ব্যর্থতাই সফলতার মূলমন্ত্র
নাজমুন নাঈম
শায়খ আলী তানতাভী তার স্মৃতিচারণের মধ্যে বর্ণনা করেছেন, দামেস্কে একটি বড় মসজিদ রয়েছে, যাকে তওবার মসজিদ বলা হয়। তওবার মসজিদ নামকরণের একটি ইতিহাস আছে। এখানে পূর্বে একটি সরাইখানা ছিল। যেখানে সব ধরনের পাপ কাজ অবাধে চলত। হিজরী সপ্তম শতাব্দীতে আইয়ূবী সুলতান আশরাফ মূসা সরাইখানাটি কিনে নেন। অতঃপর ৬৩২ হিজরীতে সেটি ভেঙ্গে তদস্থলে মসজিদ নির্মাণ করেন। গোনাহগার বান্দা যেমন তওবা করে সৎকর্মের দিকে ধাবিত হয়, পাপিষ্ঠদের আড্ডাখানাও যেন তদ্রুপ তওবা করে নেককারদের ইবাদত গৃহে পরিণত হ’ল। সম্ভবত একারণে একে তওবার মসজিদ বলা হয়।
মসজিদটিতে প্রায় সত্তর বছর যাবৎ শায়খ সালীম আস-সুয়ূতী নামে একজন আলেম ছিলেন। আশেপাশের লোকেরা তাঁকে খুবই সম্মান করত এবং ধর্মীয় ও বৈষয়িক উভয় ক্ষেত্রে পরামর্শের জন্য তাঁর শরণাপন্ন হ’ত। তিনি সেখানে ইমামতি করতেন এবং জ্ঞানপিপাসু ছাত্রদের দারস দিতেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে হতদরিদ্র অথচ অতি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একজন যুবক ছিল। সে মসজিদের সাথে একটি কক্ষে থাকত। কিন্তু সেখানে তার খাওয়া-দাওয়ার কোন ব্যবস্থা ছিল না। ফলে অধিকাংশ দিন তাকে অনাহারে বা অর্ধাহারে কাটাতে হ’ত।
একবার এমন হয়েছিল যে, দুদিন যাবৎ সে কিছুই খেতে পায়নি। তার কাছে কোন খাদ্য ছিল না। খাদ্য কেনার মত পয়সাও তার ছিল না। আবার অধিক আত্মমর্যাদাবোধের কারণে কারো কাছে চাইতেও পারছিল না। এভাবে তৃতীয় দিনে উপনীত হ’লে তার মনে হ’তে লাগল, ক্ষুধার জ্বালায় সে মারা যাবে। সে কী করবে বুঝতে পারছিল না। সে চিন্তা করল, এমতাবস্থায় শরী‘আত তাকে মৃত প্রাণীর গোশত খেতে বা সামান্য খাদ্য চুরি করতেও অনুমতি দেয়। তানতাভী বলেন, এটি একটি বাস্তব ঘটনা। এর সাথে জড়িত লোকদের আমি চিনি। এখানে আমি শুধু ঘটনাটি বর্ণনা করছি। তার চিন্তাটি সঠিক ছিল নাকি ভুল ছিল তা বিচার করছি না।
মসজিদটি একটি পুরনো পাড়ায় ছিল, যেখানে ঘরগুলি খুব কাছাকাছি ছিল। ঘরের ছাদগুলি একটি আরেকটির সাথে এমনভাবে মিলে ছিল যে, কেউ ছাদের উপর দিয়ে হেঁটে পাড়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেতে পারত। যুবকটি তার চিন্তা বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে মসজিদের ছাদে উঠে গেল। সেখান থেকে খাবারের সন্ধানে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে ঘোরাঘুরি করতে লাগল। প্রথম বাড়িতে কয়েকজন নারীকে দেখে সে তার দৃষ্টি নিচু করে নিল। অতঃপর চলে গেল পাশের বাড়িতে। বাড়িতে সে কাউকে দেখতে পেল না। উপরন্তু সেখান থেকে ভেসে আসছিল রান্না তরকারীর সুঘ্রাণ, যা তার ক্ষুধার্ত পেটে জ্বলন্ত আগুনে ঘিয়ের ন্যায় কাজ করল। ফাঁকা বাড়ির নীরবতা আর তরকারীর ঘ্রাণ তাকে চুম্বকের মত টেনে নিল বাড়ির ভিতরে।
সে ছাদ থেকে এক লাফে নীচে নামল। পরের লাফে উঠে গেল ঘরের বারান্দায়। তারপর ঘরে ঢুকে খুঁজে নিল ঢাকনা দেওয়া তরকারীর পাতিল। পাত্রের ঢাকনা খুলে সে পাতিল ভর্তি বেগুন দেখতে পেল। প্রচন্ড ক্ষুধার কারণে সে গরম ঠান্ডা পরখ না করেই সেখান থেকে একটি বেগুন তুলে কামড় বসিয়ে দিল। কিন্তু না, সে পুরো বেগুনটি খেতে পারল না। তার বিবেক ও ঈমান জাগ্রত হয়ে তাকে খাওয়া থেকে বারণ করল। সে মনে মনে বলল, আঊযুবিল্লাহ। আমি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি। আমি একজন মসজিদে অবস্থানকারী তালেবে ইলম। আমি অন্যের ঘরে ঢুকে চুরি করছি! সে অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করল এবং হাতের আধখাওয়া বেগুনটি রেখে দ্রুত সেখান থেকে ফিরে গেল। ছাদ থেকে নেমে সে প্রতিদিনের ন্যায় মসজিদে শায়খের দারসে বসে পড়ল। কিন্তু তীব্র ক্ষুধার কারণে সে দারসে মনোনিবেশ করতে পারছিল না। সে শায়খের সব কথা শুনলেও কিছুই বুঝতে পারল না।
দারস শেষে অন্য ছাত্ররা চলে গেলে সে মসজিদের এক কোণে বসে রইল। তখন শায়খের কাছে একজন বোরখা পরা মহিলা আসল। উল্লেখ্য যে, সেযুগে দামেস্কে এমন কোন মহিলা ছিল না, যে পর্দা করত না। মহিলাটি শায়খের সাথে দীর্ঘক্ষণ কথা বলছিল। যুবকটি একটু দূরে বসে তাদের কথোপকথন দেখছিল। কিন্তু কিছু শুনতে পাচ্ছিল না।
