আল-কুরআনুল কারীম :
1- قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا- وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا- وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا-
(১) ‘তুমি বলে দাও (হে অবিশ্বাসীগণ!), তোমরা কুরআনে বিশ্বাস আনো বা না আনো (এটি নিশ্চিতভাবে সত্য)। যাদেরকে ইতিপূর্বে জ্ঞান দান করা হয়েছে (আহলে কিতাবের সৎ আলেমগণ), যখন তাদের উপর এটি পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে। আর তারা বলে, মহাপবিত্র আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকরী হয়। আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয়চিত্ততা আরও বৃদ্ধি পায়’(বনু ইস্রাঈল ১৭/১০৭-১০৯)।
2- أُولَئِكَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ مِنْ ذُرِّيَّةِ آدَمَ وَمِمَّنْ حَمَلْنَا مَعَ نُوحٍ وَمِنْ ذُرِّيَّةِ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْرَائِيلَ وَمِمَّنْ هَدَيْنَا وَاجْتَبَيْنَا إِذَا تُتْلَى عَلَيْهِمْ آيَاتُ الرَّحْمَنِ خَرُّوا سُجَّدًا وَبُكِيًّا -
(২) ‘এরাই হ’ল তারা যাদের উপর আল্লাহ অনুগৃহ করেছেন নবীগণের মধ্যে। যারা আদমের বংশধর এবং যাদেরকে আমরা নূহের সাথে নৌকায় আরোহণ করিয়েছিলাম তাদের বংশধর। তারা ইবরাহীম ও ইস্রাঈল (ইয়াকূব)-এর বংশধর এবং যাদেরকে আমরা সুপথ প্রদর্শন করেছিলাম ও মনোনীত করেছিলাম তাদের বংশধর। যখন তাদের নিকট দয়াময়ের (আল্লাহর) আয়াত সমূহ তেলাওয়াত করা হ’ত, তখন তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ত ক্রন্দনরত অবস্থায়’(মারিয়াম ১৯/৫৮)।
3- وَأَنَّ إِلَى رَبِّكَ الْمُنْتَهَى- وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَأَبْكَى- وَأَنَّهُ هُوَ أَمَاتَ وَأَحْيَا-
(৩) ‘আর নিশ্চয় তোমার রবের নিকটই হলো শেষ গন্তব্য। আর নিশ্চয় তিনিই হাসান এবং তিনিই কাঁদান। আর নিশ্চয় তিনিই মৃত্যু দেন এবং তিনিই জীবন দেন’ (নাজম ৫৩/৪২-৪৪)।
4- فَلْيَضْحَكُوا قَلِيلًا وَلْيَبْكُوا كَثِيرًا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونََ-وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ-
(৪) ‘অতএব (দুনিয়ায়) তারা কিছুদিন হেসে নিক। আর অধিক হারে কাঁদুক (জাহান্নামে) তাদের কৃতকর্মের বদলা স্বরূপ। আর ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাবো। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হতে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তওবা ৯/৮২, ৯২) ।
5- وَإِذَا سَمِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَى الرَّسُولِ تَرَى أَعْيُنَهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ مِمَّا عَرَفُوا مِنَ الْحَقِّ يَقُولُونَ رَبَّنَا آمَنَّا فَاكْتُبْنَا مَعَ الشَّاهِدِينَ-
(৫) ‘আর যখন তারা শোনে যা রাসূলের প্রতি নাযিল হয়েছে (অর্থাৎ কুরআন), তখন তুমি তাদের চক্ষুগুলিকে দেখবে অবিরল ধারায় অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে; এ কারণে যে, তারা সত্যকে চিনে নিয়েছে। তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা ঈমান এনেছি। অতএব তুমি আমাদেরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করে নাও’(মায়েদাহ ৫/৮৩)।
