প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবে
প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
মুহাম্মাদ মুসলিম (রাজশাহী) 310 বার পঠিত
[জনাব মুহাম্মাদ মুসলিম (৭৪) ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র শুরুর দিকের একজন সচেতন সংগঠক। তিনি ‘যুবসংঘে’র প্রতিষ্ঠাকাল থেকে একনিষ্ঠতার সাথে কাজ করেছেন। ‘ঝিনা সাংগঠনিক যেলা’ গঠনের সময় তিনি তাবলীগ সম্পাদক হিসাবে তার সাগঠনিক দায়িত্ব পালন শুরু করেন। যৌবনকালে তিনি সাংগঠনিকভাবে দাওয়াতী কার্যক্রমে যথাসাধ্য সময় ও শ্রম ব্যয় করেছেন। তাঁর জীবন ঘনিষ্ঠ নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন ‘তাওহীদের ডাক’-এর নির্বাহী সম্পাদক আসাদুল্লাহ আল-গালিব]
তাওহীদের ডাক : আপনি কেমন আছেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি।
তাওহীদের ডাক : আপনার জন্ম ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : আমার জন্ম ১৯৫০ সালে। তবে তারিখ জানা নেই। আমার শিক্ষাজীবন বেশী দীর্ঘ নয়। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে আমি ৫ম শ্রেণী পাশ করি। এরপর পাশের গ্রাম মুহাম্মাদপুর জুনিয়র হাইস্কুলে ভর্তি হই। হাইস্কুলে ভর্তির কিছু দিন পর আমি কালাজ্বরে আক্রান্ত হই। ঐসময় অনেকেই কালাজ্বরে মারা গিয়েছিল। তবে আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। ফালিল্লাহিল হামদ! সেসময় ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা খুবই কম ছিল। পর্যায়ক্রমে ৮ম শ্রেণী পাশ করে ৯ম শ্রেণীতে উঠার পরে আমার পিতা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের পর স্কুলে যাতায়াত শুরু করলে আমার পিতা বলেন, আমি তোমাকে আর পড়াতে পারব না। ফলে এখানেই আমার পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায়।
দু’বছর পর মুহাম্মাদপুর জুনিয়র হাইস্কুলটি উচ্চ বিদ্যালয় হ’লে প্রধান শিক্ষক ছাত্র সংগ্রহে এসে আমাকে বললেন, তোমাকে ৯ম শ্রেণীতে ভর্তি নিলাম, তুমি শুধু পরীক্ষা দিবে। প্রথম দিনই আমি সকাল সকাল জমি চাষ সেরে আধা ঘণ্টা পায়ে হেঁটে স্কুলে যাই। স্যারেরা আমাকে ক্লাসে পেয়ে অনেক খুশী হলেন এবং উৎসাহ যোগালেন। ফলে আমি গৃহকর্ম বজায় রেখে নিয়মিত ক্লাসে যেতে লাগলাম। এভাবে দু’বছর কেটে গেল। ম্যাট্রিকের টেস্ট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হ’লাম।
ফাইনাল পরীক্ষার পূর্ব মুহূর্তে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হ’ল। যুদ্ধ শেষে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হ’ল। কিন্তু আমার বাম হাতে তখন স্যালুলাইটিস তথা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হ’ল। এরপরও পরীক্ষা দিলাম এবং আশা না থাকলেও পাশ করলাম। অতঃপর নিকটে কোন উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় পুরোদস্ত্তর কৃষক হয়ে গেলাম।
তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘে’র সাথে আপনার পথ চলা শুরু হয় কবে থেকে?
