মোবাইল আসক্তি ও উত্তরণের উপায়
সাইফুর রহমান
উপস্থাপনা : মানুষের শরীর কিছুটা ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের মত। দীর্ঘক্ষণ ব্যবহারের ফলে ডিভাইস যেমন গরম হয়, তেমনি সারাদিন কর্মব্যস্ততার কারণে মানব শরীরও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। তখন দরকার হয় একটু বিশ্রাম, যা শরীর ও মনকে আবার কর্মক্ষম করে তোলে। তাই আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য ঘুমের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বলেন,وَجَعَلْنَا نَوْمَكُمْ سُبَاتًا وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ لِبَاسًا وَجَعَلْنَا النَّهَارَ مَعَاشًا ‘এবং তোমাদের জন্য নিদ্রাকে করেছি ক্লান্তি দূরকারী আমরা রাত্রিকে করেছি আবরণ এবং দিবসকে করেছি জীবিকা অন্বেষণকাল’ (নাবা ৭৮/৯-১১)। সুতরাং সারাদিন কাজ-কর্মের পর রাত্রিতে মানুষ ঘুমাবে এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু দীর্ঘদিন না ব্যবহারের ফলে অনেক ডিভাইস যেমন নষ্ট হয়ে যায়, তেমনি মাত্রাতিরিক্ত ঘুম শরীরের ক্ষতি করে। আবার অনিয়মিত ঘুমও শরীরকে অবসাদগ্রস্ত করে। আমরা অনেকে রাতে দেরিতে ঘুমানোর ফলে ফজরে যথাসময়ে উঠতে পারি না। এতে ফজরের ছালাত যেমন আদায় করা সম্ভব হয় না, তেমনি সারাদিন কাজে-কর্মে মন বসে না। ফলে শরীর ও আত্মা উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই রাতে দ্রুত ঘুমানো ও ফজরের সময় জাগ্রত হওয়া যরূরী। নিম্নে ফজরের ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায়ের গুরুত্ব ও করণীয়সমূহ উপস্থাপন করা হ’ল :
ফজরের ছালাত জামা‘আতের সাথে আদায়ের ফযীলত
১. উত্তম ছালাত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,أَفْضَلُ الصَّلَوَاتِ عِنْدَ اللهِ صَلَاةُ الصُّبْحِ يَوْمَ الْجُمُعَةِ فِيْ جَمَاعَةٍ ‘সর্বোত্তম ছালাত হ’ল জুম‘আর দিন জামা‘আতের সাথে ফজরের ছালাত’ (ছহীহাহ হা/১৫৬৬)।
২. শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আত্মরক্ষা : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের কেউ যখন নিদ্রা যায়, তখন শয়তান তার মাথার শেষভাগে তিনটি গিট দেয়। প্রত্যেক গিট দেওয়ার সময় এ কথা বলে কুমন্ত্রণা দেয় যে, তোমার সামনে দীর্ঘ রাত পড়ে আছে, অতএব তুমি ঘুমাও। অতঃপর যদি সে জেগে উঠে এবং আল্লাহ্কে স্মরণ করে, তখন একটি গিট খুলে যায়। অতঃপর যদি সে ওযূ করে, তবে দ্বিতীয় গিটও খুলে যায়। আর যদি সে ছালাত আদায় করে তবে সকল গিট খুলে যায়। ফলে সে সকাল করে প্রফুল্ল ও প্রশান্ত মনে। অন্যথায় তার সকাল হয় অলস ও কলুষিত মনে’।[1]
৩. জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি : কোন ব্যক্তি যদি ফজর ছালাত নিয়মিত জামা‘আতে আদায় করে, সে জান্নামের আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لَنْ يَلِجَ النَّارَ أَحَدٌ صَلَّى قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا يَعْنِيْ الْفَجْرَ وَالْعَصْرَ ‘এমন ব্যক্তি কখনোই জাহান্নামে যাবে না, যে সূর্য ওঠা ও ডোবার আগে ছালাত আদায় করেছে, অর্থাৎ ফজর ও আছরের ছালাত’।[2]