হাদীছে নববী :
6- َعَنْ عُثْمَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّهُ كَانَ إِذَا وَقَفَ عَلَى قَبْرٍ بَكَى حَتَّى يَبُلَّ لِحْيَتَهُ، فَقِيلَ لَهُ: تُذْكَرُ الْجَنَّةُ وَالنَّارُ فَلَا تَبْكِي، وَتَبْكِي مِنْ هَذَا؟ فَقَالَ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ:إِنَّ الْقَبْرَ أَوَّلُ مَنْزِلٍ مِنْ مَنَازِلِ الْآخِرَةِ، فَإِنْ نَجَا مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَيْسَرُ مِنْهُ، وَإِنْ لَمْ يَنْجُ مِنْهُ فَمَا بَعْدَهُ أَشَدُّ مِنْهُ.قَالَ: وَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا رَأَيْتُ مَنْظَرًا قَطُّ إِلَّا وَالْقَبْرُ أَفْظَعُ مِنْهُ-
(৬) ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোন কবরের নিকটে দাঁড়াতেন, তখন কেঁদে ফেলতেন, যাতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদেন না, অথচ কবর দেখলে কাঁদেন। উত্তরে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আখেরাতের মনযিলসমূহের মধ্যে প্রথম মনযিল হচ্ছে ‘কবর’। যদি কেউ এখানে মুক্তি পায়, তাহ’লে পরবর্তী মনযিলগুলি তার জন্য অধিকতর সহজ হয়ে যায়। আর যদি এখানে মুক্তি না পায়, তাহ’লে পরের মনযিলগুলি আরও কঠিন হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘আমি এমন কোন দৃশ্য কখনই দেখিনি যে, কবর সেগুলির চেয়ে অধিক ভীতিকর নয়’।[1]
7- وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَلِجُ النَّارَ مَنْ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ حَتَّى يَعُودَ اللَّبَنُ فِي الضَّرْعِ، وَلَا يَجْتَمِعَ عَلَى عَبْدٍ غُبَارٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ. رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ. وَزَادَ النَّسَائِيُّ فِي أُخْرَى: (فِي مَنْخِرَيْ مُسْلِمٍ أَبَدًا. وَفِي أُخْرَى:فِي جَوْفِ عَبْدٍ أَبَدًا، وَلَا يَجْتَمِعُ الشُّحُّ وَالْإِيمَانُ فِي قَلْبِ عَبْدٍ أَبَدًا-
(৭) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন আল্লাহর (আযাবের) ভয়ে রোদনকারী জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে না, যে পর্যন্ত দোহনকৃত দুগ্ধ পালানে পুনরায় ঢুকিয়া না যায়। (অর্থাৎ, দোহনকুত দুধ পুনরায় পালানের মধ্যে ঢুকান যেমন অসম্ভব, আল্লাহর ভয়ে রোদনকারী জাহান্নামে যাওয়াও অসম্ভব) আর আল্লাহর রাস্তায় লাগা ধুলা বালি ও জাহান্নামের ধোঁয়া কোন এক বান্দার মধ্যে একত্র হতে পারে না (অর্থাৎ মুজাহিদ জাহান্নামের প্রবেশ করবে না)। অপর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাস্তায় ধুলা বালি ও জাহান্নামের ধোঁয়া কোন মুসলমানের নাকের ছিদ্রের মধ্যে কখনও একত্র হবে না। অন্য বর্ণনায় আছে, (ঐ দু’টি জিনিস) কোন এক বান্দার অভ্যন্তরে কখনও একত্র হতে পারে না। অনুরূপভাবে কৃপণতা ও ঈমান কোন এক বান্দার অন্তরের মধ্যে কখনও একত্র হতে পারে না’।[2]
8- عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ عَيْنَانِ لاَ تَمَسُّهُمَا النَّارُ عَيْنٌ بَكَتْ مِنْ خَشْيَةِ اللَّهِ وَعَيْنٌ بَاتَتْ تَحْرُسُ فِى سَبِيلِ اللَّهِ.