মুহাম্মাদ মুসলিম : দেশ স্বাধীনের পর স্থানীয় স্বাধীনচেতা মুক্তিযোদ্ধারা বামপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেয় এবং তারা আমাকেও তাদের দলে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। আমার কর্মদক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার কারণে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে আমি নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কিন্তু তাদের অনেক কাজ আমার পসন্দ হ’ত না। কোন পরামর্শ দিলে তারা তা গ্রহণ না করে আমাকে ‘বুর্জোয়া’ বলে তিরষ্কার করত। ফলে আমি তাদের সঙ্গ ত্যাগ করি। কিন্তু সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করার প্রবল ইচ্ছা হ’ত।
কৃষি কাজের অবসরে আমি বেকার। তাই অবসরে আমি ঝিনা ইসলামিয়া মাদ্রাসার আবাসিক শিক্ষকদের সাথে থাকতাম। মাষ্টার আব্দুল খালেকও মাঝে মাঝে মাদ্রাসায় আসতেন। ইসলামী আন্দোলন নিয়ে তার সাথে আমাদের আলাপ-আলোচনা হ’ত। মাষ্টার ছাহেব আগে থেকেই সাপ্তাহিক আরাফাত পড়তেন। তিনি পত্রিকা হাতে পেলেই এক কপি মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিতেন। একদিন তিনি আরাফাত হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে মাদ্রাসায় এসে সকলকে ডেকে বললেন, সকল দলের যুবসংগঠন আছে। আর জমঈয়তের যুবসংগঠন হ’ল ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’। তিনি আমাদেরকে নিয়ে একটি মিটিং করলেন। সকলের পরামর্শে পত্রিকায় দেওয়া ঠিকানায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব বরাবর চিঠি লেখা হ’ল এবং খুব দ্রুত চিঠির উত্তরও আসল। সেই চিঠির পরামর্শ মোতাবেক আমরা মাদ্রাসায় ‘যুবসংঘ’-এর একটি শাখা গঠন করলাম। এভাবেই ‘যুবসংঘ’-এর সাথে আমার পথ চলা শুরু হয়েছিল।
তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে কিভাবে আপনার প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল?
মুহাম্মাদ মুসলিম : ১৯৮০ সালের শেষ দিকে আমরা জানতে পারলাম যে, আমীরে জামা‘আত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেছেন। তখন আব্দুল খালেক মাষ্টার (উপরবিল্লী), বর্তমানে ‘আন্দোলনে’র কেন্দ্রীয় দাঈ অধ্যাপক আব্দুল হামীদ (মোহনপুর, রাজশাহী), মাওলানা আব্দুল মান্নান সালাফী, মাওলানা নু’মান, মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান মন্ডল, মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম, ক্বারী ইয়াসীন, আব্দুল খালেক (ঝিনা), ডা. শাহজাহানসহ আমরা ১০জন যুবক স্যারের সাথে সাক্ষাতের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। পুরানো টিনশেড মাদারবখ্শ হ’লে স্যারকে পেলাম। ছোট রুমে দু’টি চৌকি। সেখানেই সবাই কষ্ট করে বসলাম। প্রায় ঘণ্টা খানেক আমাদের সাথে আন্তরিকতার সাথে আলোচনা করলেন। যা আমাদের স্মৃতিপটে আজও অম্লান আছে। তিনি সেদিন বলেছিলেন, এই দাওয়াতী ময়দানে আমাদের প্রথম বাধা আসবে আমাদের ঘর থেকেই। শেষে উনি একটি সম্মেলন করার কথা বললেন। ইতিমধ্যে আছরের ছালাতের সময় হ’লে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে গিয়ে ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেউ ইউনিভার্সিটি স্টেশন, কেউ রাজশাহী স্টেশন থেকে ট্রেনে বাড়ি ফিরলাম। এই দিনের পর আমরা বাড়ি ফিরে আরও জোরদার গতিতে দাওয়াতী কাজ শুরু করলাম।
তাওহীদের ডাক : ঝিনা সাংগঠনিক যেলা কবে গঠন হ’ল?
