হতাশা থেকে মুক্তি
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব 989 বার পঠিত
পাঁচই আগস্ট ২০২৪। বাংলাদেশের ইতিহাসে রচিত হ’ল এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়। কোটা সংস্কারের দাবীতে ছাত্রদের আন্দোলন একসময় গণআন্দোলনে পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত নাড়িয়ে দিল এক রুদ্ধশ্বাস লৌহশাসনের তখতে তাউস। দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচলেন টানা পনের বছরের প্রতাপশালী শাসক শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা। একদিন পূর্বেও যেটা ছিল প্রায় অসম্ভব কল্পনা, ভোজবাজির মত হঠাৎ তা বাস্তবে রূপ লাভ করল। নিমিষে পাল্টে গেল সব গতিপথ। চোখের পলকে পট পরিবর্তনের এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখল বাংলাদেশ। গত পনের বছর ধরে যারা ছিলেন মহা দাপুটে সংহারী প্রশাসক, মুহূর্তে হয়ে গেলেন গর্তে লুকানো থরহরিকম্প ইঁদুর। আর ক্ষণকাল পূর্বেও যারা ছিল ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিধ্বস্ত, আশ্রয়হারা নিঃসহায়, হঠাৎ তারাই হয়ে উঠল একেকজন অতিকায় জান্তব, হারকিউলিস। সকালে যারা ছিলেন মহামান্য রাজাধিরাজ, বিকালে তারা হ’লেন মহাধিকৃত পলায়নপর স্বৈরাচার। দিনের শুরুতে যারা ছিলেন আনত মস্তকে জলদগম্ভীরভাবে পুজিত, দুপুর না হ’তেই তাদের গর্বোদ্ধত মূর্তিগুলো জাতীয়ভাবে ঘৃণ্য, লাঞ্ছিত হ’ল। ভূতলে লুটিয়ে পড়ল পূজারীদেরই নির্মম আঘাতে। চোখ কচলিয়ে আচানক দুনিয়াটা ভীষণ আজব লাগে। আল্লাহ রাববুল আলামীন কী না পারেন! সুবহানাল্লাহ!
বলতে দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনার এই দীর্ঘ শাসনামলে কিছু উন্নয়ন দৃশ্যমান হয়েছিল। বহু রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-,কালভার্ট নির্মিত হয়েছিল এ সময়। বড় বড় স্থাপনা, অবকাঠামো নির্মিত হয়েছিল। ডিজিটালাইজেশনের কারণে জীবনযাত্রা সহজ হয়ে এসেছিল। জননিরাপত্তা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছিল। চুরি-ডাকাতি হ্রাস পেয়েছিল উল্লেখযোগ্য হারে।
কিন্তু এর বিপরীতে সমাজের বুকে চেপে বসেছিল দুঃশাসন, বিচারহীনতা, যুলুম-নির্যাতন আর বাকস্বাধীনতা হরণের এক মহা জগদ্দল পাথর। মোটাদাগে দু’টি বিষয় ছিল এই দানবীয় যুগের অন্যতম প্রতীক- দুর্নীতি এবং বৈষম্য। স্বাধীনতার চেতনার নামে হাসিনাশাহী এ দেশকে দুই ভাগ করে ফেলেছিল। সরকারদলীয়দের একচ্ছত্র আধিপত্যে বাকিরা ছিল ম্রিয়মান। সরকারী প্রায় সকল সেক্টর ছিল মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা, দলীয়ভাবে নিয়োগকৃত অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একেকটা সরকারী অফিসকে গড়ে তুলেছিল দুর্নীতির আখড়া। ব্যাংকিং সেক্টর ছিল লোপাটের কারখানা। একেকটা ব্যাংককে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল একেক শিল্পগোষ্ঠী নামক দস্যুদের হাতে। এই ক’বছরে বিদেশে পাচার করা হয়েছে ১৪ হাযার ৯২০ কোটি ডলার বা ১৭ লাখ ৬০ হাযার কোটি টাকা। অথচ দেশের ঋণ এখন ১৮ লাখ ৩৫ হাযার কোটি টাকা। ২০০৯ সালে যা ছিল মাত্র ২ লাখ ৭৬ হাযার ৮৩০ কোটি টাকা। শিক্ষাব্যবস্থাকে রীতিমত ধ্বংস করে দিয়ে এদেশের শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক বিকাশের পথকে করা হয়েছিল রুদ্ধ।