৪. জান্নাত লাভ : ফজর ছালাত ব্যক্তির জান্নাতে প্রবেশের পথ সহজ করে। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَلَّى الْبَرْدَيْنِ دَخَلَ الْجَنَّةَ ‘যে ব্যক্তি দুই ঠান্ডা অর্থাৎ ফজর ও আছরের ছালাত আদায় করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[3]
৫. ফেরেশতাগণের সাক্ষ্য প্রাপ্তি : ফজর ছালাত আদায় করলে ফেরেশতাগণের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে সে সংবাদ পৌঁছে যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘রাতের ফেরেশতাগণ ও দিনের ফেরেশতাগণ তোমাদের মাঝে পালাক্রমে আগমন করে। আর তারা ফজর ও আছরের ছালাতে একত্রিত হয়। তারপর তোমাদের মাঝে রাত যাপনকারীরা উপরে উঠে যায়। তখন তাদের প্রতিপালক তাদের জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা আমার বান্দাদের কোন অবস্থায় ছেড়ে আসলে? যদিও তিনি তাদের ব্যাপারে সর্বাধিক অবগত। উত্তরে তারা বলে, আমরা তাদেরকে ছালাতরত অবস্থায় ছেড়ে এসেছি, আর আমরা যখন তাদের কাছে গিয়েছিলাম তখনও তারা ছালাতরত ছিল’।[4] যদিও আল্লাহ সবই জানেন, তবুও তিনি ফেরেশতাদের নিকট বনু আদমের মর্যাদা বর্ণনার জন্য এরূপ করেন।
৬. আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ : ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিরাপত্তা লাভ করা যায়। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ صَلَّى صَلَاةَ الصُّبْحِ فَهُوَ فِي ذِمَّةِ اللهِ فَلَا يَطْلُبَنَّكُمُ اللهُ مِنْ ذِمَّتِهِ بِشَيْءٍ فَإِنَّهُ مَنْ يَطْلُبْهُ مِنْ ذِمَّتِهِ بِشَيْءٍ يُدْرِكْهُ ثُمَّ يَكُبُّهُ عَلَى وَجْهِهِ فِي نَارِ جَهَنَّمَ ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত (জামা‘আতে) আদায় করল, সে আল্লাহর যিম্মায় চলে এল। সুতরাং আল্লাহ যেন অবশ্যই তোমাদের কাছে তার যিম্মা সম্পর্কে দাবী না করেন। কারণ যার কাছেই তিনি তাঁর যিম্মার কিছু দাবী করবেন, তাকে পাকড়াও করবেন। অতঃপর তাকে উপুড় করে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন’।[5]
অপর হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন ব্যক্তি আল্লাহর যিম্মাদারীতে থাকে। (১) যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে যুদ্ধে বের হয়, সে আল্লাহর নিরাপত্তায় থাকে যে পর্যন্ত আল্লাহ তার মৃত্যু দান না করেন এবং জান্নাতে প্রবেশ না করান অথবা অর্জিত ছওয়াব ও গনীমতসহ ফিরিয়ে আনেন। (২) যে ব্যক্তি মসজিদে গমন করে, সে আল্লাহর দায়িত্বে থাকে এবং (৩) যে ব্যক্তি সালাম দিয়ে নিজের ঘরে প্রবেশ করে, সে আল্লাহর যিম্মাদারীতে থাকে’।[6]
৭. অসংখ্য প্রতিদান লাভ : ফজরের ছালাতে অসংখ্য প্রতিদান রয়েছে, যে সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষ জানে না। ফলে তারা অলসতা করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لَوْ يَعْلَمُ النَّاسُ مَا فِيْ صَلاَةِ الْعِشَاءِ وَصَلاَةِ الْفَجْرِ، لأَتَوْهُمَا وَلَوْ حَبْوًا ‘যদি লোকেরা জানত এশা ও ফজরের ছালাতে কী ফযীলত রয়েছে, তাহ’লে অবশ্যই তারা এই দু’ছালাতে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও আসত।[7]
এজন্য ওমর (রাঃ) সারারাত ছালাত আদায়ের চেয়ে ফজরের জামা‘আতকে গুরুত্ব দিতেন। আবুবকর ইবনু সুলায়মান ইবনু আবী হাসমা (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) একদিন সুলায়মান ইবন আবী হাসমাকে ফজরের ছালাতে উপস্থিত পাননি। অতঃপর ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বাজারের দিকে গমন করলেন। আর সুলায়মানের বাড়ি ছিল বাজার ও মসজিদের মাঝপথে। তিনি সুলায়মানের জননী শিফা‘-এর পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। তখন তাকে বললেন, আমি ফজরের ছালাতে সুলায়মানকে দেখলাম না যে? তিনি (উত্তরে) বললেন, সে রাত্রি জেগে (নফল) ছালাত আদায় করেছে। ফলে ফজরের সময় দু’চোখ (ঘুম) তাকে পরাজিত করেছে। ওমর (রাঃ) বললেন, ফজরের ছালাতের জামা‘আতে হাযির হওয়া আমার নিকট সারারাত (নফল) ছালাত আদায় হ’তে পছন্দনীয়’।[8]
৮. জান্নাতে আল্লাহর আতিথেয়তা প্রাপ্তি : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ، أَوْ رَاحَ، أَعَدَّ اللهُ لَهُ فِيْ الْجَنَّةِ نُزُلًا، كُلَّمَا غَدَا، أَوْ رَاحَ ‘যে ব্যক্তি সকাল অথবা সন্ধ্যায় মসজিদে গমন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে আপ্যায়ন সামগ্রী প্রস্ত্তত করেন। সে যতবার সকাল অথবা সন্ধ্যায় গমনাগমন করে, প্রত্যেকবার আল্লাহ তার জন্য আতিথেয়তার সামগ্রী প্রস্ত্তত করেন’।[9]
৯. জামা‘আতে ফরয ছালাত আদায়ে গোনাহ মাফ : শুধু ফজর নয়, যে কোন ছালাত জামা‘আতে আদায় করলে গোনাহ মাফ হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ تَوَضَّأَ فَأَسْبَغَ الْوُضُوْءَ، ثُمَّ مَشَى إِلَى صَلَاةٍ مَكْتُوْبَةٍ فَصَلَّاهَا مَعَ الْإِمَامِ، غُفِرَ لَهُ ذَنْبُهُ ‘যে ব্যক্তি ওযূ করে এবং ওযূকে পরিপূর্ণভাবে সম্পাদন করে। অতঃপর ফরয ছালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে মসজিদে যায়, অতঃপর ইমামের সাথে ছালাত আদায় করে, তার গোনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়’।[10]
৯. আল্লাহর দর্শন লাভে ধন্য : জারীর (রাঃ) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে বসা ছিলাম। তিনি পূর্ণিমার রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা অচিরেই তোমাদের প্রভুকে দেখতে পাবে, যেমন তোমরা এই চাঁদকে দেখছ। তাঁর দর্শনে তোমরা কোনরূপ বাধাপ্রাপ্ত হবে না। অতএব তোমরা সাধ্যমত চেষ্টা করবে সূর্যোদয়ের পূর্বের ছালাত সূর্যোদয়ের আগে এবং সূর্যাস্তের আগের ছালাত সূর্যাস্তের আগে আদায় করতে যেন ব্যর্থ না হও। অতঃপর তিনি এ আয়াতটি পাঠ করলেন,وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوْعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوْبِهَا ‘আর তোমার পালনকর্তার প্রশংসাসহ পবিত্রতা বর্ণনা কর সূর্যোদয়ের পূর্বে ও সূর্যাস্তের পূর্বে’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩০)। [11]
ফজর ছালাতান্তে যিকর ও দু’রাক‘আত ছালাতে হজ্জ ও ওমরার নেকী রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, من صلى الفجر في جماعة ثم قعد يذكر الله حتى تطلع الشمس ثم صلى ركعتين كانت له كأجر حجة وعمرة ‘যে ব্যক্তি ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায় করল, অতঃপর বসে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকর করতে থাকল, তারপর দু‘রাক‘আত ছালাত আদায় করল, সে একটি পূর্ণ হজ্জ ও একটি ওমরার সমান ছওয়াব লাভ করল’। বর্ণনাকারী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কথাটি তিনবার বলেছেন, পূর্ণ হজ্জ ও ওমরার ছওয়াবপ্রাপ্ত হবে’।[12]
