অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের চার মাস : কিছু কথা
আহসান শেখ
পাহাড়-পর্বত ও সবুজ বনজঙ্গলে ঘেরা অপূর্ব সৌন্দর্যমন্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পার্বত্য চট্টগ্রামের মোট আয়তন ১৩১৪৮ বর্গ কিমি যা লেবানন, সাইপ্রাস, ব্রুনাই, কাতার কিংবা লুক্সেমবার্গের আয়তনের চেয়েও বড়।[1] দেশের সমগ্র ভূ-খন্ডের এক দশমাংশ এই পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি অনাহরিত সম্পদের বিশাল ভান্ডার হিসাবেও সম্ভাবনাময়। কিন্তু একই সাথে তা বহু সমস্যায় আকীর্ণও বটে। পুরো অঞ্চলটি দুর্গম হওয়ায় বাকী বাংলাদেশের সাথে অঞ্চলটির যোগাযোগ ও অঞ্চলটিতে সরকারের অভিগম্যতা ততটা স্বচ্ছন্দ নয়। সেই সাথে যোগ হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই এই অঞ্চলে শুরু হওয়া বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। এহেন পরিস্থিতিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের সামনে একই সাথে সম্ভাবনার দুয়ার ও কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসাবে উপস্থিত হয়েছে।
বান্দরবান যেলার রুমা এবং থানচি উপযেলার সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কেএনএফ (কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট) ২রা এপ্রিল সন্ধ্যায় রুমাতে সোনালী ব্যাংক ডাকাতের চেষ্টা এবং ৩রা এপ্রিল দুপুরে থানচি বাজারে সোনালী এবং কৃষি ব্যাংকে ডাকাতি করে। রুমা ব্যাংক থেকে কোন টাকা নিতে না পারলেও থানচির দু’টি ব্যাংক থেকে ১৭ লাখ টাকা লুট করতে সমর্থ হয়। আর রুমা থেকে টাকা নিতে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ ও আনসারের ১৪ টি অস্ত্র লুট করে এবং ব্যাংক ম্যানেজার মুহাম্মাদ নিযামুদ্দীনকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে ফিরিয়ে দেয়। কেএনএফ কর্তৃক হঠাৎ এই সন্ত্রাসী তৎপরতার ঘটনা ও এর পিছনের কারণ নির্ণয় গভীর বিশ্লেষণের দাবী রাখে’।[2]
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদের সূত্রপাত : ব্রিটিশ বেনিয়া গোষ্ঠী ভারতের শাসন ক্ষমতা গ্রহণের পূর্বে সমগ্র ভারতবর্ষের ন্যায় চট্টগ্রামের জনগণ সাম্প্রদায়িক সংঘাত মুক্তভাবে সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে বসবাস করছিল। ব্রিটিশ অনুসৃত Divide and Rule পলিসিতে চট্টগ্রামের বাঙালী জনগোষ্ঠীর সাথে পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর বিভেদের বীজ রোপণ করে। এ বিভেদকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য ১৮৫০ সালের ২২তম প্রশাসনিক Act বলে চট্টগ্রামকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাকে আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রাম যেলায় পরিণত করা হয়। পরবর্তীতে এই বিভাজনকে আরো স্থায়ী করতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা তিনটি সার্কেলে ভাগ করা হয়। নবগঠিত সার্কেলে বাঙালীরা তখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং প্রাচীন অধিবাসী হওয়া সত্বেও এগুলির নামকরণ করা হয় চাকমা, বোমা ও মং সার্কেল নামে। বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য উক্ত তিন সার্কেলের প্রধান করা হয় উপজাতীয় সদস্যদেরকে। অথচ ইতিহাস-ঐতিহ্য, প্রাচীনতা ও সংখ্যার দিক থেকে বাঙালী মুসলমানরাই ছিল সেখানের অধিবাসী ও সংখ্যাগরিষ্ঠ। ব্রিটিশ সরকারের ১৯৭২ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায়, চট্টগ্রামে তখন ৭০% এর বেশি মুসলিম ছিল। বাকীরা ছিল অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। উক্ত আদমশুমারীর হিসাব দেখেই ব্রিটিশ রাজশক্তি বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে মুসলিমশূন্য করার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। উক্ত পদক্ষেপ সমূহের অন্যতম হলো : ১. Chittagong Hill tracks Fortier police Regulation of 1881 ২. 1900 Regulation or Manual ৩. Government of India act-1935[3]
পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে প্রণীত ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রামকে Totally Excluded Area বা সম্পূর্ণ পৃথক অঞ্চল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়। এর ফলে সমতল অঞ্চলের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামের সম্পর্ক ছিন্ন হয়, উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার বীজ ছড়ায়। মূলত বৃটিশরা এ সকল অযৌক্তিক আইনের দ্বারা এ অঞ্চলে ভবিষ্যৎ বিচ্ছিন্নতাবাদের বীজ বপন করে যায়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবীর ভিত্তি মূলত ঔপনিবেশিক শাসন ও আমাদের প্রণীত অযৌক্তিক আইনের ধারা সমূহ’।[4]
