সততা : মুমিনের অনন্য বৈশিষ্ট্য

ইহসান ইলাহী যহীর 2786 বার পঠিত

উপক্রমণিকা : সততা ও স্বচ্ছতা মুমিনের বড় গুণ। কেননা সততাই জীবনের সৌন্দর্য। তিন অক্ষরের ছোট একটি শব্দ ‘সততা’। কিন্তু যিনি এই গুণ অর্জন করতে সক্ষম হন, মহান আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার মান-মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। দুনিয়ায় ধন-সম্পদে বরকত হয়। আর পরকালে জান্নাত লাভ হয়। মহান আল্লাহ মানবসমাজকে যে সীমারেখায় চলতে নির্দেশ দিয়েছেন, এগুলির মধ্যে অন্যতম হ’ল সততা। শুধু মুসলমান নয় বরং প্রত্যেক মানুষের জীবনেই সততার বিশেষ প্রয়োজন। সে ইসলামের অনুসারী হোক বা অন্য ধর্মের, অফিসার কিংবা কর্মী, শিক্ষক বা ছাত্র, ধনী হোক বা গরীব, পিতা-মাতা হোক বা সন্তান। মোটকথা মানবজীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হ’ল সততা। মানব সমাজের নিরাপত্তা, প্রশান্তি, সুখ-শান্তি, বিনির্মাণ, উন্নতির ও ভিত্তি হ’ল সততা। এই গুণ মানুষকে উন্নত, আদর্শ ও নৈতিকতায় ভূষিত করে এবং এর মাধ্যমেই ইসলামী জীবনাদর্শের ভাবধারায় মানবতার সর্বোচ্চ গুণ অর্জিত হয়।

সততার বিশ্লেষণ

‘সততা’ চরিত্রবান ব্যক্তির একটি বিভূষিত গুণ এই গুনের অধিকারী ব্যক্তিকে বলা হয় ‘সৎ’। সততার অস্তিত্ব চিন্তা বা মননে। শারীরিক বা ব্যবহারিক অভিব্যক্তি, আচরণ ও চরিত্রের মাধ্যমে তা ফুটে উঠে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, When Money is lost nothing is lost, wealth is lost something is lost, but character is lost everything is lost. ‘টাকা খোয়া গেলে কিছুই হারায় না। যদি সম্পদ নষ্ট হয় তবে কিছু হারিয়ে যায়। কিন্তু যদি চরিত্র নষ্ট হয়, তবে সবকিছু হারিয়ে যায়’। একজন ব্যক্তির মানসিক বা নৈতিক চরিত্র ভাল হ’লে তিনি সচ্চরিত্রের অধিকারী হন। অন্যদিকে মানসিক বা নৈতিক চরিত্র খারাপ হ’লে সে দুশ্চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। তখন তাকে কেউ ভালবাসে না। সেকারণ সমাজে আত্মসম্মান নিয়ে বসবাসের জন্য সততা একটি অপরিহার্য গুণ, যা সবার থাকা উচিত।

সততা বনাম শঠতা : মহান আল্লাহ কুরআন মাজীদের বহু স্থানে সততা ও স্বচ্ছতা অবলম্বনকারী নারী-পুরুষদের ফযীলত, আখেরাতে তাদের মহান পুরস্কার ও উচ্চ মর্যাদার বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। কেবল সত্য কথা বলার মধ্যে সততা সীমাবদ্ধ নয়। বরং সত্য কথা বলার সাথে কাজ-কর্ম, বিশুদ্ধ আক্বীদা-বিশ্বাস সবই সততার অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীতে অত্যন্ত আদর্শবান, ব্যক্তিবান এবং পরিপূর্ণ মানবে পরিণত হ’তে হ’লে নিজের চিন্তা-চেতনায়, ভাবনায়, কাজে-কর্মে সকল ক্ষেত্রে সততার মর্যাদা রক্ষা করে চলতে হবে। এর বিপরীতে সার্বিক জীবনে হিংসা-বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, প্রতারণা, বাড়াবাড়ি, গাদ্দারী, গীবত-তোহমত, মুনাফেকী, শঠতা, হঠকারিতা ইত্যাদি সম্পূর্ণরূপে ভুলে যেতে হবে। সকল শ্রেণীর মানুষকে ভালোবাসতে হবে। তাদের অধিকার পরিপূর্ণরূপে আদায় করতে হবে। সৎ হতে গেলে যার কোন বিকল্প নেই।