(৮) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি জাহান্নামের আগুন দু’টি চোখকে স্পর্শ করবে না। এক- যে চক্ষু আল্লাহর ভয়ে কাঁদে এবং দুই- আল্লাহর পথে যে চোখ পাহারা দিয়ে বিনিদ্র রাত অতিবাহিত করে’।[3]
9- عَنْ أَنَسٍ رضى الله عنه قَالَ خَطَبَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم خُطْبَةً مَا سَمِعْتُ مِثْلَهَا قَطُّ، قَالَ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا. قَالَ فَغَطَّى أَصْحَابُ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وُجُوهَهُمْ لَهُمْ خَنِينٌ-
(৯) আনাস (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এমন একটি খুতবা দিলেন যেমনটি আমি আর কখনো শুনিনি। তিনি বলেছেন, আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তবে তোমরা হাসতে খুব কমই এবং অধিক অধিক কাঁদতে। তিনি বলেন, ছাহাবায়ে কিরাম (রাঃ) নিজ নিজ চেহারা আবৃত করে গুনগুন করে কাঁদতে শুরু করলেন’।[4]
মনীষীদের বক্তব্য :
১. ইমাম বাগাবী (রহঃ) বলেন, আবু হুরায়রা (রাঃ) অসুস্থাবস্থায় কাঁদলেন। তাঁকে তাঁর কাঁদার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি এই দুনিয়ার জন্য ক্রন্দন করছিনা। বরং আমি আমার মৃত্যু পরবর্তী সফরের যৎসামান্য ‘পাথেয়’-এর ভয়ে কাঁদছি। নিশ্চয়ই আমি জান্নাত বা জাহান্নামের কঠিন পথ (অতিক্রমের দুঃশ্চিন্তায়) সন্ধ্যা করি। আমি জানি না, আমাকে এতদুভয়ের (জান্নাত বা জাহান্নামের) কোথায় নেওয়া হবে?[5]
২. হাফছ বিন উমর (রাঃ) বলেন, হাসান (রাঃ) কাঁদলেন। বলা হলো আপনাকে কিসে কাঁদালো। তিনি বললেন, আগামী কালকেই আমাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে, তাতে কোন পরোয়া করা হবে না- এই ভয়ে আমি ক্রন্দন করছি’।[6]
৩. ক্বাসেম বিন আব্দুর রহমান বলেন, এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ)-কে বললেন, হে আব্দুর রহমানের পিতা! আমাকে অছীয়ত করুন। তিনি বললেন, বাড়িতে অবস্থান কর, তোমার পাপকে স্বরণ করে ক্রন্দন কর ও তোমার জিহবাকে সংযত রাখ’।[7]
৪. হাসান (রাঃ) সূরা নাজমের নিম্নোক্ত আয়াতটি পড়লেন। ‘তোমরা কি এ কথায় বিস্ময় বোধ করছ? আর হাসছ এবং কাঁদছ না?’ (৫৩/৫৯-৬০)। সবচেয়ে বুদ্ধিমান সে যে কাঁদে। তোমরা তোমাদের অন্তুরসমূহকে কাঁদাও, নিজেদের আমলের ব্যাপারে কাঁদ। অবশ্যই প্রত্যেক ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করবে। কেননা না কাঁদা ব্যক্তি নির্দয় অন্তরের মানুষ’।[8]
সারবস্ত্ত :
১. ক্রন্দন আল্লাহর ভয় ও তাঁর মা‘রেফাতের দলীল।
২. ক্রন্দন আল্লাহভীতিতে বিনম্র আত্মার বৈশিষ্ট্য।
৩. বান্দার সচেতনতা ও আল্লাহর পথে সুদৃঢ় থাকার প্রমাণ।
৪. এটি ঈমানের পরিশুদ্ধতার প্রতি ইঙ্গিতবাহী।
৫. আল্লাহভীতির ক্রন্দন আবেদ ও মা‘বূদের মাঝে তাঁর ভালবাসা ও সন্তুুষ্টি অর্জনের সংযোগ সড়ক।
[1]. তিরমিযী হা/২৩০৮; ইবনু মাজাহ হা/৪২৬৭; মিশকাত হা/১৩২।
[2]. তিরমিযী হা/১৬৯৯; নাসাঈ হা/৩১০৮; ছহীহুল জামে‘ হা/৭৭৭৮; মিশকাত হা/৩৮২৮।
[3]. তিরমিযী হা/১৬৩৯; মিশকাত হা/৩৮২৯।
[4]. বুখারী হা/৪৬২১; মিশকাত হা/১৪৮৩।
[5]. শারহুস সুন্নাহ ১৪/৩৭৩ পৃঃ।
[6] .ইবনু রজব, আত-তাখবীফু মিনান্নার ২৩ পৃঃ।
[7] .ইবনু মুবারক, আয-যুহদ ৪২ পৃঃ।
[8] .ঐ, ৪১ পৃঃ।