ফজরের ছালাত পরিত্যাগের পরিণতি
পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মধ্যে ফজরের ছালাতে ফযীলত সবচেয়ে বেশী। কারণ এসময় অধিকাংশ মানুষ ঘুমিয়ে থাকে এবং শয়তান তাদের মাথায় গিট দিয়ে কুমন্ত্রণা দেয়। ফলে অধিকাংশ মানুষ ফজরের ছালাতে গাফেল থাকে। ফজরের ছালাতের সাথে অন্যান্য ছালাতের মসজিদে মুছল্লীর সংখ্যা লক্ষ্য করলে যা সহজে টের পাওয়া যায়। ফজরের ছালাতের ব্যাপারে উদাসীনতার ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ)-এর সতর্কতাসমূহ নিম্নরূপ :
১. নিফাক্বী : নিফাক্ব দুই প্রকার। বড় নিফাক্ব হ’ল অন্তরে কুফরী পোষণ করে মুখে ইসলাম প্রকাশ করা। এ প্রকার মুনাফিক চিরস্থায়ী জাহান্নামী। অন্যদিকে ছোট নিফাক্ব হ’ল অন্তরে ইসলামের প্রতি বিশ্বাস থাকলেও আমলে তা বাস্তবায়ন করতে অলসতা করা। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছোট নিফাক্বীর অনেক বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে ফজর ছালাতে অলসতা অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ أَثْقَلَ الصَّلَاةِ عَلَى الْمُنَافِقِْنَ صَلَاةُ الْعِشَاءِ، وَصَلَاةُ الْفَجْرِ ‘নিশ্চয়ই মুনাফিকদের উপর সর্বাধিক কষ্টকর ছালাত হ’ল ফজর ও এশার ছালাত’।[13]
২. আল্লাহর যিম্মাদারী থেকে মুক্ত : আল্লাহর প্রকৃত বান্দা ও কাফেরদের মধ্যে পার্থক্য হ’ল ছালাত। আর ছালাত পরিত্যাগকারী অবাধ্য বান্দার দায়িত্ব আল্লাহ গ্রহণ করেন না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,لاَ تَتْرُكِ الصَّلاَةَ مُتَعَمِّدًا فَإِنَّهُ مَنْ تَرَكَ الصَّلاَةَ مُتَعَمِّدًا فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللهِ وَرَسُوْلِهِ ‘তুমি ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো ছালাত ছেড়ে দিও না। কেননা যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে ছালাত ছেড়ে দেয়, তার থেকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যিম্মাদারী মুক্ত হয়ে যায়’।[14]
৩. জাহান্নামের শাস্তি ভোগ : আমরা সাধারণত ফজর ও আছর ছালাতের পূর্বে ঘুমিয়ে থাকি। আর এই দুই ওয়াক্ত ছালাত জামা’আতে আদায় করার ফযীলত অপরিসিম। সাথে সাথে জামা’আতে ছালাত আদায় না করার পরিণতিও ভয়ংকর হাদীছে নবী (ছাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি তাঁর স্বপ্ন বর্ণনার এক পর্যায়ে বলেন,أَمَّا الَّذِىْ يُثْلَغُ رَأْسُهُ بِالْحَجَرِ فَإِنَّهُ يَأْخُذُ الْقُرْآنَ فَيَرْفِضُهُ وَيَنَامُ عَنِ الصَّلاَةِ الْمَكْتُوْبَةِ ‘যে ব্যক্তির মাথা পাথর দিয়ে বিচূর্ণ করা হচ্ছিল, সে হ’ল ঐ লোক যে কুরআন শিখে তা পরিত্যাগ করে এবং ফরয ছালাত আদায় না করে ঘুমিয়ে থাকে’।[15]
ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায়ের জন্য করণীয়
বলা হয়, সকালের সূর্য দেখে সারাদিনের আবহাওয়া আন্দাজ করা যায়। তেমনই ফজরের ছালাতে উপস্থিতি দেখে ব্যক্তির দ্বীনদারিতা কিছুটা বুঝা যায়। সুতরাং ফজর ছালাতে জামা‘আতে উপস্থিত হওয়ার জন্য নিম্নের পরামর্শসমূহ পালন করা যায়।