মুহাম্মাদ মুসলিম : ১৯৮৪ সালের ৪ঠা মে ‘যুবসংঘ’-এর ২য় কেন্দ্রীয় শূরা সম্মেলনের একটি সিদ্ধান্ত ছিল, কমপক্ষে ১০টি শাখার সমন্বয়ে একটি সাংগঠনিক যেলা গঠিত হবে। সে সময় ঝিনাকে কেন্দ্র করে আশে-পাশে প্রায় ৮/১০টি শাখা ভালোই কাজ করছিল। ক্রমে ক্রমে অগ্রগতিও হচ্ছিল। আমরা ঐ সময় আমীরে জামা‘আতকে প্রস্তাব দেই যে, আমরা এখানে একটি সম্মেলন করব। উনি একমত হন এবং দিন ধার্য করে বক্তা নির্বাচন করে দেন। ড. মুজীবুর রহমান, ড. আফতাব আহমাদ রহমানী এবং উনি নিজে। পোস্টার ছাপানো হ’ল। অনেক প্রচার হ’ল। ফলে অনেক আহলেহাদীছ প্রিয় আলেম এসে উপস্থিত হলেন। ড. রহমানী স্যার আসতে পারেননি। ওদিকে আলোচনা চলছিল আর আমীরের জামা‘আত প্রশিক্ষণ কর্মসূচী চালাচ্ছিলেন। সম্মেলনের পর চারিদিকে ‘যুবসংঘে’র শাখা ছড়িয়ে পড়ল। ফলে আমীরে জামা‘আত এটাকে সাংগঠনিক যেলা করার পরামর্শ দিলেন। কিছুদিন পর অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ভাই আমাদের এলাকায় সফরে আসেন এবং কয়েকদিন থেকে শাখাসমূহ পরিদর্শন করে যান। উনার রিপোর্ট অনুযায়ী সংগঠনিক যেলা গঠিত হয়। এভাবেই ‘ঝিনা’ সাংগঠনিক যেলার মান পেয়ে যায়। অতঃপর ১৯৮৭ সালে শাখার সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেলে ঝিনা সাংগঠনিক যেলা বাতিল হয় এবং তা রাজশাহী সাংগঠনিক যেলায় পরিণত হয়।
তাওহীদের ডাক : তৎকালীন সময়ের দ্বীনী ভাইদের মধ্যে মধ্যে মরহুম আব্দুল খালেক মাষ্টার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : উপরবিল্লীর অব্দুল খালেক মাষ্টার ভাই আমাদের থানার মধ্যে একজন নামকরা শিক্ষক ছিলেন। তিনি সরকারের সমস্ত নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে মেনে চলতেন। যথা সময়ে স্কুলে যেতেন এবং ফিরে আসতেন। কখনও ফাঁকি দিতেন না। তাঁর আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলনা। উনি আগে থেকেই আহলেহাদীছ ছিলেন ও সাপ্তাহিক আরাফাতের নিয়মিত পাঠক ছিলেন। উনার কাছে আরাফাত আসলে মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দিতেন। তার মধ্যে স্যারের লেখা থাকত। তাতে আমরা স্যারের নামের সঙ্গে পরিচিত হই। প্রথম প্রথম আমরা বেশ উদ্যোগী ছিলাম। আব্দুল খালেক মাষ্টার যেহেতু শিক্ষকতা করতেন সেহেতু নিয়মিত সফরে যেতে পারতেন না। তখন বিভিন্ন শাখায় আমাদের সাপ্তাহিক মিটিং হ’ত। তিনি সাপ্তাহিক মিটিংগুলোতে নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন।
তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার পর মাঠ পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রম কতটা অনুকূলে ছিল?