সততার কতিপয় ইলাহী ধারা

এক্ষণে সততা ও নৈতিকতার উচ্চমার্গে আরোহণে কুরআনী কতিপয় ধারা উল্লেখ করার প্রয়াস পাব। যেমন সূরা মুমিনূনে আল্লাহ বলেন,قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ، الَّذِينَ هُمْ فِي صَلاَتِهِمْ خَاشِعُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ عَنِ اللَّغْوِ مُعْرِضُونَ، ...وَالَّذِينَ هُمْ لِأَمَانَاتِهِمْ وَعَهْدِهِمْ رَاعُونَ، وَالَّذِينَ هُمْ عَلَى صَلَوَاتِهِمْ يُحَافِظُونَ، أُولَئِكَ هُمُ الْوَارِثُونَ، الَّذِينَ يَرِثُونَ الْفِرْدَوْسَ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ- ‘নিশ্চয়ই সফলকাম হবে মুমিনগণ’। ‘যারা তাদের ছালাতে মনোযোগী’। ‘যারা অনর্থক কাজ হ’তে বিরত’।... ‘আর যারা তাদের আমানত সমূহ এবং অঙ্গীকার সমূহ রক্ষায় সচেষ্ট’। ‘এবং যারা তাদের ছালাত সমূহের হেফাযতকারী’। ‘তারাই হবে উত্তরাধিকারী’। ‘উত্তরাধিকারী হবে জান্নাতুল ফেরদাঊসের। যেখানে তারা থাকবে চিরকাল’।[1] যা বাস্তবায়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে সততা ও সৎসঙ্গী।

(ক) ওয়াদা পালন করা : নিজের ওয়াদা বা অঙ্গীকার রক্ষা করা সততার অন্যতম একটি অবলম্বন। যেমন আল্লাহ বলেন وَأَوْفُوْا بِالْعَهْدِ إِنَّ الْعَهْدَ كَانَ مَسْؤُلاً- ‘তোমরা ওয়াদা পূর্ণ করো। কেননা ওয়াদার ব্যাপারে তোমাদেরকে জওয়াবদিহি করতে হবে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/৩৪)

(খ) ক্রোধ সংবরণ করা : রাগের সময় নিজকে নিয়ন্ত্রণে রাখা অতি কষ্টসাধ্য কাজ। ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কথা বা কাজে প্রতিশোধ গ্রহণ না ব্যক্তির জন্য হাদীছে জান্নাতের মধ্যস্থানে প্রাসাদ নির্মাণের ওয়াদা প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ يُنْفِقُونَ فِي السَّرَّآءِ وَالضَّرَّآءِ وَالْكَاظِمِينَ الْغَيْظَ وَالْعَافِينَ عَنِ النَّاسِ وَاللهُ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ- ‘যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সর্বাবস্থায় (আল্লাহর রাস্তায়) ব্যয় করে, যারা ক্রোধ দমন করে ও মানুষকে ক্ষমা করে। আর আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (আলে ইমরান ৩/১৩৪)

(গ) ক্রোধ সংবরণের নববী উপায় : ক্রোধ দমনের উপায় প্রসঙ্গে হাদীছে এসেছে- মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, দুই ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সামনে পরস্পরকে গালিগালাজ করে। এমনকি তাদের একজনের চেহারায় ক্রোধের ছাপ ফুটে ওঠে। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমি এমন একটি দো‘আ জানি, যদি এ লোকটি তা উচ্চারণ করত, তবে অবশ্যই তার ক্রোধ দূর হয়ে যেত। তা হ’ল- أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، ‘আমি বিতাড়িত শয়তান হ’তে আল্লাহর নিকট আশ্রয় চাই’।[2]

(ঘ) মীমাংসায় সততা : ইসলামী শরী‘আতের বিধান মোতাবেক মিথ্যা কথা বলা নিষিদ্ধ। তবে কিছু ব্যতিক্রম আছে, যাতে কৌশল করার অনুমতি আছে। উদ্দিষ্ট কাজটি জায়েয হ’লে সেক্ষেত্রে কৌশল করার সম্মতি ইসলামে রয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِىْ يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ وَيَقُوْلُ خَيْرًا وَّيَنْمِىْ خَيْرًا- ‘যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়, সে মিথ্যাবাদী নয়। মূলত সে ভাল কথা বলে এবং ভাল কথাই আদান-প্রদান করে’।[3] উম্মু কুলছূম (রাঃ) বলেন,يُرَخِّصُ فِي شَيْءٍ مِمَّا يَقُولُ النَّاسُ كَذِبٌ إِلاَّ فِي ثَلاَثٍ : الْحَرْبُ وَالْإِصْلاَحُ بَيْنَ النَّاسِ وَحَدِيثُ الرَّجُلِ امْرَأَتَهُ وَحَدِيثُ الْمَرْأَةِ زَوْجَهَا- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তিনটি ক্ষেত্রে কৌশল অবলম্বনের অনুমতি দিয়েছেন। (১) যুদ্ধে কৌশল অবলম্বনের ব্যাপারে (২) মানুষের বিবাদ মিটিয়ে সন্ধি স্থাপনে (৩) স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন দৃঢ় করার জন্য পরস্পর কথোপকথনে’।[4]