কেএনএফের উৎপত্তি ও বিকাশ : নাথান বোম নামে জনৈক উচ্চাভিলাসী বেকার যুবক কেএনএফকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট এর একজন গ্রাজুয়েট। ছাত্র জীবন শেষে তিনি UNDP-এর একটি প্রজেক্টে কাজের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেখানে কিছু চাকমা যুবক চাকরী পেলেও তিনি ব্যর্থ হন। ফলে তার মনে ক্ষোভ জন্মে। এ সময় তিনি ধর্মীয় পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং মিজোরামে কিছু খ্রিস্টান নেতার সাথে তার যোগাযোগ ঘটে। তাদের মাধ্যমে নাথান বোম ইউরোপ গমন করেন এবং বেশ কয়েক বছর সেখানে অবস্থান করে পাহাড়ে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। উল্লেখ্য, ‘বোম’ জাতিগোষ্ঠীর সবাই খ্রিস্টধর্মাবলম্বী।
নাথান বোম এলাকায় ফিরে একটি এনজিও গড়ে তোলেন, যার নাম ছিল ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন’ (কেএনডিও)। এই এনজিওর মাধ্যমে তিনি ‘বোম’ জাতীগোষ্ঠীকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। এই এনজিওর আড়ালে তিনি কর্মী সংগ্রহ করে একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এরপর ২০১৮ সালে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে তিনি মিয়ানমারের চির রাজ্যে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেন। ২০২২ সালে ফিরে এসে নাথান এবং তার সঙ্গীরা এক ধর্মীয় পন্ডিতকে তাদের এনজিও অফিসে তুলে নিয়ে বেধড়ক মারধর করেন। এরপর থেকে তিনি এলাকা ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি বান্দরবান ও রাঙামাটি যেলার ৯টি উপযেলা নিয়ে ফেসবুকে একটি আলাদা রাজ্য গঠনের ঘোষণা দেন এবং সশস্ত্র দলের ছবিসহ অন্যান্য কর্মকান্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন। শুরুতে তারা ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য নিয়ে সশস্ত্র দল গঠন করে। বর্তমান তাদের সদস্য সংখ্যা সাত শতাধিক বলে জানা যায়। গত বছর তাদের চারটি হামলায় সেনাবাহিনীর পাঁচ জন সদস্য নিহত হয়। গত দু’বছরে তারা মোট ৯টি বড় ধরনের সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে’।[5]
সমাধান : ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী ও র্যাবের যৌথ অভিযানে কেএনএফের সমন্বয়কসহ বেশ কিছু সদস্য গ্রেফতার হয়েছে। এই অভিযান যেন এখানেই শেষ না হয়। এই অভিযানের পাশাপাশি অত্র এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়ের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তবে গহীন পাহাড়ে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রভাব বজায় রাখার জন্য সেনাবাহিনীর ক্যাম্পগুলো পুনরায় সক্রিয় করে তুলতে হবে। এতে হয়তোবা কথিত মানবাধিকার গ্রুপগুলো মায়াকান্না শুরু করতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব আমাদেরকেই রক্ষা করতে হবে। আমরা নিজেরা মানবাধিকার রক্ষার ব্যাপারে সতর্ক ও যত্নশীল থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লক্ষণীয় বিষয় : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষার্থী নাথারন বোমের হঠাৎ মিজোরামের খ্রিস্টান গুরুদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলা ও তাদের সহায়তায় ইউরোপ গমন, অতঃপর ইউরোপ থেকে ফিরে এসে প্রথমে এনজিও গড়ে তোলা ও পরবর্তীতে কেএনএফ গঠন করা পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ সন্দেহজনক। নাথান বোমের বিচ্ছিন্নতাবাদী হয়ে উঠার এই পুরো প্রক্রিয়াটা সূক্ষ্মভাবে স্টাডি করলে এর পিছনে কোন বৈদেশিক কোন গোষ্ঠীর মদদের সন্ধান পাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। যথাসম্ভব দ্রুত এর পিছনের মূলহোতাদের অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। নতুবা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরিতে কেএনএফসহ অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অপতৎপরতায় পার্বত্য অঞ্চল বসবাসের অনুপযোগী হয়ে ঊঠবে। আমরা হয়তোবা আরও একটি দীর্ঘস্থায়ী কাউন্টার ইনসার্জেন্সি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারি।[6] অদূর ভবিষ্যতে দেশের ভূখন্ড থেকে পুরোপুরি আলাদা করে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পৃথক রাষ্ট্রের দাবী উঠার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি মাটি সকল ধরনের অপতৎপতা থেকে মুক্ত রাখুন আমীন!।[7]
সাইফুর রহমান
[লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ, দিনাজপুর-পূর্ব সাংগঠনিক যেলা]
[1]. পার্বত্য চট্টগ্রাম : Parbattanews, বিচ্ছিন্নতাবাদের বর্তমান প্রবনতা, প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রব ১ ডিসেম্বর ২০২২ পৃ. ০১।
[2]. (‘‘কেএনএফ সন্ত্রাস’’ : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা, ড. একে এম মাকসুদুল হক, দৈনিক নয়া দিগন্ত, ঢাকা ২০ এপ্রিল ২০২৪ পৃ. ০৬।
[3]. সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও আরাকান এম এম নজরুল ইসলাম, (সাগরিকা প্রিন্টার্স চট্টগ্রাম, ২য় সংস্করণ ২০১৭) পৃ. ১৭১-১৭২)।
[4]. পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্নতাবাদের বর্তমান প্রবণতা পৃ. ২৩-২৪।
[5]. কেএনএফ সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা পৃ. ০৬।
[6]. প্রাগুক্ত।
[7]. কেএনএফ সন্ত্রাস : সার্বভৌম নিরাপত্তা সতর্কতা পৃ. ঐ।