মুহাম্মাদ মুসলিম : যুবসংঘ গঠনের পূর্বে জমঈয়ত কর্তৃক মাঠ পর্যায়ে তেমন কোন কাজ ছিল না। আহলেহাদীছ সমাজে দাওয়াতী কাজ না থাকায় অনেকেই বিভিন্ন তন্ত্রে-মন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তরুণ সমাজকে পপুলার ইসলামে বিশ্বাসী ব্যক্তিরা টার্গেট করেছিল। ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার পর আহলেহাদীছ যুবকরা কাজ করার একটি প্লাটফর্ম পেয়ে যায়। যাতে তারা দুনিয়াবী যাবতীয় ফিৎনা-ফাসাদ থেকে মুক্ত হয়ে সঠিক দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকে। উৎসুক জনতা চাতক পাখির মত এমনই একটি দাওয়াতী কার্যক্রমের প্রত্যাশী ছিল। ফলে মাঠ পর্যায়ে দাওয়াতী ও সাংগঠনিক কার্যক্রম অনুকূলে ছিল।
তাওহীদের ডাক :‘যুবসংঘে’রসাথে আপনার প্রথম দিকের পথচলার কিছু স্মৃতি যদি বলতেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : ১৯৮৪ সালের ৩১শে আগস্ট শুক্রবার রাণীবাজার মাদ্রাসা মার্কেটের ৩য় তলায় ৩য় শূরা সম্মেলনে ৩৪ জন কর্মীকে ‘কাউন্সিল সদস্য’ হিসাবে মনোনীত করা হয়। তন্মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। ঐ মিটিংয়েই পূর্বের এডহক কমিটি বাতিল করে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সদস্যদের মধ্য থেকে আমিসহ ১৫জনকে মজলিসে শূরার সদস্য করা হয়। এই দিনেই কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রাজশাহী নিউ ডিগ্রী কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল অধ্যাপক আব্দুন নূর সালাফীর (রংপুর) পরিচালনায় ‘যুবসংঘে’র পূর্ণ কমিটি গঠন করা হয়। তার আগে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে এবং নিজের ভোট নিজেকে দিতে পারবে না এই শর্তে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অতঃপর গণনাকৃত ২৯টি ভোটের ২৮টি ভোট পেয়ে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত যুবসংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৮৭ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারী ১ম কেন্দ্রীয় কাউন্সিল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে ‘যুবসংঘে’র ৩য় সেশন ১৯৮৭-৮৯-এর নতুন কমিটি গঠন হয়। ঐ দিনের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি হ’ল মুহাম্মাদ আবুবকর (ঝিনাইদহ)-কে সভাপতি, মুহাম্মাদ এনামুল হক (চাঁপাই নবাবগঞ্জ)-কে সহ-সভাপতি ও গোলাম কিবরিয়া (দিনাজপুর)-কে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা। আর এই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন ড. আব্দুল বারী স্যার এবং আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আব্দুল মতীন সালাফী, আব্দুছ ছামাদ সালাফী, অধ্যাপক আব্দুন নূর সালাফী, অধ্যাপক হাসানুযযামানসহ ৬জন উপদেষ্টা এবং সদস্য সচিব ছিলেন ‘যুবসংঘে’র নতুন সভাপতি মুহাম্মাদ আবুবকর।
তাওহীদের ডাক : আপনি ‘যুবসংঘে’রপ্রথম মজলিসে শূরার সদস্য ছিলেন। সাংগঠনিকভাবে ‘যুবসংঘ’ যে কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিল, সে বিষয়ে আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু বলবেন।