(ঙ) পুণ্যময় সত্য জান্নাতের পাথেয় : সত্যবাদিতা পুণ্যময় এবং মিথ্যাবাদিতা পঙ্কিলতাময়। আর পুণ্যময় সত্য জান্নাতের পাথেয় হবে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكُمْ بِالصَّدْقِ فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِىْ إِلَى الْبِرِّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِىْ إِلَى الْجَنَّةِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيْقًا وَإِيَّاكُمْ وَالْكِذْبَ فَإِنَّ الْكِذْبَ يَهْدِىْ إِلَى الْفُجُوْرِ وَإِنَّ الْفُجُوْرَ يَهْدِى إِلَى النَّارِ وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الكِذْبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا- ‘তোমাদের জন্য সত্যবাদিতা অবলম্বন করা আবশ্যক। কেননা সত্য পুণ্যের দিকে নিয়ে যায়। আর পুণ্য জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। আর যে ব্যক্তি সর্বদা সত্য কথা বলে এবং সত্য বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহর নিকট তাকে ‘ছিদ্দীক্ব’ (পরম সত্যবাদী) বলে লিপিবদ্ধ করা হয়। আর তোমরা মিথ্যা থেকে বেঁচে থাক। মিথ্যা পাপাচারের দিকে নিয়ে যায় এবং পাপাচার জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে ব্যক্তি সর্বদা মিথ্যা কথা বলে এবং মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে, আল্লাহর নিকট তাকে ‘কায্যাব’ মহা মিথ্যাবাদী বলে লিপিবদ্ধ করা হয়’।[5] ছহীহ মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় এসেছে,إِنَّ الصِّدْقَ بِرٌّ وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِىْ إِلَى الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْكَذِبَ فُجُورٌ وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِىْ إِلَى النَّار- ‘সত্যবাদিতা পুণ্যময় কাজ। আর পুণ্য জান্নাতের পথে নিয়ে যায়। অপরপক্ষে মিথ্যা হচ্ছে মহাপাপ। আর পাপ জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়’।[6]

সততার প্রয়োজনীয়তা

পৃথিবীর যেকোনো দেশ ও সমাজ যত বেশী সততা, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞান সম্পন্ন মানুষ দিয়ে সমৃদ্ধ হবে, সে দেশ ও সমাজ তত বেশী আদর্শ ও ন্যায়নিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে। পৃথিবীর প্রধান সকল ধর্ম মতে ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধাচরণের কথা বলা হয়েছে। সকল দেশের প্রচলিত আইনে অন্যায়-গর্হিত কাজ মাত্রাভেদে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে বিবেচিত। সেকারণ সার্বিক জীবনে মুমিনকে সত্যবাদিতা অবলম্বন করতে হবে। নিম্নোক্ত হাদীছগুলি থেকে সত্যবাদিতার প্রয়োজনীয়তা অনুমিত হয়। হাসান ইবনু আলী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে এই কথা স্মরণ রেখেছি যে,دَعْ مَا يَرِيْبُكَ إِلَى مَالاَ يَرِيْبُكَ فَإِنَّ الصِّدْقَ طُمَأنِيْنَةٌ وَإِنَّ الْكِذْبَ رِيْبَةٌ- ‘যে বিষয়ে তোমার সন্দেহ হয়, তা পরিত্যাগ করে যাতে সন্দেহের অবকাশ নেই তা গ্রহণ কর। কেননা সত্য হচ্ছে প্রশান্তি আর মিথ্যা হচ্ছে সন্দেহ’।[7]