১. এশার পরপরই ঘুমানো : আমরা অনেকে আছি যারা কিনা রাত জেগে কাজ করি এবং দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেই। যা একেবারেই শরীরের জন্য ভালো নয়। রাতের একটি নির্দিষ্ট সময় আমাদের শরীর থেকে এক প্রকার হরমোন নিঃসৃত হয়, যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী। ঐ নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে গেলে ঘুম আর স্বাস্থ্যকর হয় না। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এশার ছালাতের পরে অযথা কথাবার্তা ও কাজকর্ম অপসন্দ করতেন। আবু বারযা (রাঃ) বলেন, وَكَانَ يَسْتَحِبُّ أَنْ يُؤَخِّرَ الْعِشَاءَ الَّتِىْ تَدْعُوْنَهَا الْعَتَمَةَ وَكَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَهَا وَالْحَدِيْثَ بَعْدَهَا ‘আর এশার ছালাত, যাকে তোমরা ‘আতামাহ’ বল, তিনি দেরি করে আদায় করা ভালবাসতেন এবং এশার ছালাতের পূর্বে ঘুমানো ও ছালাতের পরে কথা বলাকে অপসন্দ করতেন।[16] অন্য হাদীছে আবু বারযা (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَنْهَى عَنِ النَّوْمِ قَبْلَهَا وَالْحَدِيْثِ بَعْدَهَا ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এশার ছালাতের পূর্বে ঘুমাতে ও ছালাতের পরে কথাবার্তা বলতে নিষেধ করতেন’।[17]
২. ফজরে ওঠার নিয়ত করে ঘুমানো : ‘নিয়ত’ অর্থ ‘সংকল্প’। নিয়ত ব্যতীত কোনো কাজই সম্পন্ন হয় না। তাই প্রত্যেকটি কাজে সঠিক নিয়ত থাকা আবশ্যক। বান্দা কোন সৎকাজের দৃঢ় নিয়ত করে থাকলে আল্লাহ তাকে অবশ্যই পথ দেখাবেন (আনকাবূত ২৯/৬৯)। যে কাজের নিয়ত যেমন, তা মহান আল্লাহর কাছে তেমনভাবেই গ্রহণযোগ্য হয়। আর তাই প্রসিদ্ধ দু’টি হাদীছ গ্রন্থ ছহীহ বুখারী ও মিশকাতের প্রথম হাদীছটিই নিয়ত সম্পর্কিত। হাদীছে এসেছে,إنَّمَا الْأَعْمَالُ بِالنِّيَاتِ وَ إِنَّمَا لِكُلٍّ امْرِءٍ مَّا نَوَى ‘সকল কাজ নিয়তের উপরে নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক ব্যক্তি তাই-ই পাবে, যার নিয়ত সে করবে’।[18]
২. ঘুমকে ইবাদত হিসাবে গণ্য করা : ঘুম আমাদের জীবনের অপরিহার্য একটি বিষয়। তবে আমরা অনেকেই জানি, মুমিন বান্দা তার ঘুমকে আল্লাহর ইবাদতে পরিণত করতে পারেন। ঘুমকে ইবাদতে পরিণত করার কতিপয় পদ্ধতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের শিখিয়েছেন। যেমন : ওযু করে ঘুমানো, তাহাজ্জুদের নিয়তে ঘুমানো, ইবাদতের শক্তি সঞ্চয়ের জন্য ঘুমানো ইত্যাদি। ফজরের ছালাতে জামা‘আতে আদায় করলে সারারাত ছালাতের ছওয়াব লাভ করা যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَلَّى الْعِشَاءَ فِيْ جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا قَامَ نِصْفَ اللَّيْلِ، وَمَنْ صَلَّى الصُّبْحَ فِيْ جَمَاعَةٍ فَكَأَنَّمَا صَلَّى اللَّيْلَ كُلَّهُ ‘যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে এশার ছালাত আদায় করল, সে যেন অর্ধেক রাত পর্যন্ত ক্বিয়াম (ইবাদত) করল। আর যে ফজরের ছালাত জামা‘আতসহ আদায় করল, সে যেন সারা রাত ছালাত আদায় করল’।[19] সুতরাং এশা ও ফজরের ছালাত জামা‘আতে আদায়ের মাধ্যমে আমরা সারারাত্রি ঘুমিয়ে তা নেকীতে পরিণত করতে পারব। ইনশাআল্লাহ!