বিরোধী দল ও ভিন্নমতকে কঠোরহস্তে দমন করে রেখেছিল সরকার। বিরোধী রাজনৈতিকদের ছলে-বলে কৌশলে একেবারে মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। কখনও জঙ্গী, কখনও শিবির, কখনও স্বাধীনতার চেতনা ট্রাম্পকার্ড খেলে যিম্মী আর কোনঠাসা করে রেখেছিল ইসলামপন্থীদের। পুলিশ প্রশাসনকে যথেচ্ছা ব্যবহার করা হয়েছিল দলীয় ক্যাডারের মত করে। আয়নাঘর বানিয়ে বছরের পর বছর নিরীহ মানুষকে পশুর মত গুম রাখা হয়েছিল নির্জন, অন্ধকার কক্ষে; বিচারহীনভাবে। আমেরিকার গুয়ান্তানামো বে’র কথা আমরা শুনেছিলাম। কিন্তু দেশের মধ্যে যে এর চেয়েও নির্মমভাবে মানবাধিকার লংঘন হচ্ছে, তা ছিল আমাদের ধারণারও অতীত। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের নামে যখন-তখন যাকে-তাকে ধরার ফ্রী লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল প্রশাসনকে। সেই লাইসেন্সকে পুঁজি করে প্রশাসন বসিয়েছিল গুম, খুন আর জঘন্য রকম যুলুমের মহোৎসব। পুলিশ এতটাই ধরাকে সরা জ্ঞান করেছিল যে, কোন সম্মানিত মানুষেরও ইয্যতের গ্যারান্টি ছিল না। যার-তার নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে বছরের পর বছর আদালতে ঘুরানোর বন্দোবস্ত করতে তারা একটু দ্বিধা করত না। ঘুষ বাণিজ্যকে তারা তাদের নিজেদের অধিকারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। মানবতা, সততা ও ন্যায়বিচার প্রায় বিদায় নিয়েছিল প্রশাসন থেকে। দেশ পরিণত হয়েছিল দমন, নিপীড়নে নিষ্পিষ্ট এক আগ্রাসী পুলিশী রাষ্ট্রে।
২০২৪ সালের আগস্ট মাস তাই বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতার পর এক নতুন অভ্যুদয়। তারুণ্যের হাত ধরে এক বিপ্লবী রেঁনেসা। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে এক স্বতঃস্ফূর্ত মহা গণজাগরণ। সেই সাথে সারা বিশ্বে ফ্যাসিবাদের ধ্বজাধারীদের জন্য এক প্রজ্জ্বলিত সতর্ক সংকেত। ২০২৪ সাল তাই এ জাতির ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকবে ইনশাআল্লাহ। স্বাধীনতার পঞ্চাশাধিককাল পর এসে আমরা যেন আজ সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছি। একে দ্বিতীয় স্বাধীনতা এজন্য বলা হচ্ছে যে, এই অর্জনের পিছনে এত বেশী প্রাণ গেছে, যার নযীর স্বাধীনতার পর আর দ্বিতীয়টি নেই। মাসাধিককালের এই আন্দোলনে প্রাণ হারিয়েছে অন্তুত ছয় শতাধিক বনু আদম এবং আহত হয়েছে কয়েক হাযার। পঙগুত্ব বরণ করেছে শত শত তাযা প্রাণ। যাদের অধিকাংশই স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোমলমতি সম্ভাবনাময় নবীন শিক্ষার্থী। অন্যদিকে দুর্নীতি, বৈষম্য ও যুলুমের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছে এদেশের প্রায় শতভাগ গণমানুষ। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ কেউ এর বাইরে ছিল না। দেশকে এগিয়ে নিতে গোটা জাতির এমন সার্বজনীন একতা ইতিপূর্বে আর কখনও দেখা যায়নি। এ যেন স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি অপূর্ণ থাকা বহু লালিত এক আকাশছোঁয়া স্বপ্নের বাস্তবায়ন। সবচেয়ে বড় কথা, এই জাগরণ এসেছে সমাজের সবচেয়ে নবীন প্রজন্মের হাত ধরে।
