গাযওয়াতুল হিন্দ : একটি পর্যালোচনা
মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
শরীফুল ইসলাম মাদানী 234 বার পঠিত
ভূমিকা : আমাদের সমাজে কিছু মানুষ বিদ‘আতকে হাসানাহ্ ও সায়্যিআহ্ তথা ভালো বিদ‘আত ও মন্দ বিদ‘আত শ্রেণীতে বিভক্ত করে এবং বিদ‘আতে হাসানাহ্কে ইসলামী শরী‘আতে বৈধ বলে আখ্যায়িত করে। এটা স্পষ্টভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর আদর্শ বিরোধী। কেননা তিনি বলেছেন, فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘নিশ্চয়ই সকল বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’।[1] এখানে ভালো-মন্দের কোন পার্থক্য করা হয়নি। বরং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, যা হেদায়াতের বিপরীত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَمَنْ يُضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ، وَمَنْ يهْدِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ أَلَيْسَ اللهُ بِعَزِيْزٍ ذِي انْتِقَامٍ ‘আল্লাহ যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তার জন্য কোন হেদায়াতকারী নেই। আর আল্লাহ যাকে হেদায়াত করেন, তার জন্য কোন পথ ভ্রষ্টকারী নেই’ (যুমার ৩৯/৩৬-৩৭)। কোন ভালো কাজই আল্লাহ প্রদত্ত হেদায়াতের বিপরীত হ’তে পারে না।
সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্ট হওয়ার ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরাম এবং তাবেঈনে ইযাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। তাদের কেউই বিদ‘আতকে হাসানাহ্ এবং সায়্যিআহ্ শ্রেণীদ্বয়ে বিভক্ত করেননি। শায়খ ছালেহ আল-ফাওযান (রহঃ) বলেন,مَنْ قَسَّمَ الْبِدْعَةَ إِلَى بِدْعَةٍ حَسَنَةٍ وَبِدْعَةٍ سَيِّئَةٍ؛ فهُوَ غَالِطٌ وَمُخْطِئٌ وَمُخَالِفٌ لِقَوْلِهِ فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- ‘যে ব্যক্তি বিদ‘আতকে হাসানাহ্ ও সায়্যিআহ্ তথা ভাল ও মন্দ শ্রেণীদ্বয়ে বিভক্ত করল, সে ভুল করল এবং সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা মর্মে রাসূল (ছাঃ)-এর বাণীর বিরোধিতা করল’।[2]
হাফেয ইবনে রজব (রহঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী ‘সকল বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’ একটি ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য, যা থেকে কোন কিছুই বাদ পড়ে না। এটা দ্বীনের মৌলিক বিষয় সমূহের মধ্যে একটি মৌলিক বিষয়। এটা রাসূল (ছাঃ)-এর ঐ বাণীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ‘যে ব্যক্তি আমাদের শরী‘আতে এমন কিছু নতুন সৃষ্টি করল, যা তার মধ্যে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’। অতএব যে ব্যক্তি নতুন কিছু সৃষ্টি করবে এবং তাকে দ্বীনের সাথে সম্পৃক্ত করবে, অথচ তা দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত নয়, তাহলে তা গোমরাহী। আর দ্বীন তা থেকে মুক্ত’।[3]
বিদ‘আতে হাসানাহ ও সায়্যিআহ পন্থীদের দলীলসমূহ ও তার জবাব