মুহাম্মাদ মুসলিম : সংগঠন ৬ষ্ঠ বর্ষ থেকে ৭ম বর্ষে পা দেয়ার পরপরই ‘জমঈয়ত’ সভাপতি কর্তৃক ‘যুবসংঘে’র উপর বিধিনিষেধের কঠিন চ্যালেঞ্জ নেমে আসে। জমঈয়ত সভাপতি ড. আব্দুল বারী স্যার ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই কোন অজানা কারণে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করতেন। কখনও তিনি বট গাছের ছায়ায় আশ্রয় নেওয়ার উদাহরণ দিয়ে শিশু, যুবক ও বৃদ্ধ সকলের জন্য একটিই প্লাটফর্ম হবে বলে বক্তৃতা করতেন। যখন ‘যুবসংঘে’র গ্রহণযোগ্যতা ও দাওয়াতের বিস্তৃতি গ্রামে-গঞ্জে ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে, তখন ‘জমঈয়ত’ সভাপতির বিরোধিতা যেন দিন দিন প্রকট হ’তে থাকে। যখন তার পিতৃত্বের ছায়ায় যুবকরা এগিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছিল, তখন তাঁর এই বিরোধিতা ছিল সত্যিই বিস্ময়কর এবং অপ্রত্যাশিত। তিনি বলতে থাকেন, (১) ‘যুবসংঘ’ বৌদ্ধ শব্দ। এই নাম চলবে না। (২) পরে ১৯৮০ সালের গঠনতন্ত্রে জমঈয়তের জন্য শুববান বিভাগ রাখা হ’ল। বলা হ’ল জমঈয়তের পক্ষ হ’তে শুববান বিভাগ পরিচালিত হবে। শুববান বিভাগের আলাদা কোন গঠনতন্ত্র থাকবে না। শুববান বিভাগের আলাদা কোন পত্রিকা থাকবে না ইত্যাদি। সবশেষে তিনি মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে স্বয়ং ‘যুবসংঘে’র সাথেই সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করেন। অথচ তার কিছুদিন পরই ১৯৮৯ সালের ২৮শে নভেম্বর ‘জমঈয়ত শুববানে আহলেহাদীস’ নামে পৃথক যুবসংগঠনের নাম ঘোষণা করেন। এভাবে যুবসংঘ-এর বর্তমানে পুনরায় ‘শুববান’ নামে আরেকটি যুবসংগঠন তৈরীর মাধ্যমে তিনি আহলেহাদীছ জামা‘আতকে বিভক্ত করে দেন।
তাওহীদের ডাক : ‘জমঈয়তে’র ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণার পর পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করার জন্য ‘যুবসংঘ’ কি কোন পদক্ষেপ নিয়েছিল?
মুহাম্মাদ মুসলিম : ‘যুবসংঘ’-এর পক্ষ থেকে বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে, কখনও সরাসরি জমঈয়ত সভাপতির সাথে বসে সম্পর্কহীনতা নিরসনের চেষ্টা করা হয়। যেমন সম্পর্কহীনতা ঘোষণার প্রায় চার মাস পরে কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে সমাধানের লক্ষ্যে ড. আব্দুল বারী স্যারের সাথে সরাসরি সাক্ষাতের জন্য ইউজিসিতে তাঁর সরকারী বাসভবনে যাওয়া হয়েছিল। সেদিন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও সিরাজ ভাইয়ের সাথে আমিও ছিলাম। কোন এক কথার কারণে ঐ ঘরোয়া বৈঠকে সিরাজ ভাইকে কটাক্ষ করে আব্দুল বারী স্যার বললেন, এই শ্রীমান! খুব বেড়ে গেছে। এ সময় আমীরে জামা‘আত বলেছিলেন, স্যার! আপনি ‘জাতিসংঘ’ বলেন। অথচ ‘যুবসংঘ’ বলতে আপত্তি করেন কেন? সেদিন বিদেশী মেহমান শেখ তারেক ‘যুবসংঘে’র গুরুত্ব এবং সাথে সাথে জামা‘আতী ঐক্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করলেও কোন লাভ হয়নি। ফলে বৈঠক ব্যর্থ হ’ল। এরপর ‘যুবসংঘে’র কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দল শেখ রফীক ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকায় গিয়ে স্যারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। রফীক ভাই ফিরে এসে বলেন, যার পা ধরে কাঁদবো, তিনি যদি মুখে লাথি মারেন, তাহ’লে কিভাবে ঐক্য হবে? এছাড়াও সাতক্ষীরা ও যশোর থেকে মুরববীরা গিয়ে ড. আব্দুল বারী স্যারকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত বলে সামনে বাড়ার কোন সুযোগ দেননি।