সততার বৈসাদৃশ্য

সততা ও সত্যের বিপরীত হ’ল মিথ্যা। মিথ্যার পরিণতি ভয়াবহ। মিথ্যা বলা মহাপাপ। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ؟ ثَلاَثًا. قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ : الإِشْرَاكُ بِاللهِ، وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا، فَقَالَ : أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ. قَالَ فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا لَيْتَهُ سَكَتَ- ‘আমি কি তোমাদেরকে অবহিত করব না, সবচেয়ে বড় গুনাহ কোনটি? আমরা বললাম জ্বী, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, ‘আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হওয়া’। তিনি একথাগুলি হেলান দেওয়া অবস্থায় বলেছিলেন। অতঃপর তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘মিথ্যা কথা থেকে সাবধান!’ তিনি এ কথাটি বারংবার বলতে থাকলেন। এমনকি আমরা মনে মনে বলতে লাগলাম আহ্! তিনি যদি আর উক্ত কথাগুলি না বলতেন’।[8] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন,وَيْلٌ لِمَنْ يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ بِهِ الْقَوْمَ وَيْلٌ لَّهُ وَيْلٌ لَّهُ- ‘সেই ব্যক্তির জন্য ধ্বংস, যে বাগাড়ম্বর এবং লোকদেরকে হাসানোর উদ্দেশ্যে মিথ্যা বলে। ধ্বংস তার জন্য, দুর্ভোগ তার জন্য’।[9]

মিথ্যা বলার কারণে সমাজে কপটতার প্রসার হয়। কেননা সব ধরনের কপটতার উৎস হ’ল মিথ্যাবাদিতা। বহু অপরাধের সঙ্গে মিথ্যাবাদিতা জড়িত। যেমন খেয়ানত, গুজব ছড়ানো, গীবত-তোহমত, মাপে-ওযনে কম দেওয়া, চুক্তি ভঙ্গ করা ইত্যাদি। একটি মিথ্যা অনেক মিথ্যার জন্ম দেয়। একটি মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতে আরও অনেক মিথ্যা কথা বলতে হয়। যারা মিথ্যা কথা বলে, তারা অন্যদেরও মিথ্যাবাদী মনে করে। ফলে সমাজে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হয়। এমনকি মিথ্যাবাদীরা নিজেদের উপর থেকেও আস্থা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীরা সত্যকে গ্রহণ করার সৎ মানসিকতা হারিয়ে ফেলে। মিথ্যাবাদীদের দায়িত্বজ্ঞান লোপ পায়। মিথ্যাবাদীদের সমাজে কোনো সম্মান থাকে না। তাই তারা নির্লজ্জের মতো যেকোনো ধরনের গর্হিত কাজে লিপ্ত হয়। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি মিথ্যাবাদীরা আল্লাহর রহমত ও হেদায়েত থেকে বঞ্চিত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মিথ্যাবাদী কাফিরকে সরল পথে পরিচালিত করেন না’ (যুমার ৩৯/৩)

তাই সততা থেকে বিচ্যুত ব্যক্তি সমাজের কলঙ্ক স্বরূপ। তার দ্বারা অনেকের ক্ষতি সাধিত হয়। নিজের স্বার্থ-সিদ্ধির জন্য সে নানা রকমের অন্যায় কাজে লিপ্ত হ’তে দ্বিধাবোধ করে না। এ ধরনের ব্যক্তি সমাজের বিবেকবান মানুষের কাছে ঘৃণিত। তাকে কেউ কোনো কিছুতে বিশ্বাস করে না। ফলে অসৎ ব্যক্তির সাময়িক মোক্ষলাভ দুর্বল চিত্তের মানুষদের পাপাচারে লিপ্ত হ’তে উদ্বুদ্ধ করে।