প্রথম দলীল :عَنْ عَبْدِ اللهِ قَالَ: مَا رَأَى الْمُسْلِمُوْنَ حَسَنًا فهُوَ عِنْدَ اللهِ حَسَنٌ، وَمَا رَآهُ الْمُسْلِمُوْنَ سَيِّئًا فهُوَ عِنْدَ اللهِ سَيِّءٌ، وَقَدْ رَأَى الصَّحَابَةُ جَمِيعًا أَنْ يَسْتَخْلِفُوْا أَبَا بَكْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, মুসলমানদের দৃষ্টিতে যা উত্তম আল্লাহর দৃষ্টিতেও তা উত্তম। আর মুসলমানদের দৃষ্টিতে যা নিকৃষ্ট আল্লাহর দৃষ্টিতেও তা নিকৃষ্ট। আর প্রত্যেক ছাহাবী আবু বকর (রাঃ)-কে খলীফা করার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন’।[4]
অত্র হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানদের নিকটে যে কাজ উত্তম বলে বিবেচিত হবে, আল্লাহর নিকটেও সে কাজ উত্তম। অতএব বিদ‘আতে হাসানাহ্ মানুষের নিকট উত্তম বলে বিবেচিত। বিধায় আল্লাহর নিকটেও তা উত্তম আমল হিসাবে গণ্য হবে।
জবাব : ইবনুল জাওযী (রহঃ) এই হাদীছের ব্যাপারে বলেন,تَفَرَّدَ بِهِ النَّخْعِيْ، قَالَ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ: كَانَ يَضَعُ الْحَدِيْثَ، وَهَذَا الْحَدِيْثُ إِنَّمَا يُعْرَفُ مِنْ كَلَامِ بْنِ مَسْعُوْدٍ- ‘এই হাদীছটি নাখঈ এককভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ) বলেন, তিনি (নাখঈ) হাদীছ জালকারী। আর এই হাদীছটি ইবনু মাসঊদের বক্তব্য হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে’।[5] হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,إِنَّ هَذَا لَيْسَ مِنْ كَلَامِ رَسُوْلِ الله ِ وَإِنَّماَ يُضِيفُهُ إِلَى كَلَامِهِ مَنْ لَا عِلْمَ لَهُ بِالْحَدِيْثِ وَإِنَّماَ هُوَ ثَابِتٌ عَنْ ابْنِ مَسْعُوْدٍ مِنْ قَولِهِ- ‘এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কথা নয়। হাদীছ সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তিরাই এটাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সম্পৃক্ত করে। বরং এটা ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বাণী হিসাবে প্রমাণিত’।[6]
আল-আলাঈ (রহঃ) বলেন, ‘আমি আমার দীর্ঘ গবেষণার পরেও হাদীছ গ্রন্থসমূহে মারফূ সূত্রে এটি খুঁজে পাইনি। এমনকি যঈফ সনদেও পাইনি। বরং এটা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে ‘মাওকূফ’ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে’।[7]
নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন,لَا أَصْلَ لَهُ مَرْفُوعًا، وَإِنَّمَا وُرِدَ مَوْقُوفًا عَلَى ابْنِ مَسْعُوْدٍ- ‘মারফূ‘ সূত্রে এর কোন ভিত্তি নেই। বরং এটা ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে ‘মাওকূফ’ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে’।[8] তিনি আরো বলেন,إِنَّ مِنْ عَجَائِبِ الدُّنيَا أَنْ يَحْتَجَّ بعْضُ النَّاسِ بِهَذَا الحَدِيْثِ عَلَى أَنَّ فِيْ الدِّيْنِ بِدْعَةً حَسَنَةً، وَأَنَّ الدَّلِيْلَ عَلَى حُسْنِهَا اِعْتِيَادُ الْمُسْلِمِيْنَ لَهَا-‘নিশ্চয়ই দুনিয়ার আশ্চর্যজনক বিষয় হল, কিছু মানুষ এই হাদীছটিকে দ্বীনের মধ্যে বিদ‘আতে হাসানাহ থাকার দলীল হিসাবে পেশ করে। অথচ বিদ‘আতে হাসানার দলীল পেশ করা মুসলমানদেরকে বিদ‘আতের উপর অভ্যস্ত করার নামান্তর’।[9] অতএব হাদীছটি মারফূ‘ সূত্রে ছহীহ না হওয়ায় তা দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়াও তা রাসূল (ছাঃ)-এর অকাট্য বাণী- فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘নিশ্চয়ই সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’[10] এর স্পষ্ট বিরোধী।
