য আরব রেডিও অনুসরণ করতেন। তখন থেকেই তিনি ভাষা শেখার আধুনিক পদ্ধতি নিয়ে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করেন।
ড. ভি আব্দুর রহীম ১৯৫৭ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৬১ সালে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী শিক্ষা ও আরবী ভাষা বিষয়ে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। এসময় তিনি আরবী ভাষা বিভাগের শ্রেষ্ঠ ছাত্র নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পুনরায় আরবী ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
আরব দেশগুলোতে উচ্চতর পড়াশোনার ইচ্ছা তাঁর মনে প্রবলভাবে জেঁকে বসে। ফলে তিনি মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জামাল আবদেল নাসেরকে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য একটি চিঠি লিখেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ পরে, তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হোসাইন আশ-শাফীর কাছ থেকে একটি চিঠি পান। যেখানে লেখা ছিল-আমি তাকে তার অনুমোদনের কথা জানাচ্ছি এবং তাকে ভিসা পাওয়ার জন্য নয়াদিল্লিতে মিশরীয় দূতাবাসে যাওয়ার নির্দেশ দিচ্ছি। অতঃপর ১৯৬৪ সালে তিনি মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৬ সালে আরবীয় ফার্সী শব্দ (অর্থাৎ ফার্সী ভাষায় ব্যবহৃত আরবী শব্দ) বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী নেন।
১৯৭৩ সালে তিনি আরবী ভাষা অনুষদের তৎকালীন ডীন ড. ইব্রাহীম আবু নাজার তত্ত্বাবধানে আরবী ভাষার উৎপত্তি বিষয়ে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। তাঁর থিসিসের শিরোনাম ছিল ইমাম আবুল মানছূর আজ-জাওয়ালীকীর গ্রন্থে আরবী শব্দসমূহ। তিনি সেখানে অভিধানের অক্ষর বিন্যাস অনুসারে অনারবীয় বাক্যে আরবী শব্দসমূহের প্রয়োগ বিশ্লেষণ করেন। তিনি ১৪টি প্রাচ্য এবং আন্তর্জাতিক ভাষাসহ প্রচুর সংখ্যক ভাষা এবং উপভাষা আয়ত্ত করেছিলেন। তার মধ্যে আরবী, ইংরেজী, উর্দু, ফার্সী, হিন্দী, তামিল, ফার্সী, জার্মান, গ্রীক, তুর্কী, হিব্রু, আরামাইক (সিরিয়ান), সংস্কৃত, এবং এস্পেরান্তো উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে আরবী, ইংরেজী ও উর্দু ভাষায় তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন।
কর্মজীবন : ড. ভি. আব্দুর রহীমের কর্মজীবন ছিল শিক্ষা জীবনের ন্যায় বর্ণাঢ্য। মিশরে যাওয়ার পূর্বে তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে আরবী ও ইংরেজী ভাষার প্রভাষক হিসাবে প্রায় এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের পর তিনি সুদানের উম্মে দুরমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগদান করেন। অতঃপর ১৯৬৯ সালে তিনি মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ভাষা বিভাগের শিক্ষক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি আরবী ভাষা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানে দীর্ঘ ২৬ বছরের শিক্ষকতা জীবনে তিনি মাস্টার্স, পিএইচডিসহ আরবী ভাষা সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে পাঠদান করতেন। আরবী ভাষা শিক্ষার প্রসারে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডা, পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের নানা দেশে তিনি আরবী ভাষা কোর্সের দায়িত্ব পালন করেন। বিশেষতঃ জার্মানীতে তিনি প্রায় ১০ বছর অবস্থান করেন। এছাড়া তিনি ইন্দোনেশিয়ায় রিয়াদের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাঊদ ইসলামিক ইউনিভার্সিটির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত আরবী ভাষা ইনস্টিটিউট পরিচালনা পরিষদের সদস্য ছিলেন।
১৯৯৫ সালে ড. ভি. আব্দুর রহীম মদীনার বিখ্যাত কুরআন মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান কিং ফাহাদ কমপ্লেক্সের অনুবাদ বিভাগের প্রধান হিসাবে নিযুক্ত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে এই কমপ্লেক্স থেকে বিশ্বের ৭৭টির অধিক ভাষায় কুরআনের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৯৬ সালে আরবী ভাষায় অসামান্য অবদানের জন্য তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার লাভ করেন।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য আরবী গ্রন্থসমূহ :
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য ইংরেজী গ্রন্থসমূহ :
অনারবদের আরবী শিক্ষার জন্য তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ : (১) দুরূসুল লুগাতিল আরাবিইয়াহ লিগাইরিন নাত্বিকীনা বিহা (আরবী ভাষায় ৩ খন্ড)। (২) মিফতাহু দুরূসিল লুগাতিল আরাবিইয়াহ লিগাইরিন নাত্বিকীনা বিহা (ইংরেজী ভাষায় ৩ খন্ড)। (৩) মুজামুল কালিমাতিল ওয়ারিদাহ ফী দুরূসিল লুগাতিল আরাবিইয়াহ লিগাইরিন নাত্বিকীনা বিহা।
মৃত্যু : ড. ভি. আব্দুর রহীম ২০২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে অক্টোবর বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন জুমআর পর মসজিদে নববীতে তাঁর জানাযা হয় এবং বাকী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাঊস দান করুন।-আমীন!