ইত্তেবায়ে সুন্নাত ও তাক্বলীদ
মুহাম্মাদ আবুল কালাম
শরীফুল ইসলাম মাদানী 445 বার পঠিত
উপস্থাপনা : মুসলিম সমাজে অধিকাংশ শারঈ ফিৎনার পশ্চাতে কোন না কোন বিদ‘আত থাকে। এই বিদ‘আতের কারণে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এমন ফিৎনার সৃষ্টি হয় যাতে বহু মানুষ সন্ধ্যায় মুমিন থাকে, সকালে কাফের হয়ে যায় এবং সকালে মুমিন থাকলে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যায়। সামান্য পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে এক শ্রেণীর নামধারী আলেম দ্বীনকে নিজের স্বার্থে বিক্রয় করে দেয়। ফলে বিদ‘আতই দ্বীন ও সমাজের বড় ফিৎনা হয়ে দাঁড়ায়। আলোচ্য প্রবন্ধে বিদ‘আতের পরিচয়, উৎপত্তি ও সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল।
বিদ‘আতের পরিচয়
বিদ‘আতের শাব্দিক অর্থ : البِدْعَةُ শব্দটি মাছদার যা بَدَعَ ফে‘ল হ’তে নির্গত। এর শাব্দিক অর্থ আরম্ভ করা, সৃষ্টি করা, আবিষ্কার করা ইত্যাদি। যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁর নিজের সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, بَدِيْعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ ‘আসমান ও যমীনের নতুন উদ্ভাবনকারী (যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না)’ (বাক্বারাহ ২/১১৭)। অন্যত্র তিনি রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বলেন, قُلْ مَا كُنْتُ بِدْعًا مِنَ الرُّسُلِ ‘আপনি বলুন, আমি এমন কোন রাসূল নই, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই’ (আহকাফ ৪৬/৯)। ইমাম নববী (রহঃ) বিদ‘আত শব্দের অর্থ লিখেছেন,البِدْعَةُ كُلُّ شَيْءٍ عَمِلَ عَلَى غَيْرِ مِثَالٍ سَابِقٍ অর্থাৎ এমন সব কাজ করা বিদ‘আত, যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। অতএব বিদ‘আত হ’ল সুন্নাতের বিপরীত। কেননা যেহেতু রাসূল (ছাঃ)-এর কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিকে সুন্নাত বলা হয়, সেহেতু সুন্নাতের পূর্ব দৃষ্টান্ত রয়েছে। পক্ষান্তরে বিদ‘আত ইসলামী শরী‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং বিদ‘আতের কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই।
বিদ‘আতের পারিভাষিক অর্থ : বিদ‘আতের শাব্দিক বিশ্লেষণ থেকে বুঝা যায় যে, বিদ‘আত বলা হয় ঐ সকল নতুন সৃষ্টিকে যার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত ছিল না। যেমন- বিমান, বাস, ট্রাক, ট্রেন, মাইক, ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি। এগুলো আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত হ’লেও পারিভাষিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিদ‘আত নয়। কেননা এগুলো ইসলামী শরী‘আতের সাথে সম্পৃক্ত কোন বিষয় নয়। বরং মানুষের জীবন পরিচালনার সুবিধার্থে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপকরণ তৈরী হয়েছে মাত্র। এসব ক্ষেত্রে নেকীর কোন উদ্দেশ্য থাকে না। মূলত বিদ‘আত হ’ল, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত নয়, এমন কোন কাজকে ইবাদত হিসাবে নেকী পাওয়ার আশায় পালন করা। অনুরূপভাবে আযান দেওয়া একটি ইবাদত। কিন্তু এক্ষেত্রে মাইক ব্যবহার করা ইবাদতের কোন অংশ নয়। মাইক আযানের আওয়াজ উঁচু করার একটি মাধ্যম মাত্র। যদি কেউ বেশী নেকী পাওয়ার উদ্দেশ্যে মাইকে আযান দেয়, তাহ’লে মাইকে আযান দেওয়া বিদ‘আত হবে। অনুরূপভাবে যদি কেউ নেকী পাওয়ার আশায় বিমান, বাস, ট্রেন ইত্যাদিতে আরোহণ করে অথবা ঘড়ি, চশমা ইত্যাদি পরিধান করে, তাহ’লে তা বিদ‘আতে পরিণত হবে। কিন্তু এগুলোতে মানুষের নেকী পাওয়ার কোন আশা থাকে না, বিধায় এগুলো বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত নয়। নিম্নে বিদ‘আতের পারিভাষিক অর্থ :