অসৎ লোকদের মন্দ পরিণতি

‘সততা, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞান’ এ তিনটির একটি অপরটির পরিপূরক। ন্যায়, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানকে আকৃষ্ট করে থাকে সততা। তাই সততা, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানকে বলা হয় ন্যায়ের সমার্থক। সততা, নৈতিকতা ও নীতিজ্ঞানের পরিপন্থী যেকোনো কাজই অন্যায়। একজন সৎ ব্যক্তির পক্ষে কখনো কোন অনৈতিক ও নীতিজ্ঞান বহির্ভূত কাজ করা সম্ভব নয়। যেকোন অসৎ, অনৈতিক ও নীতিজ্ঞান বহির্ভূত কাজ অন্যায় হিসেবে পরিগণিত। কেননা ন্যায়ের বিপরীত হ’ল অন্যায়। সামুরা ইবনু জুনদুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রায়ই ছাহাবায়ে কেরামকে জিজ্ঞেস করতেন এ বিষয়ে যে, ‘তোমাদের কেউ কি কোন স্বপ্ন দেখেছে? কেউ দেখে থাকলে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে উপস্থাপন করতেন। একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) পরকালীন শাস্তি বিষয়ক একটি স্বপ্ন দেখেন। তিনি পাপিষ্ঠদের নানা রকম শাস্তির দৃশ্য দেখেন। তন্মধ্যে একজনের বিবরণ হচ্ছে- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফেরেশতাদ্বয়ের সাথে এক ব্যক্তির নিকট গেলেন। সে ঘাড় বাঁকা করে শুয়ে আছে। অপর ব্যক্তি তার কাছে লোহার ধারালো আংটা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার চেহারার এক দিক থেকে তার মাথা, নাক ও চোখকে ঘাড় পর্যন্ত চিরে ফেলছে। পুনরায় তার মুখমন্ডলের অপরদিক দিয়েও প্রথম দিকের মত মাথা, নাক ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত চিরছে। চেহারার দ্বিতীয় পার্শ্বের চিরা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই প্রথম পার্শ্ব পূর্ববৎ ঠিক হয়ে যাচ্ছে। পুনরায় লোকটি একপাশে এসে আবার আগের মত চিরছে’। ...অবশেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে শাস্তিপ্রাপ্ত লোকগুলোর ব্যাখ্যা ফেরেশতাদ্বয় প্রদান করেছেন। তারা বলেন, যে ব্যক্তির নিকট দিয়ে আপনি এসেছেন, তার মাথা, নাক ও চোখ ঘাড় পর্যন্ত লোহার ধারালো আংটা দিয়ে চিরে দেওয়া হচ্ছে, সে ব্যক্তি সকাল বেলা ঘর থেকে বের হয়েই এমন সব মিথ্যা কথা বলত, যা সাধারণ লোকদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ত’।[10]

শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সততা বনাম বক্রতা

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِذَا أَصْبَحَ ابْنُ آدَمَ فَإِنَّ الْأَعْضَاءَ كُلَّهَا تُكَفِّرُ اللِّسَانَ فَتَقُوْلُ اَتَّقِ اللهَ فِيْنَا فَإِنَّا نَحْنُ بِكَ فَإِنِ اسْتَقَمْتَ اِسْتَقَمْنَا وَإِنِ اِعْوَجَجْتَ اِعْوَجَجْنَا- ‘আদম সন্তান যখন ভোরে ওঠে তখন তার অঙ্গসমূহ জিহবাকে বলে, আমাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা আমরা সবাই তোমার সাথে জড়িত। সুতরাং তুমি ঠিক থাকলে আমরাও ঠিক থাকব। আর তুমি বাঁকা হয়ে গেলে আমরাও বাঁকা হয়ে পড়ব’।[11] আসলাম (রাঃ) বলেন, একদা ওমর (রাঃ) আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর নিকট গেলেন, তখন তিনি স্বীয় জিহবা ধরে টানছিলেন। ওমর (রাঃ) বললেন,مَهْ غَفَرَ الله لَك. فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ : إِنَّ هَذَا أَوْرَدَنِي الْمَوَارِدَ- ‘থামুন! আল্লাহ আপনাকে ক্ষমা করুন। আপনার এরূপ করার কারণ কি? আবুবকর (রাঃ) বললেন, এটিই আমাকে ধ্বংসের স্থান সমূহে অবতীর্ণ করিয়েছে’।[12] রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করা হ’ল, হে আল্লাহ রাসূল (ছাঃ)! মুক্তির উপায় কি? তিনি বললেন,أَمْلِكْ عَلَيْكَ لِسَانَكَ وَلْيَسَعْكَ بَيْتُكَ وَابْكِ عَلَى خَطِيئَتِكَ- ‘তোমার জিহবা সংযত রাখ, তোমার বাসস্থান যেন প্রশস্ত হয়, আর তোমার গুনাহের জন্য ক্রন্দন কর’।[13] অতএব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সততা অবলম্বন করা যরূরী।

সততা ও সত্যবাদিতার মাহাত্ম্য

বাকসংযমী ও সত্যবাদী ব্যক্তি সকলের আস্থার প্রতীক ও শ্রদ্ধাভাজন হিসাবে বিবেচিত হন। নিখাঁদ সত্যবাদী যেমন তীব্র সংকটেও সত্যবাদিতায় অবিচল থাকেন, তেমনি অপ্রয়োজনে বাক্য ব্যয় করা থেকেও বিরত থাকেন। দুঃখ-শোকে, কষ্ট-ক্লেশে, সংকট-বিপর্যয়ে, অমিত যাতনার সময়গুলোতে সত্যবাদী কেন দৃঢ়তার সাথে সততা অবলম্বন করেন? সাময়িকভাবে সততা থেকে সরে দাঁড়ালে কি হয়? কিন্তু না! তিনি জানেন অবিচল সত্যবাদিতার সঙ্গে আল্লাহর সন্তোষ ও জান্নাতের সংযোগ রয়েছে। আবার রয়েছে জনমানুষের অকুণ্ঠ বিশ্বাসের স্বীকৃতি। তাইতো সততা ও সত্যবাদিতার মাহাত্ম্য বর্ণনা করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ يَّضْمَنْ لِىْ مَابَيْنَ لَحْيَيْهِ وَمَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ أَضْمَنْ لَهُ الْجَنَّةَ- ‘যে ব্যক্তি আমার নিকট তার চোয়ালদ্বয়ের মধ্যস্থিত বস্ত্ত জিহবা ও পদদ্বয়ের মধ্যস্থিত বস্ত্ত লজ্জাস্থানের যামিন হ’তে পারবে, আমি তার জন্য জান্নাতের যিম্মাদার হবে’।[14]

অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ وَقَاهُ اللهُ شَرَّ مَا بَيْنَ لَحْيَيْهِ وَشَرَّ مَا بَيْنَ رِجْلَيْهِ دَخَلَ الْجَنَّةَ، ‘আল্লাহ যাকে যবান ও লজ্জাস্থানের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করেছেন সে জান্নাতে যাবে’।[15]

আর মিতভাষী ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ইসলামকে সৌন্দর্য দানের রূপকার হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلاََمِ المَرْءِ تَرْكُهُ مَا لاَ يَعْنِيهِ- ‘কোন ব্যক্তির ইসলামের অন্যতম সৌন্দর্য হচ্ছে অনর্থক বিষয় পরিত্যাগ করা’।[16] সততাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া থেকে মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,فَلاَ تَتَّبِعُوا الْهَوَى أَنْ تَعْدِلُوْا وَإِنْ تَلْوُ أَوْتُعْرِضُوْا فَإِنَّ اللهَ كَانَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ خَبِيْرًا- ‘তোমরা বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে জেনে রেখ, আল্লাহ তোমাদের সকল কাজকর্ম সম্পর্কে সম্যক অবহিত’ (নিসা ৪/১৩৫)

সততার উত্তম পুরস্কার

সততাই শক্তি ও বল। সততা উৎকৃষ্ট পন্থা। সততা ছাড়া জীবনে কোন লক্ষ্য, উদ্দেশ্য বা গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না। আমাদের প্রতি আল্লাহর অসংখ্য-অগণিত নে‘মতের মধ্যে সবচেয়ে বড় হ’ল ঈমান। ঈমান ইহকালীন ও পরকালীন মুক্তির নিশ্চয়তা দেয়। মানসিক প্রশান্তি অর্জনে ঈমানের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। মানুষ তার ঈমানের স্তর অনুযায়ী সে প্রশান্তি অনুভব করে। তার ঈমান বৃদ্ধির সাথে সাথে মানসিক প্রশান্তি ও তৃপ্তি বাড়বে। তার প্রতিটি কাজে ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে। ঈমান মুমিনের জীবনে মানসিক প্রশান্তির নিশ্চয়তা দেয়। সেকারণ একজন মুমিনের ব্যক্তি জীবনে ঈমানের প্রভাবটা বেশ উল্লেখযোগ্য। যেখানে সততা তার ঈমান, আমল পরিশুদ্ধ করতে সহায়ক ভূকিা পালন করে।

(১) পবিত্র জীবন প্রাপ্তি : আল্লাহর প্রতি ঈমান নির্মল জীবনের নিশ্চয়তা দেয়। যেই জীবনের পরতে পরতে রয়েছে পবিত্রতা ও প্রশান্তির ছোঁয়া। মুক্তি মেলে দুনিয়ার যাবতীয় অস্থিরতা থেকে। জীবন সাজে বর্ণিল সৌন্দর্যে। দুনিয়া ও আখিরাতে সে পবিত্র জীবন ও উত্তম পুরস্কারে ধন্য হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِّنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘পুরুষ হৌক বা নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, আমরা তাকে অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা অধিক উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহ্ল ১৬/৯৭)

(২) সুপথের দিশা : আল্লাহর প্রতি মযবূত ঈমান অন্তরকে সঠিক পথের দিশা প্রদান করে। বিপদের সময় অনেক মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। ছোট ছোট বিপদও তার কাছে অনেক বড় মনে হয়। কিন্তু প্রকৃত ঈমানদার থাকে মহান আল্লাহর বিশেষ তত্ত্বাবধানে। প্রকৃত ঈমান খাঁটি ঈমানদারদের মনোবল যোগায়। তাকে সুপথের দিশা দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, مَآ أَصَابَ مِنْ مُّصِيبَةٍ إِلاَّ بِإِذْنِ اللهِ وَمَنْ يُّؤْمِنْ بِاللهِ يَهْدِ قَلْبَهُ وَاللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ- ‘কেউ কোন বিপদে পতিত হয় না আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত। বস্ত্তত যে ব্যক্তি আল্লাহকে বিশ্বাস করে, তিনি তার হৃদয়কে সুপথে পরিচালিত করেন। আর আল্লাহ সকল বিষয়ে বিজ্ঞ’ (তাগাবুন ৬৪/১১)