পক্ষান্তরে যদি হাদীছটিকে মাওকূফ সূত্রে ছহীহ ধরা হয়, তাহ’লে তাতে বর্ণিত اَلْمُسْلِمُوْنَ এর ال সামগ্রিকতার জন্য এসেছে। অর্থাৎ সকল মুসলমান যার উপর ঐক্যমত পোষণ করেছে। হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘আছারটি সকল মুসলমান যার উত্তমতার উপর ঐক্যমত পোষণ করেছে আল্লাহর নিকট তা উত্তম হওয়ার দলীল। কিন্তু কিছু সংখ্যক মুসলমানের রায় বা মত দলীল সাব্যস্ত হওয়া বুঝানো হয়নি’।[11] অতএব উল্লিখিত আছার দ্বারা যারা বিদ‘আতে হাসানার বৈধতার দলীল পেশ করেছে, তারা কি এমন কোন বিদ‘আত উপস্থাপন করতে সক্ষম, যার উপর সকল মুসলমান ঐক্যমত পোষণ করেছে? কখনোই তা সম্ভব নয়।
আর যদি اَلْمُسْلِمُوْنَ এর ال কে لِلْجِنْسِ বা জাতি বাচক ধরা হয়, তাহ’লে অর্থ হবে, উক্ত বিদ‘আতকে কিছু মুসলিম বিদ‘আতে হাসানাহ বলে গণ্য করেছে এবং কিছু মুসলিম তাকে বিদ‘আতে সায়্যিআহ বলে আখ্যায়িত করেছে। আর এরূপ হলে তা ইজমা বলে গণ্য হবে না এবং এর দ্বারা দলীল পেশ করা বৈধ হবে না। ইয ইবনু আব্দুস সালাম (রহঃ) বলেন, ‘যদি হাদীছটিকে ছহীহ ধরা হয়, তাহ’লে তাতে বর্ণিত اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা أَهْلُ الْإِجْمَاعِ বুঝানো হয়েছে’।[12]
প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত আছারে বর্ণিত اَلْمُسْلِمُوْنَ এর ال টি لِلْعَهْدِ। অতএব এখানে اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল ইজমায়ে ছাহাবা তথা যার উপর ছাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। আর পৃথিবীতে এমন কোন বিদ‘আত নেই যা হাসানাহ বা ভালো হওয়ার ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরাম ঐক্যমত পোষণ করেছেন। বরং তাঁরা সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতার উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
উল্লিখিত আছারের প্রকৃত উদ্দেশ্য তার শেষাংশে বর্ণনা করা হয়েছে। যেখানে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর খেলাফতের ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামের ইজমার দলীল পেশ করেছেন। হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, ‘উল্লিখিত আছারটি দ্বারা খেলাফতের ক্ষেত্রে আবু বকর (রাঃ)-কে অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যাপারে ছাহাবায়ে কেরামের ইজমার কথা বুঝানো হয়েছে’।[13]
উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, উল্লিখিত আছারে বর্ণিত اَلْمُسْلِمُوْنَ দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, ছাহাবায়ে কেরাম। অর্থাৎ ছাহাবায়ে কেরাম যার উত্তমতার উপর ঐক্যমত পোষণ করেছেন, আল্লাহর নিকট তা উত্তম। এছাড়াও আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) ছিলেন কঠোরভাবে বিদ‘আতকে প্রত্যাখ্যানকারী। তিনি বলেন,أَيهَا النَّاسُ إِنَّكُمْ سَتُحْدِثُونَ وَيُحْدَثُ لَكُمْ، فَإِذَا رَأَيتُمْ مُحْدَثَةً فعَلَيْكُمْ بِالأَمْرِ الأَوَّلِ- ‘হে মানব জাতি! নিশ্চয়ই তোমরা নতুন কিছু সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের জন্য নতুন কিছু সৃষ্টি করা হবে। যখন তোমরা (দ্বীনের মধ্যে) কোন নবাবিস্কৃত বস্ত্ত দেখবে, তখন তোমাদের কর্তব্য হল, প্রথমটাকেই অাঁকড়ে ধরা’।[14] অতএব তাঁর কথা কিভাবে বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধতার দলীল হ’তে পারে?
এছাড়াও উল্লিখিত দলীলের উপর ভিত্তি করে যে কোন ভালো কাজকে বৈধ মনে করলে তা হবে ছহীহ হাদীছের বিরোধী। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, كُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٍ وَإِنْ رَآهَا النَّاسُ حَسَنَةً ‘সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা, যদিও মানুষ তাকে উত্তম মনে করে’।[15]
প্রিয় পাঠক! মুসলমানদের নিকট যে কাজ উত্তম বলে বিবেচিত হবে, আল্লাহর নিকটেও সে কাজ উত্তম বলে বিবেচিত হ’লে রাসূল (ছাঃ) ঐ তিন ব্যক্তিকে হুঁশিয়ার করতেন না; যারা রাসূল (ছাঃ)-এর আমলকে কম মনে করেছিল এবং সারারাত্রি জেগে ছালাত আদায়, বিরতিহীন ছিয়াম পালন এবং বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। উক্ত তিন ব্যক্তির উদ্দেশ্য এতো ভালো হওয়া সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে ছালাত ও ছিয়ামের প্রতি উৎসাহ না দিয়ে বরং দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فلَيْسَ مِنِّى ‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হ’তে বিমুখ হবে (সুন্নাত পরিপন্থী আমল করবে), সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[16] অতএব যে কোন ভালো কাজ দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত হওয়ার জন্য অবশ্যই কুরআন ও ছহীহ দ্বারা প্রমাণিত হ’তে হবে।
দ্বিতীয় দলীল : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فعُمِلَ بِهَا بعْدَهُ كُتِبَ لَهُ مِثْلُ أَجْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ ينقُصُ مِنْ أُجُوْرِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِيْ الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً فعُمِلَ بِهَا بعْدَهُ كُتِبَ عَلَيْهِ مِثْلُ وِزْرِ مَنْ عَمِلَ بِهَا وَلاَ ينقُصُ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ- ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন উত্তম রীতি চালু করবে সে তার প্রতিদান পাবে এবং তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান প্রতিদানও সে পাবে। তবে তাদের প্রতিদান থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতি চালু করবে, সে তার কাজের পাপ ও তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান পাপের অধিকারী হবে। তবে তাদের পাপ থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না’।[17]
জবাব : যারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্যকে বিদ‘আতে হাসানার বৈধতার দলীল হিসাবে পেশ করে, তাদের উদাহরণ ঐ ব্যক্তির ন্যায় যারা কুরআন ও হাদীছের প্রথম ও শেষ অংশ গোপন করে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। যেমন- ছালাত অস্বীকারকারীরা দলীল দিয়ে থাকে যে, আল্লাহ নিজেই বলেছেন, فوَيْلٌ لِلْمُصَلِّينَ ‘দুর্ভোগ ছালাত আদায়কারীদের জন্য’ (মাউন ১০৭/৪)। অথচ তারা পরের আয়াতগুলো উল্লেখ করে না। যেখানে বলা হয়েছে, ٱلَّذِينَ هُم عَن صَلَاتِهِم سَاهُونَ ٱلَّذِينَ هُم يُرَاءُونَ وَيَمنَعُونَ ٱلمَاعُونَ ‘যারা তাদের ছালাত সম্পর্কে উদাসীন; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য আদায় করে এবং নিত্য ব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না’ (মাউন ১০৭/৫-৭)। অর্থাৎ যারা তাদের ছালাত সম্বন্ধে উদাসীন ও লোক দেখানোর জন্য ছালাত আদায় করে তাদের জন্য দুর্ভোগ। কিন্তু তারা এসব কিছু উল্লেখ না করে বলে, ছালাত আদায়কারীদের জন্য দুর্ভোগ।
অনুরূপভাবে তারা উল্লেখ করে আল্লাহ তা‘আলার বাণী,يَٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَقرَبُواْ ٱلصَّلَوٰةَ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না’ (নিসা ৪/৪৩)। অথচ তারা উক্ত আয়াতের পরের অংশ উল্লেখ করে না। যেখানে বলা হয়েছে, وَأَنتُمْ سُكَارَى حَتَّى تعْلَمُوْا مَا تقُوْلُوْنَ ‘তোমরা যখন নেশাগ্রস্ত থাক, যতক্ষণ না বুঝতে সক্ষম হও যা কিছু তোমরা বলছ’ (নিসা ৪/৪৩)। অর্থাৎ তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না। কিন্তু তারা অবস্থা উল্লেখ না করে শুধু বলে, তোমরা ছালাতের নিকটবর্তী হয়ো না।
বিদ‘আতে হাসানাহ্র বৈধতার প্রমাণে উল্লিখিত দলীল পেশ করার ক্ষেত্রেও ঠিক অনুরূপ ঘটনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। তারা তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে হাদীছের অংশ বিশেষ উল্লেখ করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ পূর্ণ হাদীছ উল্লেখ করলে খুব সহজেই এর সমাধান হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ্। হাদীছটি হ’ল- মুনযির ইবনু জারীর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা ভোরের দিকে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত ছিলাম। এ সময় তাঁর কাছে পাদুকাবিহীন, বস্ত্রহীন, গলায় চামড়ার আবা পরিহিত এবং তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় একদল লোক আসল। এদের অধিকাংশ কিংবা সকলেই মুযার গোত্রের লোক ছিল। অভাব-অনটনে তাদের এই করুণ অবস্থা দেখে রাসূল (ছাঃ)-এর মুখমন্ডল পরিবর্তিত ও বিষণ্ণ হয়ে গেল। তিনি ভেতরে প্রবেশ করলেন, অতঃপর বেরিয়ে আসলেন। তিনি বেলাল (রাঃ)-কে আযান দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। বেলাল (রাঃ) আযান ও এক্বামত দিলেন।
ছালাত শেষ করে তিনি উপস্থিত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন এবং এই আয়াত পাঠ করলেন- يَٰأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱتَّقُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن نَّفس وَٰحِدَة وَخَلَقَ مِنهَا زَوجَهَا وَبَثَّ مِنهُمَا رِجَالا كَثِيرا وَنِسَاء وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَ ٱلَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِۦ وَٱلأَرحَامَ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلَيكُم رَقِيبا ‘হে মানব জাতি! তোমরা নিজেদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ জোড়া থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অগণিত পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের নিকট প্রার্থনা করে থাক এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষক’ (নিসা ৪/১)। অতঃপর তিনি সূরা হাশরের শেষের দিকের এই আয়াত পাঠ করলেন- يَٰأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَلتَنظُر نَفس مَّا قَدَّمَت لِغَد ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। আর প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত এ বিষয়ে ভেবে দেখা যে, সে আগামী দিনের জন্য অগ্রীম কি প্রেরণ করছে’ (হাশর ৫৯/১৮)।