৩. ওযূ করে ঘুমানো ও যিকর করা : ঘুমানোর পূর্বে ওযূ করে শোয়া মুস্তাহাব। রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَبِيْتُ عَلَى ذِكْرٍ طَاهِرًا فَيَتَعَارَّ مِنَ اللَّيْل فَيسْأَلُ اللهُ خَيْرًا إِلَّا أَعْطَاهُ اللهُ إِيَّاهُ ‘যে মুসলিম রাতে পবিত্র অবস্থায় যিকর করতে করতে ঘুমায়, এরপর ঘুম ভেঙ্গে গেলে সে আল্লাহর কাছে কল্যাণকর কিছু চায়, আল্লাহ তাকে তা দান করেন’।[20] যদি কেউ ওযূ করে বিছানায় শোয়ার পর ঘুমানোর পূর্বে ওযূ ভেঙ্গে যায় অথবা রাতে কোন সময় ঘুম ভেঙ্গে যায়, তবে তাকে পুনরায় ওযূ করতে হবে না। কেননা প্রথমবার ওযূর মাধ্যমেই সুন্নাত পালন হয়ে গেছে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) একবার রাতে ঘুম থেকে উঠলেন এবং প্রাকৃতিক প্রয়োজন সেরে হাত-মুখ ধুলেন। অতঃপর ঘুমিয়ে গেলেন’।[21] অর্থাৎ তিনি পুনরায় ওযূ করেননি। সুতরাং ঘুমের উদ্দেশ্যে শোয়ার পূর্বে ওযূ করাই হাদীছের উদ্দেশ্য। শোয়ার পর ওযূ নষ্ট হ’লে তা ধর্তব্য নয়। তদুপরি কেউ চাইলে পুনরায় ওযূ করতে পারেন।
ঘুমানোর পূর্বে বিছানায় শুয়ে তিনবার নাস, ফালাক্ব ইখলাছ পাঠ করে সারা শরীরে হাত বুলানো মুস্তাহাব।[22] অতঃপর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে ৩৩ বার সুবহানাল্লাহ, ৩৩ বার আলহামদুলিল্লাহ ও ৩৪ বার আল্লাহু আকবার পাঠ করার পর ঘুমানো ভালো।[23]
৪. তাহাজ্জুদ ছালাতের নিয়ত করে ঘুমানো : যে বান্দা তাহাজ্জুদের নিয়তে রাতে ঘুমিয়ে পড়ে, নিয়তের কারণে তিনি তাহাজ্জুদের নেকী লাভ করেন এবং তার ঘুম আল্লাহর নিকটে ছাদাক্বাহ হিসাবে গণ্য হয়। আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর বর্ণনায় রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিছানায় শয়নকালে এই নিয়ত করবে যে, সে ঘুম থেকে জেগে রাতের ছালাত (তাহাজ্জুদ) আদায় করবে, অতঃপর ঘুমের আধিক্যের কারণে যদি সকাল হয়ে যায়, তবুও সে যার নিয়ত করেছে, তার নেকী পেয়ে যাবে। আর আল্লাহর কাছে তার সেই ঘুম ছাদাক্বাহ হিসাবে গৃহীত হবে’।[24]
৫. আল্লাহর কাছে দো‘আ করে ঘুমানো : মহান আল্লাহ তাঁর অনুগত বান্দাদের দো‘আ কবুল করে থাকেন। আর তা যদি হয় আল্লাহর ইবাদত পালনের জন্য, তাহ’লে সে দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য আরো অগ্রগণ্য হয়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা দিয়েছেন, ادْعُوْنِىْ أَسْتَجِبْ لَكُمْ ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (গাফের ৪০/৬০)।
৮. ঘুমানোর পূর্বে যাবতীয় অনর্থক কাজ হ’তে বিরত থাকা : বর্তমান মোবাইল ডিভাইসের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে সর্বদা আমরা এটা নিয়েই বেশী চিন্তিত। এমন কি ঘুমানোর পূর্বেও আমরা এর থেকে দূরে থাকতে পারিনা। একবার ডিভাইস হাতে নিলেই সময় কীভাবে পার হয়ে যায় সে দিকে আমাদের হুঁশ থাকে না। এসব ব্যবহারে প্রয়োজনীয় কাজের চেয়ে অনর্থক কাজই বেশী হয়। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مِنْ حُسْنِ إِسْلَامِ الْمَرْءِ تَرْكُهُ مَا لَا يَعْنِيْهِ ‘ব্যক্তির ইসলামের সৌন্দর্য হ’ল, অনর্থক কর্মকান্ড পরিহার করা’।[26] তাই যে সকল বিষয় আমাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে, সে সকল বিষয় থেকে আমাদের যথাসাধ্য দূরে থাকার চেষ্টা করতে হবে।