(৩) যাবতীয় কল্যাণের নিশ্চয়তা : প্রকৃত ঈমানই হ’ল বিশ্বাসগত সততা। আর প্রকৃত ঈমান যাবতীয় কল্যাণ ও বরকতের নিশ্চয়তা দেয়। আসমান ও যমীনের বরকতের অঙ্গীকার করা হয়েছে ঈমানদারদের জন্য। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِّنَ السَّمَآءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘জনপদের অধিবাসীরা যদি বিশ্বাস স্থাপন করত ও আল্লাহভীরু হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের উপর আকাশ ও পৃথিবীর বরকতের দুয়ারসমূহ খুলে দিতাম। কিন্তু তারা মিথ্যারোপ করল। ফলে তাদের কৃতকর্মের দরুণ আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম’ (আ‘রাফ ৭/৯৬)

(৪) দুনিয়ায় নিরাপত্তা : আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও আস্থা ঈমানদারদের নিরাপত্তা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মুমিন বান্দাদের নিজ হেফাজতে রাখেন। তাদের আসমান ও যমীনের বিপদাপদ থেকে রক্ষা করেন। তাদের যাবতীয় অস্থিরতা থেকে মুক্ত রাখেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে,إِنَّ اللهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِينَ آمَنُوآ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُورٍ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের পক্ষে শত্রুদের প্রতিহত করেন। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন বিশ্বাসঘাতক ও অকৃতজ্ঞকে ভালবাসেন না’ (হজ্জ ২২/৩৮)

(৫) সততায় বরকত : ব্যবসা-বাণিজ্যসহ যাবতীয় লেনদেনে সততা বজায় রাখলে তাতে বরকত হয়। রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُورِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا، وَإِنْ كَذَبَا وَكَتَمَا مُحِقَ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا- ‘যদি ক্রেতা-বিক্রেতা সত্য বলে এবং ভাল-মন্দ প্রকাশ করে, তাহ’লে তাদের লেনদেন বরকতময় হবে। আর যদি উভয়ে মিথ্যা বলে এবং দোষ-ত্রুটি গোপন করে, তাহ’লে এ লেনদেন থেকে বরকত উঠিয়ে নেওয়া হবে’।[17]

(৬) হকের উপর অবিচলতা : হেদায়াতের মালিক আল্লাহ। হেদায়াতের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। প্রকৃত ঈমানদারকে তিনি হকের উপর অবিচল রাখেন। তাদের হকের ওপর অবিচল থাকার তাওফীক দান করেন। যেমন আল্লাহ বলেন, يُثَبِّتُ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا بِالْقَوْلِ الثَّابِتِ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَيُضِلُّ اللهُ الظَّالِمِينَ وَيَفْعَلُ اللهُ مَا يَشَآءُ- ‘আল্লাহ মুমিনদের দৃঢ় বাক্য দ্বারা দৃঢ় রাখেন ইহকালীন জীবনে ও পরকালে এবং যালেমদের পথভ্রষ্ট করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যা চান তাই করেন’ (ইব্রাহীম ১৪/২৭)

(৭)অন্তরের অনাবিল প্রশান্তি : প্রকৃত ঈমান মানসিক প্রশান্তির নিশ্চয়তা দেয়। পঙ্কিল জীবনের কদর্যতা ও কলুষতা থেকে রক্ষা করে। দান করে অন্তরের অনাবিল প্রশান্তি। যেমন আল্লাহ বলেন,اَلَّذِينَ آمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوآ إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُّهْتَدُونَ- ‘যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের ঈমানের সাথে শিরককে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে নিরাপত্তা এবং তারাই সুপথ প্রাপ্ত’ (আন‘আম ৬/৮২)। সুতরাং নিরাপত্তা প্রাপ্ত এবং সুপথ প্রাপ্ত ব্যক্তিরাই দুনিয়াতে অন্তরের অনাবিল প্রশান্তি অনুভব করেন।