(১) ইমাম নববী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ فِيْ الشَّرْعِ هِيَ إِحْدَاثُ مَا لَمْ يَكُنْ فِيْ عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه و سلم- ‘শরী‘আতের মধ্যে বিদ‘আত হ’ল, নব আবিষ্কার, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় ছিল না’।[1]
(২) শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,فَكُلُّ مَنْ دَانَ بِشَيْءٍ لَمْ يَشْرَعْهُ اللهُ فَذَاكَ بِدْعَةٌ، وَإِنْ كَانَ مُتَأَوَّلاً فِيْهِ- ‘যে সকল কাজ দ্বীনের মধ্যে মিশ্রিত হয়েছে অথচ আল্লাহ তা বৈধ করেননি, সেটাই বিদ‘আত, যদিও তা ব্যাখ্যা সাপেক্ষ হয়’।[2]
তিনি অন্যত্র বলেন,اَلْبِدْعَةُ مَا خَالَفَتِ الْكِتَابَ وَالسُّنَّةَ أَوْ إِجْمَاعَ سَلَفِ الْأُمَّةِ مِنَ الْاِعْتِقَادَاتِ وَالْعِبَادَاتِ- ‘বিদ‘আত হ’ল, ইবাদত এবং বিশ্বাসের মধ্যে যা কিতাব (কুরআন), সুন্নাহ অথবা সালাফে ছালেহীনের বিগত উম্মতের ইজমার বিপরীত’।[3]
(৩) আল্লামা জুরজানী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ هِيَ الْفِعْلَةُ الْمُخَالَفَةُ لِلسُّنَّةِ، سُمِّيَتْ بِالْبِدْعَةِ لِأَنَّ قَائِلَهَا اِبْتَدَعَهَا مِنْ غَيْرِ مَقَالِ إِمَامٍ، وَهِيَ الْأَمْرُ الْمُحْدَثُ اَلَّذِيْ لَمْ يَكُنْ عَلَيْهِ الْصَّحَابَةُ وَالْتَّابِعُوْنَ، وَلَمْ يَكُنْ مِمَّا اِقْتِضَاهُ الْدَّلِيْلَ الْشَّرْعِيْ- ‘বিদ‘আত হ’ল সুন্নাতের বিপরীত কাজ। একে বিদ‘আত নামকরণ করা হয়েছে কারণ এর ভাষ্যকার ইমামের (রাসূল) কোন কথা ব্যতিরেকে এটি নতুন সৃষ্টি করে। কেননা বক্তা ইমামের (রাসূল) কথার বিপরীত কথা সৃষ্টি করেছে। আর এটা নব আবিষ্কৃত কাজ, যার উপর ছাহাবী ও তাবেঈগণ ছিলেন না এবং যা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়’।[4]
(৪) ইমাম সুয়ূতী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ عِبَارَةٌ عَنْ فِعْلَةٍ تُصَادِمُ الْشَّرِيْعَةَ بِالْمُخَالَفَةِ، أَوْ تُوْجِبُ الْتَعَاطِيْ عَلَيْهَا بِالْزِّيَادَةِ أَوْ الْنُّقْصَانِ- ‘বিদ‘আত এমন কাজকে বলা হয়, যা শরী‘আতের মধ্যে বিরোধিতা আরোপ করে অথবা শরী‘আতের মধ্যে কম-বেশী করার চর্চা অপরিহার্য করে নেওয়া হয়’।[5]
(৫) ইমাম শাতেবী (রহঃ) বলেন,اَلْبِدْعَةُ عِبَارَةٌ عَنْ طَرِيْقِةِ فِيْ الدِّيْنِ مُخْتَرَعَةُ تُضَاهِيْ الشَّرِيْعَةَ، يَقْصُدُ بِالسُّلُوْكِ عَلَيْهَا المُبَالَغَةُ فِيْ التَّعَبُّدِ لِلَّهِ سُبْحَانَهُ- ‘বিদ‘আত হ’ল দ্বীন-ইসলামের মধ্যে এমন রীতি নীতি সৃষ্টি করা বা এমন কর্মনীতি বা কর্মপন্থা চালু করা, যা শরী‘আতের বিপরীত হয় এবং যা করে আললাহর ইবাদতের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাই লক্ষ্য হয়’।[6]
তিনি অন্যত্র বলেন,اَلْبِدْعَةُ الْمَذْمُوْمَةُ هِيَ الَّتِيْ خَالَفَتْ مَا وَضَعَ الشَّارِعُ مِنَ الْأَفْعَالِ أَوْ التُّرُوْكِ- ‘ঘৃণিত বিদ‘আত হ’ল, আল্লাহ যে সকল কাজ করা ও বর্জন করার বিধান দান করেছেন, তার ব্যতিক্রম করা’।[7]
বিদ‘আতের উৎপত্তি
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘ইলম ও ইবাদত বিষয়ক সর্বপ্রকার বিদ‘আত খুলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফতকালের শেষের দিকেই প্রকাশ পায়।[8] যেমন এ বিষয়ে সতর্ক করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفاً كَثِيْراً، فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ، عَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ، وَإِيَّاكُمْ وَالْمُحْدَثَاتِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ- ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আমার পরে জীবিত থাকবে সে বহু ধরনের মতানৈক্য দেখতে পাবে। অতএব সে সময় তোমাদের অবশ্য কর্তব্য হবে আমার সুন্নাত ও আমার সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে চোয়ালের দাঁত দ্বারা মযবুতভাবে অাঁকড়ে ধরা। আর সাবধান! তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে) নতুন কাজ হতে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই বিদ‘আত’।[9]
