সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা

ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 637 বার পঠিত

নিজেদের ব্যক্তিগত চাহিদাগুলো পূরণ করতে করতে আমরা এমনই আত্মমগ্ন হয়ে যাই যে, সমাজের প্রতি, সমাজের মানুষের প্রতি আমাদের যে কোন দায় আছে, সে অনুভূতিটুকু আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যায়। এই সমাজে আমরা একা নই, কেবল আমাদের পরিবার নয়; এর বাইরে এমন শত-সহস্র মানুষ রয়েছে, যারা আমাদের অজান্তে আমাদের জীবনে অজস্র অবদান রেখে যাচ্ছে। যাদেরকে আমরা চিনি না। যাদের দায় আমরা কখনই শোধ করতে পারি না। কিন্তু এই মানুষগুলোর অসীলাতেই আমরা খারাপ সময় পেরিয়ে সুন্দর দিনগুলো অতিক্রম করছি। কখনও কি ভেবেছি, এই মানুষগুলো প্রতি আমাদের দায়টা মেটানো উচিৎ? একজন সচেতন ও হৃদয়বান মানুষ হিসাবে তাদের প্রতি কোন কর্তব্য-করণীয় থাকা প্রয়োজন? ভেবেছি কি এই সমাজ, এই দেশের প্রতি আমাদের একটা দায়বোধ থাকা আবশ্যক?

পুঁজিবাদী বিশ্বে দিন দিন মানুষ এতটাই পুঁজিসর্বস্ব হয়ে উঠেছে, এতটাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, সমাজ-সামাজিকতা এতকিছু ভাবার সময় তাদের নেই। তাদের একটাই লক্ষ্য সাধ্যমত দুনিয়াবী প্রতিযোগিতা লিপ্ত থাকা। বিবেকের বাধা মাড়িয়ে, ন্যায়-অন্যায়, নীতি-নৈতিকতাবোধের ঊর্ধ্বে উঠে দুনিয়াবী মাল-সম্পদ ও পদ-পদবীর পথ অনুসন্ধানই তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। কুরআনের ভাষায়- যারা সম্পদ জমা করে এবং গণনা করে। তারা ধারণা করে, তাদের সম্পদই তাদের স্থায়িত্ব দেবে, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা দেবে (হুমাযাহ ২-৩)। অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের ভুলিয়ে রেখেছে, যতক্ষণ কবরের সাক্ষাৎ তোমরা পাবে (তাকাছুর ১-২)

একজন মুসলিমের দ্বীনদারিতার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ হ’ল সমাজের মানুষের প্রতি তার আচরণ ও দায়বদ্ধতা। কুরআন ও হাদীছের পরতে পরতে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ, অপরের প্রতি সহমর্মিতার যে নির্দেশনা ও প্রকৃষ্ট উদাহরণ এসেছে, তা কোন মুমিনের হৃদয়কে জগতের মিথ্যা মায়া-মরীচিকার পিছনে ছুটে নিজেকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়ার সুযোগ দেয় না। কিন্তু সেসব হেদায়াতের বার্তা আমাদের হৃদয়কন্দরে খুব কমই জায়গা নিতে পারে বলে আমরা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে রাযী নই। দৃষ্টির সামনে এমন প্রগাঢ় পর্দার অন্তরাল যে, নিজের হক আদায়ে শতভাগ আপোষহীন থাকলেও অন্যের প্রাপ্য হক আদায়ে ভীষণ অমনোযোগী। আল্লাহর ভাষায়- ‘যখন তারা মানুষের কাছ থেকে মেপে নেয় তখন কড়ায় গন্ডায় পূর্ণমাত্রায় নেয়; আর নিজেরা যখন তাদের মেপে দেয় বা ওযন করে দেয় তখন কম দেয় (মুতাফ্ফিফীন ২-৩)

পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির মূল রূহ হ’ল পার্থিব সবকিছুকেই অর্থ দিয়ে মূল্যায়ন করা। যার মধ্যে পুঁজিবাদী নেশা প্রবেশ করেছে, আল্লাহ্কে সন্তুষ্ট করা, আল্লাহর জন্য দান করা, মানুষের কল্যাণে নিঃস্বার্থভাবে খরচ করা ইত্যাদি তার অভিধানে থাকে না। যতই তাক্বওয়া, ইখলাছের আলোচনা আসুক না কেন, যতই সম্পদধারী হোক না কেন, দিনশেষে অন্তরের সংকীর্ণতা থেকে সে বের হতে পারে না। সেজন্য দেখা যায়, সমাজে সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরও তারাই যেন সবচেয়ে দরিদ্রদের কাতারে। নিঃস্বার্থ সেবা দেওয়াটা যেন তাদের জন্য যেন অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কোন কাজের প্রসঙ্গ ওঠা মাত্র সে কাজের শুরু না হতেই সরকারী কর্মকর্তা টাকা চায়, ইঞ্জিনিয়ার টাকা চায়, ডাক্তার টাকা চায়, শিক্ষক টাকা চায়, আলেম টাকা চায়। নিশ্চিত করতে চায় নিজের দুনিয়াবী প্রাপ্তি। কোন অবস্থাতেই যেন নিজের রিযিকের একবিন্দু হাতছাড়া না হয়। এর পিছনে যে সামাজিক কোন দায়বদ্ধতা থাকতে পারে, মানুষের কল্যাণ বা সুবিধা-অসুবিধার বিষয় আসতে পারে, সেদিকে দৃকপাতের ফুরসৎ তাদের নেই। এদেরকে যত দেয়া যায় চক্ষুলজ্জাহীনভাবে তত চায়। পৃথিবীর সবকিছুকে তারা একমাত্র অর্থ দিয়েই মূল্যায়ন করে। ফলে কখনই যেন তাদেরকে তুষ্ট করা সম্ভব নয়। বরং কখনও প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি কম হ’লে তাদের অস্থিরতা দেখে কে! নিজেকে বড় মযলূম মনে করে তারা যে কী অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় পোড়ে, তার বাস্তবতা বোঝানো শক্ত।

