মূল্যহীন দুনিয়ার প্রতি অনর্থক ভালোবাসা (৭ম কিস্তি)
আব্দুর রহীম
মুহাম্মাদ আবুল কালাম 1168 বার পঠিত
ভূমিকা : প্রত্যেক মানুষের জন্যই দুনিয়ার জীবনের সময়সীমা নির্ধারিত। আর আখেরাতের জীবন অনন্তকাল। দুনিয়ার জীবন হ’ল কর্মক্ষেত্র। আর আখেরাত হ’ল কর্মফল লাভের জায়গা। একজন মুমিনের একমাত্র লক্ষ্য থাকে আখেরাতে সফলকাম হওয়া। কারণ দুনিয়া চিত্ত বিনোদন ব্যতীত কিছুই নয়। অথচ আমাদের পার্থিব জীবন আবর্তিত হচ্ছে দুনিয়াকে কেন্দ্র করে। কিভাবে দুনিয়াতে ভাল থাকা যায়, কিভাবে বড় বাড়ী করা যায়, কিভাবে গাড়ী করা যায়, কিভাবে বেশী সম্পদ অর্জন করা যায়, কিভাবে জৌলুশপূর্ণ জীবনের অধিকারী হওয়া যায়। আর এজন্যেই আল্লাহ বলেন,بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَى- ‘কিন্তু তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই প্রাধান্য দাও’। অথচ আখেরাতই অধিক উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী’ (আলা ৮৭/১৬-১৭)। আলোচ্য প্রবন্ধে একজন মুমিনের পার্থিব জীবন কেমন হবে তা তুলে ধরা হ’ল।-
দুনিয়ার জীবন শোভনীয় : ক্ষণস্থায়ী দুনিয়া মুমিনের জন্য ভোগ্যবস্ত্ত নয়। কিন্তু শয়তান একজন মুমিন বান্দাকে ভোগ্যবস্ত্তর সৌন্দর্য্যকে বিমোহিত করে আখেরাত থেকে গাফেল রাখার চেষ্টা করে। সে কারণেই দুনিয়ার স্বরূপ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,زُيِّنَ لِلنَّاسِ حُبُّ الشَّهَوَاتِ مِنَ النِّسَاءِ وَالْبَنِينَ وَالْقَنَاطِيرِ الْمُقَنْطَرَةِ مِنَ الذَّهَبِ وَالْفِضَّةِ وَالْخَيْلِ الْمُسَوَّمَةِ وَالْأَنْعَامِ وَالْحَرْثِ ذَلِكَ مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَاللهُ عِنْدَهُ حُسْنُ الْمَآبِ- ‘মানুষের জন্য শোভনীয় করা হয়েছে তাদের আসক্তি সমূহকে তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি, স্বর্ণ ও রৌপ্যের রাশিকৃত সঞ্চয় সমূহের প্রতি, চিহ্নিত অশ্বরাজি, গবাদিপশু ও শস্যক্ষেত সমূহের প্রতি। এসবই পার্থিব জীবনের ভোগ্যবস্ত্ত মাত্র। আর আল্লাহর নিকটেই রয়েছে সুন্দরতম ঠিকানা’ (আলে-ইমরান ৩/১৪)।
ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য ও পরীক্ষার বস্ত্ত : একজন মুমিনের আখেরাত থেকে বিমুখ হওয়ার কারণ সমূহের অন্যতম হ’ল ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্তুতি, যা তাকে খুব সহজেই বিমোহিত করে। আল্লাহ বলেন,الْمَالُ وَالْبَنُونَ زِينَةُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَالْبَاقِيَاتُ الصَّالِحَاتُ خَيْرٌ عِنْدَ رَبِّكَ ثَوَابًا وَخَيْرٌ أَمَلًا- ‘ধন-সম্পদ ও সন্তানাদি দুনিয়ার জীবনের সৌন্দর্য মাত্র। অথচ চিরস্থায়ী সৎকর্মসমূহ তোমার প্রভুর নিকটে প্রতিদান হিসাবে উত্তম এবং কাংখিত হিসাবেও উত্তম’ (কাহফ ১৮/৪৬)। অন্যত্র আল্লাহ তার নবীকে বলেন,وَلَا تُعْجِبْكَ أَمْوَالُهُمْ وَأَوْلَادُهُمْ إِنَّمَا يُرِيدُ اللهُ أَنْ يُعَذِّبَهُمْ بِهَا فِي الدُّنْيَا وَتَزْهَقَ أَنْفُسُهُمْ وَهُمْ كَافِرُونَ- ‘অতএব তাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাকে বিমুগ্ধ না করে। আল্লাহ তো কেবল এটাই চান যে, এর মাধ্যমে তাদেরকে পার্থিব জীবনে শাস্তি দিবেন এবং কাফের অবস্থায় তাদের প্রাণ বিয়োগ হবে’ (তাওবা ৯/৮৫)।
আল্লাহ আরও বলেন,وَلَا تَمُدَّنَّ عَيْنَيْكَ إِلَى مَا مَتَّعْنَا بِهِ أَزْوَاجًا مِنْهُمْ زَهْرَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَرِزْقُ رَبِّكَ خَيْرٌ وَأَبْقَى- ‘আর তুমি তোমার চক্ষুদ্বয় প্রসারিত করো না ঐ সবের প্রতি, যা আমরা তাদের বিভিন্ন শ্রেণীর লোককে ভোগ্যবস্ত্ত রূপে দান করেছি পার্থিব জীবনের জাঁকজমক স্বরূপ। যাতে আমরা এর মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা নিতে পারি। বস্ত্তত তোমার প্রতিপালকের দেওয়া (আখেরাতের) রিযিক অধিক উত্তম ও সর্বাধিক স্থায়ী’ (ত্বোয়াহা ২০/১৩১)।
দুনিয়ার জীবন তুচ্ছ ও নগণ্য : আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার জীবন একজন মুমিনের কাছে খুবই তুচ্ছ ও নগণ্য। কেননা আল্লাহ বলেন,قُلْ مَتَاعُ الدُّنْيَا قَلِيلٌ وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ لِمَنِ اتَّقَى وَلَا تُظْلَمُونَ فَتِيلًا- ‘তুমি বল, দুনিয়ার সম্পদ তুচ্ছ। আর আখেরাতই হ’ল মুত্তাক্বীদের জন্য উত্তম’ (নিসা ৪/৭৭)। তিনি আরও বলেন,أَرَضِيتُمْ بِالْحَيَاةِ الدُّنْيَا مِنَ الْآخِرَةِ فَمَا مَتَاعُ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا فِي الْآخِرَةِ إِلَّا قَلِيلٌ- ‘তোমরা কি আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়াবী জীবনের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেলে? অথচ আখেরাতের তুলনায় দুনিয়ার ভোগবিলাস অতীব নগণ্য’ (তাওবা ৯/৩৮)।
আখেরাতের অনন্ত জীবনে জান্নাতের একটি চাবুকের যে মূল্য রয়েছে, তা দুনিয়ার কোন উৎকৃষ্ট বস্ত্তর সাথেও তুলনীয় নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছন,مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنْ الدُّنْيَا وَمَا فِيْهَا- ‘জান্নাতে একটি চাবুকের সমপরিমাণ জায়গা গোটা দুনিয়া ও তার মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকে উত্তম’।[1]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مَثَلُ الدُّنْيَا فِي الآخِرَةِ إِلاَّ مَثَلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ فِي الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ يَرْجِعُ ‘আখেরাতের তুলনায় দুনিয়া হ’ল এতটুকু, যেমন তোমাদের কেউ তার একটি আংগুল সমুদ্রের পানিতে ডুবিয়ে তা তুলে আনল। সে লক্ষ্য করুক তার আংগুল কতটুকু পানি নিয়ে ফিরেছে’।[2] রাসূল (ছাঃ) দুনিয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, وَمَا أَنَا وَالدُّنْيَا إِلَّا كَرَاكِبٍ اسْتَظَلَّ تَحْتَ شَجَرَةٍ ثُمَّ رَاحَ وَتَرَكَهَا- ‘মূলত আমার ও দুনিয়ার উপমা হ’ল একজন ঐ আরোহীর ন্যায়, যে একটি গাছের নীচে ছায়ায় কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিল, অতঃপর বৃক্ষটিকে ছেড়ে চলে যায়’।[3]
দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া-কৌতুকের বস্ত্ত : দুনিয়ার জীবন ক্রীড়া-কৌতুকের বস্ত্ত। এই ভোগ্যবস্ত্ত মোহে পড়ে এক মুমিন যেন ধোকায় পতিত না হয়, সেজন্য মহান দুনিয়া ও আখেরাতের তুলনা বর্ণনা করে বলেন,وَمَا هَذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ- ‘পার্থিব জীবন ক্রীড়া-কৌতুক ছাড়া কিছু নয়, আখেরাতের জীবনই প্রকৃত জীবন। তারা যদি জানত’ (আনকাবুত ২৯/৬৪)।
অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন,فَلَا تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلَا يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُورُ- ‘দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে; আর বড় প্রতারক (শয়তান) যেন তোমাদেরকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারণা না করে’ (ফাতির ৩৫/০৫)।
দুনিয়া অর্জনে আখেরাত বিমুখতা : দুনিয়া অর্জন করতে গিয়ে অনেক মুসলিম আখেরাতকে বেমালুম ভুলে যায়। ফলে তার কাছে চিরস্থায়ী জীবন আখেরাতকে তুচ্ছজ্ঞান মনে হয়। আর দুনিয়ার প্রতি এতটাই মুগ্ধ থাকে যে একমাত্র কবরই তার অন্তরায় ঘটায়। আর এজন্য মহান আল্লাহ বলেন,أَلْهَاكُمُ التَّكَاثُرُ- حَتَّى زُرْتُمُ الْمَقَابِرَ- ‘অধিক পাওয়ার আকাংখা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে’, ‘যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْهُومَانِ لَا يَشْبَعَانِ: مَنْهُومٌ فِي الْعِلْمِ لَا يَشْبَعُ مِنْهُ وَمَنْهُومٌ فِي الدُّنْيَا لَا يَشْبَعُ مِنْهَا- ‘দু’জন লোভী ব্যক্তির পেট কখনো পরিতৃপ্তি লাভ করে না। একজন জ্ঞানপিপাসু লোক ইলম দ্বারা তার পেট কখনো ভরে না। দ্বিতীয়জন হ’ল দুনিয়া পিপাসু-দুনিয়ার ব্যাপারে সেও কখনো পরিতৃপ্ত হয় না’।[4] তিনি অন্যত্র বলেন,يَهْرَمُ ابْنُ آدَمَ وَيَشِبُّ مِنْهُ اثْنَانِ: الْحِرْصُ عَلَى الْمَالِ وَالْحِرْصُ عَلَى الْعُمُرِ ‘আদম সন্তান বৃদ্ধ হয় এবং দু’টি জিনিস তার মধ্যে জওয়ান হয়-সম্পদের প্রতি ভালবাসা এবং দীর্ঘ জীবনের আকাংখা’।[5]
দুনিয়া অর্জনে বরকত বিনষ্টতা : যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়া চায় এবং সেই লক্ষ্যে কাজ করে, সে দুনিয়া-আখেরাত দু’টিই হারায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ كَانَتِ الدُّنْيَا هَمَّهُ فَرَّقَ اللهُ عَلَيْهِ أَمْرَهُ وَجَعَلَ فَقْرَهُ بَيْنَ عَيْنَيْهِ وَلَمْ يَأْتِهِ مِنَ الدُّنْيَا إِلاَّ مَا كُتِبَ لَهُ- ‘যে ব্যক্তির প্রধান চিন্তা থাকে দুনিয়া অর্জনের, আল্লাহ তার প্রচেষ্টাকে তার প্রতিকূলে বিক্ষিপ্ত করে দেন, আর দারিদ্রকে তার দু’চক্ষুর সামনে করে দেন। আর দুনিয়ার সুখসামগ্রী তার ততটুকুই লাভ হয়, যতটুকু তার ভাগ্যে লিখা থাকে’।[6]
আর আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অমান্য করার মাধ্যমেও বরবত বিনষ্ট হয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছে কুদসী বলেছেন, আল্লাহ বলেন,وَإِنْ لَمْ تَفْعَلْ مَلأْتُ صَدْرَكَ شُغْلاً وَلَمْ أَسُدَّ فَقْرَكَ- তুমি যদি তা (আল্লাহর ইবাদত) না কর, তাহ’লে আমি তোমার অন্তরকে পেরেশানী দিয়ে পূর্ণ করব এবং তোমার দারিদ্রতা দূর করব না’।[7] অতএব নশ^র পৃথিবীর মায়া ছেড়ে অবিনশ^র ঠিকানায় শান্তির জন্য কাজ করতে হবে। বান্দার প্রবৃত্তি আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়া অর্জন করলে পরকাল হারাতে হবে।
দুনিয়াবী জীবনে তৃপ্ত থাকা জাহান্নামের নিকটবর্তী হওয়ার কারণ : আখেরাতকে ভুলে দুনিয়া লাভে মত্ত হলে, জাহান্নামের নিকটবর্তী হ’তে হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ بِالْحَيَاةِ لِقَاءَنَا وَرَضُوا الدُّنْيَا وَاطْمَأَنُّوا بِهَا وَالَّذِينَ هُمْ عَنْ آيَاتِنَا غَافِلُونَ- أُولَئِكَ مَأْوَاهُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘নিশ্চয়ই যারা আমাদের সাথে সাক্ষাতের আশা করে না এবং দুনিয়ার জীবন নিয়ে তৃপ্ত থাকে ও তার মধ্যেই নিশ্চিন্ত হয় এবং যারা আমাদের নিদর্শনাবলী সম্পর্কে উদাসীন থাকে; ‘সেসব লোকদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম তাদের কৃতকর্মের প্রতিফল হিসাবে’ (ইউনুস ১০/৭-৮)।
দুনিয়া অর্জনে সুপথ হ’তে বিচ্যুতি : পার্থিব জীবনকে যে যত বেশী প্রাধান্য দিবে সে তত বেশী সুপথ থেকে বিচ্যুত হবে। মহান আল্লাহ বলেন,ذَلِكَ بِأَنَّهُمُ اسْتَحَبُّوا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا عَلَى الْآخِرَةِ وَأَنَّ اللهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ- ‘এটা এজন্য যে, তারা আখেরাতের মোকাবেলায় দুনিয়ার জীবনকে প্রিয় মনে করে। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (নাহল ১৬/১০৭)।
দুনিয়া অর্জনে পরকালে জাহান্নামের শাস্তি : যে ব্যক্তি শুধুমাত্র দুনিয়া অর্জন নিয়েই ব্যস্ত, সে ব্যক্তি পরকালীন জীবনে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হবে। আল্লাহ বলেন,أُولَئِكَ الَّذِينَ اشْتَرَوُا الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ فَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمُ الْعَذَابُ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ- ‘এরাই হ’ল সেই সব লোক, যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবনকে খরীদ করেছে। অতএব তাদের থেকে শাস্তি লাঘব করা হবে না এবং তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/৮৬)। মহান আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ الْعَاجِلَةَ عَجَّلْنَا لَهُ فِيهَا مَا نَشَاءُ لِمَنْ نُرِيدُ ثُمَّ جَعَلْنَا لَهُ جَهَنَّمَ يَصْلَاهَا مَذْمُومًا مَدْحُورًا- ‘যে ব্যক্তি দুনিয়া চায় তাকে যা ইচ্ছা সত্বর দিয়ে থাকি। পরে তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারণ করি। সেখানে সে প্রবেশ করবে নিন্দিত ও লাঞ্চিত অবস্থায়’ (বনী ইস্রাইল ১৭/১৮-১৯)।
আখেরাতমুখী কাজে দুনিয়া ও আখেরাত অর্জন : আখেরাত অর্জনের নিমিত্তে যদি কোন ব্যক্তি নিজের জীবনকে পরিচালনা করে, তাহ’লে সে দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই লাভ করতে পারবে। আখেরাতের উত্তম জীবন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,وَمَا الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَعِبٌ وَلَهْوٌ وَلَلدَّارُ الْآخِرَةُ خَيْرٌ لِلَّذِينَ يَتَّقُونَ أَفَلَا تَعْقِلُونَ ‘পার্থিব জীবন খেল-তামাশা বৈ কিছুই নয়। আর নিঃসন্দেহে আল্লাহভীরুদের জন্য পরকালীন জীবনই উত্তম। এরপরেও কি তোমরা বুঝবে না?’ (আন‘আম ৬/৩২)।
আখেরাতের জন্য কাজ করলে দুনিয়াতেও যে মঙ্গল লাভ হয়, সেবিষয়ে নবী ইব্রাহীমের দৃষ্টান্ত দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ- شَاكِرًا لِأَنْعُمِهِ اجْتَبَاهُ وَهَدَاهُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ- وَآتَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَإِنَّهُ فِي الْآخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ- ‘নিশ্চয়ই ইব্রাহীম ছিল একটি উম্মত। যে ছিল আল্লাহর প্রতি বিনীত ও একনিষ্ঠ এবং সে কখনোই মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’। ‘সে ছিল আল্লাহর অনুগ্রহ সমূহের প্রতি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাকে মনোনীত করেন ও সরল পথে পরিচালিত করেন’। ‘আমরা তাকে দুনিয়াতে মঙ্গল দিয়েছিলাম এবং আখেরাতেও সে হবে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত’ (নাহল ১২০-১২২)।
আর যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য কাজ করে, সে ব্যক্তি দুনিয়া এবং আখেরাত দু’টিই পায়। সে বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَنْ كَانَتِ الآخِرَةُ نِيَّتَهُ جَمَعَ اللهُ لَهُ أَمْرَهُ وَجَعَلَ غِنَاهُ فِي قَلْبِهِ وَأَتَتْهُ الدُّنْيَا وَهِيَ رَاغِمَةٌ ‘আর যার উদ্দেশ্য হবে আখেরাত, আল্লাহ তার সবকিছু সুষ্ঠু করে দিবেন, তার অন্তরকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করবেন এবং দুনিয়ার (সুখসামগ্রী) তার সামনে এসে উপস্থিত হবে’।[8]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাদীছে কুদসীতে বলেছেন, আল্লাহ বলেন,يَا ابْنَ آدَمَ تَفَرَّغْ لِعِبَادَتِي أَمْلأْ صَدْرَكَ غِنًى وَأَسُدَّ فَقْرَكَ ‘হে আদম সন্তান! ইবাদতে মগ্ন হও। আমি তোমার অন্তরকে ঐশ্বর্যমন্ডিত করবো এবং তোমার দারিদ্রতা দূর করবো’।[9] সুতরাং আখেরাতমুখী জীবন-যাপন দুনিয়ার জীবনকে শান্তিময় করে তোলে। সুতরাং একজন মুমিনের একমাত্র কামনা-বাসনা এটাই হওয়া কাম্য।
আখেরাত নিয়ে ব্যস্ত ব্যক্তির প্রাপ্তি : আখেরাতে জান্নাত প্রাপ্তির আশা নিয়ে যে মুমিন ব্যস্ত থাকে, আল্লাহ তার প্রচেষ্টাকে কবুল করে থাকেন। মহান আল্লাহ বলেন,وَمَنْ أَرَادَ الْآخِرَةَ وَسَعَى لَهَا سَعْيَهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَأُولَئِكَ كَانَ سَعْيُهُمْ مَشْكُورًا- ‘আর যে ব্যক্তি আখেরাত কামনা করে এবং তার জন্য যথাযথ চেষ্টা করে মু‘মিন অবস্থায়। তাদের প্রচেষ্টা আল্লাহর কাছে স্বীকৃত হয়ে থাকে’ (বনী ইস্রাঈল ১৭/১৮-১৯)।
দুনিয়া ও আখেরাতের মেলবন্ধন ও আকাংখার পূর্ণতা : মৃত্যু এক অবশ্যম্ভাবী বিষয়। এ থেকে বাঁচার কোন পথ নেই। মহান আল্লাহ বলেন, كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ‘প্রতিটি প্রাণীর মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে’। (আলে-ইমরান ৩/১৮৫)। মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেন,أَيْنَمَا تَكُونُوا يُدْرِكْكُمُ الْمَوْتُ وَلَوْ كُنْتُمْ فِي بُرُوجٍ- ‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন মৃত্যু তোমাদের পেয়ে যাবে, যদিও তোমরা সুদৃঢ় দুর্গে অবস্থান কর’ (নিসা ৪/৭৮)।
দুনিয়ার জীবনে মানুষের আকাংখার পূর্ণতা ঘটবে না। মৃত্যু তার আশার অন্তরায় ঘটাবে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَحِيلَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ مَا يَشْتَهُونَ كَمَا فُعِلَ بِأَشْيَاعِهِمْ مِنْ قَبْلُ إِنَّهُمْ كَانُوا فِي شَكٍّ مُرِيبٍ- ‘তাদের ও তাদের (দুনিয়ায় ফিরে যাওয়ার) আকাংখার মধ্যে পর্দা পড়ে গেছে। যেমন ইতিপূর্বে তাদের সমগোত্রীয় (কাফের)-দের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। নিশ্চয়ই তারা ছিল সন্দেহের মধ্যে দোদুল্যমান’ (সাবা ৩৪/৫৪)। অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,لَوْ كَانَ لاِبْنِ آدَمَ وَادِيَانِ مِنْ مَالٍ لاَبْتَغَى ثَالِثًا وَلاَ يَمْلأُ جَوْفَ ابْنِ آدَمَ إِلاَّ التُّرَابُ وَيَتُوبُ اللهُ عَلَى مَنْ تَابَ- ‘যদি আদম সন্তানের সোনার একটি উপত্যকা হয়, তবুও সে চাইবে যে, তার কাছে দুটি উপত্যকা হোক। (কবরের) মাটিই একমাত্র তার মুখ পূর্ণ করতে পারবে। আর যে তওবা করে, আল্লাহ তার তওবা গ্রহণ করেন’।[10]
: আনাস (রাঃ) বলেন,خَطَّ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم خُطُوطًا فَقَالَ هَذَا الأَمَلُ وَهَذَا أَجَلُهُ، فَبَيْنَمَا هُوَ كَذَلِكَ إِذْ جَاءَهُ الْخَطُّ الأَقْرَبُ- ‘একবার নবী করীম (ছাঃ) কয়েকটি রেখা আঁকলেন এবং বললেন, এটা মানুষের আকাংখা আর এটা হ’ল তার মৃত্যু। সে এ অবস্থার মধ্যেই থাকে; হঠাৎ নিকটবর্তী রেখা (অর্থাৎ মৃত্যু) এসে পড়ে’।[11]
দুনিয়ার জীবনে মুমিনের করণীয়
(১) সাধ্যমত আখেরাতের জন্য কাজ করা : প্রত্যেক ব্যক্তির উচিত আখেরাতের জীবনে সুফলতা পাওয়ার জন্য সাধ্যমত দুনিয়াবী জীবনে শারঈ কাজ করে যাওয়া। মনে রাখা আবশ্যক যে, আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের বেশী চাপিয়ে দেন না। যেমন আল্লাহ বলেন, لَا يُكَلِّفُ اللهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا لَهَا ‘আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৮৬)। অন্যত্র তিনি বলেন,فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لِأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘অতএব তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর কথা শোন ও মান্য কর এবং (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্ত্তত যারা তাদের হৃদয়ের কার্পণ্য থেকে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)।
আর আল্লাহ পার্থিব জীবনে বান্দার জন্য যতটুকু নির্ধারণ করেছেন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ বলেন,وَابْتَغِ فِيمَا آتَاكَ اللهُ الدَّارَ الْآخِرَةَ وَلَا تَنْسَ نَصِيبَكَ مِنَ الدُّنْيَا ‘আর আল্লাহ তোমাকে যা দিয়েছেন, তার দ্বারা আখেরাতের গৃহ সন্ধান কর। অবশ্য দুনিয়া থেকে তোমার প্রাপ্য অংশ নিতে ভুলো না’ (ক্বাছাছ ২৮/৭৭)। সকল বাধা বিপত্তি দূর করে আখোরাত অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ কাজ করে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ সৎকর্মগুলো আল্লাহ সহজ করে দিবেন।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার কোন অংশ থাকে না’ (শূরা ৪২/২০)।
(২) স্বল্পে তুষ্ট জীবন যাপন করা : মুমিনের দুনিয়াবী জীবন হবে অনাড়ম্বরপূর্ণ। তার দৃষ্টান্ত স্বরূপ আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার দু’কাধ ধরে বললেন,كُنْ فِي الدُّنْيَا كَأَنَّكَ غَرِيبٌ أَوْ عَابِرُ سَبِيلٍ- ‘তুমি দুনিয়াতে থাক যেন তুমি একজন প্রবাসী অথবা পথচারী’। আর ইবনু ওমর বলতেন,إِذَا أَمْسَيْتَ فَلاَ تَنْتَظِرْ الصَّبَاحَ وَإِذَا أَصْبَحْتَ فَلاَ تَنْتَظِرْ الْمَسَاءَ- ‘তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হলে সকালের আর অপেক্ষা করো না এবং সকালে উপনীত হলে সন্ধ্যার আর অপেক্ষা করো না’।[12]
(৩) আল্লাহর নিকট দুনিয়া ও আখেরাত কামনা করা : একজন মুমিন দুনিয়ায় উত্তম থাকার জন্য এবং আখেরাতে চুড়ান্ত সফলতা অর্জনের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে থাকে। কেননা দুনিয়া ও আখেরাত একত্রে আল্লাহর নিকট প্রার্থনার মধ্যেই সফলতা রয়েছে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَاكْتُبْ لَنَا فِي هَذِهِ الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ إِنَّا هُدْنَا إِلَيْكَ ‘আর আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে কল্যাণ নির্ধারিত কর। আমরা তোমার দিকেই ফিরে যাচ্ছি’ (আ‘রাফ ৭/১৫৬)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,وَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ- أُولَئِكَ لَهُمْ نَصِيبٌ مِمَّا كَسَبُوا وَاللَّهُ سَرِيعُ الْحِسَابِ- ‘আর তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের ইহকালে কল্যাণ দাও ও পরকালে কল্যাণ দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও! ‘ঐসব লোকদের কৃতকর্মের জন্য পুণ্যফল রয়েছে। বস্ত্তত আল্লাহ দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী’ (বাক্বারাহ ২/২০১-২০২)।
উপসংহার : আখেরাতে বিভীষিকাময় দিনে সফলকাম হওয়া একজন মুমিনের মূল লক্ষ্য। কেননা একজন মুমিনের দুনিয়াবী জীবন আবর্তিত হয় আখেরাতকে নির্ভর করে। আল্লাহর নিকট জবাবদিহিতার জন্য সদা ভীত থাকেন। দুনিয়ার সম্পদ-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তি, যশ-খ্যাতি, জৌলুশ সবকিছু বিলীন হয়ে যাবে সৎ আমল ব্যতীত। সুতরাং হে মুমিন! দুনিয়ার কথিত সাফল্যের পিছনে না ছুটে, চিরস্থায়ী ঠিকানা আখেরাতে সফলকাম হওয়ার প্রতিযোগিতা করুন। একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা হচ্ছে আখেরাতে মুক্তি পেয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস লাভ। আল্লাহ আমাদের যাবতীয় ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়ে পরকালের প্রকৃত সফলতা দান করুন।- আমীন!
মুহাম্মাদ আবুল কালাম
[লেখক : কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ]
[1]. বুখারী হা/৩২৫০; তিরমিযী হা/১৬৪৮; মিশকাত হা/৫৬১৩।
[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৮; তিরমিযী হা/২৩২৩।)।
[3]. তিরমিযী হা/২৩৭৭; ইবনু মাজাহ হা/৪১০৯; মিশকাত হা/৫১৮৮।।
[4]. বায়হাক্বী, মিশকাত হা/২৬০।
[5]. বুখারী হা/৬৪২১; মিশকাত হা/৫২৭০।
[6]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৫।
[7]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; মিশকাত হা/৫১৭২।
[8]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৫।
[9]. ইবনু মাজাহ হা/৪১০৭; মিশকাত হা/৫১৭২।
[10]. বুখারী হা/৬৪৩৬; মুসলিম হা/১০৪৮; মিশকাত হা/৫২৭৩।
[11]. বুখারী হা/৬৪১৮; মিশকাত হা/৫২৬৯।
[12]. বুখারী হা/৬৪১৬।