তাওহীদের ডাক : ‘যুবসংঘে’র সাথে ‘জমঈয়তে’র ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণার পরবর্তী পেক্ষাপট কেমন দেখেছেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : ১৯৮৯ সালে ‘জমঈয়তে’র সাথে ‘যুবসংঘে’র ‘সম্পর্কহীনতা’র কোন প্রভাব আমাদের এলাকায় পড়েনি। কারণ এলাকায় জমঈয়তের কোন তৎপরতা ছিল না। এখনও নেই বলা চলে। তবে ‘জামায়াতে ইসলামী’রা আমাদের এ বিষয়ে বড় প্রশ্নের সম্মুখীন করত।
তাওহীদের ডাক : অন্যান্য ইসলামী সংগঠন ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র মধ্যে পার্থক্য কী বলে আপনি মনে করেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : অন্যান্য ইসলামী সংগঠন ও আহলেহাদীছ সংগঠনের মধ্যে আক্বীদা ও আমলগত অনেক পার্থক্য রয়েছে। কেননা ইসলামী কোন সংগঠনই ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির জন্য পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে একমাত্র মানদন্ড হিসাবে গ্রহণ করেনি। বরং কেউ ইসলাম প্রচারের মাধ্যম হিসাবে বুযুর্গানে দ্বীন, আকাবির ও অতিরঞ্জিত ফাযায়েল-মাসায়েলে বিশ্বাসী। আবার পপুলার ইসলামে বিশ্বাসী কিছু সংগঠন ব্যালটে বিশ্বাসী। যেখানে জনগণকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস ও অধিকাংশের রায় চূড়ান্ত মনে করা হয়, যা সম্পূর্ণ শিরকী আক্বীদা। এছাড়া তাদের সাথে প্রকৃত ইসলামের নানাবিধ সাংঘর্ষিক বিষয় রয়েছে। এছাড়াও কিছু খারেজী আক্বীদা সম্পন্ন সংগঠন রয়েছে, যারা বুলেটে বিশ্বাসী। যা আদৌ ইসলামী আদর্শ নয়। এছাড়াও আহলেহাদীছ নামধারী কিছু সংগঠন রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন তন্ত্রে-মন্ত্রে বিশ্বাসী লোকদের ঠিকানা হয়েছে। যারা কখনোই আহলেহাদীছদের প্রকৃত স্পীরিট বুঝেনা।
তাওহীদের ডাক : আমীরে জামা‘আতের সাথে আপনার উল্লেখযোগ্য কোন স্মৃতি বলবেন কি?
মুহাম্মাদ মুসলিম : আমীরে জামা‘আত যখন মাদারবখ্শ হলে থাকতেন তখন আমি একদিন তার সাথে সাক্ষাৎ করে রাত্রে হলেই ছিলাম। ফজরের ছালাত পর তিনি বললেন, চলুন একটু হেঁটে আসি। এদিন আমি প্রশ্ন করলাম, আমরা ক্ষমতায় না গেলে কিভাবে দ্বীন কায়েম হবে? উনি উত্তর দিলেন আমরা দেড় কোটি আহলেহাদীছ এর মধ্য হ’তে যদি এক লক্ষ সাংগঠনভুক্ত যুবক সংসদ ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাবী করি, কুরআন ও ছহীহ হাদীছ মোতাবেক দেশের আইন চালু করতে হবে, তাহ’লে কি পার্লামেন্ট আমাদের দাবি মানবে না? তখন আমার সমস্ত সংশয় দূর হয়ে গেল।
এছাড়াও কোন প্রয়োজনে রাজশাহী শহরে গেলে আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ না করে আসলে আত্মতৃপ্তি হ’ত না। তার সাথে সাক্ষাৎ করলে দাওয়াতী জাযবা বৃদ্ধি পেত।
তাওহীদের ডাক : ব্যক্তি জীবনে আপনার এমন কোন অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি আছে কি যা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করবে?
মুহাম্মাদ মুসলিম : আমি কোন কেন্দ্রীয় মিটিং মিস করতাম না। কখনও ট্রেন মিস হ’লে আমি সাইকেল চালিয়ে চলে যেতাম। একদিন মিটিংয়ে উপস্থিত হওয়ার জন্য ট্রেন ধরতে কাকনহাট স্টেশনের নিকটবর্তী হ’তেই দেখলাম ট্রেন চলে গেল। তাই বাড়ী ফিরে এলাম। এশার ছালাতের পর সাইকেল চালিয়ে রাজশাহীতে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। এমন সময় পাশের বাড়ীতে ডাকাত পড়ে। তখন আমার বাবা বন্দুক বের করে দিয়ে বললেন, বাবা যাও। তখন আমি বন্দুক নিয়ে আমাদের বাড়ী থেকেই ডাকাত আক্রান্ত বাড়ীর দরজা লক্ষ্য করে ফায়ারিং করা শুরু করলাম। কিন্তু খুব বেশী সুবিধা হচ্ছিল না। তাই বাড়ী থেকে বের হয়ে ধান মাড়াইয়ের খলেন থেকে ফায়ার করলাম। এরপর পাশের বাড়ীর ওয়াল টপকিয়ে অন্য সাইড থেকেও ফায়ার করলাম, যাতে ডাকাতরা মনে করে আমরা বেশ কয়েকজন বন্দুকধারী আছি। কিছুক্ষণ পর আরও দু’জন বন্দুক নিয়ে আসল।
তারপর আমি আক্রান্ত বাড়ির সরাসরি সামনে কুয়ার পিছনে নিরাপদ জায়গা দেখে দরজা বরাবর ফায়ার করলাম। এবার গুলি গিয়ে সরাসরি ডাকাত সর্দারের হাতে লাগল। তখন ডাকাতদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুরু হয়ে গেল। ওরা যখন বাড়ী থেকে বের হচ্ছে তখন আমি আবারও ফায়ার করলাম, কিন্তু কার্তুজ কাটল না। মূলত এই কার্তুজ নষ্ট ছিল। আর পাশের জন ভয়ে ফায়ার করতে পারল না। ফলে ডাকাতরা চলে গেল। একারণে আমার ঐ দিনের মিটিং মিস হয়ে গেল।
তবে নযরুল ইসলাম ভাই মিটিংয়ে যাওয়ার সময় তাকে বিষয়টি জানালাম, যেন তিনি স্যারকে ঘটনাটি জানিয়ে দেন।
মূলত আমাদের এলাকায় তখন মাঝে-মধ্যে ডাকাত পড়ত। তাই এলাকার ৬-৭ জনের কাছে সরকারী লাইসেন্সকৃত বন্দুক ছিল। পরবর্তীতে বন্দুক রাখার চার্জ বেড়ে গেল। আবার কার্তুজও ঠিক মত পাওয়া যেতনা। তার চেয়ে বড় কথা, ডাকাতদের উপদ্রব একেবারেই শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল। তাই আমরা বন্দুক জমা দিয়ে দিয়েছিলাম।
তাওহীদের ডাক : যুবসমাজের জন্য যদি কিছু নছীহত করতেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : যুব সমাজের প্রতি আমার একটাই নছীহত আমীরে জামা‘আতের লেখনী পড়ুন। তার বক্তব্য শুনুন ও আমল করুন। কেননা কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে পড়লে আর যাই হোক ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জন করা সম্ভব নয়।
তাওহীদের ডাক : ‘তাওহীদের ডাক’ পত্রিকার পাঠকদের উদ্দেশ্যে যদি কিছু নছীহত করতেন?
মুহাম্মাদ মুসলিম : বর্তমানে দাওয়াতের ময়দান বিস্তৃত। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মাধ্যমে দ্বীনের সঠিক দাওয়াত মানুষের নিকট খুব দ্রুতই পৌঁছানো সম্ভব। তবে সঠিক দাওয়াত লোকদের নিকট পৌঁছালেই যে মানুষ গ্রহণ করবে এমনটি নয়। সেজন্য ত্বরিৎ ফল কামনা না করে ধৈর্যের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ একদিন সাফল্য আসবেই।
তাওহীদের ডাক : আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
মুহাম্মাদ মুসলিম : আমার সাক্ষাৎকার ‘তাওহীদের ডাকে’ প্রকাশের জন্য পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ।