মৃত্যু যন্ত্রণার ভয়াবহতা

আব্দুর রহীম 428 বার পঠিত

ছাহাবায়ে কেরামের মৃত্যুর ভয় ও যন্ত্রনা : প্রকৃত জ্ঞানী মানুষ মাত্রই মৃত্যু পরবর্তী স্থায়ী জীবনের শাস্তির ভয় করে থাকেন। তার চেয়ে বেশী ভয় করেন মৃত্যুকে বা মৃত্যুকালীন যন্ত্রণাকে। কারণ মৃত্যু যন্ত্রণা এমন বাস্তব সত্য যা থেকে নবী-রাসূলগণও রক্ষা পাননি। এজন্য জান্নাতের সুসংবাদ প্রাপ্ত ছাহাবায়ে কেরামসহ সকল ছাহাবী মৃত্যুকালীন যন্ত্রণার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। নিম্নে কতিপয় ছাহাবীর মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনা করা হ’ল-

আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-এর অবস্থা :

ছাহাবী ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) বড় মাপের ছাহাবী ছিলেন। তার ছেলে আব্দুল্লাহ (রাঃ) একজন প্রখ্যাত ছাহাবী। এরপরও তিনি মৃত্যুকালীন অবস্থা ও পরকালীন মুক্তির বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন। ইবনু শিমাসা আল-মাহরী (রহঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আমরা একদা ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-এর মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে দেখতে গেলাম। তখন তিনি অনেকক্ষণ কাঁদলেন এবং মুখমন্ডল দেয়ালের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। তার পুত্র তাকে রাসূল (ছাঃ) প্রদত্ত বিভিন্ন সুসংবাদের উল্লেখ পূর্বক সান্তনা দিয়ে বললেন, আববা! রাসূল (ছাঃ) কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাসূল (ছাঃ) কি আপনাকে অমুক সুসংবাদ দেননি? রাবী বলেন, তখন তিনি পুত্রের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন,إِنَّ أَفْضَلَ مَا نُعِدُّ شَهَادَةُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا الله ُوَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ- ‘আমার সর্বোৎকৃষ্ট পাথেয় হচ্ছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ’ এ কালিমার সাক্ষ্য দেয়া’। আর আমি অতিক্রম করেছি আমার জীবনের তিনটি পর্যায়। এক সময় তো আমি এমন ছিলাম যে, রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধাচরণে আমার চেয়ে কঠোর আর কেউ ছিল না। আমি যদি রাসূল (ছাঃ)-কে কবযায় পেতাম তাকে হত্যা করতাম, এটা ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় ভাবনা। যদি সে অবস্থায় আমার মৃত্যু হ’ত, তবে নিশ্চিত আমাকে জাহান্নামে যেতে হ’ত। এরপর আল্লাহ যখন আমার অন্তরে ইসলামের অনুরাগ সৃষ্টি করে দিলেন, তখন আমি রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে উপস্থিত হয়ে অনুরোধ জানালাম যে, আপনার ডান হাত বাড়িয়ে দিন, আমি বায়‘আত করতে চাই। রাসূল (ছাঃ) তাঁর ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন, তখন আমি আমার হাত টেনে নিলাম। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-বললেন, ‘আমর! কী ব্যাপার? আমি বললাম, পূর্বেই আমি শর্ত করে নিতে চাই। তিনি (জিজ্ঞেস করলেন, কী শর্ত? আমি উত্তরে বললাম, আল্লাহ যেন আমার সব গোনাহ মাফ করে দেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘আমর! তুমি কি জানো না যে, ইসলাম পূর্বের সকল গোনাহ মিটিয়ে দেয়। হিজরত এবং হজ্জও পূর্বের সকল গোনাহ মিটিয়ে দেয়। ‘আমর (রাঃ) বলেন, এ পর্যায়ে আমার অন্তরে রাসূল (ছাঃ) অপেক্ষা অধিক প্রিয় আর কেউ ছিল না। আমার চোখে তিনি অপেক্ষা মহান আর কেউ ছিল না। অপরিসীম শ্রদ্ধার কারণে আমি তাঁর প্রতি চোখ ভরে তাকাতেও পারতাম না। আজ যদি আমাকে তাঁর দেহ আকৃতির বর্ণনা করতে বলা হয়, তবে আমার পক্ষে তা সম্ভব হয়ে উঠবে না। কারণ আমি কখনোই চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাতে পারিনি। ঐ অবস্থায় যদি আমার মৃত্যু হ’ত তবে অবশ্যই আমি জান্নাতী হওয়ার আশাবাদী থাকতাম। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা নানা বিষয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েছি, তাই জানি না, এতে আমার অবস্থান কোথায়? সুতরাং আমি যখন মারা যাব, তখন কোন বিলাপকারী অথবা আগুন যেন আমার জানাযার সাথে না থাকে। আমাকে যখন দাফন করবে তখন আমার উপর আস্তে আস্তে মাটি ফেলবে এবং দাফন সেরে একটি উট যবেহ করে তার গোশত বণ্টন করতে যে সময় লাগে, ততক্ষণ আমার কবরের পাশে অবস্থান করবে। যেন তোমাদের উপস্থিতির কারণে আমি আতঙ্কমুক্ত অবস্থায় চিন্তা করতে পারি যে, আমার প্রতিপালকের দূতের কী জবাব দেব’।[1]

নাওফেল ইবনু আবী আকরাব বলেন, ‘আমর ইবনুল ‘আছ মৃত্যুর সময় অত্যন্ত শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তার পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমর তা দেখে বলেন, হে আবু আব্দুল্লাহ, এত দুশ্চিন্তা কীসের? অথচ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আপনাকে নিকটে টেনে নিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্বও দিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘বৎস, ব্যাপারটা এমনই ছিল এবং আমি তোমাকে সে বিষয়ে বলব। আল্লাহর কসম, আমি জানি না এটা আমার প্রতি তার ভালোবাসা ছিল নাকি বন্ধুত্ব। কিন্তু আমি দু’জনের ব্যাপারে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে তারা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন যখন রাসূল (ছাঃ) তাদের ভালোবাসতেন: তারা হলেন ইবনে সুমাইয়া আম্মার এবং ইবনে উম্মে আবদ। যখন তিনি এসব কথা বলছিলেন তখন তিনি তার হাতটি চিবুকের যেখানে শিকল বাধা হয় সেখানে রেখে বললেন,اللَّهُمَّ أَمَرْتَنَا فَتَرَكْنَا وَنَهَيْتَنَا فَرَكِبْنَا وَلاَ يَسَعُنَا إِلاَّ مَغْفِرَتُكَ- ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আদেশ করেছেন অথচ আমরা তা পরিত্যাগ করেছি। আপনি আমাদেরকে কোন কাজ করতে নিষেধ করেছেন অথচ আমরা তা করেছি। আপনার ক্ষমা ব্যতীত আমাদের বাঁচার কোন উপায় নেই’। তিনি এই কথাগুলো বলতে বলতে পৃথিবী ত্যাগ করলেন।[2]

ইয়াকূব ইবনু আব্দুর রহমান বলেন, ‘আমর ইবনুল ‘আছের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসলে তিনি কেঁদে অশ্রু ঝরালেন। তার ছেলে আব্দুল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ওহে পিতা! আমি দৃঢ় বিশ্বাস করি যে, আপনার নিকট আল্লাহর কোন নির্দেশ আসলে আপনি তাতে ধৈর্য ধারণ করবেন। তিনি বললেন, হে বৎস! তোমার পিতার নিকট তিনটি বিষয় ঘুরপাক করছে। তার প্রথমত আমল বন্ধ হয়ে যাওয়া, দ্বিতীয়ত কবরের ভয়াবহতা, তৃতীয়ত প্রিয়জনের বিচ্ছেদ। আর তিনটির মধ্যে এটিই (তৃতীয়টি) তুলনামূলক সহজ। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহ! তুমি যে আদেশ করেছিলে আমি তা অমান্য করেছি, তুমি নিষেধ করেছিলে আমি তার অবাধ্যতা করেছি। হে আল্লাহ! ক্ষমা ও উদারতাই তোমার পরিচয়’।[3] বুজায়েয ইবনু রায়সান তার পিতার সূত্রে বর্ণনা করে বলেন, ‘যখন ‘আমর ইবনুল ‘আছের মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তখন তার ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে পিতা আপনি বলতেন, আফসোস! যদি আমি একজন জ্ঞানী মানুষের মৃত্যুর সময় তার সাথে সাক্ষাৎ করতে পারতাম! যাতে সে যে যন্ত্রণা পায় তা আমাকে বর্ণনা করতে পারে। আর আপনিই সেই জ্ঞানী মানুষ, আমার কাছে মৃত্যুকালীন অবস্থা বর্ণনা করুন। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, বৎস! আমার পাশটা যেন একটা তাঁবুতে, যেন আমি একটা সূঁচের বিষে শ্বাস নিচ্ছি, যেন একটা কাঁটাযুক্ত ডাল আমার পা থেকে মাথার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর তিনি নিম্নের পঙক্তি আবৃতি করলেন-

لَيتَنِي كُنْتُ قبْلَ مَا قَدْ بَدَا لِي. فِي قِلَالِ الْجِبَالِ أَرْعَى الْوُعُولَا

‘আফসোস! যদি আমার এ অবস্থা শুরুর পূর্বেই আমি পর্বতমালার গিরিখাতে গিয়ে ছাগল চরাতাম অর্থাৎ পরকালীন পাথেয় সঞ্চয় করতাম’।[4]

আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর অবস্থা :

খুব কম সময় রাসূল (ছাঃ)-এর সান্নিধ্য লাভ করেও সর্বাধিক হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)। তিনিও মৃত্যুর সময় শঙ্কিত ছিলেন। আব্দুর রহমান ইবনু মেহরান বলেন,

أَنَّ أَبَا هُرَيرَةَ أَوْصَى عِنْدَ مَوْتِهِ لَا تَضْرِبُوا عَلَيَّ فُسْطَاطًا وَلَا تَتَّبِعُونِي بِمَجْمَرٍ وَأَسْرِعُوا بِي أَسْرِعُوا بِي فَإِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يقُولُ: إِذَا وُضِعَ الْمُؤْمِنُ عَلَى سَرِيرِهِ يقُولُ: قَدِّمُونِي وَإِذَا وُضِعَ الْكَافِرُ عَلَى سَرِيرِهِ يقُولُ: يَا وَيلَتَا أَيْنَ تَذْهَبُونَ بِي؟

‘আবু হুরায়রা (রাঃ) তার মৃত্যুর সময় উপদেশ দিয়ে বলেন, তোমরা আমার উপরে শিবির স্থাপন করবে না এবং ধূপকাঠি নিয়ে আমাকে অনুসরণ করবেন না, তোমরা দ্রুত আমার দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করবে। কারণ আমি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি। ‘যখন একজন মুমিনকে তার খাটে রাখা হয়, তখন সে বলে, আমাকে দ্রুত নিয়ে চল। আর যখন একজন কাফেরকে তার বিছানায় বা খাটে রাখা হয়, তখন সে বলে, হায়! হায়! তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?’।[5]

হাম্মাম (রহঃ) ইকরিমা থেকে বর্ণনা করে, لَمَّا حَضَرَ أَبَا هُرَيرَةَ الْمَوْتُ جَعَلَ يبْكِي قِيلَ لَهُ مَا يبْكِيكَ يَا أَبَا هُرَيرَةَ؟ قَالَ قِلَّةُ الزَّادِ وَبعْدُ الْمَفَازَةِ وَعَقَبَةٌ هُبُوطُهَا الْجَنَّةُ أَوِ النَّارُ- আবু হুরায়রা যখন মৃত্যুর নিকটবর্তী হলেন, তখন তিনি কাঁদতে লাগলেন। তাকে বলা হ’লঃ হে আবু হুরায়রা, আপনাকে কীসে কাঁদাচ্ছে? তিনি বললেন, পাথেয়-এর অভাব, ছওয়াব প্রাপ্তির দূরত্ব এবং সর্বশেষ পরিণতি- জান্নাত নাকি জাহান্নাম।।[6]

অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন,أَمَا إِنِّي لا أَبْكِي عَلَى دُنْيَاكُمْ هَذِهِ، وَلَكِنِّي أَبْكِي لِبُعْدِ سَفَرِي وَقِلَّةِ زَادِي. أَصْبَحْتُ فِي صُعُودٍ مُهْبِطَةٌ عَلَى جَنَّةٍ وَنَارٍ، فَلا أَدْرِي إِلَى أيهما يُسلك بي ‘আমি তোমার এই দুনিয়ার জন্য কাঁদছি না, বরং আমি আমার পথের দীর্ঘতা ও পাথেয়-এর স্বল্পতার কারণে কাঁদছি। আমি এমন বাহনে আরোহণ করেছি, যা জান্নাত কিংবা জাহান্নামের দিকে ধাবমান। অথচ আমি জানি না কোনটির দিকে আমাকে নিয়ে যাওয়া হবে?’[7]

আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর অবস্থা :

ইবনু মাসঊদ (রাঃ) একজন প্রখ্যাত ছাহাবী ছিলেন। তিনি বদর, ওহোদসহ প্রায় সকল যুদ্ধে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি মৃত্যুযন্ত্রণা এবং তার পরবর্তী অবস্থার ব্যাপারে শঙ্কিত ছিলেন। যেমন বিভিন্ন আছারে বর্ণিত হয়েছে,

لَمَّا حَضَرَ عَبْدَ اللهِ بْنَ مَسْعُودٍ الْمَوْتُ دَعَا ابنَهُ فقَالَ يَا عَبْدَ الرَّحْمَنِ بْنَ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ إِنِّي أُوصِيكَ بِخَمْسِ خِصَالٍ فَاحْفَظْهُنَّ عَنِّي: أَظْهِرِ الْيَأْسَ لِلنَّاسِ فَإِنَّ ذَلِكَ غِنًى فَاضِلٌ وَدَعْ مَطْلَبَ الْحَاجَاتِ إِلَى النَّاسِ فَإِنَّ ذَلِكَ فِقْرٌ حَاضِرٌ وَدَعْ مَا تعْتَذِرُ مِنْهُ مِنَ الْأُمُورِ وَلَا تعْمَلْ بِهِ. وَإِنِ اسْتَطَعْتَ أَنْ لَا يَأْتِيَ عَلَيْكَ يَوْمٌ إِلَّا وَأَنْتَ خَيْرٌ مِنْكَ بِالْأَمْسِ فَافعَلْ. فَإِذَا صَلَّيْتَ صَلَاةً فَصَلِّ صَلَاةَ مُوَدِّعٍ كَأَنَّكَ لَا تُصَلِّي بعْدَهَا-

‘যখন আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) মৃত্যুর সন্নিকটে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি তার ছেলেকে ডেকে বললেন, হে আব্দুর রহমান ইবনু আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, আমি তোমাকে পাঁচটি কাজের উপদেশ দিচ্ছি, তুমি সেগুলো রক্ষা কর। ১. মানুষের নিকট (দুনিয়া সম্পর্কে) নিরাশা প্রকাশ কর, কারণ এটি একটি উত্তম সম্পদ। ২. তুমি মানুষের নিকট প্রয়োজনের কথা বলা পরিহার কর। কারণ এটাই উপস্থিত দারিদ্র্য। ৩. তুমি যেসব বিষয়ে অযুহাত পেশ কর, তা ছেড়ে দাও এবং সে ধরনের কাজ কর না। ৪. তুমি যদি এমন একটি দিন আনতে সক্ষম হও, যেটা গতকালের চেয়ে ভালো তবে তা কর। ৫. যখন তুমি ছালাত আদায় করবে, তখন বিদায়ী ব্যক্তির ন্যায় ছালাত আদায় করবে, যেন তুমি তার পরে আর ছালাত আদায় করতে পারবে না’।[8]

ইবনু মাসঊদের মৃত্যুশয্যায় ওছমান (রাঃ) তার কাছে গেলেন এবং বললেন, হে ইবনু মাসঊদ! আপনি কী সম্পর্কে অভিযোগ করছেন? তিনি বললেন, আমি আমার পাপের ব্যাপারে অভিযোগ করছি। তিনি বললেন, আপনি কী আশা করেন? তিনি বললেন, আমার রবের রহমত। তিনি বললেন, আপনি কীসের ভয় করেন? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করি। তিনি বললেন, আমি কি আপনার জন্য ডাক্তার ডাকব? তিনি বললেন, ডাক্তার আমাকে অসুস্থ করে দিয়েছে। তিনি বললেন, আমি কি আপনাকে কিছু অর্থসহায়তা করার আদেশ দেব? তিনি বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমার এর কোন প্রয়োজন নেই’।[9]

সালমান ফারেসী (রাঃ)-এর অবস্থা :

সালমান ফারেসী (রাঃ) যিনি খৃষ্টান ছিলেন পরে ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হয়েছিলেন। তিনিও মৃত্যুর সময় চরম ভীত ছিলেন। যেমন বিভিন্ন আছারে পাওয়া যায়, ‘যখন মৃত্যু তার নিকটবর্তী হ’ল, তখন তিনি তার স্ত্রীকে বললেন, এসো, আমার বোন। তিনি একগুচ্ছ কস্ত্তরী নিয়ে তার কাছে এলেন। তিনি বললেন, এক পেয়ালা পানি নিয়ে এসো, সে এক পেয়ালা পানি নিয়ে এলো। তিনি পানিতে কস্ত্তরী রাখলেন এবং তাতে মিশিয়ে দিলেন। তারপর তিনি তাকে বললেন, এটি আমার চারপাশে ছিটিয়ে দাও। কারণ আমার পাশে আল্লাহর এমন সৃষ্টিরা আগমন করবে যারা সুগন্ধি গ্রহণ করে কিন্তু খাদ্য খায় না। তিনি বলেন, সে তাই করল। তারপর তিনি তাকে বললেন, তুমি দরজা বন্ধ করে নিচে নেমে যাও। সে তাই করল। কিছুক্ষণ পর আমি উপরে উঠে দেখলাম তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তার উপর আল্লাহ তা‘আলার রহমত ও সন্তুষ্টি বর্ষিত হোক’।[10]

সালমানের স্ত্রী বুক্বায়রা বলেন, ‘সালমান (রাঃ)-এর যখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল, তখন তিনি চার দরজা বিশিষ্ট একটি উঁচু ঘরে অবস্থান করছিলেন। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, হে বুকবায়রা তুমি দরজা চারটি খুলে দাও, কেননা আজ আমার কাছে যিয়ারাতকারীরা আগমন করবে। আমি জানি না তারা কোন দরজা দিয়ে আমার কাছে প্রবেশ করবে। অতঃপর তিনি সুগন্ধি নিয়ে ডাকলেন এবং সেগুলো মিশ্রণ করতে বললেন। আমি তাই করলাম। তারপর তিনি বললেন, এগুলো আমার বিছানার চারপাশে ছিটিয়ে দাও। এরপর তুমি নিচে নেমে গিয়ে অপেক্ষা কর। অতঃপর উপরে উঠে আমার বিছানা লক্ষ্য করবে। আমি কিছুক্ষণ পরেই তাকিয়ে দেখতে পেলাম যে, তার রূহ কবয করা হয়েছে, যেন তিনি তার বিছানায় ঘুমাচ্ছেন এরূপ অবস্থায় রয়েছেন’।[11]

আম্বাসা ইবনু আবী সুফিয়ান এর অবস্থা :

নবী পত্নী উম্মে হাবীবার ভাই আম্বাসা (রাঃ) মৃত্যুযন্ত্রণা থেকে রক্ষা পেতে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছ বর্ণনা করে আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন। হাস্সান ইবনু আতিয়্যাহ বলেন, আম্বাসা ইবনু আবী সুফিয়ানের যখন মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে আসল তখন মৃত্যু তাকে খুব শঙ্কিত করে ফেললো। তাকে বলা হ’ল, এতো শঙ্কা কীসের? তিনি বললেন, আমি উম্মে হাবীবাকে বলতে শুনেছি, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,مَنْ صَلَّى أَرْبَعاً قبْلَ الظُّهْرِ وَأَرْبَعاً بعْدَهَا حَرَّم اللَّهُ لَحْمَهُ عَلَى النَّارِ. فَمَا ترَكْتهُنَّ مُنْذُ سَمِعْتهُنَّ ‘যে যোহরের ফরয ছালাতের পূর্বে চার রাক‘আত এবং ফরযের পর চার রাক‘আত ছালাত আদায় করবে, আল্লাহ তা‘আলা জাহান্নামের আগুনের জন্য তার গোশত (শরীর) হারাম করে দিবেন। তিনি বলেন, এ সমন্ধে শুনার পর থেকে আমি কখনো উক্ত ছালাত ছাড়িনি’।[12] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি দিবা রাত্রে বার রাকআত (সুন্নাতে মুওয়াক্কাদা) ছালাত আদায় করবে, আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানাবেন’।[13]

ইহকালীন জীবনের সমাপ্তি ও পরকালীন জীবনের সূচনার সন্ধিক্ষণ হ’ল মৃত্যু। মৃত্যু পথযাত্রী এসময় কঠিন যন্ত্রণা অনুভব করে থাকেন। সেসময় উপস্থিত ব্যক্তিদের কর্তব্য হ’ল তাকে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর তালক্বীন দেওয়া। তার নিকটে কোন মন্দ কথা না বলা ও কোন কিছুর জন্য জোরাজুরি না করা। অন্যথায় অধিক যন্ত্রণার কারণে তার মুখ থেকে মন্দ কথা বের হ’তে পারে এবং সেটাই তার শেষ বাক্য হ’তে পারে। আল্লাহ আমাদের মৃত্যু যন্ত্রণা লাঘব করুন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে জান্নাতের প্রবেশের পথ সুগম করে দিন।-আমীন!

আব্দুর রহীম

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

[1]. মুসলিম হা/১২১; মিশকাত হা/২৮।

[2]. আহমাদ হা/১৭৮১৬; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৫৮৯৯, সনদ ছহীহ।

[3]. আবু সুলায়মান রিবঈ, ওয়াছায়াল ওলামা ১/৬৮ পৃ.।

[4]. ইবনু আবীদ্দুনিয়া, আল মুহতাযিরীন হা/ ১০৩; আল-মুতামান্নিঈন হা/৯৩; কুরতুবী, আত-তাযকিরা ১/১৯৩ পৃ.।

[5]. আবু সুলায়মান রিবঈ, ওয়াছায়াল ওলামা ১/৫৭ পৃ.।

[6]. বুখারী, আত-তারীখুল কাবীর ৪/১৫৭-১৫৮; আবু সুলায়মান রিবঈ, ওয়াছায়াল ওলামা ১/৫৭ পৃ.।

[7]. ইবনু সা‘দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ৪/২৫৩, সনদ ছহীহ।

[8]. আবু সুলায়মান রিবঈ, ওয়াছায়াল ওলামা ১/৫০; আব্দুল আযীয সালমান, মাওয়ারিদুয যামাআন ৩/৭ পৃ.।

[9]. মুহাম্মাদ হাসসান, সিলসিলাতু মাছাবীহিল হুদা ৯/১৫; দুরুস ১০/৯৫।

[10]. আবু সুলায়মান রিবঈ, ওয়াছায়াল ওলামা ১/৫০ পৃ.।

[11]. তাবারাণী কাবীর হা/৬০৪৩; ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাকাতুল কুবরা ৪/৬৯ পৃ.; আবু নাঈম আস্ফাহানী, হিলইয়াতুল আওলিয়া ১/২০৭ পৃ.।

[12]. আহমাদ হা/২৬৮০৭, সনদ ছহীহ।

[13]. নাসাঈ হা/১৭৯৯, সনদ ছহীহ।



বিষয়সমূহ: পাপ
আরও