হাফেয ছালাহুদ্দীন ইউসুফ (রহ.)-এর কুরআনী খেদমত
মুখতারুল ইসলাম
উপস্থাপনা : উত্তম মুমিনের একটি গুরুত্বপূর্ণ নে‘মত হ’ল আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা। কেননা কান্না মানুষের শুদ্ধ আবেগের বহিঃপ্রকাশ। আল্লাহর বান্দাকে যে নে‘মত দিয়েছেন তার শুকরিয়া জ্ঞাপন করে ক্রন্দন করা আবশ্যক। একজন মুমিন বান্দা প্রকাশ্য ও গোপনে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের মাধ্যমে যাবতীয় পাপ-পঙ্কিলতা ক্ষমার মাধ্যমে নিজেকে পুতঃপবিত্র করতে পারে। সাথে সাথে পরকালে জাহান্নামের ভয়াবহ শাস্তি থেকে নিজেকে আত্মরক্ষা করতে পারে। আলোচ্য প্রবন্ধে সে বিষয়ে আলোচনার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ!
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের ফযীলত :
একজন সফল মুমিন ব্যক্তির জন্য আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা যরূরী। কেননা এতে তার ইহকালীন সফলতা ও পরকালীন কল্যাণ নিহিত রয়েছে। ক্বিয়ামতের দিন সৎআমল ব্যতীত কোন ব্যক্তি পরিত্রাণ পাবে না। সেদিনের মর্মান্তুদ শাস্তির কথা স্মরণ করে মুমিন জীবন সফলতার জন্য আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতে হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,وَاللهِ لَوْ تَعْلَمُوْنَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيْلًا، وَلَبَكَيتُمْ كَثِيْرًا، وَمَا تلَذَّذْتُمْ بِالنِّسَاءِ عَلَى الْفُرُشَاتِ، وَلَخَرَجْتُمْ إِلَى الصُّعُدَاتِ، تَجْأَرُوْنَ إِلَى اللهِ- ‘আল্লাহর কসম! আমি যা জানি তোমরা যদি তা জানতে, তবে তোমরা কম হাসতে ও বেশী কাঁদতে এবং বিছানায় তোমরা স্ত্রীদের সাথে আনন্দ উপভোগ করতে না। (বরং) তোমরা আল্লাহর আশ্রয় নেওয়ার জন্য পথে পথে বের হয়ে যেতে’।[1]
পরকালীন জীবনে একজন মুমিন চূড়ান্ত সফলতার জন্য আল্লাহর ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে সিজদায় লুটিয়ে পড়েন। আর এতে তার বিনয় আরো বৃদ্ধি পায়। আর এজন্য আল্লাহ বলেন,وَيَخِرُّوْنَ لِلْأَذْقَانِ يبْكُوْنَ وَيَزِيْدُهُمْ خُشُوْعًا- ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় আরও বৃদ্ধি পায়’ (ইসরা ১৭/১০৯)।
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَا يَلِجُ النَّارَ رَجُلٌ بَكَى مِنْ خَشْيَةِ اللهِ حَتَّى يعُوْدَ اللَّبَنُ فِيْ الضَّرْعِ، وَلَا يَجْتَمِعُ غُبَارٌ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَدُخَانُ جَهَنَّمَ- ‘সেই ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে না, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কাঁদে; যতক্ষণ না দুধ স্তনে ফিরে না যাবে। আর আল্লাহর পথের ধূলা ও জাহান্নামের ধোঁয়া (কোন বান্দার উপর) একত্রিত হবে না’।[2] অর্থাৎ স্তন থেকে বের হওয়া দুধ স্তনে ফিরে যাওয়া যেমন সম্ভব নয়, তেমনি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী বান্দার জাহান্নামে প্রবেশ অসম্ভব। অনুরূপভাবে আল্লাহর পথে নিরবিচ্ছিন্ন চলা ব্যক্তিকে জাহান্নামের ধোঁয়া স্পর্শ করবে না।
আবু উমামাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, لَيْسَ شَيْءٌ أَحَبَّ إِلَى اللهِ مِنْ قَطْرَتَيْنِ وَأَثرَيْنِ، قَطْرَةٌ مِنْ دُمُوْعٍ فِي خَشْيَةِ اللَّهِ، وَقَطْرَةُ دَمٍ تُهَرَاقُ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، وَأَمَّا الأَثرَانِ: فَأَثرٌ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، وَأَثرٌ فِيْ فَرِيْضَةٍ مِنْ فرَائِضِ اللهِ- ‘দু’টি বিন্দু ও চিহ্ন অপেক্ষা অন্য কিছুই আল্লাহর নিকট অধিক পসন্দনীয় নয়; আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের এক বিন্দু অশ্রু এবং আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদে) প্রবাহিত একবিন্দু রক্ত। আর দু’টি চিহ্নের একটি হ’ল আল্লাহর রাস্তায় (চলার) চিহ্ন এবং অপরটি হ’ল আল্লাহর ফরযসমূহের কোন ফরয পালন করার ফলে পড়া (ক্ষতের) চিহ্ন’।[3] মুহাম্মাদ বিন আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন, ‘আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন অর্থ হ’ল আল্লাহর তীব্র ভয়ে এবং তাঁর ভালোবাসার মহিমা অর্জনের জন্য কান্নাকাটি করা’।[4]
ইয়াযীদ ইবনু মায়সারা বলেন,وَبُكَاءٌ مِنْ خَشْيَةِ اللهِ، فَذَلِكَ الَّذِي تُطْفِي الدَّمْعَةُ مِنْهُ أَمْثَالَ الْجِبَالِ مِنَ النَّارِ- ‘আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের কারণে চোখ হতে নির্গত অশ্রুফোটা যা আগুনের পাহাড়কেও নিভিয়ে দেয়।[5]
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফযীলত হ’ল ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়া লাভ। আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; তন্মধ্যে একটি হ’ল,وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا ففَاضَتْ عَينَاهُ ‘আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আললাহকে স্মরণ করে; ফলে তার চক্ষুদ্বয় অশ্রু সিক্ত হয়’।[6]
ছাহাবীদের ক্রন্দন :
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদা এমন ভাষণ দিলেন যে, এমন ভাষণ আগে কখনো শুনিনি। তিনি বললেন, ‘যা আমি জানি তা যদি তোমরা জানতে, তাহ’লে তোমরা কম হাসতে এবং অধিক কাঁদতে। এ কথা শুনে ছাহাবীগণ তাঁদের চেহারা ঢেকে নিলেন এবং তাদের কান্নার রোল আসতে লাগল’।[7]
হাফেয ইবনু রজব (রহঃ) বলেন, আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করা অন্তরে ঈমান বৃদ্ধি করে এবং এর কারণে অন্তরের সাথে সম্পর্কিত আমল বৃদ্ধি পায়। যেমন আল্লাহভীরুতা, আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তাঁর উপর ভরসা করা, বেশী বেশী ছওয়াবের আকাঙ্খা করা ইত্যাদি।
মালেক ইবনু দিনার বলেন,الْبُكَاءُ عَلَى الْخَطِيئَةِ يَحُطُّ الْخَطَايَا كَمَا يَحُطُّ الرِّيحُ الْوَرَقَ الْيَابِسَ- ‘পাপের উপর অনুশোচনা স্বরূপ ক্রন্দন পাপকে মুছে দেয়। যেমনভাবে বাতাস শুষ্ক পাতাকে ফেলে দেয়’।[8]
আব্দুর রহমান ইবনু আহমাদ আদ-দাওরানী (রহঃ) বলেন, لِكُلِّ شَيْءٍ عَلَمٌ وَعَلَمُ الْخِذْلَانِ تَرْكُ الْبُكَاءِ ‘প্রত্যেকটি জিনিসের একটি নিদর্শন বা চিহ্ন রয়েছে। আর ব্যর্থতার চিহ্ন বা নিদর্শন হ’ল আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন ছেড়ে দেওয়া’।[9]
ছাহাবায়ে কেরাম আল্লাহর আনুগত্য নষ্ট হওয়ার ভয়ে ক্রন্দন করতেন। তাদের ব্যপারে মহান আল্লাহ বলেন,لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ لاَ يَجِدُوْنَ مَا يُنْفِقُوْنَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوْا لِلّهِ وَرَسُوْلِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِيْنَ مِنْ سَبِيْلٍ وَاللهُ غَفُوْرٌ رَحِيْمٌ- وَلاَ عَلَى الَّذِيْنَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَا أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيْضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوْا مَا يُنْفِقُوْنَ- ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তার রাসূলের প্রতি বিশুদ্ধ ঈমান রাখে। আর সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন পথ নেই। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। ‘আর ঐসব লোকদের বিরুদ্ধেও অভিযোগের কোন পথ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাবো। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হ’তে অশ্রুধারা প্রবাহিত হ’তে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তাওবা ৯/৯১-৯২)।
হাফেয ইবনু রজব (রহঃ) বলেন, ‘এই আয়াতদ্বয় একদল দরিদ্র মুসলিমদের ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল। যারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসেছিলেন। আর তখন তিনি তাবুক যুদ্ধের জন্য প্রস্ত্ততি নিচ্ছিলেন। তখন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে তাদেরকে যুদ্ধে নিতে অনুরোধ করলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) উত্তর দিলেন, আমার কাছে এমন কিছু নেই, যাতে করে আমি তোমাদেরকে বহন করব। তখন তারা রাসূলের সাথে জিহাদের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখে ক্রন্দন করতে করতে চলে গেল’।[10]
ইমাম কাসেমী (রহঃ) বলেন,دَلَّتِ الْآيَةُ عَلَى جَوَازِ الْبُكَاءِ وَإِظْهَارِ الْحُزْنِ عَلَى فَوَاتِ الطَّاعَةِ، وَإِنْ كَانَ مَعْذُوْرًا- ‘এই আয়াতটি আনুগত্য ছুটে যাওয়ার জন্য ক্রন্দন করা এবং দুঃখ প্রকাশ করা জায়েয হওয়ার প্রতি নির্দেশ করে। যদিও সেটা বাধ্যগত অবস্থায় হয়।[11]
যুহরী (রহঃ) বলেন,دَخَلْتُ عَلَى أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ بِدِمَشْقَ وَهُوَ يَبْكِى فَقُلْتُ مَا يُبْكِيكَ فَقَالَ لاَ أَعْرِفُ شَيْئًا مِمَّا أَدْرَكْتُ إِلاَّ هَذِهِ الصَّلاَةَ، وَهَذِهِ الصَّلاَةُ قَدْ ضُيِّعَتْ- ‘আমি দামেশকে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হলাম, তিনি তখন কাঁদছিলেন। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে কোন বিষয়টি কাঁদাচ্ছে? তিনি বললেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) -এর যুগে যা কিছু পেয়েছি তার মধ্যে কেবল ছালাত ছাড়া আর কিছুই বহাল নেই। কিন্তু ছালাতকেও নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে’।[12]
ওছায়মীন (রহঃ) বলেন, এই হাদীছটিতে কোন ধর্মীয় বিধান লঙ্ঘিত হ’লে অথবা কোন নিষিদ্ধ হারাম বিষয় সংঘটিত হ’লে সেজন্য ক্রন্দনের বৈধতার প্রমাণ রয়েছে। অতএব কোন ওয়াজিব লঙ্ঘন করে ক্রন্দন করা হারাম কাজ করে (অনুতপ্ত হয়ে) ক্রন্দন করার সমান। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, নিশ্চয়ই প্রত্যেকটা মানুষের হৃদয় রয়েছে। অতএব কেউ যখন কোন হারাম বিধান লঙ্ঘন করবে অথবা কোন ওয়াজিব বিধান উপেক্ষা করতে দেখবে, তখন সে অবশ্যই কষ্ট পাবে। যেমন ঐ তিন ব্যক্তির ঘটনা যারা তাবুক যুদ্ধে অংশগ্রহণ হ’তে পিছিয়ে ছিলেন। তারা হলেন কা‘ব ইবনু মালেক এবং তার দুই সাথী। কা‘ব (রাঃ) তার সাথে যা ঘটেছিল তার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হয়ে গিয়েছিল’।[13]
হাফেয ইবনু হাযার (রহঃ) বলেন, اسْتِحْبَابُ بُكَاءِ الْعَاصِي أَسَفًا عَلَى مَا فَاتَهُ مِنَ الْخَيْرِ ‘এ ঘটনা কল্যাণময় কোন কিছুকে হারিয়ে দুঃখিত হয়ে পাপী ব্যক্তির কান্না মুস্তাহাব হওয়া প্রমাণ করে’।[14]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ক্রন্দন
আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, ‘রাসূল (ছাঃ)-এর ক্রন্দন তার মুচকি হাসির মতই ছিল। তাতে কোন চিৎকার কিংবা উচ্চ আওয়ায ছিলনা। যেমনটা তার হাসিতেও ছিলনা। কিন্তু ক্রন্দনের সময় তার চক্ষুদ্বয় থেকে এমনভাবে অশ্রু প্রবাহিত হ’ত যেন তা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। আর তখন তাঁর বুকের মধ্যে ঝাঁকুনি শুনা যেত। যখন তাঁর ছেলে ইব্রাহীম মারা যায়, তখন তিনি তার জন্য কেঁদেছিলেন। যা তার প্রতি স্নেহের কারণে ছিল। তিনি ক্রন্দন করেছিলেন যখন তার কোন এক কন্যা মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ক্রন্দন করেন যখন উসমান ইবনু মাযঊন মারা যায়। সূর্যগ্রহণের সময় তিনি ক্রন্দন করতেন। তখন তিনি ছালাতুল কুসূফে দাঁড়িয়ে ক্রন্দন শুরু করতেন। তিনি কখনো কখনো তাঁর উম্মতের জন্য ভীত হয়ে এবং দয়াপরবশ হয়ে ক্রন্দন করতেন। আবার কখনো কখনো আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করতেন’।[15]
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বললেন, কুরআন পড়ে শুনাও। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে পড়ে শোনাব! অথচ আপনার উপরে তা অবতীর্ণ হয়েছে। তিনি বললেন, অন্যের মুখ থেকে কুরআন পড়া শুনতে আমি ভালোবাসি। অতঃপর তাঁর সামনে আমি সূরা নিসা পড়তে লাগলাম। পড়তে পড়তে যখন এই আয়াতে পৌঁছলাম, فَكَيْفَ إِذَا جِئنَا مِنْ كُلِّ أُمَّةٍ بِشَهِيْدٍ وَجِئنَا بِكَ عَلَى هَؤُلَاءِ شَهِيْدًا- ‘অতএব সেদিন কেমন হবে, যেদিন আমরা প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী (নবী) আনব এবং তোমাকে তাদের সকলের উপর সাক্ষী করব?’ (নিসা ৪/৪১)। অতঃপর আমি তাঁর দিকে ফিরে দেখি, তাঁর চক্ষুদ্বয় অশ্রুপাত করছে’।[16]
তিনি কখনো কখনো রাতের ছালাতে ক্রন্দন করতেন। যখন তিনি ছালাত পড়তেন তখন তার বক্ষ ক্রন্দনের কারণে ডেকচির ন্যায় কম্পিত হ’ত। মুতররিফ (রহঃ) তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, أَتَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم- وَهُوَ يُصَلِّى وَلِجَوْفِهِ أَزِيزٌ كَأَزِيزِ الْمِرْجَلِ يَعْنِى يَبْكِى ‘একদিন আমি নবী (সা.)-এর কাছে আসলাম তখন তিনি ছালাত আদায় করছিলেন। আর তার ভিতরে ডেকচির শব্দের ন্যায় শব্দ হচ্ছিল। অর্থাৎ তিনি কাঁদছিলেন’।[17]
উপদেশ শ্রবণ করে খলীফা ও শাসকগণের কান্না
(১) খলীফা সুলায়মান ইবনু আব্দুল মালেকের কান্না : একদা খলীফা সুলায়মান ইবনু আব্দুল মালেক হজ্জ সম্পাদন করলেন। এ সময় মানুষদের ভিড় দেখে তিনি ওমর ইবনু আব্দুল আযীযকে বললেন, আপনি কি এই সৃষ্টিকুলকে দেখেন না যাদের সংখ্যা আল্লাহ ব্যতীত কেউ গণনা করতে পারবে না এবং তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তাদের রিযিকের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হবে না। অতঃপর ওমর ইবনু আব্দুল আযীয বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! এরা আজ আপনার প্রজা এবং আগামীকাল আল্লাহর সম্মুখে আপনার প্রতিপক্ষ। তখন সুলায়মান প্রচন্ড কান্না করলেন এবং বললেন, আমি আল্লাহর সাহায্য কামনা করি’।[18]
(২) খলীফা হারূনুর রশীদের কান্না : আব্দুল্লাহ ইবনু আব্দুল আযীয আল-আনমারী একদিন ছাফা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে খলীফা হারূনুর রশীদকে উপদেশ দিলেন। তিনি তাকে বললেন, আপনি কি দেখছেন কা‘বার চারপাশে কত মানুষ? রশীদ উত্তর দিলেন, অনেক। তখন তিনি বললেন, এদের প্রত্যেকেই ক্বিয়ামতের দিন তাদের স্ব স্ব ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হবে। আর আপনি তাদের সবার জন্য জিজ্ঞাসিত হবেন। তখন রশীদ প্রচন্ড কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তার দিকে একটার পরে একটা রুমাল এগিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি তা দিয়ে চোখের পানি মুছলেন। তিনি আরও বললেন, হে খলীফা! নিশ্চয়ই প্রত্যেক ঐ ব্যক্তি যে নিজের মাল-সম্পদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে তার উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হবে। তাহলে ঐ ব্যক্তির কি হবে যে সকল মুসলিমের মাল-সম্পদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করে! তারপর তিনি তাদের ছেড়ে চলে গেলেন। হারূনুর রশীদ তখনো কাঁদছিলেন।[19]
ফুযায়েল ইবনু আইয়ায মক্কায় এক রাত্রে খলীফা হারূনুর রশীদকে নছীহত করে বলেন, হে সুন্দর চেহারার অধিকারী! নিশ্চয়ই আপনি এদের সবার কারণে জিজ্ঞাসিত হবেন। আল্লাহ বলেন,إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتُّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ- ‘(স্মরণ কর) যেদিন অনুসৃতগণ তাদের অনুসারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং তারা শাস্তিকে প্রত্যক্ষ করবে ও তাদের সকল সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাবে’ (বাক্বারাহ ২/১৬৬)। তখন তিনি উচ্চ আওয়াজে কেঁদে উঠলেন।[20]
একদিন হারূনুর রশীদ পান করার জন্য পানি চাইলেন। ফলে তার জন্য এক মটকা ঠান্ডা পানি নিয়ে আসা হ’ল। এমতাবস্থায় ইবনু সিমাক তাঁর নিকটে আসলেন। তখন তিনি ইবনু সিমাককে বললেন, আমাকে কিছু উপদেশ দিন। ইবনু সিমাক বললেন, যদি আপনাকে এই পানি পান করতে না দেওয়া হয়, তাহলে পানি পান করার জন্য আপনি কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবেন? রশীদ উত্তর দিলেন, আমার অর্ধেক রাজত্ব। তখন তিনি বললেন, আপনি তৃপ্তি সহকারে পানি পান করুন। অতঃপর যখন তিনি (রশীদ) পান শেষ করলেন, তখন ইবনু সিমাক বললেন, আপনি কি মনে করেন, যদি এই পানিটা আপনার দেহ থেকে না বের হয়, তখন আপনি তা বের করতে কত পরিশোধ করবেন? তিনি উত্তর দিলেন, বাকী অর্ধেক রাজত্ব দ্বারা। তখন তিনি বললেন, নিশ্চয়ই এই রাজত্বের অর্ধেকের মূল্য এক ঢোক পানি। আর বাকি অর্ধেকের মূল্য একবারের প্রস্রাব। অতএব দুনিয়া নিয়ে প্রতিযোগিতা করা যথাযোগ্য নয়। অতঃপর হারূনুর রশীদ কেঁদে ফেললেন।[21]
আবুল আতাহিইয়া বলেন, ‘একদিন ইবনু সিমাক হারূনুর রশীদকে বললেন, আপনি মৃত্যুবরণ করবেন একাকী, কবরস্থ হবেন একাকী, উত্থিত হবেন একাকী। অতএব আপনি আল্লাহর সম্মুখে অবস্থান এবং জান্নাত-জাহান্নামে অবস্থান করার ব্যাপারে সতর্ক হৌন। যেদিন পা নড়বড়ে হবে। কেবল অনুশোচনা হবে। কিন্তু কোন তওবা কবুল করা হবে না। কোন ভুল বলা হবে না এবং কোন মালের বিনিময়ে গ্রহণ করা হবে না। তখন খলীফা উচ্চ স্বরে কাঁদতে লাগলেন’।[22]
(৩) খলীফা মুস্তাযীর ক্রন্দন : ইমাম ইবনুল জাওযী খলীফা মুস্তাযীকে বলেন, হে আমীরুল মুমিনীন! যদি আমি কোন কথা বলি তাহ’লে তার জন্য আমি আপনাকে ভয় পাই। আর যদি আমি চুপ থাকি তাহ’লে আপনার জন্য ভয় করি। নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আপনাকে বলে ‘আল্লাহকে ভয় করুন’ সে ব্যক্তির কথা উত্তম ঐ ব্যক্তির কথার চেয়ে যে বলে, ‘আপনারা তো ক্ষমাপ্রাপ্ত পরিবারের সদস্য’। ওমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলতেন, ‘যদি আমার কাছে কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যুলুমের অভিযোগ আসে, আর আমি যদি তাকে পরিবর্তন না করি, তাহ’লে আমিও যালেম’। হে আমীরুল মুমিনীন! ইউসুফ (আঃ) দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা নিবারণ না হওয়া পর্যন্ত তৃপ্ত হ’তেন না। হযরত ওমর (রাঃ) রামাদার বছর পেটে পাথর বাঁধতেন এবং বলতেন, হায় শব্দ! শব্দ করিসনা। আল্লাহর শপথ! ওমর ততক্ষণ পর্যন্ত কোন প্রকার ঘি অথবা গোশত খাবে না যতক্ষণ মানুষরা খেয়ে শক্তিশালী না হয়। অতঃপর মুসতাযী ক্রন্দন করলেন এবং অনেক মাল-সম্পদ ছাদাক্বাহ করলেন’।[23]
(৪) আব্দুর রহমান আল-উমারীর কান্না : বিচারক মুনযির আল-বালুত্বী একদিন আব্দুর রহমানের দরবারে আসলেন। তখন তার জন্য একটি সুউচ্চ বালাখানা নির্মাণ করা হয়েছিল। সেটি বিভিন্ন রঙে সুশোভিত করা ছিল এবং তাতে পর্দা লাগানো ছিল। আর তার পাশে রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্বশীল ব্যক্তিগণ বসে ছিলেন। যারা এই নির্মিত বালাখানার এবং তার প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু বিচারক তখন চুপ ছিলেন। কোন কথা বলছিলেন না। তখন বাদশাহ তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, তুমি কি বলবে? তখন বিচারক কান্নায় ভেঙে পড়লেন এবং তার অশ্রু দাড়িতে গড়িয়ে পড়তে লাগল। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহ আপনাকে যা (রাজত্ব) দিয়েছেন এবং মানুষজনের উপর আপনাকে মর্যাদা মন্ডিত করেছেন। এমনকি তিনি আপনাকে কাফের ও মুশরিকের মঞ্জিলে প্রেরণ করেছেন। এগুলো সত্ত্বেও আপনি আপনার কৌশল দ্বারা শয়তানকে শক্তিশালী করতে পারেন না। আল্লাহ বলেন, وَلَوْلَا أَنْ يَكُوْنَ النَّاسُ أُمَّةً وَاحِدَةً لَجَعَلْنَا لِمَنْ يَكْفُرُ بِالرَّحْمَنِ لِبيوْتِهِمْ سُقُفًا مِنْ فِضَّةٍ وَمَعَارِجَ عَلَيهَا يَظْهَرُوْنَ- ‘যদি (দুনিয়ার মোহে) সকল মানুষ (কুফরীতে) একদল ভুক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা না থাকত, তাহ’লে যারা দয়াময়কে অস্বীকার করে, আমরা তাদেরকে তাদের গৃহের জন্য দিতাম রৌপ্য নির্মিত ছাদ ও সিঁড়ি, যার উপরে তারা আরোহণ করত’ (যুখরুফ ৪৩/৩৩)। অতঃপর ঐ সময় বাদশাহ নির্বাক হয়ে গেলেন এবং কেঁদে ফেললেন। অতঃপর বললেন, আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আর অধিকাংশ মুসলমানই আপনার মতো’।[24]
[ক্রমশ]
আব্দুল্লাহ
[লেখক : ২য় বর্ষ, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]
[1]. তিরমিযী হা/২৩১২; ইবনু মাজাহ হা/৪১৯০; আহমাদ হা/২১৫১৬।
[2]. তিরমিযী হা/১৬৩৩; নাসাঈ হা/৩১০৮; মিশকাত হা/৩৮২৮।
[3]. তিরমিযী হা/১৬৬৯।
[4]. তুহফাতুল আহওয়াযী ৫/২৫৩ পৃ.।
[5]. হিলইয়াতুল আওলিয়া ৫/২৩৫ পৃ.।
[6]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১।
[7]. বুখারী হা/৪৬২১; মুসলিম হা/২৩৫৯।
[8]. জামেউল উলূম ওয়াল হুককাম ১/৪২৪ পৃ.।
[9]. আয-যাহবী, আস-সিয়ার ১০/১৮২ পৃ.।
[10]. ইবনু হাযম, লাত্বায়েফুল মা‘আরেফ ২৪৩ পৃ.।
[11]. তাফসীরে ক্বাসেমী ৫/৪৭৮ পৃ.।
[12]. বুখারী হা/৫৩০।
[13]. বুকাউস সালফ।
[14]. ইবনু হাযার, ফৎহুল বারী ৮/১২৪ পৃ.।
[15]. আয-যা’দুল মা‘আদ, ১/১৭৫ পৃ.।
[16]. বুখারী হা/৫০৪৯; মুসলিম হা/৮০০; মিশকাত হা/২১৯৫।
[17]. নাসাঈ হা/১২১৪; মিশকাত হা/১০০০।
[18]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২০৩ পৃ.।
[19]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১০/২০০ পৃ.।
[20]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১০/২৩৬ পৃ.।
[21]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১০/২৩৪ পৃ.।
[22]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১০/২৩৬ পৃ.।
[23]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১৩/৩৬ পৃ.।
[24]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১১/৩২৭ পৃ.।