৯. এ্যালার্ম ব্যবহার করা : ফজরে জেগে ওঠার জন্য যে কোন বৈধ উপায় গ্রহণ করা যায়। বাড়ির অন্য সদস্যদের জাগিয়ে দিতে বলা বা ঘড়িতে এ্যালার্ম দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে মোবাইল ফোন সকলের হাতে হাতে। মোবাইলের এ্যালার্ম ব্যবহারের মাধ্যমে এর সুন্দর ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রত্যেক সক্ষম পুরুষের উপর জামা‘আতের সাথে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত আদায় করা ওয়াজিব। তাই কোনো ভাবেই যেন ফজরের ছালাত ক্বাযা না হয়, সে দিকে আমাদের সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নৈকট্য হাছিলের উদ্দেশ্যে পাঁচ ওয়াক্ত ফরয ছালাত বিশেষ করে ফজর ছালাত যথা সময়ে জামা‘আতের সাথে আদায় করার তাওফীক দান করুন।-আমীন!
হাসীবুর রশীদ
[1]. বুখারী হা/৩২৬৯; মুসলিম হা/৭৭৬; মিশকাত হা/১২১৯।
[2]. মুসলিম হা/৬৩৪; মিশকাত হা/৬২৪।
[3]. বুখারী হা/৫৭৪; মুসলিম হা/৬৩৫; মিশকাত হা/৬২৫।
[4]. বুখারী হা/৫৫৫; মুসলিম হা/৬৩২; মিশকাত হা/৬২৬।
[5]. মুসলিম হা/৬৫৭; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৪৫।
[6]. বুখারী হা/১০৯৪; আবুদাউদ হা/২৪৯৪।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৭৯৬।
[8]. মুয়াত্ত্বা হা/২৯৬; মিশকাত হা/১০৮০; ছহীহুত তারগীব হা/৪২৩।
[9]. বুখারী হা/৬৬২; মুসলিম হা/৬৬৯; মিশকাত হা/৬৯৮।
[10]. ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/১৪৮৯; ছহীহুত তারগীব হা/৪০৭।
[11]. বুখারী হা/৫৫৪; মুসলিম হা/৬৩৩; মিশকাত হা/৫৬৫৫।
[12]. তিরমিযী হা/৫৮৬; মিশকাত হা/৯৭১; ছহীহাহ হা/৩৪০৩।
[13]. ইবনু মাজাহ হা/৭৯৭; ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৪৮৪।
[14]. আহমাদ হা/২৭৪০৪; ছহীহুত তারগীব হা/৫৭৩।
[15]. বুখারী হা/১১৪৩; ছহীহুত তারগীব হা/৪৭৮।
[16]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৮৭ ‘জলদী ছালাত আদায়’ অনুচ্ছেদ।
[17]. আবু দাউদ হা/৪৮৪৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৬৯১৫, সনদ ছহীহ।
[18]. বুখারী হা/১, মিশকাত হা/১।
[19]. মুসলিম হা/৬৫৬; মিশকাত হা/৬৩০।
[20]. আবুদাঊদ হা/৫০৪২, মিশকাত হা/১২১৫।
[21]. বুখারী হা/৬৩১৬, মুসলিম হা/৭৬৩।
[22]. বুখারী হা/৬৩১৯।
[23]. আহমাদ হা/২৬৫৯৩, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৭০৩৭।
[24]. নাসাঈ হা/১৭৪৭, ইবনু মাজাহ হা/১৩৪৪, ছহীহুল জামে‘ হা/৫৯৪১, সনদ হাসান।
[25]. আহমাদ হা/৫৬৬০।
[26]. ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩, মিশকাত হা/৪৮৩৯।