ওছমান (রাঃ)-এর শাহাদত বরণের পরে যখন মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হ’ল, ঠিক তখনই সর্বপ্রথম ‘হারূরিয়্যাহ’দের মাধ্যমে বিদ‘আত প্রকাশিত হ’ল। অতঃপর ছাহাবায়ে কেরামের শেষ যামানায় ‘কদর’ অর্থাৎ তাক্বদীর বলে কিছু নেই এই বিশ্বাসের বিদ‘আত প্রকাশ লাভ করে। তার পরপরই ‘ইরজা’ অর্থাৎ আমল ঈমানের অংশ নয় এই বিশ্বাসের বিদ‘আত, ‘তাশায়্যু’ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর পরে আলী (রাঃ) প্রথম খলীফা হওয়ার যোগ্য অধিকারী এই বিশ্বাসের উপর গঠিত বিদ‘আত এবং ‘খাওয়ারেজ’ অর্থাৎ কাবীরা গুনাহগার কাফের ও চিরস্থায়ী জাহান্নামী বিশ্বাসের বিদ‘আত প্রকাশ লাভ করে। অতঃপর তাবেঈনদের শেষ যামানায় ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর মৃত্যুর পরে খোরাসানে হিশাম ইবনু আব্দুল মালেক (রহঃ)-এর খেলাফতকালে জাহমিয়াদের উৎপত্তি হয়। আর উল্লিখিত বিদ‘আতগুলি দ্বিতীয় শতাব্দী হিজরীতে সৃষ্টি হয়। সে সময় ছাহাবায়ে কেরামের অনেকেই জীবিত ছিলেন এবং তাঁরা এ সকল বিদ‘আতকে সাধ্যমত দমন করেছিলেন। অতঃপর ইসলামের সোনালী যুগের পরে এসে ‘মু‘তাযিলা’ (যারা নিজেদের জ্ঞান বা বিবেকের মানদন্ডে শরী‘আতকে মানে) বিদ‘আতের সৃষ্টি হয়। তারপর ‘তাছাউফ’ বা ‘ছূফীবাদ’ তথা কবরপূজারীদের জন্ম হয়। এভাবে যুগের আবর্তনে বিশ্বব্যাপী রকমারী বিদ‘আতের প্রাদুর্ভাব ঘটে।
বিদ‘আত সৃষ্টির কারণ
(১) অজ্ঞতা : আল্লাহ কর্তৃক নাযিলকৃত অহি-র বিধান তথা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান না থাকাই সমাজে বিদ‘আত সৃষ্টির প্রধান কারণ। সঠিক পথ না চেনার কারণে মানুষ যেমন পথ ভুল করে, তেমনি কুরআন ও ছহীহ হাদীছের যথার্থ জ্ঞান না থাকার কারণে মানুষ শরী‘আত বহির্ভূত কাজকে ইবাদত হিসাবে গ্রহণ করে। আর এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জ্ঞানার্জনকে ফরয বলে ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, طَلَبُ الْعِلْمِ فَرِيْضَةٌ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ ‘প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয’।[10]
আল্লাহ তাঁর সম্বন্ধে ইলমবিহীন কথা বলতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ وَأَنْ تُشْرِكُوْا بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ سُلْطَانًا وَأَنْ تَقُوْلُوْا عَلَى اللهِ مَا لَا تَعْلَمُوْنَ- ‘বল, আমার প্রতিপালক হারাম করেছেন প্রকাশ্য ও গোপন অশ্লীলতা, পাপাচার ও অসঙ্গত বিরোধিতাকে এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করাকে, যার কোন দলীল তিনি অবতীর্ণ করেননি এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন কিছু বলাকে, যে সম্বন্ধে তোমাদের কোন জ্ঞান নেই’ (আ‘রাফ ৭/৩৩)।
তিনি অন্যত্র বলেন,وَلَا تَقْفُ مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ إِنَّ السَّمْعَ وَالْبَصَرَ وَالْفُؤَادَ كُلُّ أُولَئِكَ كَانَ عَنْهُ مَسْئُوْلًا- ‘যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই সে বিষয়ে অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয়ই কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় ওদের প্রত্যেকেই জিজ্ঞাসিত হবে’ (বানী ইসরাঈল ১৭/৩৬)।
হাসান বছরী (রহঃ) বলেন,إِنَّ اَهْلَ الْبِدْعِ أَصَاغِرُ فِي الْعِلْمِ وَلِأَجْلِ ذَلِكَ صَارُوْا أَهْلَ الْبِدْعِ- ‘নিশ্চয়ই বিদ‘আতীরা ইলমের দিক থেকে একেবারেই নগণ্য। আর এ কারণেই তারা বিদ‘আতী হয়েছে’।[11]
শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমল ব্যতীত ইলমের দিকে আহবান করে সে পথভ্রষ্ট। আর যে ব্যক্তি ইলম বিহীন আমলের দিকে আহবান করে সেও পথভ্রষ্ট। এদের চেয়ে অধিক পথভ্রষ্ট সে ব্যক্তি, যে বিদ‘আতীদের পথে ইলম অন্বেষণ করে। ফলে সে কুরআন ও সুন্নাত বহির্ভূত কর্মের অনুসরণ করে এবং ধারণা করে যে, তা ইলম; অথচ তা অজ্ঞতা। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বিদ‘আতীদের পন্থায় ইবাদত করে সে ইসলামী শরী‘আত বহির্ভূত আমল করে এবং ধারণা করে যে, সে ইবাদত করছে; অথচ তা ভ্রষ্টতা’।[12]
অতএব জ্ঞান এমন এক আলোকবর্তিকা, যার মাধ্যমে মানুষ জান্নাতের পথ সুস্পষ্টভাবে দেখতে পায়। নিজেকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে এবং অন্যকেও রক্ষা করতে সক্ষম হয়। পক্ষান্তরে অজ্ঞতা এমন এক অন্ধকার, যার মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে সে নিজে জান্নাতের পথের দিশা হারিয়ে ফেলে এবং অপরকেও সে পথের সন্ধান দিতে পারে না। আর এরূপ অজ্ঞ ব্যক্তিরাই নিজে বিদ‘আতী হয় এবং ছহীহ, যঈফ ও জাল হাদীছের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণে অক্ষম হওয়ায় ভুল ফৎওয়া দেয়। সাথে সাথে মানব রচিত কিছ্ছা-কাহিনী ও স্বপ্নবৃত্তান্তের মাধ্যমে মানুষকে ভ্রষ্টতার শেষ সীমানায় নিক্ষেপ করে। ফলে নিজেরা পথভ্রষ্ট হয় এবং অপরকে পথভ্রষ্ট করে এবং পরকালে জাহান্নামের খড়ি হয়।
(২) প্রবৃত্তিপূজা : প্রবৃত্তিপূজা তথা নিজের মন যে কাজকে ভালো মনে করে তার অনুসরণ করা বিদ‘আত সৃষ্টির অন্যতম একটি কারণ। শয়তান মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য সদা বদ্ধপরিকর। সে ইসলাম বহির্ভূত কাজকে মানুষের সামনে খুব সুন্দর ও সুশোভিতরূপে উপস্থাপন করে। ফলে মানুষের মন তা সানন্দে গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে তা এক সময় ইসলামের বিধান হিসাবে মানব সমাজে পরিচিতি লাভ করে। এমনকি শেষ পর্যন্ত মানুষ কুরআন ও ছহীহ হাদীছকেই অগ্রাহ্য করে বসে। ফলে সে পথভ্রষ্ট জাহান্নামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আল্লাহ বলেন,فَإِنْ لَمْ يَسْتَجِيْبُوْا لَكَ فَاعْلَمْ أَنَّمَا يَتَّبِعُوْنَ أَهْوَاءَهُمْ وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِنَ اللهِ إِنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ- ‘অতঃপর তারা যদি তোমার আহবানে সাড়া না দেয়, তাহ’লে জানবে যে, তারা তো কেবল তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে। আল্লাহর পথনির্দেশ অগ্রাহ্য করে যে ব্যক্তি নিজ খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে তার অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে পথনির্দেশ করেন না’ (কাছাছ ২৮/৫০)।
তিনি অন্যত্র বলেন,إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَمَا تَهْوَى الْأَنْفُسُ وَلَقَدْ جَاءَهُمْ مِنْ رَبِّهِمُ الْهُدَى- ‘তারা তো অনুমান এবং নিজেদের প্রবৃত্তিরই অনুসরণ করে, অথচ তাদের নিকট তাদের প্রতিপালকের পথনির্দেশ এসেছে’ (নাজম ৫৩/২৩)।
তিনি অন্যত্র বলেন,أَفَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ وَأَضَلَّهُ اللهُ عَلَى عِلْمٍ وَخَتَمَ عَلَى سَمْعِهِ وَقَلْبِهِ وَجَعَلَ عَلَى بَصَرِهِ غِشَاوَةً فَمَنْ يَهْدِيْهِ مِنْ بَعْدِ اللهِ أَفَلَا تَذَكَّرُوْنَ- ‘তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ? যে তার খেয়াল-খুশিকে নিজ ইলাহ বানিয়ে নিয়েছে? আল্লাহ জেনেশুনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং তার কর্ণ ও হৃদয়ে মোহর মেরে দিয়েছেন এবং তার চক্ষুর উপর রেখেছেন আবরণ। অতএব আল্লাহর পরে কে তাকে পথনির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?’ (জাছিয়া ৪৫/২৩)।