(৮) জান্নাতের মহা সুসংবাদ : আল্লাহর প্রতি ঈমান মুমিনদের জান্নাতের সুসংবাদ দেয়। তাদের আল্লাহ জান্নাতের নে‘মতরাজির সুসংবাদ দেন। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ إِنَّا لاَ نُضِيعُ أَجْرَ مَنْ أَحْسَنَ عَمَلاً، أُولَئِكَ لَهُمْ جَنَّاتُ عَدْنٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهِمُ الْأَنْهَارُ يُحَلَّوْنَ فِيهَا مِنْ أَسَاوِرَ مِنْ ذَهَبٍ وَّيَلْبَسُونَ ثِيَابًا خُضْرًا مِّنْ سُنْدُسٍ وَّإِسْتَبْرَقٍ مُّتَّكِئِينَ فِيهَا عَلَى الْأَرَآئِكِ نِعْمَ الثَّوَابُ وَحَسُنَتْ مُرْتَفَقًا- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে (আমরা তাদের পুরস্কৃত করি)। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, আমরা তার পুরস্কার বিনষ্ট করি না’। ‘তাদের জন্য রয়েছে চিরস্থায়ী বসবাসের জান্নাত। যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত। সেখানে তাদেরকে স্বর্ণ-কংকন দ্বারা অলংকৃত করা হবে এবং তারা মিহি ও মোটা রেশমী সূতার সবুজ পোষাক পরিধান করবে। তারা সেখানে সুসজ্জিত আসনে ঠেস দিয়ে বসবে। কতই না সুন্দর প্রতিদান ও কতই না সুন্দর আশ্রয়স্থল!’ (কাহ্ফ ১৮/৩০-৩১)

উপসংহার : সততাই মুমিনের সার্বিক জীবনের অমূল্য মূলধন। সততা বিহীন জীবন তুচ্ছ ও মূল্যহীন। সততা আছে বলেই আল্লাহ রহমতের বারিধারা বর্ষণ করেন। সততা মানব চরিত্রের এক অনন্য গুণ। সততার ছোঁয়ায় মানব চরিত্র হয়ে ওঠে মহিমান্বিত। সত্যের শক্তিতে জাগ্রত ব্যক্তিই সর্বক্ষেত্রে সততা প্রদর্শন করেন। আর এর মধ্য দিয়েই মানুষ অর্জন করে মনুষ্যত্ব। সমাজের স্থিতিশীলতা সততার কারণেই বজায় রয়েছে। বিগত প্রত্যেক নবী-রাসূল সৎ মানুষ ছিলেন। সততা মুমিন জীবনের অমূল্য সম্পদ। আমরা যেন আমাদের সার্বিক জীবনে সততার পথে চলতে পারি, আললাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!

ড. ইহসান ইলাহী যহীর

[লেখক : কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]

[1]. মুমিনূন ২৩/১-৩, ৮-১১

[2]. তিরমিযী হা/৩৪৫২; আবুদাঊদ হা/৪৭৮১।

[3]. বুখারী হা/২৬৯২; মুসলিম হা/২৬০৫; মিশকাত হা/৪৮২৫

[4]. মুসলিম হা/২৬০৫; মিশকাত হা/৫০৩১

[5]. বুখারী হা/৬০৯৪; মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪

[6]. মুসলিম হা/২৬০৭; মিশকাত হা/৪৮২৪।

[7]. তিরমিযী হা/২৫১৮, হাদীছ ছহীহ; ত্বাবারাণী ছগীর হা/২৮৪; মিশকাত হা/২৫১৮

[8]. বুখারী হা/২৬৫৪; মুসলিম হা/৮৭

[9]. আহমাদ হা/২০০৪৬; আবুদাঊদ হা/৪৯৯০; তিরমিযী হা/২৩১৫; দারেমী হা/২৭৪৪; মিশকাত হা/৪৮৩৪

[10]. বুখারী হা/৭০৪৭

[11]. তিরমিযী হা/২৪০৭, সনদ হাসান; মিশকাত হা/৪৮৩৮

[12]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৬২১; বায়হাক্বী শো‘আব হা/৪৬৩৬; মিশকাত হা/৪৮৬৯

[13]. তিরমিযী হা/২৪০৬; মিশকাত হা/৪৮৩৭

[14]. বুখারী হা/৬৪৭৪; মিশকাত হা/৪৮১২

[15]. তিরমিযী, হা/২৪০৯; হাকেম হা/৮০৫৯; ছহীহাহ হা/৫১০

[16]. তিরমিযী হা/২৩১৭; মিশকাত হা/৪৮৩৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯১১

[17]. বুখারী হা/২০৭৯; মুসলিম হা/১৫৩২; মিশকাত হা/২৮০২



আরও