অতঃপর উপস্থিত লোকদের কেউ তার দীনার, কেউ দিরহাম, কেউ কাপড়, কেউ এক ছা‘ আটা ও কেউ এক ছা‘ খেজুর দান করল। অবশেষে তিনি বললেন, এক টুকরা খেজুর হলেও তোমরা নিয়ে এসো। বর্ণনাকারী বলেন, আনছার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি একটি বিরাট থলে নিয়ে আসলেন। তার হাত তা বহন করতে প্রায় অক্ষম হয়ে পড়েছিল। রাবী আরো বলেন, অতঃপর লোকেরা সারিবদ্ধভাবে একের পর এক দান করতে থাকল। ফলে খাদ্য ও কাপড়ের দু’টি স্তূপ হয়ে গেল। রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা খাঁটি সোনার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন উত্তম রীতি চালু করবে সে তার প্রতিদান পাবে এবং তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে, তাদের সমান প্রতিদানও সে পাবে। তবে তাদের প্রতিদান থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামে কোন মন্দ রীতি চালু করবে, সে তার কাজের পাপ ও তার দেখাদেখি পরবর্তীতে যারা তা করবে তাদের সমান পাপের অধিকারী হবে। তবে তাদের পাপ থেকে কোন কিছুই কম করা হবে না’।[18]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত বক্তব্য দ্বারা উদ্দেশ্য হ’ল, সুন্নাতের উপর আমল আরম্ভকারী। তাকে দেখে পরবর্তী আমলকারীদের সমপরিমাণ নেকীর হকদার হবে। এখানে বিদ‘আতে হাসানাহ্কে বৈধ করা হয়নি। আর দু’টি দিক লক্ষ্য করলে এটা স্পষ্ট হবে।
(ক) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখন উক্ত কথা বলেছিলেন? তিনি যখন ছাহাবায়ে কেরামকে দানের উৎসাহ দিচ্ছিলেন তখন এক আনছারীর দান আরম্ভ করার মাধ্যমে সকলেই দান আরম্ভ করেছিলেন। আর দান ইসলামী শরী‘আতের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত। আর সুন্নাত কখনোই বিদ‘আত হ’তে পারে না। অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী- مَنْ سَنَّ سُنَّةً حَسَنَةً এর অর্থ হ’ল, مَنْ عَمِلَ بِسُنَّةٍ তথা ‘যে ব্যক্তি সুন্নাতের উপর আমল আরম্ভ করল’।
(খ) বিদ‘আতে হাসানাহ ও বিদ‘আতে সায়্যিআহ এরূপ প্রকারভেদ কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা সাব্যস্ত হ’তে হবে। কেননা কোন জিনিস উত্তম এবং কোন জিনিস নিকৃষ্ট? তা ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত হবে। মানুষের বিবেক নির্ধারণ করলে তা কখনোই গৃহীত হবে না। সুন্নাত হ’ল, যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। পক্ষান্তরে বিদ‘আত হ’ল, যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বহির্ভূত। আর কুরআন ও ছহীহ হাদীছ বহির্ভূত কোন কাজ কখনোই হাসানাহ বা উত্তম হ’তে পারে না।
অতএব যে সুন্নাত কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত অথচ মানুষ তার উপর আমল করে না, এমন কোন সুন্নাতকে নতুনভাবে জীবিত করাকে সুন্নাতে হাসানাহ্ বলা হয়। যেমন- জামা‘আতবদ্ধভাবে তারাবীহ্র ছালাত আদায় করা। এটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত যা কুরআন ও ছহীহ হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু তিনি তাঁর উম্মাতের উপর ফরয হওয়ার আশংকায় তিন দিনের বেশি জামা‘আতে আদায় করেননি। ওমর (রাঃ) তাঁর মৃত্যুর পরে উক্ত সুন্নাতকে জীবিত করলেন।
হে মুসলিম ভাই! রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথাকে আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করার জন্য কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা হল,