কিছুক্ষণ পর শায়খ এদিক ওদিক তাকালেন। সেখানে আর কাউকে দেখতে না পেয়ে তাকে কাছে ডাকলেন। ছেলেটি ছিল অত্যন্ত ভদ্র ও অনুগত। ডাকা মাত্রই সে শায়খের খেদমতের জন্য হাযির হল। শায়খ বললেন, তুমি কি বিবাহিত? সে বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি বিয়ে করতে চাও? ছেলেটি লজ্জায় কিছু বলতে পারল না। চুপচাপ বসে থাকল। শায়খ তাকে আবার বললেন, বল, তুমি কি বিয়ে করতে চাও? সে বলল, উস্তাদযী! আল্লাহর কসম, আমার কাছে একটা রুটির দামও নেই। তাহলে আমি বিয়ে করব কীভাবে? শায়খ বললেন, এই মহিলা আমাকে বলল যে, তার স্বামী মারা গেছেন এবং সে এই শহরে একজন অপরিচিতা নারী। এখানে তার কেউ নেই। এমনকি একজন বৃদ্ধ চাচা ছাড়া এই পৃথিবীতেই তার আর কেউ নেই। সে তার চাচাকে সাথে নিয়ে এখানে এসেছে। অতঃপর তিনি মসজিদের কোণায় বসে থাকা এক বৃদ্ধের দিকে ইশারা করলেন।
শায়খ আরো বললেন, সে তার স্বামীর উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বাড়ি এবং কিছু সম্পত্তি পেয়েছে। এখন সে এমন একজন পুরুষকে খুঁজছে, যে তাকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী বিয়ে করবে। যে তাকে সঙ্গ দিবে এবং মন্দ লোকদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করবে। এখন কি তুমি তাকে বিয়ে করতে চাও? সে বলল, হ্যাঁ। অতঃপর শায়খ মহিলাটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি তাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করবে? সে বলল, হ্যাঁ। অতঃপর শায়খ মহিলাটির চাচা ও দু’জন সাক্ষী ডেকে বিবাহ সম্পাদন করলেন এবং তিনি ছাত্রের পক্ষ থেকে মোহর পরিশোধ করলেন।
বিবাহ শেষ করে মহিলাটি তার নতুন স্বামীর হাত ধরে বাড়িতে নিয়ে গেল। বাড়িতে প্রবেশ করে যুবকটি প্রথমবার তার নতুন স্ত্রীর রূপ ও সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হ’ল। সে আরো আশ্চর্য হ’ল যখন বুঝতে পারল, এটা সেই বাড়ি যেখানে সে কিছুক্ষণ আগে খাবারের সন্ধানে ঢুকেছিল। তার স্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কিছু খেয়েছেন? অত্যন্ত ক্ষুধার্ত থাকা সত্ত্বেও লজ্জায় সে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু মহিলাটি বুঝতে পারল, সে প্রচন্ড ক্ষুধার্ত।
মহিলাটি তাকে খাবার দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল। পাতিলের ঢাকনা খুলে সে দেখল, একটি বেগুন এক কামড় খাওয়া। সে চমকে উঠে বলল, কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আমরা ঘরে আসার আগে কেউ ঘরে ঢুকে বেগুন খেয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য! সে পুরোটা বেগুন খায়নি। এক কামড় খেয়ে চলে গেছে। তখন ছেলেটি কেঁদে উঠে জানাল, এই বেগুন অন্য কেউ নয় তার নববিবাহিত স্বামীই খেয়েছে। অতঃপর সে তাকে পুরো ঘটনা খুলে বলল। মহিলাটি বলল, এটি সততার ফল। আপনি একটি হারাম বেগুন খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। ফলে আল্লাহ আপনাকে হালালভাবে এই পুরো ঘর এবং ঘরের অধিবাসীসহ সবকিছু দান করেছেন।
শিক্ষা : গল্পের শিক্ষাটি গল্পের শেষ তিন লাইনে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। সৎ মানুষকে খালি চোখে নিরেট বোকা মনে হ’লেও সেই প্রকৃত বুদ্ধিমান। হারাম উপার্জনের সামান্য লোভ সংবরণ করতে পারলে আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিরাট প্রতিদান লাভ করা যায়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন,اللّهُمَّ اكْفِنِى بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ وَأَغْنِنِى بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ ‘হে আল্লাহ তুমি আমাকে হারাম ছাড়া হালাল দিয়ে যথেষ্ট কর ও তোমার অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে অন্যদের মুখাপেক্ষীহীন কর’ (তিরমিযী হা/৩৫৬৩)।
মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম