আমার বন্ধু ফাহিম
আরীফ মাহমুদ, আটলান্টা, জর্জিয়া
বাবার সাথে প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে ব্যাংকে বসে আছি। খুবই বিরক্ত লাগছে। ম্যানেজার ছাহেব এখনো আসেননি। দশটায় তার আসার কথা। এখন সাড়ে দশটা বাজে। তিনি এসে ক্যাশ খুলে টাকা বের করলেই সবাই টাকা পাবে। তাই চেকের অর্ধাংশ হাতে নিয়ে আমাদের মত আরো আট-দশজন দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা রাগ করেই বললাম, বাবা! এখন অনলাইনের যুগে কেউ ব্যাংকে এসে এভাবে লাইন ধরে? কতবার বলেছি অনলাইন ব্যাংকিংটা শিখে নেও। তাহলে ঘরে বসেই তুমি ভাইয়াকে টাকাটা পাঠাতে পার। গরমে এখানে এসে লাইন ধরে বসে থাকতে হয় না। কিন্তু তুমি তো আমার কথা শুনবে না। প্রতি মাসের এক তারিখ তোমাকে এসে এই লাইন ধরতে হবে। আবার সাথে আমাকেও নিয়ে আসবে।
বাবা বললেন, অনলাইন শিখলে কী হবে? আমাকে আর ঘরের বাইরে বের হ’তে হবে না? বললাম, না, কোন দরকারই নাই। এখন তো অনলাইনে কেনাকাটাও করা যায়। রোদে মাছ বাজার, সবজি বাজার ঘুরে ঘুরে কেনাকাটা করতে হয় না। কত সময় বেঁচে যায়! এরপর বাবা যা বললেন তাতে আমি নির্বাক হয়ে গেলাম। বাবা বললেন, এত সময় বাঁচিয়ে আমি কী করব? সারাদিন একা একা বাড়িতে বসে থাকতে ভালো লাগে? বের হ’লে কত পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হয়, সুখ-দুঃখের কথা হয়। বিপদের সময় এই মানুষরাই তো পাশে এসে দাঁড়ায়।
ঘরে বসে কি আর মানুষের সাথে আন্তরিকতা হয়? তুমি তো সারাদিন ফোন হাতে বসে থাক। এখন বল তো, শেষ কবে তুমি তোমার ফুফুর সাথে কথা বলেছ? দশ হাত দূরে থাকে তোমার বড় চাচা। গত দু’সপ্তাহ যাবৎ তিনি অসুস্থ। তার খবর নিয়েছ? অথচ আমরা ছোটবেলায় আপনজনের সাথে দেখা করতে দশ মাইল পথ হেঁটেছি। সময় বাঁচানোর চিন্তা করিনি। প্রয়োজনের সময় মানুষ যদি মানুষের পাশে না যায় তবে সময় বাঁচিয়ে কী লাভ!
বাবার কথা পাশ থেকে মানুষেরা শুনছেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। বাবা বললেন, ব্যাংকে প্রবেশের পর থেকে চারজন পরিচিত মানুষের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। কুশল বিনিময় হয়েছে। এটাই আমার আনন্দ। হঠাৎ রাস্তায় কোন পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলে তার আন্তরিক হাসিটাই আমার ভালো লাগা। আমারতো এখন সময়ের কমতি নেই। মানুষের সাহচর্যের কমতি আছে।
তোমার মনে পড়ে, দু’বছর আগে আমি যখন অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলাম। যে দোকান থেকে আমি দৈনিক কেনাকাটা করি তিনি কতগুলো ফল-মূল নিয়ে আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন। আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কেঁদেছিলেন। তোমার ফোন হয়তো ঘরে বসে পণ্য এনে দিবে। কিন্তু মানুষের এই আন্তরিকতা আমাকে এনে দিতে পারবেনা। আমার পাশে বসে সান্ত্বনা দিয়ে চোখের পানি তো মুছে দিবেনা। অসুস্থ হলে সেবা করা বা বিপদে-আপদে সহমর্মিতা দেখানোর মত কোন ডিভাইস কি তৈরী হয়েছে?
বাবা বলে যাচ্ছেন। আমি তার দিকে তাকিয়ে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, আন্তরিকতা অনুভব করার চেষ্টা করছি। বাবা বললেন, গত মাসে সকালে হাঁটতে গিয়ে তোমার মা পড়ে গিয়েছিলেন। মনে আছে? আমি একা তখন কী করব বুঝতে পারছিলাম না। তখন আমাদের দেখে তোমার আনোয়ার চাচা আর চাচী এগিয়ে এলেন। চাচা একটা রিক্সা ডেকে দিলেন। চাচী তোমার মাকে ধরে তুলে দিলেন। তোমার অনলাইন তো মানুষ চিনেনা। কেবল মানুষের একাউন্ট চিনে। রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষের সেবায় এগিয়ে আসে না। কেবল অনলাইনে একটি স্যাড ইমোজি আর বড় জোর কমেন্ট এনে দেয়।
এই যে মানুষ আমার শয্যা পাশে ছিল, তোমার মাকে ঘরে পৌঁছে দিল এগুলো দৈনন্দিন নানা প্রয়োজনে একে অপরের সহযোগিতায় তিলে তিলে গড়ে ওঠা আন্তরিকতার কারণে সম্ভব হয়েছে। সবকিছু অনলাইন হয়ে গেলে মানুষ মানুষের স্পর্শের অনুভূতি ভুলে যাবে। যন্ত্র মানুষের কমান্ড অনুযায়ী কাজ করে। সে মানবীয় সম্পর্ক বা প্রয়োজন বোঝে না। এজন্যই তো পাশের ঘরে মানুষ মরে গিয়ে লাশ হয়ে থাকে, দু’তিন দিনেও কেউ জানতে পারে না। বড় বড় এ্যাপার্টম্যান্টগুলো মানুষ থেকে মানুষকে এ্যাপার্টই (আলাদা) করে দিয়েছে। আগে পুরো গ্রামের মানুষ মিলে একসাথে পুকুর খনন, নদীতে বাঁধ নির্মাণ, রাস্তা তৈরী কত কাজ করেছি। একে অপরের দুঃখ-কষ্ট, আনন্দ ভাগাভাগি করে নিয়েছি। এখন আমরা রুমে বসে উন্নয়নের পোস্ট করে নিজের দায়িত্ব শেষ মনে করি। নানা ডিভাইস আমাদের সময় বাঁচাতে পারে। কিন্তু সেই ঐকান্তিক আনন্দ জড়ো করতে পারে না।
এই যে ব্যাংকের ক্যাশিয়ারকে দেখছ। তুমি উনাকে ক্যাশিয়ার হিসাবেই দেখছ। একজন সবজি বিক্রেতাকে সবজিওয়ালা হিসাবেই দেখছ। কিন্তু আমি সুখ-দুঃখের অনুভূতিসম্পন্ন একজন মানুষকে দেখছি। তার চোখ দেখছি। মুখের ভাষা দেখছি। হৃদয়ের কান্না দেখছি। ঘরে ফেরার আকুতি দেখছি। এই যে মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখা এটাই আন্তরিক বন্ধন তৈরী করে। অনলাইন শুধু সার্ভিস দিতে পারে। এই বন্ধন দিতে পারেনা। ঘরে পণ্য পৌঁছে দিতে পারে, পুণ্য অর্জনের পথ দেখাতে পারেনা। কিন্তু দোকান থেকে কেনাকাটার সময় ক্রেতা-বিক্রেতার চোখে চোখে হওয়া ভাবের আদান-প্রদানে যে আন্তরিকতা গড়ে্ওঠে তা কখনো সম্ভব নয়।
টেকনোলজী নিঃসন্দেহে অনেক কিছু সহজ করেছে। অনলাইনে লাখ লাখ ছেলেমেয়েরা পড়ছে, শিখছে। দূরে থাকা মানুষদের সাথে যোগাযোগ সহজ করেছে। তবে টেকনোলজীতে আসক্ত হওয়া খারাপ। স্ক্রিন এ্যাডিকশন ড্রাগ এ্যাডিকশনের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। দেখতে হবে, প্রযুক্তি যেন আমাদের মানবিক সত্তার মৃত্যু না ঘটায়। আমরা যেন ডিভাইসের যথাযথ ব্যবহার করতে পারি। নিজেরা যেন ডিভাইসের দাসে পরিণত না হই।
মানুষ ডিভাইস ব্যবহার করবে। মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করবে। কিন্ত ভয়ঙ্কর সত্য হ’ল, এখন আমরা মানুষকে ব্যবহার করি। আর ডিভাইসের সাথে সম্পর্ক তৈরী করি। মানুষ ঘুম থেকে উঠে আপন সন্তানের মুখ দেখার আগে স্ক্রিন দেখে। সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইন্সটিউট এটাকে ভয়ঙ্কর মানসিক অসুখ বলে ঘোষণা করেছে। কিছুদিন আগে ভারতের একজন জনপ্রিয় ব্যক্তি তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করেছেন, আমার চারপাশে মানুষ বসে আছে। কিন্তু আমার সাথে কথা বলার কোন মানুষ নেই। কারণ সবার হাতে ডিভাইস’। মজার ব্যাপার হ’ল, তিনি এই কথাটি মানুষের সাথে সরাসরি না বলে অনলাইনে পোস্ট করেছেন। আসলে এটি আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, জানিনা ভুল বলছি কিনা, তবে আমার মনে হয় তোমরা একটা ফোনের যতকিছু জানো, ততটা নিকটস্থ আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে জানো না। তাই মানুষের সাথে সম্পর্ক তৈরী করো। ডিভাইসের সাথে না। টেকনোলজী আমাদের জীবন না। স্পেন্ড টাইম উইথ পিপল, নট উইথ ভিডাইস।
বাবাকে চাচা বলে কে একজন ডাক দিল। বাবা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি লক্ষ্য করলাম, বাবা ক্যাশিয়ারের দিকে যাচ্ছেন না। বরং একজন মানুষ মানুষের কাছে যাচ্ছেন। বাবাকে আমি অনলাইন শেখাতে চেয়েছিলাম। বাবা আমাকে লাইফলাইন বুঝিয়ে দিলেন।
[লেখক : ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]