(ক) যিনি বলেছেন, مَنْ سَنَّ سُنَّةً حَسَنَةً ‘যে ব্যক্তি একটি সুন্নাত জারী করল’। তিনিই আবার বলেছেন, فَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ‘নিশ্চয়ই সকল প্রকার বিদ‘আত ভ্রষ্টতা’।[19] আর এটা অসম্ভব যে, কখনো দু’টি হাদীছ বিরোধপূর্ণভাবে একই অর্থে ব্যবহৃত হবে। বরং এখানে সুন্নাতে হাসানাহ দ্বারা রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত উদ্দেশ্য। নতুন সৃষ্ট কোন আমল নয়। তাহ’লে দুই হাদীছের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। সুতরাং আমাদের জন্য জায়েয হবে না যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর এক হাদীছকে গ্রহণ করব আর অন্য হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করব।
(খ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ سَنَّ ‘যে ব্যক্তি সুন্নাত জারী করল’। কিন্তু বলেননি من ابتدع ‘যে বিদ‘আত করল’। অতঃপর তিনি বলেছেন, فِيْ الإِسْلاَمِ তথা ইসলামের মধ্যে। আর বিদ‘আত ইসলামের অন্তর্ভুক্ত নয়; বরং ইসলাম বহির্ভূত বলেই তাকে বিদ‘আত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। অতঃপর তিনি বলেছেন, حَسَنَةً তথা উত্তম। আর বিদ‘আত কখনো হাসানাহ্ তথা উত্তম হয় না; বরং রাসূল (ছাঃ) বিদ‘আতকে ضَلاَلَةٌ বা ভ্রষ্টতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।[20]
(গ) সালাফে ছালেহীনের কেউ সুন্নাতে হাসানাহ্র ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাকে বিদ‘আতে হাসানাহ বলে আখ্যায়িত করেননি।
অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত কথা দ্বারা বিদ‘আতে হাসানাহ বৈধতার দলীল পেশ করা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপর মিথ্যারোপ করার শামিল। আর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ كَذَبَ عَلَىَّ مُتعَمِّدًا فلْيتبوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ- ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে আমার উপর মিথ্যারোপ করল, সে যেন জাহান্নামে তার স্থান বানিয়ে নিল’।[21]
(ক্রমশঃ)
মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম
[লেখক : কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদী আরব।
[1]. ইবনু মাজাহ হা/৪২, ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা অনুচ্ছেদ।
[2]. ছালেহ আল-ফাওযান, আল-ইরশাদ ইলা ছহীহিল ই‘তিকাদ ১/৩০০ পৃঃ।
[3]. তদেব।
[4]. মুসনাদে আহমাদ হা/৩৬০০; সিলসিলা যঈফা হা/৫৩৩।
[5]. আবু উসামাহ্ সালীম ইবনু আব্দিল হিলালী আস-সালাফী, আল-বিদ‘আত ওয়া আছারুহুস সায়্যি ফিল উম্মাহ্, ৬০ পৃঃ।
[6]. ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফুরুসিয়্যাহ, পৃঃ ৬১।
[7]. সুয়ূতী, আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের, পৃঃ ৮৯।
[8]. সিলসিলা যঈফা হা/৫৩৩-এর আলোচনা দ্রঃ।
[9]. তদেব।
[10]. ইবনু মাজাহ হা/৪২।
[11]. ইবনুল কাইয়িম (রহঃ), আল-ফুরূসিয়্যাহ ৬০ পৃঃ।
[12]. ফাতাওয়া ইয ইবনু আব্দিস সালাম, পৃঃ ৪২।
[13]. ইবনু কাছীর (রহঃ), আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/৩২৮ পৃঃ।
[14]. সুনানুদ দারেমী হা/১৬৯; ইবনু হাযার আসকালানী, সনদ ছহীহ, ফাতহুল বারী ১৩/২৫৩ পৃঃ।
[15]. সিলসিলাতুল আছারিছ ছহীহাহ্ হা/১২১; আলবানী, সনদ ছহীহ, তালখীছু আহকামিল জানায়েয ১/৮৩ পৃঃ।
[16]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫।
[17]. মুসলিম হা/১০১৭; মিশকাত হা/২১০।
[18]. মুসলিম হা/১০১৭; মিশকাত হা/২১০।
[19]. ইবনু মাজাহ, হা/৪২।
[20]. তদেব।
[21]. বুখারী হা/১০৮; মুসলিম হা/৩;