অতএব প্রবৃত্তিপূজা এমন এক মারাত্নক ব্যাধি যা মানুষকে সরল-সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে বক্রপথ অবলম্বনে বাধ্য করে। ফলে তার সামনে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পর্বতসম দলীল পেশ করলেও সে তা অগ্রাহ্য করে নিজের মতের উপরই অটল থাকে। এমতাবস্থায় কুরআন ও ছহীহ হাদীছ শুনতে তার কর্ণ বধির এবং সরল ও সঠিক পথ দেখতে তার চক্ষু অন্ধ হয়ে যায়। এমনকি সে তার নিজের মতকে বলবৎ করার জন্য কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যায় লিপ্ত হয়। কখনো বা কুরআনের একটিমাত্র আয়াত অথবা হাদীছের কোন অংশকে নিজের মতের উপর দলীল হিসাবে পেশ করে নিজেকে কৃতার্থ মনে করে। অথচ পূর্ণ হাদীছ ও আয়াতের ব্যাখ্যা জানার প্রয়োজন মনে করে না। আর এর ফলেই সমাজে সৃষ্টি হয় নানা বিদ‘আত।
(৩) তাক্বলীদ বা অন্ধ অনুসরণ : আল্লাহ মানব জাতিকে আশরাফুল মাখলূকাত তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন এবং তার সার্বিক জীবন পরিচালনার যাবতীয় বিধি-বিধান নাযিল করেছেন। সাথে সাথে নির্দেশ দিয়েছেন,اِتَّبِعُوْا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُوْا مِنْ دُوْنِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيْلاً مَّا تَذَكَّرُوْنَ- ‘তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে যা অবতীর্ণ হয়েছে, তোমরা তার অনুসরণ কর, আর তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কাউকে বন্ধুরূপে অনুসরণ কর না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৩)। অথচ মানুষ যখন আল্লাহর এই নির্দেশকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়েছে, ঠিক তখনই অনেক ক্ষেত্রে কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে অগ্রাহ্য করে বিদ‘আতী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে।
মা‘ছূমী (রহঃ) বলেন, ‘প্রচলিত নব আবিষ্কৃত মাযহাব সমূহের অন্ধ অনুসারীদের আশ্চর্যের বিষয় হ’ল, নিশ্চয়ই তাদের কেউ (মুকাল্লিদ) তারই অনুসরণ করে, যা কেবল তার মাযহাবের দিকে সম্পর্কিত, যদিও তা দলীল থেকে অনেক দূরে হয় এবং বিশ্বাস করে যে তিনি (অনুসরণীয় ইমাম) আল্লাহ প্রেরিত নবী। আর অন্যজন হক্ব এবং সঠিকতা থেকে অনেক দূরে। আর আমরা লক্ষ্য করেছি এবং পরীক্ষা করে দেখেছি যে, নিশ্চয়ই ঐ সমস্ত মুক্বাল্লিদরা বিশ্বাস করে যে, তাদের ইমামের এরূপ ভুল হওয়া অসম্ভব। বরং তিনি যা বলেছেন তাই সঠিক। কিন্তু তারা তাদের অন্তরে গোপন রেখেছে যে, তারা কখনই তাদের (অনুসরণীয় ইমাম) তাক্বলীদ ছাড়বে না, যদিও দলীল তার বিপরীত হয়’।[13]
কামাল বিন হুমাম হানাফী (রহঃ) বলেন, ‘ছহীহ মতে নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ করা অপরিহার্য নয়। কেননা তার (মাযহাবের) অন্ধ অনুসরণ অপরিহার্য করা হয়নি। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ) যা ওয়াজিব করেননি তা কখনই ওয়াজিব হবে না। আর অল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) মানুষের মধ্যে কারো উপর ইমামগণের কোন একজনের মাযহাবকে এমনভাবে গ্রহণ করা ওয়াজিব করনেনি যে, দ্বীনের ব্যাপারে তার (ইমাম) আনীত সকল কিছুই গ্রহণ করবে এবং অন্যের সকল কিছু পরিত্যাগ করবে। নির্দিষ্ট কোন মাযহাবের অন্ধ অনুসরণ অপরিহার্য হওয়ার কথা বলা ছাড়াই মর্যাদাপূর্ণ শতাব্দী সমূহ অতিবাহিত হয়েছে।[14]
সাবেক সউদী গ্র্যান্ড মুফতী, বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বলেন, ‘চার মাযহাবের কোন এক মাযহাবের তাক্বলীদ করা ওয়াজিব’ মর্মে প্রচলিত কথাটি নিঃসন্দেহে ভুল; বরং চার মাযহাবসহ অন্যদের তাক্বলীদ করা ওয়াজিব নয়। কেননা কুরআন ও সুন্নাহ-এর ইত্তেবা করার মধ্যেই হক্ব নিহিত আছে, কোন ব্যক্তির তাক্বলীদের মধ্যে নয়’।[15]
(৪) শারঈ বিষয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি : মানব জাতির উপর অবশ্য কর্তব্য হ’ল, অহি-র বিধান যেভাবে নাযিল হয়েছে তাকে সেভাবেই অক্ষুণ্ণ রাখা। আল্লাহ যাকে যে মর্যাদা দিয়েছেন তাকে সে মর্যাদায় ভূষিত করা। কিন্তু মানুষ শারঈ বিষয়ে অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি করতে করতে অনেক সুন্নাত বা নফলকে ফরযে পরিণত করেছে। ইসলামী শরী‘আতে কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না এমন বিষয়কে ফযীলতের উচ্চ শিখরে সমুন্নীত করে নিকৃষ্ট বিদ‘আতের জন্ম দিয়েছে। খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে আল্লাহর পুত্র বানিয়েছে। ছূফীরা মাটির তৈরী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নূরের তৈরী বানিয়ে আল্লাহর আসনে বসিয়েছে। স্বয়ং আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মৃত্যুর ঘোষণা দিলেও বাংলার অধিকাংশ মানুষ তা উপেক্ষা করে রাসূল (ছাঃ)-কে জীবিত ঘোষণা দিয়ে তাঁর জন্ম দিবস উপলক্ষ্যে অসংখ্য বিদ‘আত করে চলেছে।
(৫) যঈফ ও জাল হাদীছের অনুসরণ : বিদ‘আতীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যঈফ ও জাল হাদীছের ভিত্তিতে বিদ‘আতী কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়। তাদেরকে সংশোধনের উদ্দেশ্যে যদি বলা হয় যে, তোমরা যে হাদীছের ভিত্তিতে আমলটি করছ সেটি যঈফ অথবা জাল, তাহ’লে সাথে সাথে তারা বলে উঠে, হাদীছ কি কখনো যঈফ অথবা জাল হয়? অথচ একথাই সঠিক যে, রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীছ কখনো যঈফ ও জাল হয় না। বরং যেসব কথা ও কর্ম রাসূল (ছাঃ) থেকে প্রমাণিত নয়; অথচ তা রাসূল (ছাঃ)-এর দিকে সম্বন্ধিত করা হয় তাই মূলত যঈফ ও জাল হাদীছ। আর এরূপ অসংখ্য যঈফ ও জাল হাদীছ সমাজে প্রচলিত আছে এবং এর অধিকাংশই হাদীছের কিতাবগুলিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। ফলে মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে এবং বিদ‘আতকে ছাড়তে তাদের কষ্ট হচ্ছে। একশ্রেণীর আলেম সমাজ উক্ত হাদীছগুলির যঈফ ও জাল হওয়ার কারণ জানলেও মাযহাবী গোঁড়ামী ও তাদের ইলমের অহংকারের কারণে সেগুলোকে সমাজে জিইয়ে রেখেছে।
(৬) বিধর্মীদের অনুকরণ : মুসলমানরা বিধর্মীদের অনুকরণে মুসলিম সমাজে অনেক বিদ‘আত চালু করেছে। যেমন- কবরপূজা, পীরপূজা, ঈদে মীলাদুন্নবী, কবরে ও শহীদ মীনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অসংখ্য বিদ‘আত বিধর্মীদের অনুকরণেই সৃষ্টি হয়েছে। আর মুসলমানরা যে বিধর্মীদের অনুকরণ করবে এমন ভবিষ্যদ্বাবাণীও রাসূল (ছাঃ) করে গেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমার উম্মতের উপর তেমন অবস্থা আসবে, যেমন এসেছিল বনু ইস্রাঈলের উপর এক জোড়া জুতার পরস্পরে সমান হওয়ার ন্যায়। এমনকি তাদের মধ্যে যদি কেউ এমনও থাকে, যে তার মায়ের সাথে প্রকাশ্যে যেনা করেছে, আমার উম্মতের মধ্যেও তেমন লোক পাওয়া যাবে যে এমন কাজ করবে। আর বনু ইস্রাঈল ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছিল, আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। সবাই জাহান্নামে যাবে, একটি দল ব্যতীত। তারা বললেন, সেটি কোন দল হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)? তিনি বললেন, যারা আমি ও আমার ছাহাবীগণ যার উপরে আছি, তার উপর টিকে থাকবে’।[16] আর বিধর্মীদের অনুকরণের পরিণতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে কওমের অনুকরণ করবে ক্বিয়ামতের দিন সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত হবে’।[17]
অতএব বিধর্মীদের অনুকরণে বিদ‘আতী কর্মকান্ডে লিপ্ত হ’লে অবশ্যই জাহান্নামে যেতে হবে। আর এথেকে রক্ষা পেতে হ’লে রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের পথ তথা একমাত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসরণ করতে হবে।
(৭) নিজের জ্ঞানকে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর প্রাধান্য দেওয়া : আল্লাহ মানব জাতিকে অন্যান্য মাখলূকাতের উপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করেছেন। আর এই শ্রেষ্ঠত্বের মানদন্ড হিসাবে মানুষকে দান করেছেন বিবেক বা বুদ্ধি। মানুষ সেই বিবেক-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মানদন্ডে ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ করবে। কিন্তু মানুষ কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে উপেক্ষা করে নিজের বিবেকের মানদন্ডে ভালো-মন্দের পার্থক্য নিরূপণ করতে গিয়ে ভালো কাজের দোহাই দিয়ে বিদ‘আতে হাসানার নামে অসংখ্য বিদ‘আতের জন্ম দিয়েছে। অথচ ইসলামী শরী‘আতে বিদ‘আতে হাসানার কোন অস্তিত্ব নেই। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ أَصْدَقَ الْحَدِيْثِ كِتَابُ اللهِ وَأَحْسَنَ الْهَدْىِ هَدْىُ مُحَمَّدٍ وَشَرَّ الأُمُوْرِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ وَكُلَّ ضَلاَلَةٍ فِيْ النَّارِ- ‘নিশ্চয়ই সর্বোত্তম কথা হ’ল আল্লাহর কিতাব, আর সর্বোত্তম হিদায়াত হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হিদায়াত। সর্বনিকৃষ্ট কাজ হ’ল (শরী‘আতের মধ্যে) নব আবিষ্কার। আর প্রত্যেক নব আবিষ্কারই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী। আর প্রত্যেক গোমরাহীর পরিণামই জাহান্নাম’।[18]
(৮) পীর-দরবেশের মিথ্যা কাশ্ফ ও স্বপ্নের প্রবঞ্চনা : ছূফী মতবাদে বিশ্বাসী একশ্রেণীর পীর, দরবেশ ও ফকীরেরা তাদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে কাশফের মিথ্যা দাবী করে। এমনকি তাদের মধ্যে অনেকে আবার সরাসরি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের কথাও বলে থাকে। তাদের কাছে কুরআন ও ছহীহ হাদীছ তুলে ধরলে তারা বলে, তোমাদের এই জ্ঞানের সনদ তো এক মৃত ব্যক্তি থেকে অপর মৃত ব্যক্তি। আর আমাদের জ্ঞানের সনদ স্বয়ং আল্লাহ। সরাসরি আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের ইলম শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তোমাদের ইলম কিতাবের মধ্যে বিদ্যমান, আর আমাদের ইলম কলবের মধ্যে বিদ্যমান। আমাদের মাদ্রাসায় লেখা-পড়ার প্রয়োজন হয় না। এভাবে তারা শারঈ বিষয়ে অজ্ঞ ব্যক্তিদের সামনে এধরনের নানা বুলি আওড়িয়ে মানবতার মুক্তির সনদ কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে উপেক্ষা করে নিজেদের মস্তিষ্কপ্রসূত কাল্পনিক ভাবাবেগকে কারামতের দোহাই দিয়ে অসংখ্য শিরক ও বিদ‘আতের জন্ম দিয়ে থাকে। আল্লাহ তাদেরকে হেদায়াত দান করুন।
(৯) ওলামায়ে কেরামের নীরবতা ও স্বার্থান্বেষণ : আল্লাহ বলেন,وَلْتَكُنْ مِنْكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُوْنَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُوْنَ بِالْمَعْرُوْفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা (মানুষকে) কল্যাণের দিকে আহবান করবে এবং সৎকাজের নির্দেশ দিবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে; আর ওরাই হবে সফলকাম’ (আলে-ইমরান ৩/১০৪)। মহান আল্লাহ এই দায়িত্ব পালনের জন্য নবীগণকে নিয়োজিত করেছিলেন। বর্তমানে এই দায়িত্ব ওলামায়ে কেরামের উপর অর্পিত হয়েছে। কেননা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الأَنْبِيَاءِ ‘নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীগণের ওয়ারেছ’।