তবে আমাদের কাজ এখন কেবলমাত্র শুরু। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। ইরাক-লিবিয়ার পরিণতি আমাদের জানা। সেটাকে মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সুশাসন, ন্যায়বিচার ও শৃংখলা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি স্বাধীনতা অর্জন হ’তে না হ’তেই একদল শুরু করেছে পূর্ব আচরিত গুন্ডামী, চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষের উপর বেশুমার নারকীয় হামলা আর সম্পত্তি লুটতরাজ। প্রত্যাশার আলো জ্বলতে না জ্বলতেই এমন ঘটনা আমাদের অর্জনকে কিছুটা ম্লান করেছে। জানিনা সামনের দিনগুলো কেমন আসছে।
তবে আমাদের কাজ এখন কেবলমাত্র শুরু। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা অর্জন করার চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। ইরাক-লিবিয়ার পরিণতি আমাদের জানা। সেটাকে মাথায় রেখে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। সুশাসন, ন্যায়বিচার ও শৃংখলা সর্বাগ্রে নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি স্বাধীনতা অর্জন হ’তে না হ’তেই একদল শুরু করেছে পূর্ব আচরিত গুন্ডামী, চাঁদাবাজি, প্রতিপক্ষের উপর বেশুমার নারকীয় হামলা আর সম্পত্তি লুটতরাজ। প্রত্যাশার আলো জ্বলতে না জ্বলতেই এমন ঘটনা আমাদের অর্জনকে কিছুটা ম্লান করেছে। জানিনা সামনের দিনগুলো কেমন আসছে।
তবে আমরা অত্যন্ত আশাবাদী থাকতে চাই। কারণ এই রেনেসাঁ এসেছে এদেশের আলোকিত ছাত্রসমাজের মাধ্যমে, কর্মচঞ্চল নতুন প্রজন্মের হাত ধরে। লাইব্রেরীর তত্ত্বজগৎ থেকে বেরিয়ে, ফেসবুক-ইউটিউবের অসার বিনোদনের পসরাকে পায়ে মাড়িয়ে দল-মত নির্বিশেষে তারা যে ত্যাগের নযরানা পেশ করেছে জাতির জন্য, তা তুলনারহিত। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে ময়দানে বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়ে তারা এই অমর বিজয়কাব্য রচনা করেছে। ছাত্র-জনতার এই মহান আত্মত্যাগ ও কুরবানী ইনশাআল্লাহ বৃথা যাবে না। তাদের রক্তভেজা পথ বেয়ে আগামীর বাংলাদেশ হবে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের বাংলাদেশ, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ, খোলাফায়ে রাশেদার স্বর্ণালী আদর্শে আলোকিত বাংলাদেশ, ইসলামী খেলাফতের আদলে সাম্য ও মৈত্রীর বাংলাদেশ-এ আশায় আমরা বুক বেঁধেছি। আল্লাহ আমাদের এ দেশকে তাঁর দ্বীনের জন্য কবুল করে নিন। শান্তি ও সুশাসনের নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে তরুণ সমাজকে কবুল করুন। সর্বোপরি একটি খাঁটি ইসলামী সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আমাদের সবাইকে অগ্রসর হওয়ার তাওফীক দিন- আমীন!