প্রিয় পাঠক, জেনে রাখা ভাল যে, পৃথিবীতে সব কাজের মূল্য টাকা দিয়ে হয় না। টাকাই এ জগতে মূল্যায়নের একমাত্র মানদন্ড নয়। বরং এর বাইরে অপার্থিব এক মূল্য রয়েছে, যা দিতে পারেন কেবল আল্লাহ। আর তিনি যা দেবেন, তার সমতুল্য কিছু নেই। হ’তেও পারে না। যে কাজের বিনিময় দুনিয়াবী নয়, তার চেয়ে মূল্যবান কিছু আর নেই। যে মানুষ এই মূল্যের প্রত্যাশী হয়, তার কাছে দুনিয়াবী মূল্যের আলাপ তুচ্ছ হয়ে যায়। মানুষের জন্য এতটুকু ছাড় দেয়া, একটু উপকার করা, ক্ষমা করে দেয়া, ধৈর্য ধরা, নিজেকে পরের জন্য বিলিয়ে দেয়া, নিজের চাওয়া-পাওয়া আল্লাহর কাছে পেশ করা, নিজের মানবিক গুণগুলোর বিকাশ হ’তে দেয়া-এগুলো তার জন্য সহজসাধ্য হয়ে যায়। এভাবে মানবতার বিজয়ের মধ্য দিয়েই ব্যক্তির বিজয় গৌরব ফুটে ওঠে। আল্লাহ বলেন, যে আখেরাতের ফসল কামনা করে, আমি তার ফসলে সমৃদ্ধি দান করি। আর যে দুনিয়ার ফসল কামনা করে আমি তাকে তা থেকে কিছু দেই এবং আখেরাতে তার জন্য কোন অংশই থাকবে না (শূরা ২০)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তির একমাত্র ভাবনার বিষয় হবে পরকাল, আল্লাহ তার অন্তরকে চাহিদামুক্ত করে দেবেন এবং তার কাজকে একত্রিত করে সুসংহত করে দেবেন এবং দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়া তার কাছে নগণ্য হয়ে যাবে। আর যার একমাত্র ভাবনা দুনিয়া, আল্লাহ তাদের দু’চোখের সামনে অভাব ছড়িয়ে রাখবেন এবং সব কাজ এলোমেলো করে দেবেন। আর দুনিয়াতে তার জন্য নির্ধারিত জিনিস ছাড়া আর কিছুই সে পাবে না (তিরমিযী হা/২৪৬৫)

মানুষের প্রতি উপকারের অমূল্য প্রতিদান সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষায় এতটুকুই বলা যায়, তিনি বলেন, আল্লাহ এই উম্মতকে সাহায্য করেন এবং রিযিক দেন দুর্বলদের দ্বারাই, তাদের দো‘আ, ছালাত এবং ইখলাছের কারণে (নাসাঈ হা/৩১৭৮)। অর্থাৎ যেই সাধারণ, দরিদ্র, অসহায় মানুষগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করেন, আমাদের রিযিক বৃদ্ধি করে দেন, তাদের জন্য জান-প্রাণ উজাড় করে দায়িত্ব পালন করা, তাদের প্রতি মানবিকতা প্রদর্শনেই রয়েছে আমাদের স্বার্থকতা।

সুতরাং যারা সমাজের প্রতি নিজের দায়বদ্ধতা অনুভব করেন, অপরের হক আদায়ে সচেতন থাকেন, নিজের চাওয়া-পাওয়াকে আল্লাহর সাথে সংযুক্ত করেন, দুনিয়াবী চাহিদাকে তুচ্ছ করে দেখেন, আখেরাতের গন্তব্যকে নিজের জন্য স্থির করে নেন, তার চেয়ে মূল্যবান ব্যক্তি আর নেই। দুনিয়াতে সফল ব্যক্তির চেয়ে মূল্যবান ব্যক্তির প্রয়োজন বড় বেশী। অতএব আসুন! যে সমাজে আমাদের নিত্য বসবাস, যাদের সাথে আমাদের চলাফেরা তাদের প্রতি আমাদের কর্তব্যগুলো যথাযথভাবে পালন করি। মানবিক মূল্যবোধকে সদা সর্বদা সমুন্নত রাখি। দুনিয়ার পিছনে ছুটে নিজের আদর্শ, নৈতিকতা, ব্যক্তিত্বকে খাটো না করি, মহান রবের দরবারেই নিজের সবকিছুকে সমর্পণ করি, তবেই দুনিয়া ও আখেরাতে আল্লাহ আমাদেরকে সম্মানিত করবেন। আমাদের দোষ-ত্রুটি মাফ করে চিরন্তন সুখের স্থান জান্নাতুল ফেরদাউসের পথে পরিচালিত করবেন। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!



আরও