[19] কিন্তু দুঃখের বিষয় হ’ল, বর্তমানে অধিকাংশ আলেম নবীদের ওয়ারিছ হওয়ার পরিবর্তে তাঁদের দুশমনে পরিণত হয়েছে। সমাজে তাদের নেতৃত্ব, পকেট ভর্তি টাকা ও পেট ভর্তি ভালো খাদ্য হাছিলের উদ্দেশ্যে এবং ইমামতির চাকুরী হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপ করে অসংখ্য বিদ‘আতকে লালন করছে। আজকেই যদি ঘোষণা দেওয়া হয় যে, মীলাদ করলে কোন টাকা দেওয়া হবে না, শবেবরাত উপলক্ষে কোন হালুয়া-রুটি ও মিষ্টি বিতরণ হবে না, তাহলে তারাই এগুলিকে বিদ‘আত বলে ঘোষণা দিবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর এরূপ আলেমদের পরিণাম ভয়াবহ। হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم مَنْ سُئِلَ عَنْ عِلْمٍ يَعْلَمُهُ فَكَتَمَهُ أُلْجِمَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِلِجَامٍ مِنْ نَارٍ- আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার জানা ইলম সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হয়েও তা গোপন করে রাখে, ক্বিয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেওয়া হবে’।[20]
পক্ষান্তরে হক্বপন্থী ওলামায়ে কেরামের অধিকাংশই দুনিয়া অর্জনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আবার কেউ কেউ বিলাসবহুল অলস জীবন-যাপন করছেন; যারা হক্বের প্রসারে সামান্য কষ্ট স্বীকার করতেও সম্মত নন। এহেন পরিস্থিতিতে হক্ব প্রচারের জন্য তাদের হাতে কোন সময় নেই। এর মধ্যেও যারা হক্ব প্রচারের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন, তাদের সংখ্যা অতীব নগণ্য। ফলে তাদের পক্ষেও সর্বস্তরের মানুষের নিকট হক্ব পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে সমাজ থেকে বিদ‘আত দূরীভূত হচ্ছে না; বরং আরো বাড়ছে।
(ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
[লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. ইমাম নববী (রহঃ), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত ৩/২২ পৃ.।
[2]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, আল-ইসতিক্বামাহ ১/৪২ পৃ.।
[3]. শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া, মাজমু ফাতাওয়া ৮/৩৪৬ পৃ.।
[4]. জুরজানী, আত-তা‘রীফাত ১/৬২ পৃ.।
[5]. ইমাম সুয়ূতী, আল-আমরু বিল ইত্তেবা ওয়ান নাহী আনিল ইবতিদা, ৮৮ পৃ.।
[6]. ইমাম শাতেবী, আল-ই‘তিছাম ১/৩৭।
[7]. ইমাম শাতেবী, আল-মুয়াফাকাত ২/৩৪২ পৃ.।
[8]. ইবনু তাইমিয়াহ মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১০/৩৫৪ পৃ.।
[9]. আবুদাউদ হা/৪৬০৭; তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪২; মিশকাত হা/১৬৫, ‘সুন্নাহকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ, বঙ্গানুবাদ (এমদাদিয়া) ১/১২২ পৃ.; আলবানী, সনদ ছহীহ।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/২২৪; মিশকাত হা/২১৮; আলবানী, সনদ ছহীহ, ছহীহুল জামে‘ হা/৩৯১৩।
[11]. আবু ইসহাক আশ- শাতিবী, আল-ই‘তিছাম ২/২০৪ পৃ.।
[12]. শায়খুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১১/২৭ পৃ.।
[13]. আল-মা‘ছূমী, হাদিয়্যাতুস সুলতান ৭৬ পৃ.।
[14]. আল-মা‘ছূমী, হাদিয়্যাতুস সুলতান ৫৬ পৃ.।
[15]. আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায, মাজমূ ফাতাওয়া, ৩/৭২ পৃ.।
[16]. তিরমিযী হা/২৬৪১; মিশকাত হা/১৭১; আলবানী, সনদ হাসান; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৩৪৩।
[17]. আবুদাউদ হা/৪০৩১; মিশকাত হা/৪৩৪৭; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৬১৪৯।
[18]. নাসাঈ হা/১৫৭৮; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/১৩৫৩।
[19]. আবূদাউদ হা/৩৬৪১; ইবনু মাজাহ হা/২২৩; মিশকাত হা/২১২; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৯৭।
[20]. আবূদাউদ হা/৩৬৫৮; তিরমিযী হা/২৬৪৯; ইবনু মাজাহ হা/২৬৪; মিশকাত হা/২২৩; আলবানী, সনদ ছহীহ; ছহীহুল জামে‘ হা/৬২৮৪।